মূল: হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী 
অনুবাদ
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
জাহেলী যুগে নারী ছিল অবহেলিত
ইসলাম পূর্ব আরবে নারীরা এতটাই অবহেলিত ছিল, কন্যা-শিশুর জন্মগ্রহণ তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারত না। তারা নিষ্পাপ কোমলমতি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলত। কেউ মারা গেলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ যেমনিভাবে ছেলেরা পেত, অনুরূপভাবে তার স্ত্রীরাও ছেলেদের মাঝে বণ্টিত হতো‌। নারীদেরকে জুতার চেয়েও তুচ্ছ ভাবা হতো। এমনকি নারীদের বৈধ ও যৌক্তিক কথা মেনে নেওয়াটাকেও তারা পুরুষত্বের পরিপন্থী মনে করত।
রাসূল ﷺ-এর আগমণ
আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম রাসুল  পৃথিবীতে এসে পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে, হে লোকসকল! নারী যদি তোমার কন্যাসন্তান হয় তাহলে সে তোমার সম্ভ্রম। যদি সে বোন হয় তাহলে সে তোমার সম্মান। যদি সে স্ত্রী হয় তাহলে সে তোমার জীবনসঙ্গী। আর যদি নারী হয় তোমার মা তবে তার পায়ের নিচে তোমার জান্নাত।
পাশাপাশি তিনি সুসংবাদ দিয়ে দিলেন, যার ঘরে দুটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করবে আর সে তাদেরকে উন্নত শিক্ষা দিবে, উত্তম দীক্ষা দিবে এবং তাদের ব্যাপারে অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে। আমার সঙ্গে এমনভাবে থাকবে যেমন দুটি আঙুল পাশাপাশি থাকে।
তিনি আরো বলেছেন, যার ঘরে কন্যাসন্তান জন্ম নিল তার জন্য জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।
আরো সুসংবাদ দিলেন مَنْ عَمِلَ صَالِحًا ‘যে ব্যক্তি নেক আমল করবে।’ مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ ‘সে পুরুষ হোক কিংবা নারী।’ وَهُوَ مُؤْمِنٌ ‘সে যদি মুমিন হয়।’ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ‘তাকে আমি অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব।’
অর্থাৎ পুরুষরা যেমন নেক আমল এবং ইবাদত করে আল্লাহর ওলী হতে পারে, তাঁর প্রিয় বান্দা হতে পারে। তেমনিভাবে নারীরাও নেককাজ-ইবাদত করে আল্লাহর ওলী হতে পারে, তাঁর প্রিয় বান্দী পারে। ওলী হওয়ার দরজা তাদের জন্যও খোলা।
মোটকথা, ইসলাম নারীদেরকে এমন মর্যাদা দিয়েছে যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কেউ দিতে পারেনি।
 ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর প্রোপাগান্ডা
বর্তমানে ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো আজব সব প্রপাগান্ডা শুরু করেছে! ইসলাম নারীদের প্রতি অনেক বেশি বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বলে তারা মুসলিম নারীদেরকে উসকে দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। আর আমাদের সমাজের কিছু নারীও এসব প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। তারা মনে করে, বাস্তবে হয়তো তাদেরকে তাদের বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ বিষয়টা কিন্তু এমন নয়।
ইসলামে পর্দার বিধান
দেখুন, প্রথমত তারা তো এটা বলে যে, ইসলাম নারীদেরকে পর্দার ভিতর থাকার নির্দেশ দিয়েছে। পক্ষান্তরে অমুসলিম সমাজে নারীরা অবাধে চলাফেরা করতে পারে। দেখুন, বিষয়টা খুব সহজ। নারী পর্দায় থাকলে তার নিজেরও ভালো, পুরুষের জন্যও ভালো। আসুন পর্দাহীনতার প্রভাব পাশ্চাত্য সমাজকে কোন অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে; তা আমরা একটু যাচিয়ে-খতিয়ে দেখি।
সুইডেনে পর্দাহীনতার কুপ্রভাব
সুইডেন বৃটেনের একেবারে নিকটে ইউরোপের একটি ধনী রাষ্ট্র। আমাদের দেশগুলোতে বাজেটের ঘাটতি নিয়ে আলোচনা হয় আর ওই রাষ্ট্রে আলোচনা হয় মুনাফাভিত্তিক বাজেট নিয়ে। আমরা ভাবি, টাকা আসবে কোথা থেকে আর তারা চিন্তা করে টাকা খরচ করবে কোন খাতে। দেশটি এত ধনী যে, গোটা দেশের সকল নারী-পুরুষ; ছোট-বড় কিশোর-বৃদ্ধ যদি কাজ বাদ দিয়ে শুধু খায় আর আনন্দ-ফুর্তি করে তাহলে গোটা জাতি লাগাতার ছয় বছর খরচ করতে পারবে। আর্থিক টানাপোড়েন দেখা দিবেনা। যদি কোনো ব্যক্তি চাকরি না পায় তাহলে সরকারের কাছে খবর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই ব্যক্তি ঘরে বসেই প্রতি মাসে বিশ হাজার টাকা সরকারের পক্ষ থেকে পেয়ে যায়। যদি তার ঘর না থাকে রাষ্ট্র তাকে ঘর বানিয়ে দেয়। অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার ভার সরকার নিজেই নিয়ে নেয়। এজন্য লক্ষ টাকাও খরচ করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ব্যয়ভার বহন করে সরকার নিজেই।
