ইয়াজিদী সৈন্যদের ভয়ংকর পরিণতি – শেষ পর্ব

⭕   অজগর ও ইয়াজিদী সৈন্য
ইবনে যিয়াদ এবং তার সেনাপতিদের মাথা মুখতার সাকাফীর সামনে এনে যখন রাখা হল, তখন হঠাৎ এক বিশাল অজগর দেখা গেল;  এমতাবস্থায় অজগরটি সব মাথা ছেড়ে ইবনে যিয়াদের মাথায় তার নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করলো।  কিছুক্ষণ পরই অজগরটি মুখ দিয়ে বাহিরে এল। অতঃপর আবার নাক দিয়ে ঢুকলো, আবার মুখ দিয়ে বের হল।  অর্থাৎ এমন করে তিন বার ভিতর ঢুকল আর বাহিরে আসল। এক পর্যায়ে অজগরটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঐতিহাসিক লিখেন যে, মুখতার সাকাফীর সাথে যুদ্ধে সত্তর হাজার(৭০,০০০) শামবাসী মারা যায়(যারা সবাই ইমাম পাকের শাহাদাতের সাথে জড়িত ছিল)। আর এমনিভাবে হাদীস শরীফে বর্ণিত আল্লাহ তা’আলার ওয়াদাও পূর্ণ হল যে, হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র রক্তের বদলায় সত্তর হাজার পাপীষ্ঠ মারা যাবে।
إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তিমান।
টীকা
জান্নাতের সর্দার, সাইয়্যেদুশ শোহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাত  এমন এক চরম হৃদয় বিদারক ঘটনা যে, আজ পর্যন্ত কারবালার যমীনে প্রবাহিত হওয়া তাঁদের এক এক ফোটা রক্তের বিনিময়ে পৃথিবী অশ্রু সাগরে পরিণত হয়েছে। সংক্ষেপে এতটুকু বলা যায় যে, পৃথিবীর কোন মর্মান্তিক ঘটনার বেলায় এতটুকু অশ্রু ঝরেনি, যতটুকু কিনা কারবালার ব্যাপারে ঝরেছে।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যেহেতু এই ফিত্‌নার বিষয়ে অবগত হয়েছিলেন। এজন্যই তিনি শেষ বয়সে এই দু’আ করতেন,
“হে আল্লাহ ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, ষাটতম হিজরী এবং নবীনদের নেতৃত্ব থেকে”
ষাট হিজরীতেই ইয়াজিদের মত কনিষ্ঠ ব্যক্তি খিলাফতের দায়িত্ব নেয় এবং এই ফিত্‌নারও সূত্রপাত হয়।
টীকা
সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা বাতিলের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন এবং হক্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই ছিল। কিন্তু পাপীষ্ঠ খারেজী সম্প্রদায়রা বলে যে, (নাউযু বিল্লাহ) ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইয়াজিদের বিপক্ষে অন্যায়ভাবে দাঁড়িয়েছে,এ জন্যই সে নির্মমভাবে মারা গিয়েছে। (আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অভিশম্পাত ইমাম হুসাইনের এই দুশমনদের উপর -অনুবাদক)
সুতরাং খারেজীদের সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করব।
    হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র দুশমন অন্ধ হয়ে গেলো
মুহাম্মদ বিন ছলাত আব্দী এবং র’বী বিন মুনযির তোরী যারা তাদের পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি এসে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতের সুসংবাদ দেয়(অর্থাৎ সে ইমাম হুসাইনের শাহাদাতে খুশি ছিল-অনুবাদক) এবং সে তখনই অন্ধ হয়ে যায়। যাকে পরে অন্য এক লোক এসে ধরে নিয়ে যায়।
    পৃথিবীতে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র দুশমনের শাস্তি
ইবনে আইনিয়্যাহ বর্ণনা করেন যে, আমাকে আমার দাদী বলছেন, জুফাইন গোত্রের দু’ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতে শরীক ছিল, যাদের মধ্যে থেকে একজনের লজ্জাস্থান এতটাই দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল যে, সে বাধ্য হয়েই সেটাকে ভাঁজ করে চলাফেরা করতো। এবং অপরজনের এত চরম পিপাসা সৃষ্টি হয়ে গেল যে, সে পানি ভর্তি মশক’কে(বড় পাত্র) মুখের সাথে লাগাতো এবং পাত্রের শেষ বিন্দুটা পর্যন্ত চুষে খেতো।
    হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র দুশমন জ্বলন্ত আগুনে পুরে মারা গেলো
সুদ্দী এক ঘটনার বর্ণনা করেন যে- আমি এক জায়গায় মেহমান হিসেবে গেলাম, যেখানে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতের আলোচনা চলছিল। আমি বললাম, হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতে যারা জড়িত ছিল, তারা ন্যাক্কারজনকভাবে মারা গিয়েছে। একথা শুনে এক ব্যক্তি বলল, হে ইরাকিরা ! তোমরা কতইনা মিথ্যাবাদী। দেখো ! আমি হুসাইনের হত্যায় জড়িত ছিলাম, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি এহেন মৃত্যূ থেকে নিরাপদ আছি। এ কথা শেষে সে তখন জ্বলন্ত একটি চেরাগে তেল ভরে বাতিকে নিজের আঙ্গুল দ্বারা কিছুটা বাড়িয়ে দিতেই পুরো বাতিতে আগুন লেগে যায়, ঐ আগুন সে তার থু থু দ্বারা নিভাতে ছিল, ঠিক তখনই তার দাঁড়িতে আগুন ধরে যায়। সে সেখান থেকে দৌঁড়িয়ে পানিতে ঝাপ দেয়, যাতে আগুন নিভে যায়। কিন্তু পরিশেষে যখন তাকে দেখা গেল, ততক্ষনে সে জ্বলে কয়ালায় পরিণত হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতেই দেখিয়ে দিলেন যে, “তোর দুস্কৃতির এটাই পরিণতি।”
    ইবনে যিয়াদের উপর অজগরের আক্রমন
আম্মার বিন উমায়ের রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, যখন উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ এবং তার সাথীদের মাথা নিয়ে মসজিদের বরাবর বাহিরে রাখা হয়েছিল, তখন আমি ঐ লোকদের নিকট পৌঁছলাম, যখন কিনা তারা বলছিল- “ঐ এসেছে-ঐ এসেছে”। এমনই মুহুর্তে একটি সাপ এসে ঐসকল মাথার মধ্যে ঢুকতে শুরু করলো। অতঃপর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ এর নাকের ছিদ্রে ঢুকলো ও তাতে কিছুক্ষন থাকার পর বাহিরে চলো এলো। সাপটি কোথায় থেকে আসলো আবার কোথায় চলে গেল। এই ঘটনাটিকে ইমাম তিরিমিযী বর্ণনা করেন এবং তার সনদকে সহীহ হাসান বলেছেন।
    আগুলের স্ফুলিঙ্গ লাগাতে অন্ধ হয়ে গেলোঃ
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’কে ফাসিক ইবনে ফাসিক (ফাসিকের ছেলে ফাসিক) বলে গালি দেয়। আল্লাহ তা’আলা তখনই তার উপর দুইটি ছোট তারকার স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করে তাকে অন্ধ করে দেন। [সাওয়াইকে মুহাররিকাহ,পৃষ্ঠা ১৯৪]
    ইয়াজিদের চেলা মুসলিম বিন উকবার পরিণতি
মুসলিম বিন উকবা মদীনা শরীফে গিয়ে লোকদেরকে ইয়াজিদের বায়’আত হওয়ার আহবান জানাতেই কিছু লোক জান-মালের ভয়ে ইয়াজিদের বায়’আত হলো। তাদের মধ্যে কুরাইশ গোত্রের একজন ব্যক্তিও ছিল। বায়’আতের সময় সে বলল যে, আমি বায়’আত হলাম ইয়াজিদের আনুগত্যের উপর, তার গুনাহের (সাথে একাত্মতার) উপর নয়। একথা শোনা মাত্রই মুসলিম বিন উকবা তাকে হত্যা করলো। এমতাবস্থায় সে ব্যক্তির মা ছেলে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নিয়ে বলল যে, যদি মুসলিম বিন উকবা মরেও যায়. তাহলেও আমি কবর খনন করে তার লাশ জ্বালিয়ে দেব। মুসলিম বিন উকবা যখন মারা গেল, তখন ঐ মা তার দাসকে বলে তার কবর খনন করলো। খননের এক পর্যায়ে যখন লাশের নিকট পৌঁছলো তখন দেখলো যে, তার ঘাড়ে অজগর সাপ পেঁচিয়ে আছে এবং তার নাক দিয়ে ঢুকে তাকে দংশন করছে। [ইবনে আসাকির,তইয়ুল ফারাসিখ]
    হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর দুশমন
