মূল
মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী
অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
আল্লাহপ্রেমিকের আনন্দ ও বেদনা
তৃতীয় অধ্যায়
দুনিয়াতে আশেকের অবস্থা
বিশ্বের পালনকর্তা বলেন-
وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ
আমি এই দিনগুলো মানুষের মাঝে পরিবর্তন করতে থাকি। (সূরা আল ইমরান ১৪০)
মানবজীবনকে যদি একটি সমুদ্রের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে এর ঊর্মিমালা আছে। আছে তার চড়াই-উৎরাই। কখনও বসন্ত তো; কখনও হেমন্ত। কখনও মিলন, কখনও বিরহ। কখনও নৈকট্য, কখনও দূরত্ব। কখনও সুস্থতা, কখনও অসুস্থতা। মোটকথা, জীবনের পরিস্থিতি সবসময় একরকম থাকে না। আল্লামা ইকবালের ভাষায়-
سکوں محال ہے قدرت کے کارخانے میں
ثبات ایک تغیر کو ہے زمانے میں
কুদরতের এই কারখানাতে সম্ভব নয় স্থিরতা
একটাই স্থির সর্বকালে, নাম তার অস্থিরতা।
সুতরাং পরিবেশ-পরিস্থিতির এই অস্থিরতার প্রভাব আশেকের অবস্থার ওপরও পড়ে। তাই কখনও সে আনন্দ পায়, কখনও পায় নিরানন্দ। কখনও পায় ‘কবয’ তথা সঙ্কীর্ণতা, কখনও পায় ‘বসত’ তথা প্রশস্থতা। কখনও পায় প্রিয়তম মালিকের পক্ষ থেকে দয়া ও মায়া, কখনও হয় তাঁর বিরাগভাজন। কখনও পায় উৎসাহ-তরঙ্গ, কখনও পায় শান্ত-সমুদ্র। কবির ভাষায়-
کبھی جوش و جنوں اکسا کہ چھاجاتے ہیں صحرا پر
کبھی ذرے میں غم ہو کر اسے صحرا سمجھے ہیں
কখনও আবেগ-উত্তেজনা ছেয়ে ফেলে গোটা প্রান্তর
কখনও ভেঙ্গে পড়ি তুচ্ছ বিষয়ে, মনে হয়, মরুপ্রান্তর।
তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, এটাই শেষ কথা যে, সত্যিকারের আশেক তাঁর প্রিয়তমের ওপর সন্তুষ্ট থাকে। সে এটাই ভাবে যে-
لطف سجن دم بدم قہرسجن گاہ بگاہ
ایں بھی سجن واہ واہ اوں بھی سجن واہ واہ
দান তাঁর অবিরাম, রাগ তাঁর মাঝে মাঝে
এটাও প্রিয়তমের, ওটাও প্রিয়তমের তবে আর চিন্তা কি-সে!
আশেকের অবস্থা
ইশকের রাস্তায় চড়াই-উৎরাইয়ে আশেক বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। যার বিবরণ নিম্নে পেশ করা হল।
১. আশেক প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের জন্য এই পরিমাণ অস্থির থাকে যে, কোনো প্রান্তরেই সে স্বস্তি পায় না। তার একমাত্র কাজ হয় প্রিয়তমের স্মরণে লেগে থাকা।
مجھ کو نہ اپنا ہوش نہ دنیا کا ہوش ہے
بیٹھا ہوں مست ہو کے تمہاری جمال میں
تاروں سے پوچھ لو میری رودادزندگی
راتوں کوجاگتاہوں تمہارے خیال میں
নেই কো খবর আমার নিজের কিংবা খবর এই জগতের;
প্রভু! আছি বসে, তোমার রূপে, হয়ে বিভোর।
তারকাগুলো বলে দিবে, কেমন কাটে আমার জীবন
রাত্রি সবই যায় চলে যায়, করি শুধু তোমার স্মরণ।