মোটকথা, তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের কোনো টেনশন নেই। বাকি থাকলো শুধু জৈবিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি। এদিক থেকেও তারা স্বাধীন। দেশটি সেক্স ফ্রি কান্ট্রি। পশুর মত নারী-পুরুষও যখন যেখানে ইচ্ছা একজন আরেকজনের সঙ্গে সেক্স করতে পারে। কোনো বাধা-নিষেধ নেই। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, যাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের চিন্তা নেই, জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে কোন বাধা নেই, যখন যার সঙ্গে ইচ্ছা চাহিদা মেটাতে পারছে– এদের দুশ্চিন্তা করার তো কোনো কারণ নেই? কিন্তু এরপরও দু’টি বিষয় বড়ই বিস্ময়কর।
প্রথম বিষয় হল, তাদের সমাজের তালাক বিবাহ-বিচ্ছেদের হার শতকরা সত্তর পারসেন্ট। শত পরিবারের মধ্যে সত্তরের অধিক পরিবার তালাকের কারণে বরবাদ হয়।
দ্বিতীয় বিষয় হল, গোটা পৃথিবীতে সুইডেনে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। দেশটিতে যে পরিমাণ মানুষ আত্মহত্যা করে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তা পাওয়া যায় না। এর কারণ হলো লজ্জাহীনতা ও পর্দাহীনতার কারণে তাদের অন্তরে শান্তি নেই। পুরুষ সবসময় থাকে উত্তম থেকে উত্তমের সন্ধানে। নারী ও উন্নত থেকে উন্নততর বস্তুর সন্ধানে বিভোর থাকে। ফলে শান্তির জীবন কারো কপালে জোটে না। যে সমাজের সত্তরের অধিক নারী ডিভোর্সি হয় সেখানে কার মনে সুখ থাকবে? ফলে তারা ডিপ্রেশনে ভোগে। মানসিক অশান্তিতে জীবন যাপন করে।
পর্দা ব্যবস্থার চমৎকার প্রভাব
ইসলাম আমাদেরকে পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছে। এর কল্যাণ আমরাই ভোগ করে থাকি। আমাদের দেশে খাদ্যসংকট ও বাসস্থানের সংকট রয়েছে। তারপরও আমাদের দেশে শতকরা ০.৭ পারসেন্টও তালাকপ্রাপ্ত হয়না। আমরা এমন সুখের জীবন কোথায় পেলাম? এমন শান্তির জীবন কিভাবে লাভ করলাম? এর কারণ, আমাদের দেশ-সমাজে কিছুটা হলেও ইসলামের বিধিনিষেধ এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। যার সুফল আমরা নিজেরাই ভোগ করছি।
ইউরোপে বেপর্দা নারীদের দূরাবস্থা
অমুসলিম সমাজে পর্দার প্রচলন নাই বলে তারা স্বাধীন; আমাদের মুসলিম-নারীদের এজতীয় ভাবনা চরম ভুল। কেননা, প্রকৄত বিষয় মোটেও এমন নয়। আমি ইউরোপের একটি ফ্যাক্টরিতে দেখেছি, চারটা ছেলের সঙ্গে দু’টো মেয়ে ভারী ভারী বোঝা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি ম্যানেজারকে বললাম, আপনারা মেয়েদের দ্বারাও এসব করাচ্ছেন? সে উত্তর দিল, কাজ না করলে খাবি কী? এই হলো নারী স্বাধীনতার স্বরূপ! কুলিদের মত অমানবিক বোঝা টানছে, ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে– এর নামই নারী স্বাধীনতা!!
পাকিস্তানে আপনারা এনএলসি-এর বড় বড় ট্রলার দেখেন। করাচি থেকে পেশাওয়ার যায়। ইউরোপিয়ান কান্ট্রিগুলোতে এমন বিশাল বিশাল ট্রলার মেয়েরাও চালায়। ড্রাইভার যেমন যেকোনো জায়গায় চা পান করে, রাত হলে হোটেল ভাড়া করে ঘুমায়। মহিলা ড্রাইভাররাও ঠিক সেটাই করে। আপনারা নিজেরাই বলুন, এসব মেয়েরা সম্মান লাভ করেছে নাকি লাঞ্চিত হচ্ছে?
নারী ঘরের রাণী
ইসলাম নারীকে তার জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই জীবিকা নির্বাহের দায়িত্ব দেয়নি। মেয়ের দায়িত্ব বাবার। বাবা মেয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করবে। বোনের দায়িত্ব ভাইয়ের। ভাই তার ভরণপোষণের দেখভাল করবে। স্ত্রীর দায়িত্ব স্বামীর। স্বামী তার সব ধরনের ব্যয় ভার বহন করবে। আর মায়ের দায়িত্ব সন্তানের। সন্তান তার সব খরচাপাতি চালাবে।
মোটকথা, ইসলাম নারীকে তার জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই উপার্জন করার দায়িত্ব দেয়নি; বরং নারীর মাহরাম পুরুষদের উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
ইসলাম বলে, নারীরা ঘরের রাণী। পুরুষরা ঘাম ঝরিয়ে কামাই করে তাদেরকে দিবে। নারীরা শুধু সন্তানদের লালন-পালন করবে। ঘরকন্নার কাজ সামলাবে। আপনারা নিজেরাই বিচার করুন, নারীদেরকে প্রকৃত মর্যাদা কে দিয়েছে? ইসলাম নাকি পাশ্চাত্য সমাজ?