আবু নঈম এবং ইবনে আসাকির আ’মাশ হতে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মাজার শরীফে পায়খানা করে দিল (নাউজুবিল্লাহ)। সে সঙ্গে সঙ্গে পাগল হয়ে গেল এবং কুকুরের ন্যায় ঘেউ ঘেউ শব্দ করতে লাগলো। যখন সে মারা গেল, তখন তার কবর হতেও কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ আসতে লাগলো। [তাবাক্বাতে মানাদী আজ জামালে আউলিয়া,পৃষ্ঠা-৩৪]
টীকা
প্রকৃতার্থে আহলে বাইত রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম’দের দুশমন কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট। অর্থাৎ পৃথিবীর কুকুর তো তার জীবনে ঘেউ ঘেউ করেই; আর আহলে বাইতের দুশমন মানুষ হয়ে জন্ম নিলেও কুকুর হয়ে মরে এবং মরার পরও ঘেউ ঘেউ করে। বুঝা গেল যে,আল্লাহ ওয়ালাদের ব্যক্তিত্বই সম্মানের পাত্র।এভাবে তাঁদের মাজার শরীফও সম্মানের স্থান।
    ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র উট
হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান জামী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি তাঁর কিতাব “শাওয়াহেদুন নবুওয়াতে” উল্লেখ করেন যে, সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র (কাফেলা হতে) বেচে যাওয়া কিছু উট ছিল। সেগুলোকে জালিমরা যবেহ করে কাবাব বানালো। ঐ গোশতের স্বাদ এতই তিক্ত ছিল যে, সেখান থেকে ভক্ষন করার সাহস কারোরই হল না।
টীকাঃ
এই শাস্তি ফেরাউনীদের ঐ শাস্তির সদৃশ, যেখানে পানি বনী ইসরাঈলীদের জন্য তার মৌলক অবস্থায় ছিল। অন্যদিকে ফেরাউনীদের জন্য রক্তে পরিণত হয়েছিল। এমনকি যে, যেই পাত্র দ্বারা বনী ইসরাঈলগণ পানি নিত তা পানিই থাকতো। কিন্তু ঐ পাত্র দ্বারা যখন ফিরাউনীরা পানি নিত তখন তা রক্তে রুপান্তরিত হত। তাদের খাদ্য দ্রব্যে উকুনে ছেঁয়ে গেলো। এমনকি যে, বনী ইসরাঈল হতে তারা খাদ্য নিলে সেটাও উকুনে ছেঁয়ে যেত।
   ✴  ইয়াজিদের উপর খোদায়ী গযব
ইয়াজিদের মৃত্যূর পর তার কবরে পাথর নিক্ষেপ করা হত। পরবর্তীতে লোকেরা এটার উপর দালান-কোঠা তৈরী করে ফেলে। এক পর্যায়ে ইয়াজিদের কবরের উপর লোহা,কাঁচ গলানোর বিশাল চুলা স্থাপিত করা হয়। যেমনটা মনে হচ্ছে যে, ইয়াজিদের কবরে প্রত্যহ আগুন প্রজ্জলিত হচ্ছে। এমনকি এক পর্যায়ে তার কবরের নাম নিশানাই আর থাকল না।
  ✴  ইয়াজিদের ধংস
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতের পর এক দিনও শান্তিতে কাটেনি ইয়াজিদের। সমগ্র মুসলিম জাহানে শহীদদের রক্তের ডাক এবং ক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ইয়াজিদের জিন্দেগী এর পর দুই বছর আট মাস এর বেশী দীর্ঘ হয়নি। দুনিয়াতেও আল্লাহ তা’আলা তাকে অপদস্থ করেছেন এবং সে অপদস্থতার সাথেই ধংস হয়ে যায়।
    তীর নিক্ষেপকারী পিপাসার্ত অবস্থায় ছটফট করে মারা গেলো
যে ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে তীর নিক্ষেপ করেছিল এবং পানি পান করতে দেয়নি। তার মধ্যে আল্লাহ তা’আলা এমন পিপাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যে, কোনভাবেই তা নিবারণ হত না।পানি যতই পান করুক না কেন, পিপাসায় সর্বদা কাতরাতো। এক পর্যায়ে সে পেট ফেটে মারা গেল।
✴   অবিশ্বাস্য সময়
এটা আমাদের দূর্ভাগ্য মনে করা হোক বা অবিশ্বাস্য সময় বলে মনে করা হোক, আমাদের যুগে এসে এমন পাপীষ্ঠও সৃষ্টি হয়েছে; যে কিনা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদতকে বিদ্রোহ জনিত মৃত্যূ বলে আখ্যা দেয়। বদমাশ,নাফরমান,খবীস ইয়াজিদকে আমীরুল মু’মিনীন ইত্যাদি বলে। এমতাবস্থায় খলিফায়ে রাশিদ সাইয়্যেদুনা উমর বিন আব্দুল আযীয রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ঐ ব্যক্তিকে বিশটি বেত্রাঘাতের হুকুম দিতেন, যে কিনা ইয়াজিদকে আমীরুল মু’মিনীন বলতো।
