প্রিয় নবী ﷺ মদিনায় এসে দেখতে পেলেন ইয়াহূদীরা ‘আশুরা দিবসে রোজা পালন করে। তাদেরকে রোজা পালনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এদিনই আল্লাহ্ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও বনী ইসরাঈলকে ফিরাউনের উপর বিজয় দিয়েছিলেন। তাই আমরা ঐ দিনের সম্মানে রোজা পালন করি। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আঃ)-এঁর বেশি নিকটবর্তী/ হকদার। এরপর তিনি রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী ৩৯৪৩)

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তারা বলল, এটি (আশুরা) একটি মহান দিবস। এ এমন দিন যে দিনে আল্লাহ্ মূসা (আঃ)-কে নাজাত দিয়েছেন এবং ফির‘আউনের সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর মূসা (আঃ) শুকরিয়া হিসেবে এদিন রোজা পালন করেছেন। তখন নবী ﷺ বললেন, তাদের তুলনায় আমি হলাম মূসা (আঃ)-এঁর অধিক নিকটবর্তী। কাজেই তিনি নিজেও এদিন রোজা পালন করেছেন এবং এদিন রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী ৩৩৯৭)

প্রিয় নবী ﷺ এঁর এই দুনিয়ায় আগমনের দিন, প্রিয় নবী ﷺ কে অন্যতম একটা মু'জিযা "মিরাজ" দান করার দিন এগুলো আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানের দিন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এসব গুরুত্বপূর্ণ রাত বা দিনগুলো অত্যন্ত গুরুগাম্ভীর্যের সাথে স্মরণ করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন, "আর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করবে সে তো তার অন্তরস্থিত আল্লাহ-ভীতি থেকেই তা করবে।" (সূরা হজ্জ্ব, আয়াত ৩২)

সবসময় অতিরিক্ত নফল ইবাদতে মগ্ন না থাকতে পারলেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এমনসব দিনগুলোকে উপলক্ষ করে বেশি বেশি করে আল্লাহ'র নফল ইবাদত আদায় করার চেষ্টা করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, খুশির দিনগুলোতে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী আনন্দ প্রকাশ করে। এমনকি অনেক বেনামাজীও মসজিদের দিকে অগ্রসর হয়। আল্লাহর ভয়, নবীজির প্রেম একটুখানি হলেও জাগ্রত হয়, যার ফলস্বরূপ হয়ত অনেকের তাওবা করার সুযোগও নসিব হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

"সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহগুলোকে স্মরণ করো এবং পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদকারী হয়ে বিচরণ করো না।" (সূরা আ‘রাফঃ ৭৪)

"তাদেরকে আল্লাহর দিবসসমূহ (অনুগ্রহ কিংবা অনুগ্রহের দিনগুলো) স্মরণ করিয়ে দিন। এতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক পরম ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।" (সূরা ইব্রাহিমঃ ৫)

“(হে রাসূল!) আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ (ফদ্বল) ও তাঁরই দয়া (রহমত) এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। এটা তারা যা সঞ্চয় করছে তা হতে অধিক উত্তম।’ (সূরা ইউনুস ৫৮)

এছাড়াও প্রিয় নবীজি ﷺ সোমবারে এই দুনিয়ায় শুভাগমন করেছেন এবং সোমবারেই কুরআন নাজিল হয়েছে বিধায় এই দিনে তিনি রোজা রাখতেন বলেও জানান (সহীহ মুসলিম ২৬৪০, ২৬৩৭)। "মিরাজ" এটা এমন একটা মু'জিযা যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা শুধুমাত্র আমাদের নবীকেই দান করেছেন। এমন নবীর উম্মত হিসেবে এটা আমাদের জন্যও অনেক আনন্দের, সম্মানের বিষয়। আবার এই রাতেই আমাদেরকে নামাজ উপহার দেয়া হয়, শুধু তা-ই নয়, আমাদের কষ্ট কমানোর জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজকে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয় কিন্তু সাওয়াবের পরিমাণ কমানো হয়নি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাই এই মিরাজুন্নবী ﷺ এর রাত ও দিনকে আল্লাহ'র ইবাদতে কাটিয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায়ের চেষ্টা করে, নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে।