২. যখন উদাস-হৃদয় ভারি হয়ে যায় তখন কান্নাকাটি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কান্নাকাটি ইশকের তেজ আরো বাড়িয়ে দেয় এবং অসন্তুষ্ট বন্ধুকে সন্তুষ্ট করে নেয়।
خود توپردے میں ہیں اور ذوق نظر دیتے ہیں
اور بھی تیز میرے شوق کو کر دیتے ہیں
پہلے خود آگ لگاجاتے ہیں آکردل میں
پھر بجھانے کیلۓ دیدہ تردیتے ہیں
পর্দায় থেকে দাও গো তুমি দৃষ্টি মায়াবী,
বাড়িয়ে দাও আগ্রহ মোর, কর উদ্যমী।
আগে তুমি মনে আসো জ্বালাতে আগুন মনপুরীতে;
এরপর তুমি দর্শন দাও জ্বালানো অগ্নি নিভিয়ে দিতে।
৩. আশেকের ঐকন্তিক তামান্না হয়, মাহবুব তাকে ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখবে। সে প্রিয়তম প্রভুর কাছ থেকে রহমতের অপেক্ষায় থাকে। সে জানে, তিনি আমার প্রতি পরিপূর্ণভাবে একবার বরং কোনোভাবে একবার তাকালেই কাজ হয়ে যাবে।
خدارا سوۓ عشاقاں نگاہے
پیاپے گرنہ باشد گاہے گاہے
نگاہ کن کہ امید ازکہ دارم
کہ دارم از توامید نگا ہے
মাওলা আমার! একবার দাও, দৃষ্টি তুমি, আমার প্রতি;
দৃষ্টি তোমার, অবিরাম নয়; মাঝে-মাঝে দাও আমার প্রতি।
শধু একবার, দাও দৃষ্টি;
এই আশাই তো লালন করি।
৪. প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের চাইতে বড় নেয়ামত আর হতে পারে না। এজন্য আশেকের কাছে এই নেয়ামতের সামনে অন্যসব নেয়ামত অর্থহীন ও অন্তরসারশূন্য মনে হয়। এর জন্য সে সব কিছু লুটিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে।
بحزاز وصل ہرچیزے فضول است
زصد دنیا مراوصلے قبول است
زمن پرسی دخول جنتے چیست
وصال دوست در جنت دخول است
মিলনের তরে সবকিছুকে অর্থহীন আমি জানি
মিলনের তরে শত দুনিয়া ছাড়তে আমি পারি;
জান্নাত প্রবেশের অর্থ বল- এই প্রশ্ন যদি কর;
জান্নাত প্রবেশ, মিলন বন্ধুর- আমার উত্তর শোনো।
৫. আল্লাহ তাআলার দয়ার দৃষ্টির মোড় যেদিকে যায় সেদিকে বসন্ত ফোটে ওঠে। হেমন্ত তাঁর দয়ার দৃষ্টি বর্জনের অপর নাম।
یہ خزاں کی فصل کیا ہے فقط انکی چشم پوشی
وہ اگر نگاہ کردیں تو ابھی بہار آۓ
হেমন্ত নয়; বরং অবজ্ঞা আমার প্রিয়তমের;
দরকার তাঁর দয়ার দৃষ্টির, হেসে ওঠবে বসন্ত ফের।
৬. মাহবুবের দয়া-মায়া পেলে সত্যিকারের আশেক কেঁদে ফেলে। এটা বেদনার অশ্রু হয় না; বরং আনন্দের অশ্রু হয়। কারণ, ভালোবাসার আনন্দ, প্রেমের মাতম অশ্রু দ্বারাও হয়। মানুষের অন্তর তো গোশতের টুকরা; মাহবুবের দৃষ্টি পাথরেরও প্রতি যদি পড়ে তাহলে পাথরও প্রভাবিত হয়।
حسینے کرد سوۓ من نگاہے
نمی دارم گرکرے جزآہے
گناہم چیست قلب من لحم است
نگاہ اوکند درسنگ واہے
হয়েছি মোহিত এক মায়াবীর দৃষ্টি-যাদুতে
আহ! রাজ্যের মায়া ওখানে আছে জোট বেঁধে;
কী অপরাধ আমার, অন্তর তো মোর, গোশতের টুকরা!
