ইমামে আজম আবূ হানিফা রহঃ একজন তাবেঈ ছিলেনও বটে। ইমাম শাফেঈ রহঃ ইমামে আজমের মাজারে গিয়ে আল্লাহ'র ইবাদত তথা নামাজ আদায় করতেন এবং হাজত পূরণ বা সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহ'র কাছে আবূ হানিফা রহঃ এঁর উসিলায় দোয়া করতেন এবং কখনো খালি হাতে ফিরতেন না (অতি তাড়াতাড়ি উনার সমস্যা সমাধান হয়ে যেত)।

ইমাম শাফেঈ রহঃ বলেন, "নিশ্চয়ই আমি ইমাম আবু হানিফা রহঃ হতে বরকত হাসিল করি। যখন আমার কোন সমস্যা দেখা দেয় তখন আমি উনার মাজার শরীফে এসে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। অতঃপর উনার উসীলা দিয়ে আল্লাহ পাকের নিকট সমস্যা সমাধানের জন্য প্রার্থনা করি। তা অতি তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে যায়।

[ফতোয়ায়ে শামী, মুকাদ্দিমা ১ম খন্ড ৫৫ পৃষ্ঠা। তারিখে বাগদাদ,১ম খন্ড, পৃঃ ১২৩। রুদ্দুল মুখতার, ১ম খন্ড,পৃঃ৩৮]

ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (রহঃ) লিখেন, উলামা ও যাদের প্রয়োজন তাঁদের মধ্যে এই আচার সবসময়ই চালু ছিল যে তাঁরা ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এঁর মাজারে যেতেন এবং নিজেদের অসুবিধা দূর করার জন্যে তাঁর মাধ্যমে দোয়া করতেন। এ সকল ব্যক্তি এটাকে সাফল্য লাভের একটা উসিলা মনে করতেন এবং এর অনুশীলন দ্বারা বড় ধরনের পুরস্কার লাভ করতেন। বাগদাদে থাকাকালীন সব সময়েই ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ইমাম আবু হানিফা (রহ:)-এর মাজারে যেতেন এবং তাঁর কাছে আশীর্বাদ তালাশ করতেন। যখন আমার (ইমাম ইবনে হাজর রহঃ) কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন আমি দু’রাকাত নামাজ আদায় করে তাঁর মাযারে যাই এবং তাঁর ওসীলায় দোয়া করি। ফলে আমার অসুবিধা তক্ষণি দূর হয়ে যায়।

[খায়রাত আল্ হিসান, ১৬৬ পৃষ্ঠা]

খতীব বাগদাদী রহঃ লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী রহঃ বাগদাদে থাকতে ইমামে আজম আবূ হানীফার কবর জিয়ারত করতেন এবং তাঁকে উসীলা করে দোয়া করতেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার মাজার শরীফের বরকত সম্পর্কে নিজের পরীক্ষিত আমল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: “আমি ইমাম আবূ হানীফার উসীলায় বরকত লাভ করি এবং প্রতিদিন তাঁর কবর জিয়ারত করি। যখন আমার কোনো প্রয়োজন বা সমস্যা হয়–তখন আমি দু’রাকাত নামায আদায় করে তাঁর কবরের কাছে এসে, এর পাশে দাঁড়িয়ে হাজত (প্রয়োজন) পূরণের জন্যে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে দোয়া করি। এরপরে আমি সেখান থেকে ফিরতে না ফিরতেই আমার হাজত পূরণ হয়ে যায়!”

[তারিখে বাগদাদ,১ম খন্ড, ১২৩ পৃষ্ঠা]

হাদিসে পাকে রয়েছে, সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলছেন,

"যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, তা দ্বারাই কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ‘ইবাদাত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে কোন দ্বিধা করি-না, যতটা দ্বিধা করি মু’মিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।" (সহীহ বুখারী ৬৫০২)