নারীদের প্রতি এত কোমল আচরণের কারণ
আপনারা গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, ইসলাম নারীদের প্রতি কোমল আচরণ করেছে। কারণ পুরুষদেরকে আল্লাহ তাআলা শক্তি দিয়েছেন। পক্ষান্তরে নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল। কোমল। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের শারীরিক ক্ষমতা অনুপাতে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আর পুরুষদেরকে তাদের শারীরিক ক্ষমতা অনুপাতে দায়িত্ব দান করেছেন।
নারী-জীবনের বিভিন্ন ধাপ
নারী-জীবনের বিভিন্ন ধাপ ও পর্যায়ে সাওয়াব বা প্রতিদান প্রাপ্তির বিষয়ে কিছু কথা বলবো। এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, ইসলাম নারীর সঙ্গে কত চমৎকার আচরণ করেছে!
কন্যা শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া
ইসলাম বলে, কন্যাসন্তান জন্ম নিলে আল্লাহ তাআলা রহমতের দুয়ার খুলে দেন। দুই কন্যা হলে তারা বাবার জন্য রহমত হয়ে যায়। কারণ নবীজি  বলেছেন, যারা দু’টি কন্যা সন্তান হবে সে জান্নাতে আমার কাছেই থাকবে; যেমন হাতের দুটি আঙুল পাশাপাশি থাকে।
অবিবাহিত মেয়ের মৃত্যু
হাদীসের মর্ম কথা হল, কোন অবিবাহিত মেয়ে মারা গেলে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে শহীদের কাতারে শামিল করবেন।
কারণ, সে অবিবাহিত ছিল। মা বাবার সংসারে ছিল। মা বাবার সংসারে থেকে সে নিজের ইজ্জত-সম্ভ্রম হেফাজত করেছে। সে স্বামীর ঘরে দেখিনি। স্বামীর আদর পায়নি। বিবাহিত মেয়ের মত জীবনের সুখ লাভ করেনি। সে দুনিয়ার অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাই আল্লাহ তাআলা তার প্রতি দয়া করেছেন। আখেরাতে তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন। দুনিয়ায় তাকে শহীদ বলা হবেনা কিন্তু কেয়ামতের দিন তাকে তাদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে। একজন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে।
বিবাহিত মেয়েদের সব বাড়িয়ে দেওয়া হয়
একটি মেয়ে যখন বড় হয়ে যৌবনে পা রাখে মা-বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। এবার স্বামীর সংসারে গিয়ে স্বামীর সেবা করে। আনুগত্য করে। পাশাপাশি আল্লাহর ইবাদত করে। ফকিহগণ লিখেছেন, বিবাহিত মেয়ে একা নামাজ পড়লে এক নামাজের সাওয়াব পায়। আর বিবাহিত মেয়ে এক নামাজ পড়লে একুশ নামাজের সাওয়াব পায়। কারণ তার ওপর এখন দুইজনের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। সে এখন স্বামীর খেদমত করে, আল্লাহর ইবাদতও করে। স্বামীর খেদমতের সঙ্গে সঙ্গে যখন আল্লাহর ইবাদত করছে তাই আল্লাহ তার ইবাদতের সাওয়াব বাড়িয়ে দেন। এক নামাজ পড়লে একুশ নামাজের সওয়াব সে পায়।
আল্লাহর সুপারিশ
আল্লাহ তাআলা পুরুষের কাছে মেয়েদের পক্ষে সুপারিশ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এর বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ
‘তোমরা নারীদের সঙ্গে উত্তম ভাবে জীবন যাপন করো।’
দেখুন, দুনিয়ার জীবনে কারো বোন সুপারিশ করে।  কারো মা সুপারিশ করে। কারো খেলা সুপারিশ করে। কারো ফুফু সুপারিশ করে। মোটকথা সুপারিশ করে আপনজন। কিন্তু কোরআন মজিদে নারীদের জন্য সুপারিশ করেছেন আল্লাহ নিজেই। তিনি বলেছেন,
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
‘পুরুষের তুলনায় নারীদের সাথে উত্তমভাবে জীবন যাপন কর। তাদের সঙ্গে আদর-সোহাগপূর্ণ  উদার আচরণ কর। ভালোবাসাময় পরিবেশে ঘর-সংসার কর।’
গর্ভধারণের কারণে গুনাহ মাফ হয়ে যায়
বিয়ে-শাদির পর যখন সে ঘর সংসার শুরু করে স্বামীর সাথে আনন্দঘন জীবন যাপন করতে থাক তখন একসময় আল্লাহ তাআলা তাকে মা হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।
প্রিয় বোনেরা, হাদীস শরীফের মর্মার্থ হল, যে মুহুর্তে একজন নারী গর্ভধারণ করে আল্লাহ তাআলা সঙ্গে সঙ্গে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন।
কারণ, গর্ভে সন্তান আসার পর মায়েরা নানারকম রোগে ভোগে। নিদারুণ দুঃখ-যাতনা সহ্য করতে হয়। এই সময়টা তাদের সীমাহীন কষ্টে কাটে। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি দয়া করেন। তাদের অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন।
গর্ভাবস্থায় যখন ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে, সাওয়াব লিখে দেয়া হয়