দৃষ্টি তো তার, মায়ার যাদুকর, পাথরও হয় ফুটা।
৭. ھجر তথা রিবহের পরিস্থিতিতে আশেকের অন্তর চৌচির হয়। এই পরিস্থিতিতে সত্যিকারের আশেক স্বস্তি পায় না।
دل مادلیرادیوانہ تست
بیابے فکر خانہ خاصہ تست
تواز شہد وشکر مارالذیذی
دل اندر ہجر دانہ دانہ تست
দেওয়ানা আমি তরে তোমারি;
আসো এখানে, ঘরেতে তোমারি।
মধু চিনি নয় মিষ্টি বেশি;
মিষ্টি অধিক মিলন তোমারি।
হয় খান-খান দিল আমারি,
যদি না মিলে মিলন তোমারি
ভাঙ্গা দিল, তাও তোমারি।
৮. দুনিয়ার কোনো জিনিস আশেকের অন্তর শান্ত করতে পারে না। তার অন্তর কোনো জিনিসের সঙ্গে লেগে থাকে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর মিলনের সামনে এই লাঞ্ছিত দুনিয়ার কোনো মূল্য তার অন্তরে থাকে না।
بہ شوق ماہ رو یاں دل کبابم
رود عمرے دریں کارثوابم
بہ خواب اندر نجاست جاہ ومال است
نہ عاشق پر نجاست چوں ذبابم
হয়েছে কাবাব অন্তর মোর প্রিয়জনেরই টানে,
জীবন আমার কাটছে এখন সওয়াব লাভের কামে।
স্বপ্নে দেখা নাপাকির নাম দুনিয়া ও মর্যাদা,
মাছির মত নই প্রেমিক আমি; এগুলো সব নাপাক সদা।
৯. যদি কোনো ব্যক্তি সত্যিকারের আশেককে উপদেশ দেয় যে, ইশকের জগতে এত পাগলামি ভালো নয়; তখন সে উপদেশদাতাকে শত্রু মনে করে।
میں اسے سمجھوں دشمن جو مجھے سمجھاۓ ہے
আমি তাকে দুশমন মানি যে আমায় বোঝাতে চায়।
বরং আশেক মনে মনে কামনা করে, আহ! এই উপদেশদাতা শুধু একবার যদি আমার প্রিয়তমের সৌন্দর্যবিভা দেখত, তাহলে সেও আমারই মত দেওয়ানা হয়ে যেত।
مراطعنہ دہد واعظ بعشقت
توایک بارے بسوۓ اونظر کن
درامانند مادیوانہ کرداں
تکبر از دماغ اوبدر کن
উপদেশদাতা বলে আমায়, কেন তোমায় ভালোবাসি!
শুধু একবার, দাও দৃষ্টি, এই উপদেশদাতার প্রতি।
করে নাও তাকেও, আমার মত পাগল তোমার,
দূর হয় যাতে, মাথা থেকে তার, সকল অহংকার।
دوستاں منع کنندم کہ چرادل بتودادم
باید اوّل بتو گفتن کہ چنیں خوب چرائ
তোমায় যেন প্রেম না করি, নিষেধ করে বন্ধুরা মোর;
উচিত ছিল বলবে তারা, কেন তুমি এত সুন্দর!
১০. সত্যকারের আশেকের কাছে স্বজন এবং পরজন চেনার মাপকাঠি হল, তার মাহবুব। অর্থাৎ তার কোনো শত্রু যদি তার মাহবুবকে ভালোবাসে তাহলে সে ওই শত্রুকেও ভালোবাসতে শুরু করে। বিপরীতে তার কোনো বন্ধু যদি মাহবুবকে ভালো না বাসে তাহলে তাকেও সে পর ভাবতে শুরু করে।
سوداۓ تواندردل دیوانہ ماست
ہر جاکہ حدیث تست افسانہ ماست
بیگانہ کہ از گفت آں خویش من است
خویشی کہ نہ ازھ توگفت بیگانہ ماست
পাগল-মন পেয়েছে তোমার প্রেমের দেখা;
কথা নয়, গল্প হয়, যদি ওঠে তোমার কথা।
দুশমন মোর, হয় যে স্বজন, যদি বলে তোমার কথা;
স্বজনও মোর, হয় দুশমন, যদি পাও তুমি ব্যথা।
১১. আশেক মাহবুবের স্মরণে আরাম পায়। মাহবুবের নাম বার বার নিলে যে শান্তি পায়।
کتنی تسکین وابستہ ترے نام کے ساتھ
نیند کانٹوں پہ بھی آجاتی ہے آرام کے ساتھ
কি যে সুখ জড়িয়ে আছে, প্রভু তোমার নামে,
কাঁটার বিছানায়াও ঘুম এসে যায়, শান্তি ও আরামে!