হায় ! আজ যদি সাইয়্যেদুনা উমর বিন আব্দুল আযীয রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু জীবদ্দশায় থাকতেন, তাহলে আমরা তাঁর নিকট আবেদন করতাম যে, “বাংলাদেশে এক জন নয় এরকম লাখো আছে,আর তারা কোন সাধারণ ব্যক্তি নয় বরং ধার্মিক। এমনকি ধর্মের কর্ণধার। হে উমর বিন আব্দুল আযীয ! একটু অনুগ্রহ করে তাদেরকেও শিক্ষা দিন। কিন্তু আফসোস যে, তিনি আমাদের সময়ের আগেই দুনিয়া হতে পর্দা করেছেন। ইনশা’আল্লাহ আমরা কিয়ামতের দিন ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র পতাকা তলে থাকবো এবং তারা ইয়াজিদের ধুঁতির মধ্যে থাকবে।
    একটি সংশয়ের নিরসনঃ
ইয়াজিদ পন্থীরা বলে থাকে যে, ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে হত্যার আদেশ দেয়নি এবং না সে এই কাজে সন্তুষ্ট ছিল। (যারা এমনটা বলে) তারাও ভ্রান্ত।
“এবং কতেক বলে থাকে যে, ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হত্যা ছিল কবীরা গুনাহ, কুফরী নয়; এবং লা’নত যে  কাফিরের জন্য নির্ধারিত,এটাও ভূল।”
তোমরা কি জান না যে, দো’জাহানের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’কে কষ্ট দেওয়াটাও যে অন্যতম কুফরী।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُهِينًا
অর্থাৎ নিশ্চয় যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের উপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর অভিশম্পাত। এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে অপমানজনক শাস্তি।
আপত্তিঃ কিছু লোক বলে থাকে যে, ইয়াজিদের শেষ অবস্থাটা জানা যায়নি। হয়ত সে কুফর ও গুনাহের পর তাওবা করে থাকতেও পারে। তাওবাকারী হয়ে সে মৃত্যূ বরণ করেছে। ইমাম গাজ্জালী তারঁ “এহয়াউল উলুম” এর মধ্যে এ দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
জবাবঃ  তাওবার সম্ভাবনা সম্ভাবনাই । আহ ! এই অভাগা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত যারা এমন কিছু করেছে, যা অন্য কেউই করেনি। ইমাম হুসাইন এবং আহলে বাইতকে শহীদের পর সে মদিনা মুনাওয়ারাকে অপবিত্র করতে এবং মদীনাবাসীকে হত্যা এবং শহীদ করার জন্যে সেখানে সৈন্য প্রেরণ করে। তিন দিন পর্যন্ত মসজিদে নববী আযান ও নামাযহীন থাকে। তারপরে কাবা শরীফে আক্রমণ করা এবং স্বয়ং কাবার অভ্যন্তরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে শহীদ করা এবং তাঁদের দুর্নাম বর্ণনা করা; সবই তার কাজ ছিল। [আল্লাহই ভালো জানেন]
আপত্তিঃ বুখারী শরীফ প্রথম খন্ডে কিতাবুল জিহাদে হযরত উম্মে হেরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বর্ণনা করেন যে,আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হতে শুনেছি। তিনি ইরশাদ করেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে থেকে প্রথম সৈন্যবাহিনী যারা কিনা রোম সম্রাটের এর শহর কুস্তন্তুনিয়ায় জিহাদ করবে, তাদেরকে ক্ষমা করা হবে। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আমিও কি সেখানে যাব ? হুজুর বললেন ‘না’।
এই জিহাদ ৫০ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে সেনাপতি ছিল ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া। এবং এই যুদ্ধে অনেক সাহাবায়ে কিরামও অংশ নিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এবং আবু আইয়ুব আনসারী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম। এই মুজাহিদদেরকে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ক্ষমাকৃত বলে ঘোষণা করেছেন। এজন্যই ইয়াজিদের খিলাফত সঠিক ছিল এবং সে জান্নাতী।