সন্তান গর্ভে আসার পর মা তাকে পেটে ধারণ করে চলাফেরা করে। সংসারের কাজ-কাম করে। ক্লান্ত হয়ে অনেক সময় কঁকিয়ে উঠে। হাদীসে বর্ণিত আছে, এ সময়ে তার মুখ দিয়ে তো উহ শব্দ বের হয় কিন্তু আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে বলেন, আমার এই বান্দী অনেক বড় দায়িত্ব পালন করছে। কষ্ট সইতে না পেরে তার মুখ থেকে উহ শব্দ বের হচ্ছে। তোমরা তার এই শব্দের পরিবর্তে আমলনামায় সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলার সাওয়াব লিখে দাও।
ব্যথার কারণে সাওয়াব
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় যত ঘনিয়ে আসে মায়ের কষ্ট তত বেড়ে যায়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, এই সময়ে প্রতিবার নারী যে ব্যথা অনুভব করে এর পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা একটি আরব বংশের গোলাম আজাদ করার সাওয়াব দান করেন।
অপর হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি একটি গোলাম আজাদ করবে আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেন।
এবার দেখুন, নারীর সাথে কত কোমল আচরণ করা হয়েছে যে, প্রতিটি ব্যাথার বিনিময়ে একটি আরব গোলাম আজাদ করার সাওয়াব লেখা হয়।
যে নারী প্রসববেদনার সময় মারা যায় সে শহীদ
সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যদি নারী মারা যায় তাহলে হাদীস শরীফে এসেছে, এই নারী শহীদ। কেয়ামতের দিন তাকে শহীদদের কাতারে দাঁড় করানো হবে।
সন্তান জন্মদানের ভিত্তিতে ক্ষমাপ্রাপ্তির ঘোষণা
যদি বাচ্চা সুস্থ হয়ে জন্ম নেয়। প্রসূতি এবং সন্তান উভয় সুস্থ থাকে তাহলে হাদিস হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ তাআলা এক ফেরেশতাকে নির্দেশ দেন যে, ওই নারীকে সে বলে, হে মা! আল্লাহ তাআলা তোমার গুনাহগুলো থেকে তোমাকে এমনভাবে পবিত্র করে দিয়েছেন, যেমন তুমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন পবিত্র ছিলে।
দেখুন, সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কষ্ট সহ্য করেছে আর আল্লাহ তা’আলা এর বিনিময় তার অতীতের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিয়েছেন। সে যেদিন পৃথিবীতে এসেছিল সেদিন যেমন নিষ্পাপ ছিল, সন্তান প্রসব করার কষ্ট সহ্য করার কারণে আজ সে তেমনই নিষ্পাপ হয়ে গিয়েছে।
সুবহানাল্লাহ! কত বড় পাওনা! কত অসাধারণ প্রতিদান!
সন্তানকে আল্লাহ শেখানোর প্রতিদান
সন্তান এবার ধীরে ধীরে বড় হয়। মা তাকে দিন শিক্ষা-দীক্ষা দেয়। আল্লাহর নাম শিখায়। হাদীস শরীফের মর্মার্থ হল, সন্তান জীবনের প্রথম যখন আল্লাহ শব্দ বলে আল্লাহ তাআলা সঙ্গে সঙ্গে তার মা-বাবার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন।
বোনেরা! আমার আল্লাহর দয়া দেখুন, তিনি কত অনুগ্রহ করেছেন আপনাদের প্রতি!
শিশুদেরকে উঠানোর সময় আল্লাহর নাম নিন। ঘুম পাড়ানোর সময় আল্লাহর নাম নিন। খাওয়ানোর সময় আল্লাহর নাম নিয়ে খাওয়ান। একসময় দেখবেন সন্তান আল্লাহর নাম নিচ্ছে।
অথচ বর্তমান আমাদের বৌ-ঝিরা শিশুর সামনে মাম্মি বলে, পাপা বলে। আল্লাহর নাম নেয় না। আলট্রা মডার্ন হলে twinkle twinkle Little Star বলে। তারা এই কথাটার অর্থ পর্যন্ত জানে না। আমরা যদি শিশুদের সামনে আল্লাহ আল্লাহ বলি, একসময় সে আল্লাহ বলে উঠবে। আর প্রথম যখন সে আল্লাহ বলে উঠবে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা তার মা-বাবার অতীতের জীবনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
সন্তানকে কোরআন পড়ানোর ফজিলত
মা যখন সন্তানকে পবিত্র কোরআন পড়ানোর জন্য পাঠাবে-শিখাবে। যখনই সন্তান পুরো কোরআন পড়া সম্পন্ন করবে আল্লাহ তা’আলা সঙ্গে সঙ্গে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন।
সন্তানকে হাফেজ বানানোর ফজিলত
ছেলে বা মেয়েকে কোরআন হিফজ করানোর জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। সে হাফেজ হলে, হাফেজা হলে হাদিসের মর্মার্থ হল, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা হাফেজ ছেলে-মেয়ের মা-বাবাকে নূরের তাজ পরিয়ে দিবেন। যার জ্যোতি হবে চাঁদ ও সূর্যের চাইতেও বেশি। এমনকি যদি সূর্য কোনো ঘরের মধ্যে আসে তবে ওই পরিমাণ আলোকিত হবে না যে পরিমাণ ওই নূরের তাজের কারণে আলোকিত হবে।
কিয়ামতের দিন ওই মা-বাবাকে দেখে সবাই বিস্মিত হবে। জিজ্ঞেস করবে, কে এই ব্যক্তি?