[যেহেতু তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে সকল কাজ-কর্ম আল্লাহ তাআলারই সন্তুষ্টি মোতাবেক প্রকাশ পায় এজন্যে একথা বলা হয়েছে যে, আঁমিই যেন তার চোখ, কান, হাতও পা হয়ে যাই। আল্লাহ তায়ালা নিরাকার তথা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হতে পবিত্র। ইমাম বায়হাকী রহঃ বলেন, “নিশ্চয় আমাদের ও সকল মুসলমানের জানা অত্যাবশ্যক যে, আমাদের প্রভু আকৃতি ও অবয়ব বিশিষ্ট নন। কেননা, "আকৃতি'', কেমন এর চাহিদা রাখে। অথচ কেমন প্রশ্নটি আল্লাহ ও তাঁর গুণবলীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোনো ক্ষেত্রে যদি আকৃতি প্রকাশের কথা আসে তা হবে তাঁর সিফাত বা গুণাবলী।” (কিতাবুল আসমা ওয়াল সিফাত)]

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাগণকে অসংখ্য ক্ষমতা দান করেছেন। নবীদেরকে দিয়েছেন অসংখ্য মু'জিযা ও আউলিয়ায়ে কেরামকে দিয়েছেন অসংখ্য কারামত। এছাড়াও

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা এ উম্মতকে সাহায্য করবেন তার দুর্বলদের দ্বারা, তাদের দু'আ, নামায এবং ইখলাসের কারণে।
(সুনানে আন-নাসায়ী ৩১৭৮)

ইমাম বুখারী রহঃ বর্ণনা করেন,

মুস‘আব ইবনু সা‘দ (রাঃ) বলেন সা‘দ (রাঃ)-এর ধারণা ছিল অন্যদের চেয়ে তাঁর মর্যাদা অধিক। তখন নবী ﷺ বললেন, ‘তোমরা দুর্বলদের ওয়াসীলায়ই সাহায্যপ্রাপ্ত ও রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছ।’ (সহিহ বুখারী ২৮৯৬)

হারিসাহ ইবনু ওয়াহ্ব (রাঃ) বলেন, আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছিঃ আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকদের সম্পর্কে জানাব না? তারা হবে (দুনিয়াতে) দুর্বল, মজলুম। তারা যদি আল্লাহর ওপর কসম করে, তবে আল্লাহ্ তা পূর্ণ করে দেন। আর জাহান্নামের অধিবাসী হবে অবাধ্য, ঝগড়াটে ও অহংকারীরা।
(সহীহ বুখারী ৬৬৫৭)

প্রিয় নবী ﷺ বলেনঃ আমি কি তোমাদের জান্নাতীদের সম্পর্কে জ্ঞাত করবো না? (তারা হলেন) ঐ সকল লোক যারা অসহায় এবং যাদের তুচ্ছ মনে করা হয়। তারা যদি আল্লাহর নামে শপথ করে, তাহলে তা তিনি নিশ্চয়ই পুরা করে দেন। আমি কি তোমাদের জাহান্নামীদের সম্পর্কে জ্ঞাত করবো না? তারা হলোঃ কর্কশ স্বভাব, শক্ত হৃদয় ও অহংকারী।
(সহীহ বুখারী ৬০৭১)

স্বয়ং নবীজি ﷺ ই উসিলা দিয়ে দোয়া করা শিখিয়ে ছিলেন যা সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী সকল বুযূর্গগণসহ এখনও বাস্তবায়িত হয়ে আসছে।

উসমান ইবনু হুনাইফ রাঃ থেকে বর্ণিত। এক অন্ধ সাহাবী নবী ﷺ এঁর নিকট এসে আরজ করল, আপনি আল্লাহ্‌র কাছে আমার জন্য দুআ করুন। তিনি যেন আমাকে রোগমুক্তি দান করেন। তিনি বলেনঃ তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দুআ করতে বিলম্ব করবো, আর তা হবে কল্যাণকর। আর তুমি চাইলে আমি দুআ করবো। সে বললো, তাঁর নিকট দুআ করুন। তিনি তাকে উত্তমরূপে উযূ করার পর দু রাকআত সালাত পড়ে এ দুআ করতে বলেনঃ

হে আল্লাহ্! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, রহমতের নবী মুহাম্মাদ ﷺ এঁর উসীলা দিয়ে, আমি তোমার প্রতি মুতাওয়াজ্জু হচ্ছি/ মনোনিবেশ করলাম। ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আমার চাহিদা পূরণের জন্য আমি আপনার উসীলা দিয়ে আমার রবের প্রতি মনযোগী/ মুতাওয়াজ্জু হলাম যাতে আমার প্রয়োজন মিটে।
হে আল্লাহ্! আমার জন্য তাঁর সুপারিশ কবূল করো। (অতঃপর তার অন্ধত্ব দূর হয়। বর্তমানে এর উপর আমল করতে চাইলে, "ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ" এর স্থলে "ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ" বলতে বলা হয়েছে)