সাহাবায়ে কেরামগণও শুকরিয়া আদায়ের মজলিস সাজাতেন, একেকজন একেকভাবে আনন্দ, ভালবাসা, সম্মান প্রকাশ করতেন। সাহাবায়ে কেরাম শুধুমাত্র ভালবাসার কারণেই এমন আমলও করতেন যার হুকুম রাসূলুল্লাহ ﷺ দেননি কিন্তু যা শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, মুআবিয়া (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বের হয়ে তাঁর সাহাবীদের এক মজলিসে পৌঁছলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমাদের এখানে কিসে বসিয়েছে? তারা বললেনঃ আমরা আল্লাহ্‌র স্মরণে এবং তিনি যে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন এবং আপনাকে প্রেরণ করে আল্লাহ তা'আলা আমাদের উপর যে ইহসান (অনুগ্রহ) করেছেন তার শোকর আদায় করার জন্য বসেছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ সত্যিই কি তোমরা এজন্য এখানে বসছো? তাঁরা বললেনঃ আল্লাহ্‌র কসম! আমরা এজন্যই এখানে সমবেত হয়েছি। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করে তোমাদের থেকে শপথ নেইনি বরং এজন্য যে, জিব্‌রাঈল (আ) এসে আমাকে সংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ্‌ তা'আলা তোমাদের ব্যাপারে ফিরিশতাদের সামনে গৌরব (গর্ব) করেছেন। (সুনানে আন-নাসায়ী ৫৪২৬, কিছুটা পরিবর্তিত শব্দে সহিহ মুসলিম শরীফে হা/ ৬৭৫০)

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মদীনায় আসলেন তখন আবিসিনিয়রা (হাবশীরা) তাঁর আগমনের খুশিতে বল্লম (বর্শা) নিয়ে খেলায় মেতে উঠে। (সুনান আবূ দাউদ ৪৯২৩)

বারা‘ ইবনে আযিব (রাঃ) বলেন, নবী ﷺ এঁর আগমনে মদিনাবাসী যতখানি আনন্দিত হয়েছিল ততখানি আনন্দিত হতে কখনো দেখিনি। এমনকি দাসীগণও বলছিল, নবী ﷺ শুভাগমন করেছেন। (সহীহ বুখারী ৩৯২৫)

হযরত আবূ বকর (রা.) বলেন, রাতে তাঁরা (যখন) মদীনায় পৌঁছেন, (তখন) রাসূলুল্লাহ ﷺ কার গৃহে অবস্থান করবেন, এ নিয়ে লোকদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা শুরু হলো। তখন তিনি ﷺ বললেন, আমি আব্দুল মুত্তালিবের মামার বংশ বনু নাজ্জারে অবস্থান করব এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করব। অতঃপর পুরুষ লোকেরা ও মহিলাগণ নিজ নিজ গৃহের ছাঁদে এবং বালক ও ক্রীতদাসগণ পথে পথে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সকলে অভ্যর্থনা জানিয়ে উচ্চঃস্বরে ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ এঁর স্লোগান দিতে লাগল।
(সহীহ মুসলিম ৭৪১২)

উরওয়াহ ইবনে মাসউদ (যিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন) কুরাইশদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-

"হে আমার কওম, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা-বাদশাহর দরবারে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার, কিসরা ও নাজাশী সম্রাটের দরবারে দূত হিসেবে গিয়েছি; কিন্তু আল্লাহর কসম করে বলতে পারি যে, কোন রাজা বাদশাহকেই তার অনুসারীদের মত এত সম্মান করতে দেখিনি, যেমন মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাঁকে করে থাকে।

আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ ﷺ যদি থুথু ফেলেন, তখন তা কোন সাহাবীর হাতে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন; তিনি ওযু করলে তাঁর ওযুর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়; তিনি কথা বললে, সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে শুনেন। এমনকি তাঁর সম্মানার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না। (সহিহ বুখারী ২৭৩২)