১২. আশেক এটা কল্পনাও করতে পারে না যে, সে প্রিয়তমের স্মরণ ছাড়া কিছু সময় অতিবাহিত করবে। সে জাগ্রত অবস্থায় প্রিয়তমের স্মরণ এবং শোয়া অবস্থায় প্রিয়তমের স্বপ্ন লালন করে।
بزم انجم میں قباخاک کی پہنی ہم نے
بس مری ساری فضیلت اسی پوشاک سے ہے
خواب میں بھی تجھے بھولوں توروارکھ مجھ سے
وہ رویہ جو ہواکا خس وہ خاشاک سے ہے
তারকাসভায় আছি আমি, ধুলোর পোশাক পরে
সবই আমার লুকিয়ে আছে, এই পোশাকের মাঝে;
স্বপ্নেও যদি ভুলি তোমায়, খাদ্য দিও রুখে;
বাতাসেতে যাতে ভর করে যায়, খড়কুটো সব ভেসে।
১৩. ইশকে ইলাহী এমন শরাবের নাম যে, পেয়ালার পর পেয়ালা পান করলেও আশেক তৃপ্ত হয় না এবং শরাবও নিঃশেষ হয় না।
اَمُوْتُ إِذ ذَكَرْتُكَ ثُمَّ اَحْيَ
وَ لَوْلَا مَاءُ وَصْلِكَ مَا حَيَّيْتُ
فَاَحْيَ بَاطِنِىْ وَاَمُوتُ شَوْقًا
فَكَمْ اَحْيَ عَلَيْكَ وَ كَمْ اَمُوْتُ
شَرِبْتُ الْحُبَّ كَأْسًا بَعْدَ كَأْسٍ
فَمَا نَفِذَ الشَّرَابُ وَلَا رَوَيْتُ
তোমার কথা পড়লে মনে, প্রাণ উড়ে যায়, প্রাণ এসে যায়;
তোমার মিলন-শরাবেতে, দেহটা মোর প্রাণ ফিরে পায়।
বেঁচে যাই আমি আত্মিকভাবে, মরে যাই আমি তোমার টানে;
কতবার মরি, কতবার বাঁচি, সবই কেবল তোমার তরে।
একের পর এক শেষ করেছি, বন্ধু তোমার প্রেম-পেয়ালা;
তবু রয়ে যায় প্রেম-পেয়ালা, তবু রয়ে যায় প্রেম-পিপাসা।
১৪. আশেকের অন্তরে থাকে প্রিয়তমের নাম এবং আশেকের চোখে থাকে প্রিয়তম-মাহবুবের কল্পনা। ফলে তার মন ও নয়ন মাহবুব তথা প্রিয়তমের জন্য অস্থির থাকে।
لِىْ حَبِيْبٌ خِيَالُهُ نَصِيْبُ عَيْنِىْ
وَإِسْمُهُ فِىْ ضَمَائِرِ مَكْنُوْنٌ
اِنْ تَذَكَّرْتُهُ فَكُلِّىْ قُلُوْبٌ
وَاِنْ تَاَمَّلَتْهُ فَكُلِّىْ عُيُوْنٌ
বন্ধু আমার আছে একজন, আছে আমার চোখের তারায়;
নাাম তাঁর এঁকে নিয়েছি, এঁকেছি আমার মনের কোঠায়।
যখনি স্মরি তাঁর নাম আমি, পুরোটা হয়ে উঠি হৃদয় আমি;
যখনি ভাবি তাঁর কথা আমি, পুরোটা হয়ে যাই নয়ন আমি।
১৫. সত্যিকারের আশেক যখন এটা অনুভব করে যে, তার ‘আহ…’ মাহবুব পর্যন্ত পৌঁছে, তখন এর দ্বারা সে আত্মিক-প্রশান্তি পায়।
عاشقاں راایں بود آرام جاں
کہ رساند آہراتاآسماں
প্রেমিক-হৃদয় হয় খুশি,
শুনেছে মালিক আহাজারি।
১৬. এটা বড় মুগ্ধকর ব্যাপার যে, যেমনিভাবে দুনিয়ার দূরত্ব জয় করতে হয় কদম দিয়ে সামনে চলে, অনুরূপভাবে আধ্যাত্মিকজগতের দূরত্ব জয় করতে হয় চোখের পানি ফেলে, মোতির মত করে।
ساری چمک دمک توانہی موتیوں سے ہے