(সুনান আত তিরমিযি ৩৫৭৮, সুনানে ইবনে মাজাহ ১৩৮৫)

প্রিয় নবী ﷺ এঁর ওফাতের পর এক ব্যক্তি এই উসমান বিন হানিফ রাঃ এঁর কাছে হাজত পূরণের জন্য এলে তিনি তাকে একইভাবে দোয়া করতে শিখিয়ে দেন। তিনি বলেন, উত্তমরুপে ওযু করে দু’রাকাত নামায পড়ুন এবং এ দো’আ করুন-

“হে আল্লাহ্‌! তোমার কাছে প্রার্থনা করছি ও তোমার দিকে মুতাওয়াজ্জু হচ্ছি রহমতের নবী মুহাম্মদ ﷺ এঁর বদৌলতে বা উসিলায়। ইয়া মুহাম্মাদ ﷺ! আমি আপনার উসিলায় আল্লাহ্‌র দিকে মুতাওয়াজ্জু হলাম তিনি যেন আমার প্রয়োজন পূরণ করে দেন"।

(মুজামুল কাবির লিল তাবরানি, হা/৮৩১১; মুজামুস সাগির হা/৫০৮, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৩৬৬৮)

এছাড়াও আমার নবীর দুনিয়াতে আগমনের পূর্বেও উনার উসিলা দিয়ে দোয়া করা হত। কেনই বা করবে না!! তিনিই যে, আল্লাহর সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, "তাদের নিকট যা (তাওরাত) আছে, আল্লাহর নিকট হতে তার সমর্থক কিতাব (কুরআন) এল; যদিও পূর্বে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তারা এর (ঐ কিতাব সহ নবীর) সাহায্যে (উসিলায়) বিজয় কামনা করত, তবুও তারা যা জ্ঞাত ছিল তা (সেই কিতাব নিয়ে নবী) যখন তাদের নিকট এল, তখন তারা তা অস্বীকার করে বসল। সুতরাং অবিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ হোক।" (সূরা বাকারাহঃ ৮৯)

তাফসীরে জালালাইনে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রয়েছে, "তারা বলতো হে আল্লাহ! আখেরী নবীর (মুহাম্মদ ﷺ) উসিলায় কাফেরদের মোকাবেলায় আমাদেরকে সাহায্য করুন। শুধু তারা নয়, হযরত আদম (আ.)ও আমাদের নবীর উসিলায় দোয়া করেছিলেন।

“হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল ﷺ বলেন, যখন হযরত আদম আলায়হিস সালাম এঁর দ্বারা অপ্রত্যাশিতভাবে কাজটি হয়ে গেল তখন হযরত আদম আলায়হিস সালাম আল্লাহর দরবারে আবেদন করলেন, হে পরওয়ারদিগার, হযরত মুহাম্মদ ﷺ এঁর উসিলায় আমাকে ক্ষমা করুন।

(আল মুস্তাদরাক : ২/৪৮৬ পৃ. হাদিসঃ ৪২২৮, মু'জামুস সগীর : ২১৮২ হাদিসঃ ৯৯২, মাযমাউদ যাওয়াইদ : ৮/২৫৩ : পৃ. এছাড়াও ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতীসহ অসংখ্য ইমামগণ এই হাদিস বর্ণনা করেছেন)