তাদেরকে বলা হবে, এ ব্যক্তি নবীও নন, শহীদও নন। এ ব্যক্তি হলো, সেই সৌভাগ্যবান পিতা-মাতা যারা তাদের ছেলে-মেয়েকে পবিত্র কোরআনের হাফেজ বানিয়ে ছিল। এজন্য আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নুরের তাজ পরিয়ে দিয়েছেন।
দেখুন, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি কদমে কদমে সাওয়াব ও প্রতিদান প্রদানের ব্যবস্থা নারীর জন্য রেখেছেন।
সংসারের কাজের জন্য সওয়াব
নারী সংসারের কাজ করে। এ কাজ করার জন্যও তাদেরকে সাওয়াব দেওয়া হয়। বলুন, এমন কোন মহিলা আছে যে তার ঘর ঝাড়ু দেয় না? জামা-কাপড় পরিষ্কার করে না? রান্নাবান্না করে না? এগুলো সব মহিলাই করে থাকে। এজন্যও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে প্রতিদান দিবেন।
একটি হাদিস আপনাদেরকে শোনাচ্ছি, মনোযোগসহ শুনুন। অন্তরের কান দিয়ে শুনুন। রাসূল  বলেছেন, যে মহিলা তার স্বামীর সংসারে অগোছালো জিনিস গুছিয়ে রাখবে, আল্লাহ তাআলা তাকে একটি নেকি দিবেন। একটি গুনাহ মাফ করে দিবেন। আর জান্নাতে তাহর জন্য একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।
এবার ভেবে দেখুন, নারীরা প্রতিদিন তাদের ঘর-সংসারের কতগুলো জিনিস গুছিয়ে রাখে। এক রান্নাঘরের হিসাবেই করুন, কতগুলো জিনিস তারা পরিষ্কার করে ঠিকঠাক করে।
আমাদের মা-বোনেরা ভোর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শতশত কাজ করে। সব সময় তাদের হাত চলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই কাজগুলো কোন নিয়তে করা উচিত–তারা এর খবর রাখে না।
আমাদের মা-বোনেরা কেবল এই নিয়তে কাজ করে যে, ঘর-দোর গুছিয়ে না রাখলে মানুষ কী বলবে! সবাই নোংরা বলবে। মনে রাখবেন, মা-বোনেরা এই নিয়তে ঘর-সংসার কাজ করে তিল পরিমাণও প্রতিদান পাবে না। কারণ তারা এই কাজগুলো মানুষকে দেখানোর জন্য করছে। মানুষের প্রশংসা করানোর জন্য করছে।
নিয়ত শুদ্ধ করা খুবই জরুরী আমল
নিয়ত শুদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি একটি আমল। বর্তমানে নারীদেরকে নিয়ত শুদ্ধ করার বিষয়ে কোনো কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় না।, মনে রাখবেন, নিয়ত বিশুদ্ধ থাকলেই সওয়াব পাবেন। অন্যথায় পাবেন না। যেহেতু নিয়ত শুদ্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়–এজন্য একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করছি।
ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, এক ব্যক্তি ঘর বানিয়েছে এবং ঘরের জানালা লাগিয়েছে আর নিয়ত করেছে– এই জানালা দিয়ে আলো আসবে, বাতাস আসবে। এই ব্যক্তি আলো-বাতাস তো পাবে কিন্তু কোনো সওয়াব পাবে না। আরেক ব্যক্তি ঘর বানিয়েছে, জানালা লাগিয়েছে। কিন্তু সে এই নিয়ত করেছে যে, এ জানলা দিয়ে আযানের আওয়াজ ভেসে আসবে। এতে সময় মত নামাজ পড়তে সুবিধা হবে। এই নিয়ত করার কারণে সে সাওয়াব পাবে, আলো-বাতাসও পাবে।
এক মহিলা তরকারি রান্না করছে। তরকারি রান্নার সময় একটু পানি বেশি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়ত করে নিল যে, মেহমান আসলে যেন তাকে মেহমানদারি করানো যায়। প্রয়োজন হলে প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করা যায়। মেহমান বা প্রতিবেশীর নিয়ত করে পানি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে এই মহিলা মেহমান বা প্রতিবেশীকে খাওয়ানোর সাওয়াব পেয়ে যাবে।
এবার বলুন, এমন কোন মহিলা আছে যে এই সওয়াব নিতে পারবে না? সবাই তো নিতে পারবেন। কিন্তু দীনি ইলম না থাকার কারণে তারা এসব থেকে বঞ্চিত হয়।
এজন্য নবীজি  বলেছেন,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِم ومسلمة
  ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর দীনি ইলম তলব করা ফরজ।’
এর অর্থ হলো, দীনি ইলমশিক্ষা করা মহিলাদের জন্যও ফরজ। কিন্তু বাস্তবতা হল, মহিলারা দীনি ইলম থেকে এমনভাবে দুরে থাকে যে, গোসলটা পর্যন্ত করা জানে না। মাসআলা জানা তো অনেক দূরের কথা।
কোন নিয়তে ঘরদোর পরিস্কার করবেন?