آنسو نہ ہوں تو عشق میں کچھ آبرو نہیں
সকল চমক সকল ঝলক, পড়ে আছে এই মোতির ভেতর;
চোখ যদি এই; অশ্রু না দেয়, ইশকের ঘর হয় চুরমার।
১৭. আশেকের অবস্থা অনেকটা দয়ার যোগ্য বলা যায়। কারণ, বিরহের পরিস্থিতিতে মিলনের আগ্রহে কান্নাকাটি এবং মিলনের পরিস্থিতিতে কৃতজ্ঞতার অশ্রু অর্থাৎ সকল পরিস্থিতিতে অশ্রু নিবারণ করা যেন তার জীবনের সঙ্গে বাঁধা। মনে হয় যেন ইশক এবং কান্নাকাটি পরস্পর হাত ধরাধরি করে সামনে অগ্রসর হয়।
عاشق راکم رونادھوناتے بن روون نہیں منظوری
دل رونےچاہےاکھیاں روون تےوچ عشق وےرون ضروی
کئ بے روون دیردی خاطرتے کئ روندے وچ حضوری
تے اعظم عشق وچ پیئداچاہے وصل ہووے چاہے دوری
প্রেমিকের কাজ অশ্রু দেয়া, মালিকের কাজ কবুল করা;
মনের কান্না চোখের কান্না, চলে না ইশক কান্না ছাড়া।
কাখনও হয় কান্না মিলনের, কখনও কান্না হয় বিরহের;
ইশকের পথ কান্নার আনন্দের কিংবা বেদনার।
১৮. যখন চোখ থাকে মাহবুবের তালাশে অধীর, অন্তর থাকে ভালোবাসায় বিভোর, তখন যবানেও থাকে মাহবুবেরই উপাখ্যান। আশেকের চেতন-মন থেকে এমন ‘প্রিয়তম’ হারিয়ে যাবে কিভাবে!
خِيَالُكَ فِىْ عَيْنِىْ وَ ذِكْرُكَ فِىْ فَمِىْ
وَمَثْوَاكَ فِى قَلْبى فَاَيْنَ تَغِيْبُ
কল্পনা তোমার নয়নে মোর , সুনাম তোমার যাবানে মোর;
আবাস তোমার হৃদয়ে মোর, কাজেই তুমি যাবে না আর।
১৯. যখন সূর্য ওঠে তখন প্রিয়তমের কথা মনে পড়ে। যখন সূর্য ডোবে তখনও প্রিয়তমের স্মরণে বিভোর থাকে। বন্ধুদের সভায় প্রিয়তমের আলোচনা চলতে থাকে। আর যখনি তাঁর পক্ষ থেকে সাক্ষাতের ডাক পায় তখন তা মেনে নিয়ে তাঁর পানে ছুটে যাওয়ার জন্য আশেক সদা প্রস্তুত থাকে।
وَاللهِ مَا طَلَعَتْ شَمْسٌ وَلَا غَرَبَتْ
اِلَّا وَاَنْتَ فِىْ قَلْبِىْ وَسْوَاسِىْ
وَلَا ذَكَرْتُكَ مَحْزُوْنً وَلَا طَرْبًا
اِلَّا وَحُبُكَ مَقرُوْنٌ بِاَنْفَاسِىْ
وَلَا هَمَمْتُ بِشُرْبِ الْمَاء مِن عَطْشٍ
اِلّا رَأَيْتُ خَبَالًا مِنْكَ فِىْ الْكَأْسِ
فَلَوْ قَدَرْتُ عَلَى الاِيَّيَانِ زُرْتُكُمْ
سَحْبًا عَلَى الْوَجْهِ أَوْ مَشْيًا عَلَى الرَّأْسِ
‘সূর্যের উদয় অস্তে শুধু তোমায় আমি স্মরি,
কসম তোমার, ধ্যানে-মনে আমি তোমায় জপি,
চেতন-মনে সুখে-দুঃখে থাকো পুরোপরি,
তৃষ্ণা আমার তবু পানি পান করি না আমি,
তবে তোমায় ভালোবেসে পান করেছি পানি।
পারতাম যদি তোমার কাছে চলে আসতাম আমি,
ছুটতাম আমি তোমার পানে দিয়ে হামাগড়ি।