হ্যা, আল্লাহ'র হুকুম অনুসারে আমরা তাঁকেই একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর-ই ইবাদত করি এবং তাঁর কাছে সাহায্যে প্রার্থনা করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আল্লাহ'কে ইবাদতের যোগ্য একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে অন্য কারো কাছে সাহায্যে চাইলেই সে মুশরিক হয়ে যাবে। বরং আল্লাহ'কে একমাত্র ইলাহ (মাবূদ) মেনে, তাঁকে প্রকৃত সাহায্যকারী মেনে, তাঁরই প্রদত্ত ক্ষমতার কারণে (ক্ষমতাপ্রাপ্ত) অন্য কারো কাছ থেকেও সাহায্য প্রার্থনা করা জায়েজ। নবীজি ﷺ এঁর কাছে ইস্তিগাসা পেশ করেছেন মর্মে সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃকও আমলের প্রমাণ রয়েছে কেননা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ক্ষমতা দিয়েছেন, বুখারীতেই বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পৃথিবীর ভান্ডার সমূহের চাবি তুলে দিয়েছেন, বুখারিতেই আছে আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন (প্রকৃত) দাতা (দানকারী) আর তিনি ﷺ হচ্ছেন বন্টনকারী। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে তাদের কামালিয়ত অনুসারে ক্ষমতা দিয়ে থাকেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলছেন, আর আমিতো রাসূল এ কারনেই পাঠিয়েছি, যেন আল্লাহর আদেশে তাঁর আনুগত্য করে, তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করার পর যদি আপনার কাছে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও (তাদের জন্য) ক্ষমা চাইতেন, তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল, দয়ালু পেত।” [সূরা নিসাঃ ৬৪ ]

উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহ:) হযরত আবূ সাদেক (রা:) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইমাম আলী (রাঃ) বলেন, “মহানবী ﷺ-এঁর ওফাতের তিন দিন পর জনৈক আরব এসে তাঁর রওজা মোবারকের ওপর পড়ে যান এবং তা থেকে মাটি নিয়ে মাথায় মাখতে থাকেন। তিনি আরজ করেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আপনি বলেছিলেন আর আমরাও শুনেছিলাম, আপনি আল্লাহর কাছ থেকে জেনেছিলেন আর আমরাও আপনার কাছ থেকে জেনেছিলাম; আপনার কাছে আল্লাহর প্রেরিত দানগুলোর মধ্যে ছিল তাঁর-ই পাক কালাম – আর যদি কখনো তারা (মো’মেনগণ) নিজেদের আত্মার প্রতি জুলুম করে, তখন (হে মাহবুব!) তারা আপনার দরবারে হাজির হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল ﷺও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী, দয়ালু হিসেবে পাবে (আল-কুরআন, ৪:৬৪)। আমি একজন পাপী, আর এক্ষণে আপনার-ই দরবারে আগত, যাতে আপনার সুপারিশ আমি পেতে পারি।’ এই আরজির পরিপ্রেক্ষিতে রওজা মোবারক থেকে জবাব এলো, ‘কোনো সন্দেহ-ই নেই তুমি ক্ষমাপ্রাপ্ত!’

[তাফসীরে কুরতুবী, আল-জামে’ লি আহকাম-ইল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উক্ত আল-কুরআনের ৪:৬৪-এর তাফসীর]

শুধু তাই-ই নয়, তাঁর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম যে, তাঁর দরবারে গিয়ে আরজি জানাতেন, এ প্রসঙ্গে আরো হাদিস বর্ণনা করেন সহিহ বুখারীর প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার ইবনে হাজর আসকালানী রহঃ, বুখারীর ১০১০ হাদিস (যে হাদিসে হযরত উমার রাঃ নবীজির চাচা হযরত আব্বাস রাঃ এঁর উসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন বলে উল্লেখ আছে) এর ব্যাখ্যায়।

মদিনাবাসীগন একবার হযরত উমার (রা.) এঁর খেলাফতকালে অনাবৃষ্টির কারনে দূর্ভিক্ষে পতিত হন। হযরত বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) নামক জনৈক সাহাবী নবী করিম ﷺ-এঁর রওজা মােবারকে গিয়ে আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ﷺ! আপনার উম্মতেরা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। আপনি তাঁদের জন্য বৃষ্টির দোয়া করুন। অতঃপর রাত্রে স্বপ্নে এসে নবী করিম ﷺ বেলাল (রা.) কে বললেনঃ তুমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) এঁ নিকট গিয়ে আমার সালাম জানিয়ে বলো- তাঁরা বৃষ্টি পাবে। স্বপ্ন দেখে বেলাল ইবনে হারেছ (রা.) হযরত ওমর (রা.) কে এ শুভ সংবাদ দিলেন। হযরত ওমর (রা.) এ সংবাদ শুনে কেঁদে ফেললেন। মদিনাবাসীগন রহমতের বৃষ্টি লাভ করলেন।”

(মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহ হা/৩২৬৬৫/৩২০০২, ইমাম বায়হাক্বীঃ দালায়েলুন নবুয়াত, হা/ ৩০৩০/২৯৭৪,ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ১০১০ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)

এছাড়াও নবীজির ব্যবহৃত জিনিসপত্র, রওজা মোবারক উসিলা হিসেবে ব্যবহৃত হত।

আবদুল্লাহ ইবনু মাওহাব (র.) বলেন, আমাকে আমার পরিবারের লোকেরা এক পেয়ালা পানিসহ উম্মু সালামাহ্‌র কাছে পাঠাল। (উম্মু সালামাহ্‌ রা. কাছে রক্ষিত) একটি পানির পাত্র হতে (আনাসের পুত্র) ইসরাঈল তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কিছু পানি তুলে নিল। ঐ পাত্রের মধ্যে নবী ﷺ এঁর কয়েকটি চুল ছিল। কারো চোখ লাগলে কিংবা কোন রোগ দেখা দিলে, উম্মু সালামাহ্‌র নিকট হতে পানি আনার জন্য একটি পাত্র পাঠিয়ে দিত। আমি সে পাত্রের মধ্যে একবার তাকালাম, দেখলাম লাল রং-এর কয়েকটি চুল।
(সহিহ বুখারী ৫৮৯৬)

আসমা (রাঃ) এঁর নিকট রাসুলুল্লাহ ﷺ এঁর ব্যবহৃত জুব্বা ছিল। তিনি বলেন, এটি আয়িশা (রা.) এঁর ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিল। তাঁর ওফাতের পর আমি এটি নিয়েছি। নবী ﷺ এটি পরিধান করতেন। তাই আমরা রোগীদের শেফা হাসিলের জন্য এটি ধৌত করি এবং সে পানি তাদের কে পান করিয়ে থাকি। (সহীহ মুসলিম ৫৩০২)

আবু জাওযাআ আওস ইবনু আব্দুল্লাহ (র.) বলেন, একবার মদীনাবাসী ভীষণ অনাবৃষ্টির কবলে পড়েছিল। লোকজন আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার নিকট অভিযোগ করলে তিনি বলেন, নবী ﷺ এঁর রওজার দিকে দেখ, আর তাতে আসমানের দিকে একটি ফুটো করে দাও, যেন আসমান ও তাঁর মাঝে কোনো আচ্ছাদন না থাকে। তিনি বলেন, তখন তারা তা-ই করলো। ফলে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হল। সেই বৃষ্টিতে এত বেশি ঘাস জন্মেছিল যে, উটগুলো তা খেয়ে বেশ মোটাতাজা হয়ে গিয়েছিল। তাদের পেট চর্বিতে ফুলে গিয়েছিল। ফলে সেই বছরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘উর্বরতার বছর’। (সুনান আদ-দারেমী ৯৩)

এছাড়াও ইউসুফ আঃ এঁর জামা মোবারকও শেফার উসিলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

আল্লাহ তায়ালা বলছেন,

(ইউসুফ আ. বললেন) "তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও এবং এটা আমার পিতার চেহারার উপর রেখো; তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর তোমাদের পরিবারের সবাইকে আমার কাছে নিয়ে এসো।" (অতঃপর) যখন সুসংবাদদাতা (ইয়াকুব আ. এঁর নিকট) এসে হাযির হল, তখন সে জামাটি ইয়াকুব (আঃ) এঁর মুখমন্ডলের উপর রাখল, তাতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। (সূরা ইউসুফ ৯৩, ৯৬)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন,

"ওহে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহকে ভয় কর, উসিলা (তাঁর নৈকট্য লাভের উপায়) অন্বেষণ কর এবং তার পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা মায়িদাহঃ ৩৫)

