মূল
মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী
অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
ইশকে ইলাহী পর্ব-০৫: আশেক তথা আল্লাহপ্রেমিকের অবস্থা
আশেকের অবস্থা
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের চমৎকার ঘটনা
একবার হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম চারণভুমিতে বকরির পাল চরাচ্ছিলেন। ইত্যবসরে এক পথচারী তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এবং আল্লাহ তাআলার শানে মৃদু উঁচু আওয়াজে বলছিল,
سُبْحَانَ ذِىْ الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوْتِ سُبْحَانَ ذِىْ الْعِزَّةِ وَالْعَظمَةِ وَالهَيْبَة وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوْتِ
‘পবিত্রতা সেই সত্তার যিনি জমিন ও আসমানের বাদশাহ। পবিত্রতা সেই সত্তার যিনি মর্যাদা, বড়ত্ব, প্রতিপত্তি, মহত্ব ও দাপটের মালিক।’
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এমন চমৎকার শব্দমালায় নিজের প্রাণপ্রিয় মালিকের গুণগান শুনে তাঁর অন্তর খুশিতে নেচে ওঠল। তিনি আনন্দে ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘ভাইটি আমার! আরেকটি বার এই শব্দগুলো বলো না!
পথচারী বলল, ‘তবে বিনিময়ে আমাকে কী দিবেন?’
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘বকরির অর্ধেক পাল তোমাকে দিয়ে দিব।’
লোকটি উক্ত শব্দমালা আবার শোনাল। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এতে এত মজা পেলেন যে, তাই তিনি আরো ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘ভাই আমার! আমাকে আরেকবার শব্দগুলো শুনাও।’
লোকটি বলল, ‘এবার কী দিবেন?’
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘বকরির অবশিষ্ট অর্ধেক পাল তোমাকে দিয়ে দিব।’
লোকিট উক্ত শব্দমালা আবার শোনাল। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মন ভরল না। তিনি আরো ব্যাকুলতা ছড়িয়ে বললেন, ‘আমার ভাই! আবার শোনাও।’
এবার লোটি বলল, ‘আপনার কাছে তো দেয়ার আর কিছু নইে। তোএখন শোনালে কী দিবেন?’
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘ভাই! দেয়ার মত আমার কাছে কিছু নাই। তবে বকরিগুলো চরানোর জন্য আমাকে রাখাল হিসাবে তো রাখতে পার। তুমি আমার প্রিয়তমের প্রশংসা আমাকে আবার শোনাও। আমি তোমার রাখাল হয়ে যাব।’
একথা শোনামাত্র লোকটি বলে ওঠল, ‘ওহে আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিম! মুবারক হোন। আমি একজন ফেরেশতা। আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, যাও। আমার বন্ধুর সামনে আমার নাম বলে দেখো, তিনি আমার নামের কত দাম দেন!’ সুবহানাল্লাহ!
ایک دم بھی محبت چھب نہ سکی
جب تیرا کسی نے نام لیا
‘তোমার ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে পারি নি
যখনি নিয়েছে কেউ নাম তোমারি।’
উত্তপ্ত তেলে কাবাব হওয়া
কোনো এক জিহাদের ঘটনা। দুইজন তাবিঈ শত্রুদের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। সৈন্যরা তাঁদেরকে নিজেদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল। বাদশাহ ছিল খ্রিস্টান। বাদশাহ যখন তাঁদের প্রতি তাকাল, তখন অনুভব করল, এরা তো টগবগে যুবক। এদের চেহারায় বীরত্বের দীপ্তি আছে। সুতরাং এদেরকে হত্যা না করে যদি আমাদের ধর্মে দীক্ষিত করা যায়, ফৌজের সিপাহসালার হতে পারবে।
এই চিন্তা করে সে দু’জনকে নয়নাভিরাম এক পার্কে নিয়ে গেল এবং তাদেরকে বোঝাল, ‘যদি তোমরা আমাদের ধর্ম গ্রহণ কর তাহলে যা চাও তা-ই দেয়া হবে। তোমাদের জীবন আলোয় ঝলমল করে দেয়া হবে। যে সুন্দরীটা তোমরা কামনা কর, তাকে তোমাদের বিবাহবন্ধনে দিয়ে দেয়া হবে। উপরন্তু আমাদের সেনাদলের গুরুত্বপূর্ণ পদ তোমাদেরকে উপহার দেয়া হবে।’