২০. সাধরণত ইবাদতের ক্ষেত্রে এটাও সামনে রাখা হয় যে, এই আমলে এই সওয়াব, ওই আমলে এই সওয়াব। আমল করার এটাও একটা পদ্ধতি। কিন্তু আশেকের অবস্থা হয় বিস্ময়কর‌। সে সকল কাজ একমাত্র প্রাণপ্রিয় মাওলার সন্তুষ্টির জন্য করে‌। তার সামনে অন্য কিছু থাকে না। নেছার আহমদ ফতহি রহ.-এর ভাষায়-
بند گی سے ہمیں تو مطلب ہے
ہم ثواب وعذاب کیا جانیں
کس میں کتنا ثواب ملتا ہے
عشق والے حساب کیاجانیں
মোরা বন্দেগিতে লাগাই সময় স্বার্থ দেখে;
সওয়াব-আযাব কী-ইবা জানি বন্দেগিতে।
আছে কোথায় সওয়াব কত; নেই এই হিসাব প্রেমজগতে;
সব আশেকেই আমল করে সাঁতার কেটে প্রেমসাগরে।
২১. আল্লাহর বাণী-
كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
প্রতিদিন তার জন্য রয়েছে নিত্যনতুন শান-শওকত। (সূরা আর রাহমান ২৯)
যেহেতু বন্ধুর সৌন্দর্য-দ্যুতি প্রতিদিন নতুন আঙ্গিকে দীপ্তিময় হয়, সুতরাং সত্যনিষ্ঠ আশেকের অন্তরেও প্রতিদিন ভালোবাসার নতুন উদ্দীপনা বিচিত্র উত্তেজনা তৈরি হয়। মাওলার রূপ-সৌন্দর্য কুল-কিনারাবিহীন, তাই আশেকের আগ্রহ-আকর্ষণও হয় সীমাহীন। এরূপ পরিস্থিতিতে অন্যের প্রতি আকর্ষণবোধ করার সম্ভাবনাই থাকে না। এমর্মে খাজা গোলাম ফরিদ রহ.- এর কয়েকটি ছন্দ নিম্নে পেশ করা হল-
ہورکہانی مول نہ بھاڑنں
الف لئم دل کھس وے مکاں جی
“ب” “ت” دی میکوں لوڑنہ کائ
الف کیتم بے دس وے میاں جی
ذکراللہ واچر خہ چلاویں
ہٹی شابس وے میاں جی
جنیدیاں مردياں یاردی رہساں
وسری ہورہوسوے میاں جی
رانجھڑمیڈامیں رانجڑوی
روزازلدی ہس وے میاں جی
عشق مول فرید نہ پہر سوں
روزنویں ہم چس وے میاں جی
লাগে না ভালো গল্প আমার আল্লাহর গল্প ছাড়া,
আল্লাহর ‘আলিফ’ কেড়েছে মন, শোনো ও ভাই মিয়াঁ।
আলিফ আমায় করেছে পাগল, কী করব আর ‘বা’ ‘তা’
নিয়েছে আলিফ সবকিছু মোর, কী করি ভাই মিয়াঁ।
মারতে থাকো যিকির দিয়ে অন্তরেতে ধাক্কা
সাবাস পাবে, সাহস পাবে, হবে দিল তোর পাক্কা।
জীবন-মরণ দিয়ে তাঁকে, তুলব সফলতা
ভুলব সবি তার স্মরণে, করব ঈমান তাজা।
ফরিদ! তুমি এগিয়ে চল, সাহস রেখে সদা
ইশ্ক মানে জীবন-মরণ তাঁকে দিয়ে পথ চলা।
ইশকে ইলাহীর সাগরে ডুব দিয়ে কবি অন্যত্র আরো চমৎকার বলেছেন-
میڑاعشق بھی میڑایاروی توں میڑادیں وی توایمان بھی توں
میڑاجسم میڑاروح وی توں میڑاقلب وی توں میڑاجان وی توں
میڑاکعبہ قبلہ مسجد منبر مصحف تے قرآن وی توں
میڑے فرض فریضے حج زکواتاں صوم صلواۃ اذان وی توں
میڑاذکروی توں میڑافکروی توں میڑاذوق وی توں وحدان وی توں
میڑاسانول مٹھر اشام سلونڑاں من موہن جاناں وی توں