আবদুর রহমান ইবনু আবূ কুরাদ (রাঃ) বলেন, একদিন নবী ﷺ উযূ করলেন। সাহাবায়ে কিরাম তাঁর উযূর পানি স্বীয় শরীরে মর্দন করতে লাগলেন। নবী ﷺ তাঁদেরকে বললেনঃ কিসে তোমাদেরকে এ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করল? সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ এঁর ভালবাসা। তখন নবী ﷺ বললেনঃ যার আন্তরিক বাসনা যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসবে অথবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ তাঁকে ভালোবাসবেন, সে যেন যখন কথা বলে সত্য বলে, যখন তার কাছে গচ্ছিত রাখা হয় সে তা যথারীতি ফেরত দেয় এবং যার প্রতিবেশী আছে, সে প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশীসুলভ উত্তম আচরণ করে। [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), অধ্যায়ঃ শিষ্টাচার (كتاب الآداب), হাদিস নম্বরঃ ৪৯৯০, শু‘আবুল ঈমান লিল বায়হাক্বী ১৫৩৩]




আমার আল্লাহ তায়ালা বলেন,

"অতএব তাদের ভয় করো না, বরং ভয় করো আমাকে। আর যাতে আমি তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করতে পারি, আর যাতে তোমরা সুপথগামী হতে পারো। যেমন (তোমরা আমার একটি অনুগ্রহ লাভ করেছ যে) আমি তোমাদেরই মধ্য হতে তোমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াতগুলো তোমাদেরকে পড়ে শুনায়, তোমাদেরকে শুদ্ধ করে, তোমাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না। অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সূরা বাক্বারাহঃ ১৫০ নং আয়াতের শেষ অংশ, ১৫১, ১৫২)

"স্মরণ কর, যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য (আমার নি‘য়ামাত) বৃদ্ধি করে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও (তবে জেনে রেখ, অকৃতজ্ঞদের জন্য) আমার শাস্তি অবশ্যই কঠিন।
(সূরা ইব্রাহিমঃ ৭)

"আর আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা তোমাদের উপর রয়েছে এবং তাও স্মরণ কর, যে কিতাব ও জ্ঞানের কথা তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে যার দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দান করা হয়। আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ সর্ববিষয়েই জ্ঞানময়। (সূরা বাকারাহঃ ২৩১)

"যারা ইমান আনে ও নেক আমল করে আমি কি তাদেরকে যমীনে বিপর্যয় (ফ্যাসাদ) সৃষ্টিকারীদের সমতুল্য গণ্য করব? নাকি আমি মুত্তাকীদেরকে পাপাচারীদের সমতুল্য গণ্য করব?" (সূরা ছোয়াদ ৩৮ঃ ২৮)

আমার আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাছে মুনাফিকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেনঃ

"যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে। " (সূরা তাওবাহ ৪৭)

"আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা যমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না’, তারা বলে, 'আমরা তো কেবল সংশোধনকারী।" (সূরা বাকারাহ ১১)

"এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।" (সূরা মুনাফিকুন ১)

"সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু এরা তা অনুভব করতে পারে না।"(সূরা বাকারাহ ১২)

"আল্লাহ ও ঈমানদারদের তারা ধোঁকা দিতে চায়,আসলে তারা অন্য কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না বরং নিজেদেরই প্রতারিত করছে,অথচ তাদের সে অনুভূতি নেই।" (সূরা বাকারাহ ৯)

"তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আর এ উপায়ে তারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করে তা কতই না মন্দ! তা এ জন্য যে, তারা ইমান এনেছিল তারপর কুফরী করেছিল। ফলে তাদের অন্তরসমূহে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বুঝতে পারছে না।" (সূরা মুনাফিকুন ২, ৩)

"ওহে যারা ঈমান এনেছ! ভালো বিষয়গুলো যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য বৈধ করেছেন সেসব তোমরা নিষিদ্ধ করো না, আবার বাড়াবাড়িও (সীমালঙ্ঘন) করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ভালোবাসেন না সীমালঙ্ঘন কারীদের।" (সূরা আল মায়িদাহঃ ৮৭)

"মুনাফেক পুরুষ ও মুনাফেক নারী একে অপরের অনুরূপ, তারা অসৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং সৎকাজে নিষেধ করে।" (সূরা আত-তাওবাহ ৬৭)

আনন্দ প্রকাশ করা, শুকরিয়া আদায় করা এগুলো সরাসরি আল্লাহর হুকুম। যেকোন সময় যেকোনভাবে যেকোন দিনে কিংবা প্রতিদিনই এগুলো করতে পারবেন। এগুলোর মধ্যে শরীয়তের সাথে সংঘর্ষমূলক এমন কিছু না জড়ালেই হল।
 
Top