নারীরা সাধারণত এই নিয়তে ঘরদোর পরিষ্কার করে যে, ঘর নোংরা দেখলে মানুষ কি বলবে।
প্রিয় বোনেরা আমার! মানুষ কি বলবে না বলবে সে দিকে তাকাবেন না; বরং ঘরদোর পরিষ্কার করার সময় আল্লাহর এই বাণীর কথা মনে রাখবেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবাকারীদেরকে এবং অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালোবাসেন।’
এ কথার অর্থ কি? এ কথার অর্থ হল, তাওবার মাধ্যমে ভিতরটা পরিস্কার হয়। ঘরদোর পরিষ্কার করার দ্বারা বাইরের দিকটা পরিষ্কার হয়। এর অর্থ, যে ব্যক্তি বহিরাঙ্গন পরিষ্কার রাখবে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং যে ব্যক্তি ভেতরটা অর্থাৎ অন্তর্জগৎ পরিষ্কার রাখবে আল্লাহ তার প্রতিও সন্তুষ্ট।
এজন্য নারীদের উচিত ঘরদোর পরিষ্কার করার সময় নিয়ত করা যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে আল্লাহ ভালবাসেন। আর শরীয়তের নির্দেশ الطَّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ ‘পবিত্রতা-পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’
সুতরাং আপনি এই নিয়ত করুন রাসুলুল্লাহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা ঈমানের অর্ধেক বলেছেন। যে ব্যক্তি পরিচ্ছন্ন থাকে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন, তাই আমি পরিষ্কার করছি।
প্রিয় বোনেরা আমার! আপনি যদি ঘরদোর এই নিয়তে পরিষ্কার করেন, ফার্নিচার তৈরি করেন, জামা-কাপড় ইস্ত্রি করে রাখেন তাহলে প্রতিটি কাজের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা আপনাকে সাওয়াব ও প্রতিদান দান করবেন।
কারণ আপনার নিয়ত পরিশুদ্ধ হয়েছে। কাজটি আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মাফিক করেছেন। তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য করেছেন তাই আপনি আপনার প্রতিটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকবেন।
বিয়ের পর মা বাবাকে দেখতে আসার ফজিলত
বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েই তার মা-বাবাকে দেখার জন্য আসে। কিন্তু তাদের নিয়ত কী থাকে? মাকে দেখতে যাচ্ছি, বেড়াতে যাচ্ছি–এতোটুকুই।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, বিয়ের পর যখন কোনো মেয়ে স্বামীর অনুমতি নিয়ে মা-বাবাকে দেখতে যাবে। আর যাওয়ার সময় মনে মনে নিয়ত করবে, এর দ্বারা আল্লাহ খুশি হবেন। এ নিয়তের বিনিময়ে আল্লাহতালা তাকে প্রতিটি কদমে একশত নেকি দান করবেন। একশত গুনাহ মাফ করবেন এবং জান্নাতে একশত মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।
দেখুন, নিয়ত শুদ্ধ করলে কত সব লাভ হয়!
অপর হাদীসে এসেছে, মেয়ে যখন স্বামীর বাড়ি থেকে মায়ের বাড়িতে আসলো। এসে মা-বাবার প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। নবীজী  বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে একটি কবুল হজ অথবা ওমরাহর সাওয়াব দান করবেন।
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কেউ যদি তার মা-বাবাকে ভালোবাসার সঙ্গে বারবার দেখে তখনও কি এই সওয়াব পাবে? নবীজি উত্তর দিলেন, যত দেখবে ততবারই সে কবুল হজ অথবা ওমরাহর সাওয়াব পেতে থাকবে।
শিশুদের সঠিক শিক্ষা না হওয়ার মৌলিক কারণ
এখনকার মেয়েরা তো মা হয়ে যায়। কিন্তু সন্তানদেরকে কিভাবে তারবিয়াত দিতে হবে, কিভাবে তাদেরকে মানুষ করতে হবে– তা জানে না। এরা নিজেরাই তো তরবিয়ত পাই নি, বাচ্চাদেরকে কী শিখাবে! বর্তমানে আমাদের সমাজে এটাই হল প্রধান সমস্যা। এ কারণেই আমাদের সমাজের সন্তানেরা সঠিকভাবে শিক্ষাদীক্ষা পায় না।
এক সময় মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে সঠিকভাবে মানুষ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। আপনাদেরকে একটা ঘটনা শোনাচ্ছি। এর মাধ্যমে আপনারা বুঝতে সক্ষম হবেন যে, নেককার নারীরা তাদের সন্তানদেরকে কিভাবে দীক্ষা দিয়ে থাকে! কিভাবে তাদেরকে মানুষ করে থাকে।
কুতুবুদ্দিন কাকী রহ.-এর শৈশবের ঘটনা
দিল্লিতে একজন বড় বুজুর্গ ছিলেন হযরত খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী রহ.। যাঁকে মোঘল বাদশাহদের পীর মনে করা হতো। আমি তাঁর মাজার দেখেছি। কুতুব মিনারের একদম নিকটে। তার নামে এই মিনারের নামকরণ করা হয়েছে। তার আসল নাম কুতুবুদ্দিন। কিন্তু নামের সঙ্গে কাকীশব্দ যুক্ত করে বলা হয় কুতুবুদ্দিন কাকী। কাকী  হিন্দি শব্দ। এই শব্দের অর্থ রুটি।
তাঁর শিশুকালের একটা বিখ্যাত ঘটনা রয়েছে। তিনি মাত্র মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। তখন তাঁর মা-বাবা ভাবলেন, আমরা আমাদের সন্তানকে উত্তম তরবিয়ত দিব। আর এর প্রথম ধাপ হলো, তার অন্তরে এ বিষয়ে প্রোথিত করে দিব যে, সে যেন সব বিষয়ে আল্লাহর প্রতি ধাবমান থাকে। অর্থাৎ তারা ভাবলেন প্রথমে ছেলেকে ঈমান শিক্ষা দিতে হবে। সে যেন সবকিছু আল্লাহর কাছে চায়। সব বিষয়ে আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হয়। এতে তার মাঝে তাওয়াককুল সৃষ্টি হবে একমাত্র আল্লাহর প্রতি। মাখলুকের পরিবর্তে খালেকের সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হবে।
যাই হোক, এ উদ্দেশ্যে তার মা একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। পরদিন শিশু বখতিয়ার কাকী মাদ্রাসা থেকে আসার আগেই তার মা খাবার রান্না করে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখেন।
বখতিয়ার কাকী মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসে তার মাকে বললেন, মা ক্ষুধা পেয়েছে। খেতে দিন।
মা বললেন, বাবা! খাবার তো আল্লাহর কাছে চাইতে হয়। তুমি আল্লাহর কাছে খাবার চাও। তিনি তোমাকে দিবেন।
বখতিয়ার কাকী বলল, আল্লাহর কাছে কিভাবে চাইতে হয়?