میڑی آس امیدتے کھٹکاوٹیا میڑا تکیہ مان تران وی توں
میڑادھرم وی توں میڑا بھرم وی توں میڑا شرم وی توں میڑاشان وی توں
میڑادکھ سکھ رون کھلن وی توں میڑادرد وی توں درمان وی توں
میڑاحسن تے بھگ سہاگ وی توں میڑا بخت تے نام نشان وی توں
میڑے ٹدنڈے ساہ تےمونجھ میخاری ہنجواں واطوفان وی توں
میڑی مہندی کحل مساگ وی توں میڑی بارش تے براں وی توں
ہے یاو فرید قبول کرے سرکاروی توں سلطان وی توں
তুমি আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা, তুমি আমার ঈমান, আমার দেহ, আমার প্রাণ।
আমার কা’বা, আমার মসজিদ, আমার মিম্বর। আমার কুরআন, আমার ফরজ,
আমার হজ, আমার যাকাত। আমার নামায, আমার রোজা, আমার আযান।
আমার যিকির, আমার ফিকির। আমার আগ্রহ, আমার আকর্ষণ, আমার প্রাণপ্রিয়, আমার প্রিয়তম।
আমার আশা, আমার ভরসা, আমার শেষ ঠিকানা।
আমার দীন, আমার ঈমান, আমার সম্মান। আমার লজ্জা, আমার শান, আমার সম্মান। আমার সুখ, আমার দুঃখ। আমার হাসি, আমার কান্না।
আমার ওষুধ, আমার বেদনা। আমার আনন্দের উৎস, আমার সৌন্দর্য, আমার যৌবন। আমার ভাগ্য, আমার নিশানা, আমার শান্ত নিঃশ্বাস, আমার উদাস।
আমার অশ্রুর বন্যা, আমার বৃষ্টি, আমার মেঘমালা। বন্ধু গো! প্রাণপ্রিয় মাওলা! তুমি আমার সব। তুমি আমার মালিক, তুমি আমার বাদশাহ।
২২. আশেকের তামান্না হয় মাহবুবের সঙ্গে ভেদ-রহস্যের কথা বলার জন্য নির্জন পরিবেশ খুঁজে পাওয়া। এজন্য রাতের অন্ধকারের চাইতে উত্তম কোনো সময় হতে পারে না। তাই তাহাজ্জাুদের সময় ওঠা, মুনাজাতের মজা নেয়া, অশ্রুর বন্যা দিয়ে প্রিয়তমকে মানিয়ে নেয়া তার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়।
اٹھ فرید استیاتے جھاڑدے مسیت
توستا تیرارب جاگتاتیرے کینیں بنھے پربت
ফরিদ! তুমি, ছাড়ো বিছানা, মসজিদে যাও ঝাড়ু দিতে
ঘুমিয়ে তুমি, মালিক সজাগ; ওঠে যা তোর প্রেম টিকাতে।
২৩. রাত্রি-নিশিতে ইবাদতে মগ্ন থাকা সত্ত্বেও সত্যিকারের আশেক মনে করে, আমার যা করার ছিল, তা করতে পারি নি। রাতের বেলায় তো কুকুরও জাগে, তার মালিকের বাড়ী পাহারা দিতে। সুতরাং আমি জেগে ছিলাম তো বেশি কী-ই বা করলাম!
راتیں جاگیں تو شیخ سڈاویں جاگن کتیں تواتے
رکھ سکھا ٹکراکھاکے دنیں جار کھاں وچ ستے تیں تواتے
در مالک دامول نہ چھوڑن بھانویں مارے سو سوجتے تیں تواتے
تو ناشکرا اتے پلنگاتے اوشاکرروڑیاں اتے تیں تواتے
اٹھ بلہیا تو یار منالے نہیں توبازی لے گے کتے تیں بواتے
রাত জেগেছো, শায়েখ বনেছো?