এ প্রস্তাব শুনের তাঁরা বললেন, ‘এই ক্ষণস্থাহী দুনিয়োর কোনো কিছুর প্রতি আমাদের আকর্ষণ নেই। আমরা কিছুতেই আমাদের ইসলামধর্ম ছাড়ব না।’
তাঁদের উত্তর শুনে বাদশাহ বুঝে নিল এভাবে হবে না। সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠবে না। তাই সে এবার ধমকের সুরে বলতে লাগল, ‘যদি তোমরা আমার কথা না মানো তাহলে তোমাদেরকে উত্তপ্ত তেলে ফেলে ভুনা করা হবে।’
ধমকের জবাবে তাঁরা শান্তচিত্তে জবাব দিলেন, فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ ‘তোমরা যা ইচ্ছা তাই সিদ্ধান্ত নিতে পার।’
অবশেষে বাদশাহ নির্দেশ জারি করল, ‘লোহার একটি বড় কড়াইয়ে তেল গরম করা হোক।’
নির্দেশমাফিক তা করা হল। যখন তেল প্রচণ্ড গরম হয়ে টগবগ করতে লাগল তখন বাদশাহ তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘শেষবারের মত বলছি, তোমরা ধর্ম পাল্টাও। আমাদের ধর্মে আসো। তোমাদের মুক্তি দেয়া হবে। যদি না শোনো তাহলে উত্তপ্ত তেলে এক্ষুণি ফেলে দেয়া হবে। তেলে তোমরা একেবারে ফ্রাই হয়ে যাবে।’
বাদশাহর প্রস্তাব তাঁরা এবারও অত্যান্ত সাহসিকতার সঙ্গে নাকচ করে দিলেন।
অবশেষে একজনকে ধরে উত্তপ্ত কড়াইয়ে ফেলে দেয়া হল। তিনি বার কয়েক আর্তচিৎকার করলেন। তারপর একেবারে কাবাব হয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন।
এ পর্যায়ে বাদশাহ তাকাল অপর তাবিঈর প্রতি। দেখল, তাঁর চোখ থেকে টপটপ অশ্রু পড়ছে। বাদশাহ ভাবল, এতো দেখি ভয় পেয়েছে। এবার হয়ত কথা শুনবে। তাই সে খুব মায়া দেখিয়ে বলল, ‘তোমার বেচারা সঙ্গী আমার কথা মানল না। যার কারণে কী ঘটে গেল, তা তো তুমি নিজেই দেখেছ। এবার তোমার পালা। আমার কথা মেনে নাও। তোমাকে শাস্তি দিব না। মুক্তি দিয়ে দিব।’
তাবিঈ উত্তর দিলেন, ‘ওহে অপরিণামদর্শী বাদশাহ! তুমি মনে করেছ, আমি মরণকে ভয় পাচ্ছি। মোটেও না। একেবারে না।’
বাদশাহ বলল, ‘তাহলে তুমি কাঁদছ কেন?’
তাবিঈ উত্তর দিলেন, ‘কাঁদছি এজন্য যে, আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার তো একটি মাত্র প্রাণ। তোমার তেলে পুড়ে এটা শেষ হয়ে যাবে। আহা! আমার শরীরে যত চুল-পশম আছে, যদি আমার প্রাণও এতগুলো হত, তবে তো আমাকে ততবার এই উত্তপ্ত তেলে ফেলা হত। আর আমি আমার সবগুলো প্রাণ মহান আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে পারতাম!’
একজন বৃদ্ধ আশেক
একবারের ঘটনা। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একবৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হল। তিনি লক্ষ্য করলেন, বৃদ্ধ একাকী নিবিড় মনে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলছেন। মূসা আলাইহিস সালাম শুনতে পেলেন, বৃদ্ধ বলছেন, ‘ওগো আল্লাহ! আমি শুনেছি তোমার স্ত্রী নেই। ছেলেমেয়ে নেই। আল্লাহজী! আপনি আমার কাছে চলে আসেন। আমি আপনার খুব সেবা করব। আপনাকে খাইয়ে দিব। আপনার কাপড় ধুয়ে দিব। মিষ্টি খাওয়াব। মাখন খায়ওাব। ওষুধ লাগলে ওধুধ খাওয়াব। প্রাণপ্রিয় মাওলা! আমি আপনার অনেক যত্ন নিব।’
বৃদ্ধের মুখে এসব অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে মূসা আলাইহিস সালাম বৃদ্ধকে বোঝালেন, ‘আল্লাহর শানে এরূপ ব্যবহার করা বেআদবি, গোস্তাখি। এ জাতীয় কথা আল্লাহর মর্যাদাপরিপন্থী।’
মূসা আলাইহিস সালামের কথা শুনে বৃদ্ধ ঘাবড়ে গেল। এবার কান্না শুরু করে দিল, কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। ইত্যবসরে আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে অহি পাঠালেন যে, ‘হে আমার প্রিয় নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সম্পর্ক গড়ে দেয়ার জন্য; সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আপনাকে পাঠাই নি।’
توبراۓ وصل کردن آمدی
نے براۓ فصل کردن آمدی
‘এসেছ তুমি জুড়ে দিতে
আস নি তুমি দূরে  ভাগাতে।’
 
Top