মা বললেন, জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া কর। আল্লাহকে বল, আল্লাহ! আমার ক্ষুধা লেগেছে। আপনি আমাকে খাবার দিন। আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই তোমাকে খাবার দিবেন।
ছোট্ট বাচ্চা মায়ের কথামত জায়নামাজ বিছিয়ে নেয়। এরপর নিষ্পাপ দু’টি হাত আসমানের দিকে উঠায়। নিষ্পাপ মুখ থেকে বের হয় ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ কিছু কথা ও দোয়া। সে বলতে থাকে, আল্লাহ! আমার ক্ষুধা পেয়েছে। আপনি আমাকে খাবার দিন। আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমাকে দ্রুত খাবার দিন। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
দোয়া শেষ হওয়ার পর মা বললেন, বাবা! তুমি দোয়া করেছ। আল্লাহর কাছে খাবার চেয়েছ। আল্লাহ অবশ্যই তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। তুমি এদিকে ওদিকে খুঁজে দেখো।
নিষ্পাপ শিশু সরল মনেই ঘরের এখানে ওখানে ইতিউতি করে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে একজায়গায় খাবার পেয়ে যায়। শিশু মহাখুশিতে খাবার খেয়ে নেয়।
এরপর থেকে এটা তার প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়। মা আগে থেকেই খাবার রেডি করে কোথাও লুকিয়ে রাখেন। বাচ্চা মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসে জায়নামাজ বেশি আল্লাহর কাছে খাবার চায়–আল্লাহ আমার ক্ষুধা পেয়েছে আমাকে খাবার দিন।
ছেলেকে এভাবে আল্লাহর কাছে চাইতে দেখে মায়ের মন খুশিতে নেচে ওঠে। ছেলে আমার, আল্লাহর কাছে চাচ্ছে! আল্লাহর দিকে রুজু হচ্ছে! মাখলুকের পরিবর্তে খালেকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে! খালেকের কাছে চাচ্ছে! মা দারুন খুশি!!
দোয়া শেষে সে ঘরের এখানে ওখানে খাবার খুঁজতে থাকে। এক সময় খাবার পেয়ে যায়। খেয়ে-দেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
একদিন বখতিয়ার কাকীর মা কোনো এক প্রয়োজনে এক আত্মীয় বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে ছেলের কথা ভুলে যান। হঠাৎ তার মনে পড়ে। ছেলে তো এতক্ষণে মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসেছে। আজ তো খাবার রান্না করে রেখে আসেনি। আল্লাহই ভালো জানেন, আজ কী ঘটনা ঘটে! এই চিন্তায় মায়ের কান্না চলে আসে। দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগুতে থাকেন। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন, ওগো আল্লাহ! আমার সন্তানের অন্তরে তোমার প্রতি ইয়াকিন পয়দা করার জন্য, ঈমান মজবুত করার জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছিলাম। আজ আমার ভুল হয়ে গেছে। তার জন্য খাবার রেখে আসতে পারিনি। এতক্ষণে হয়তো মাদ্রাসা থেকে সে ফিরে এসেছে। তোমার কাছে খাবার চাচ্ছে। দোয়া করছে। হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতি রহম কর। আমার এই রহস্য ফাঁস করে দিও না।
বখতিয়ার কাকীর মা কাঁদতে থাকেন আর আল্লাহর কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে দোয়া করতে থাকেন।
কিন্তু বাড়িতে এসে মা বিস্মিত বিস্মিত হন! দেখেন, ছেলে তার দিব্যি আরামে ঘুমাচ্ছে! তিনি মনে করলেন, বেশি ক্ষুধা লাগার কারণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
তাই তিনি ঝটপট খাবার তৈরি করে লুকিয়ে রাখেন। এর মধ্যে ছেলে ঘুম থেকে জেগে যায়। মা বললেন, বাবা তোমার হয়তো আজ বেশি ক্ষুধা পেয়েছে।
বখতিয়ার কাকী উত্তর দিলেন, মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহর কাছে খাবার চাইলাম যে, আল্লাহ! আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি আমার খাবার দিন। আজ আমার মা নেই। আজ আমাকে আরও ভালো খাবার দিন। দোয়া শেষ করে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি, বিছানার উপর খাবার পড়ে আছে। আমি খাবার খেয়ে নিলাম। আম্মা! আজকের খাবার খেতে বেশি মজাদার ছিল। এমন খাবার আমি কোনোদিন খাইনি।
প্রিয় বোনের আমার! একটা সময় ছিল যখন মায়েরা তাদের সন্তানের অন্তরে এভাবে ঈমান সৃষ্টি করত। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দিত।
বর্তমানে এমন কোনো মা কি আছে যে এ কথা বলতে পারে যে, আমি আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস আমার সন্তানের অন্তরে সৃষ্টি করে দিয়েছি? আছে কি এমন কোনো মা যে সকাল-বিকাল তার সন্তানকে খাবার খাওয়ানোর সময় এই শিক্ষা দিবে যে, বাবা সর্ববস্থায় সত্য কথা বলতে হয়?
এসব বিষয়ের প্রতি আমরা মোটেই মনোযোগ দেই না। এগুলো যে আমাদের জন্য অপরিহার্য, সন্তানের ভবিষ্যৎ তৈরির মূল বুনিয়াদ– তা আমরা চিন্তাও করি না!