কুকুর দেখেছো? জাগে সে ভালো।
ঝুটা খাবার খেয়ে গাছতলাতে,
ঘুম দিয়ে দেয় শরীর ছেড়ে।
মারলে জুতো মালিক তাহার,
ছাড়েনা দরজা গোলাম সে তার
একটু ঝুটা খেয়ে।
ঘুমাও তুমি কই? বিছানায়!
জমাও গুনাহ আমালনামায়,
রবকে বেজার করে।
বলো তো তবে, নিশি জয়ী কে?
তুমিও রাত জাগো, সেও রাত জাগে,
তুমি ছেড়ে দাও মালিক তোমার,
সে ছাড়ে না মালিক তাহার- ঝুটা খাবার খেয়ে।
২৪. আশেক মাহবুবের পক্ষ থেকে দেওয়া বেদনাকে আনন্দের চাইতেও উত্তম মনে করে।
تراغم بھی مجھ کو عزیزہے
کہ وہ تیری دی ہوئ چیزہے
লেগেছে ভালো বেদনা আমার; দিয়েছ যে তুমি;
তোমার দেয়া জিনিস কী করে আমি বেদনার বলতে পারি।
মাহবুবের পক্ষ থেকে সে যত কষ্ট পায়, তার প্রেম-পগলামী তত বৃদ্ধি পায়।
نشودنصیب دشمن کہ شودہلاک تبغت
سردوستاں سلامت کہ تو خنجر آزمائ
তোমার অসি দ্বারা দুশমন যেন না হয় ভাগ্যবান;
নাও ক্ষুর, দাও চালিয়ে পেতেছে নতশির তোমারি আপনজন।
অনেক সময় তো এরূপ পরিস্থিতিতে আশেক আ…. আরো আছে কি- বলে ফরিয়াদ করে ওঠে।
ہواجو تیر نظر نیم کش تو کیا حاصل
مزہ تو جب ہے کہ سینے کے آرپار چلے
তোমারি চাহনি-তীরে আহত আমি, তবে পাইনি এখনও সুখ;
করাত চালাও বক্ষে আমার-আমি পেতে চাই আসল সুখ।
২৫. এটাও বাস্তব যে, মাহবুবের মায়া-দৃষ্টি যখন পড়ে তখন তো বসন্ত ছেয়ে যায়। এমন সুখকর পরিস্থিতিতে তো প্রত্যেকেই আনন্দে আত্মহারা হয়।
مستوں پہ انگلیاں نہ اٹھاوبھار میں
دیکھ تو ہوش بھی ہے کسی ہوشیار میں
দেওয়ানা যারা তাদের প্রতি আঙ্গুল তুলো না বসন্তকালে;
চেতনাধারীরাও এই কালেতে হারিয়ে বসে হুঁশটাকে।
২৬. মাহবুবের আলোচনা করা আশেকের কাছে এতটা ভালো লাগে যে,
ہوتی رہی ثنا تیرے حسن و جمال کی
চলতে থাক প্রশংসা তোমার রূপ-সৌন্দর্যের।
যদি আশেক তার মত ইশকের উত্তাপ লালনকারী আরেকজন পেয়ে যায় তাহলে কী আর বলবো-উভয়ের সময় কী যে দারুণভাবে কেটে যায়!
قیس جنگل میں اکیلا ہے مجھے جانے دو
خوب گزرے گی جومل بیٹھیں گے دیوانے دو
যেতে দাও কায়েসের কাছে, জঙ্গলে আছে সে একা,
জমবে খুব প্রেমের গল্প বসবো যখন উভয় দেওয়ানা।
২৭. মাহবুবের আলোচনা যখন ইশকের পাগলামিতে ঝড় তুলে তখন আশেকের অন্তর চায় সে মাহবুবের জিয়ারতে ধন্য হবে।
گھمنر کھل دیرارد کھا – میں آیا مکھ ویکہن نوں
দাও খুলে নেকাব, দেখাও মুখাবয়ব, এসেছি আমি দেখব বলে।
২৮. আশেক নিজের ইশকের উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এভাবেই অতিবাহিত তার গোটা জীবন।
ہے شوق و ضبط شوق میں دن رات کشمکش
دل مجھکو میں ہوں دل کو پریشان کۓ ہوۓ
বেপরোয়া ইশক এবং চেপেরাখা ইশক লড়াই করে দূর্বার;
হৃদয় করে আমাকে, আমি করি তাকে পেরেশান জীবনভর।
 
Top