নবীগণ যে, ওফাতের পরও আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় বিভিন্ন জায়গায় উপস্থিত হতে পারেন এবং সাহায্য করতে পারেন তার অসংখ্য প্রমাণের মধ্যে উপরোল্লিখিত বর্ণনা ছাড়াও আরো উল্লেখযোগ্য হল মেরাজের রাতের ঘটনাগুলো। হযরত মূসা আলায়হিস সালাম কর্তৃক উম্মাতে মুহাম্মদীর কষ্ট দূরীকরণার্থে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজকে পাঁচ ওয়াক্তে নামানোতে সাহায্য করা, আমাদের প্রিয় নবী ﷺ কর্তৃক আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সর্বমহলে সমাদৃত কাসীদায়ে বুরদা শরীফের রচয়িতা ইমাম শরফুদ্দীন বুসরী রহঃ এঁর পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) রোগ হতে মুক্তকরণ এবং চাঁদর উপহার দেয়া। উপমহাদেশের সর্বজনমান্য মুহাদ্দিস হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহ্‌লভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর মত জানিয়ে। তিনি তাঁর রচিত ‘আশি‘আতুল লুমআত’ গ্রন্থে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহঃ এঁর উক্তি নকল করে বলেনঃ

‘‘ইমাম গাজ্জালী রহঃ বলেন, যাঁর কাছ থেকে জীবদ্দশায় সাহায্য চাওয়া যায়, তাঁর ওফাতের পরেও তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে।’’

(আশিয়াতুল লুমআত, যিয়ারত অধ্যায়)

ওফাতের পরও আল্লাহ'র প্রিয় বান্দাগণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় জীবিত।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং আবু বকর রা. এঁর ওফাতের পর, উমর রা. এর ওফাতের আগে, আয়িশাহ্ (রাঃ) সাধারণ কাপড় পরিধান করেই তাঁদের রওজা মোবারকে যেতেন। কারণ- "আয়েশা রা. মনে মনে বলতেন, "তিনি ﷺ তো আমার স্বামী, আর অপরজনও আমার পিতা।

(আয়েশা রা. বলেন) কিন্তু যখন ‘উমার (রাঃ) কে এখানে তাঁদের সাথে দাফন করা হলো, আল্লাহর কসম, তখন থেকে আমি যখনই ঐ ঘরে (রওজায়) প্রবেশ করেছি, ‘উমরের কারণে লজ্জায় শরীরে চাদর (অতিরিক্ত পর্দা সহকারে) পেঁচিয়ে রেখেছি।"

[মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৭৭১, মুসনাদে আহমাদ ২৫৬৬০, মুসতাদরাক লিল হাকিম ৪৪০২]

উক্ত হাদিসে মুবারকা থেকে এটাও প্রমাণ হল যে, সাহাবায়ে কেরাম এমন আকীদা রাখতেন না যে, আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দাগণ মরে পঁচে মাটির সাথে মিশে গেছে, যেমনটা বর্তমান বাতিল ফেরকার অনুসারীরা মনে করে। এরাই আবার অন্যদের বিদআতি বলে ডাকে আর নিজেরাই বিদআতী (নতুন সৃষ্ট) আকীদা পোষণ করে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ লালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। যাদের আকীদা হল আল্লাহর প্রিয় বান্দারা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন ঠিকই কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এঁদেরকে কবরের জীবনেও জীবিত থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যেমনটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা কুরআনুল কারিমে, মর্যাদার দিকে যারা তৃতীয় স্তরের, তাদেরকেও মৃত বলে ধারণা করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।  

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ লিখেন-

-‘‘ইমাম তিব্বী রহঃ বলেন, (এ হাদিস থেকে বুঝা গেল) ওফাত হওয়ার পরে তেমনই তা‘যিম করতে হবে যেমনটি জীবিত অবস্থায় (জাহিরী হায়াতে) করা হত।’’

(মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ৪/১২৬০ পৃ. হা/১৭৭১)

ইমামে আজম আবু হানীফা রহঃ ‘কাসিদায়ে নু’মান’ এ হুযুর (ﷺ) কে উদ্দেশ্য করে লিখেন,

‘ওহে জ্বীন ও মানবজাতির সর্বাধিক সম্মানিত ও দয়াবান সত্ত্বা, ওহে খোদার নেয়ামত সমূহের ভান্ডার, আল্লাহ আপনাকে যে নিয়ামতের বিশাল ভান্ডার দান করেছেন, সেখান থেকে দয়া করে আমাকেও কিছু দিন। আল্লাহ তা’আলা আপনাকে সন্তুষ্ট করেছেন। আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করুন। আপনার দান ও করুণার প্রত্যাশী হয়েছি। এ আবূ হানীফার জন্য সৃষ্টি জগতে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।  (ইমাম আবু হানিফাঃ কাসীদায়ে নুমানঃ পৃ.২২)
 
Top