বাবা যদি একটু উপদেশ দেয়, কিছু বলে, মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। অথচ শৈশবের স্বভাব সত্তর বছরেও সংশোধন হয় না।
বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের সঠিক শিক্ষাদীক্ষা না দেওয়ার কারণে এরা যখন বড় হয়, মা-বাবাকে দূরে ঠেলে দেয়। তাদেরকে এমন ভাবে ঘৃণা করে, যেমন পাপকে ঘৃণা করে থাকে। একটা সময় ছিল, যখন মেয়েরা ফজরের পর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করত। সন্ধায় সূরা ওয়াকিয়া পড়ত। কোরআন তেলাওয়াত করত। ফজরের পর সন্তানকে কোলে নিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করবে এমন মা আজ কোথায়? এখনতো অবস্থা এমন যে, সকাল হয়ে যায় মা ঘুমিয়ে থাকে। বাচ্চাও ঘুমিয়ে থাকে। সন্ধ্যা নেমে আসে, মা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ে। এদিকে বাচ্চা দুধ পান করে আর এদিকে মা সিনেমা দেখতে থাকে।
হে মায়েরা! সিনেমা-নাটকে তুমি যখন পর-পুরুষকে দেখতে থাকো, গান শুনতে থাকো আর এই অবস্থায় তোমার সন্তান দুধ পান করতে থাকে! তুমিই বলো,  তোমার ছেলে জোনায়েদ বাগদাদী কী করে হবে?! আব্দুল কাদের জিলানী হবে কিভাবে?!
কোরআনের সঙ্গে এক মহিলা সাহাবীর গভীর সম্পর্ক
প্রিয় বোনেরা আমার! শুনুন, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। পুরুষরা ইবাদত-বন্দেগী করে যেমন আল্লাহর প্রিয় হতে পারে, নারীরাও  আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারে। তারাও পারে আল্লাহর মা’রিফাত লাভ করতে।
এক মহিলা চুলা রুটি তৈরি করতে করতে তিন পারা কোরআন তেলাওয়াত করে ফেলেন। একদিকে রুটি তৈরি করছেন আর অন্যদিকে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। রুটি হতে হতে তার তিন পারা কোরআন তেলাওয়াত হয়ে যায়।
ফাতেমা রাযি.-এর ইবাদতের প্রতি আগ্রহ
এমন এক সময় গিয়েছে যখন নারী সারাদিন সংসারের কাজ করত আর সারারাত জায়নামাজে থাকতো। হযরত ফাতেমা সম্পর্কে বর্ণিত আছে, শীতের দীর্ঘ রাত। এশার নামাজ পড়ে দুই রাকাত নফল নামাজের নিয়তে দাঁড়িয়েছেন এবং পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন। শরীর-মন উভয়টা ফুরফুরে ছিল। তিনি যতই তেলাওয়াত করতে থাকেন ততই মজা পেতে থাকেন। সালাম ফিরিয়ে দেখেন, ফজরের সময় হয়ে গেছে। তিনি কান্না করতে থাকেন আর বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! তোমার রাত কত ছোট হয়ে গিয়েছে, দুই রাকাত নামাজ পড়তে পড়তে রাত শেষ হয়ে গেল।
প্রিয় বোনেরা আমার! তারা দুই রাকাত নামাজে রাত শেষ করে দিতেন আর ছোট হওয়ার অভিযোগ করতেন। আর বর্তমানে আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেরই ভাগ্যে জোটে না।
চাশতের নামায দ্বারা রিজিকে বরকত হয়
এমন সময়ও ছিল যখন স্বামীরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে বের হতো। স্ত্রীরা জায়নামাজ বিছিয়ে চাশতের জন্য দাঁড়িয়ে যেত। স্ত্রীরা আঁচল তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত, হে আল্লাহ! আমার স্বামী হালাল রিজিকের জন্য ঘর থেকে বের হয়েছে। আপনি তার কাজে বরকত দিন। রিজিকে বরকত দিন।
ঘরে স্ত্রীরা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত আর আল্লাহ তাআলা তাদের স্বামীকে কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন। ব্যবসা সুন্দর করে দিতেন। রিজিকে বরকত দান করতেন।
সারকথা
মুসলিম সমাজে নারী হল ঘরের রাণী। এজন্য ঘরের সার্বিক পরিবেশ নির্ভর করে নারীদের দ্বীনদারীর উপর। নারীরা নেককার হলে, সৎ চরিত্রের অধিকারী হলে বাচ্চারাও নেককার হবে। উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে। তাদের মধ্যেও দ্বীনদারী সৃষ্টি হবে।
এজন্য মুসলমান নারীদের দ্বীনি শিক্ষা এবং উত্তম দীক্ষার বিষয়ে বিশেষভাবে মেহনত জরুরী। জনৈক ব্যক্তি চমৎকার বলেছেন–
مرد پڑھا فرد پڑھا
عورت پڑھی خاندان پڑھا
‘পুরুষ শিক্ষিত হলে ব্যক্তি শিক্ষিত হয়। আর নারী শিক্ষিত হলে গোটা পরিবার শিক্ষিত হয়।’
জনৈক ইংরেজি মনিষী বলেছেন, তোমরা আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি আদর্শ জাতি দিব।
বর্তমানে মুসলিম নারীদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দাবি। যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মায়ের কাছ থেকে দীন শিখতে পারে। অন্তরে দীনের মহাব্বত, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পয়দা করতে পারে এবং নবীর চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে বিশ্বজুড়ে আলো ছড়াতে পারে। চন্দ্র সূর্যের মতো কিরণ বিলাতে পারে।
 
Top