এটা ছিল ইয়াজিদ পন্থী খারেজীদের সবচেয়ে বড় দলীল, যা কিনা তাদের পক্ষ হতে বলা হয়ে থাকে। এবং এই হাদীস দ্বারা অনেকে কারণ বের করেছে যে, ইয়াজিদের খিলাফত সহীহ ছিল এবং সে জান্নাতী।
জবাবঃ এই হাদীস দ্বারা এটা কিভাবে হৃদয়াঙ্গম হলো যে, ইয়াজিদের খিলাফত সঠিক ! কেননা যখন ইয়াজিদ কুসতুন্তুনিয়াতে আক্রমন করতে গিয়েছিল সে সময়ে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু জীবিত ছিলেন। তখন তাঁর খিলাফতকাল ছিল। তাঁর আমরণ খিলাফত ওলামায়ে কিরামের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সহিহ ছিল। কারণ ইমামে বরহক্ব হযরত ইমাম হাসান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইসলামী সম্রাজ্যের খিলাফত হযরতে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র নিকট অর্পণ করেছিলেন। এখন যোদ্ধাদের ক্ষমাকৃত হওয়ার দ্বারা এটা আবশ্যক হয় না যে, তার প্রত্যেককে মাফ করা হবে এবং সে বেহেশতী হবে। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার সাথে স্বয়ং এক ব্যক্তি বীরত্বের সাথে লড়াই করছিল।  হুজুর ইরশাদ করেন, সে দোযখী।  বেহেশতী আর দোযখী হওয়াটা সর্বশেষ অবস্থার উপর নির্ভর করে।  ইয়াজিদ প্রথমে অনেক ভাল কাজ করেছে যে, কুসতুনতুনিয়ায় আক্রমন করা। কিন্তু খলীফা হওয়ার পর সে এমন হীন কর্মের দ্বারা নিজ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে যে, নাউজুবিল্লাহ ! ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে হত্যা এবং আহলে বাইতকে অপমান করিয়েছে।  যখন ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র মাথা মুবারক আনা হল, তখন অভিশপ্ত ইয়াজিদ বলতে লাগল, “আমি বদরের প্রতিশোধ নিলাম”।
মদীনা মুনাওয়ারায় সে হামলা চালালো, হেরেমের পবিত্র স্থানে ঘোড়া বাধলো, মসজিদে নববী এবং রওযা শরীফকে অপমান করলো। এসকল গুনাহের পরও কি ইয়াজিদকে ক্ষমাকৃত এবং জান্নাতী বলা যেতে পারে !!
সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম কুস্তোলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, এ কথা তো সবারই জানা যে, ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হত্যায় এবং আহলে বাইতের অপমানে খুশি ও রাজী ছিল। এজন্যই আমরা তার বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করি না। বরং তার ঈমানের ব্যাপারেই আমাদের আপত্তি। আল্লাহর অভিশম্পাত ইয়াজিদ ও তার সহযোগীদের উপর।
    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের ফয়সালা
সকল মুফাসসীরিন, মুহাদ্দীসীন, আইম্মায়ে কিরাম, ওলামায়ে রাব্বানী এবং আল্লাহর ওলীগণ এই কথার উপর ঐক্যমত যে, হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হক্বের উপর ছিলেন। অপরদিকে ইয়াজিদ ফাসিক ও ফাজির ছিল। হুজুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে,আমার উম্মতের ঐক্যমত কখনোই গোমরাহীর উপর হতে পারে না।
ইমামে রাব্বানী হযরত মুজাদ্দীদ আলফে সানী সহ অন্যান্য আওলিয়ায়ে কিরাম এবং ওলামায়ে ইসলামগণ বলেন, ইয়াজিদ পাপীষ্ঠ ও ফাসিকদের দলের অন্তর্ভূক্ত। তার পাপীষ্ঠতার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নাই। যে হীন কর্ম এই দূর্ভাগা করেছে, কোন কাফির ফিরিঙ্গিও তা করতো না। [মাকতুবাত শরীফ-৫৪,২৫১]
[মুফতীয়ে আযম শায়খ আল্লামা ফয়য আহমদ ওয়াইসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র লিখিত ”ইয়াজিদ গাজীয়ো কে আঞ্জামে বদ্‌” কিতাব হতে লেখাটি অনূদিত]
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ মহিউদ্দীন।
==> আলহামদুলিল্লাহ ! সমাপ্ত <==
 
Top