ইলমে গায়েব


রসুলেপাক (ﷺ) এর উজ্জ্বলতর মোজেজাসমূহের মধ্যে গায়েবী বিষয়ে অবহিত হওয়া, ভবিষ্যতের এবং অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রদান অন্যতম। সত্তাগতভাবে এলমে গায়েব অবশ্য আল্লাহ্তায়ালার জন্যই নির্দিষ্ট। তিনিই একমাত্র আল্লামূল গুয়ুব। রসুলে করীম (ﷺ) এর পবিত্র রসনা থেকে এবং তাঁর কোনো কোনো প্রকৃত অনুসারীগণের কাছ থেকে যে এলেমসমূহ প্রকাশ পেয়েছে, চাই তা ওহীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকুক অথবা এলহামের মাধ্যমে, সে সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ্র কসম! আমি নিজে থেকে কিছু জানি না, তবে আমার প্রতিপালক আমাকে জানিয়ে দেন।


আল্লামা কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) এর গায়েবী এলেম যাতী হিসেবে অর্থাৎ নিজস্ব হিসেবে ছিলো না। একথা নিঃসন্দেহে বলতেই হয়, নবী করীম (ﷺ) এর গায়েবী এলেম আল্লাহ্তায়ালার দান। তাঁর গায়েবী এলেমের বিষয়টি সর্বজনবিদিত।


নবী করীম (ﷺ) এর গায়েবী সংবাদ ছিলো দুই ধরনের। এক প্রকারের এলেম হচ্ছে কোরআন মজীদ। এই কোরআন মজীদ অতীত ও ভবিষ্যতের সংবাদসমূহ সরবরাহ করেছে। অতীত ও বর্তমান উম্মতসমূহের অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। সৃষ্টির উৎপত্তি ও চূড়ান্ত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছে।


দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, এমন বিষয়ের এলেম যা ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে। তার আলোচনা হাদীছ শরীফে এসেছে। কোরআন মজীদে ভবিষ্যত সম্পর্কে যে গায়েবী এলেম নবী করীম (ﷺ) কে প্রদান করা হয়েছে, তন্মধ্যে রয়েছে ‘আমি যা আমার রসুলের প্রতি নাযিল করেছি সে সম্পর্কে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে এর সুরাগুলোর মতো একটি সুরা তৈরী করে নিয়ে এসো।’ এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে ‘তোমরা কক্ষনো পারবে না।’ এই ভবিষ্যদ্বাণী কাফেরদের বেলায় প্রতিফলিত হয়েছিলো।


গায়েবী খবর প্রসঙ্গে বদরের ঘটনা সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘যখন আল্লাহ্তায়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দু’টি দলের মধ্যে একটি তোমাদের হস্তগত হয়ে যাবে। আর তোমরা চাচ্ছিলে ওই দলটি তোমাদের হস্তগত হোক, যাতে বাধাবিপত্তি নেই।’ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রাক্কালে কুরাইশদের দু’টি কাফেলা ছিলো। একটি ছিলো দ্রব্যসামগ্রীতে সমৃদ্ধ নিরস্ত্র কাফেলা, আরেকটি ছিলো সামগ্রীবিহীন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। মুসলমানগণ নিরস্ত্র ও সম্পদপূর্ণ কাফেলাটিকে কামনা করেছিলো, যাতে সহজেই গনিমত হিসেবে সম্পদ অর্জিত হয়। আল্লাহ্তায়ালা তখন তাদের অন্তরস্থিত আকাংখা প্রকাশ করে দিলেন। তার সাথে সাথে যুদ্ধে তাদের নিশ্চিত বিজয়ের খবরটিও জানিয়ে দিলেন। এ জাতীয় সংবাদ গায়েবী খবর প্রদানেরই অন্তর্ভূত। এর বিস্তারিত আলোচনা করা হবে বদর যুদ্ধের বর্ণনায়। গায়েবী খবর সংক্রান্ত আরও আয়াত রয়েছে, যেমন আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘কাফেরেরা অচিরেই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে।’


এই আয়াতের মাধ্যমে কাফেরদের ভবিষ্যত অবস্থা প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। আর তা বাস্তবে রূপ লাভ করেছিলো বদর যুদ্ধের দিন। অথচ তারা সংখ্যার দিক দিয়ে ছিলো মুসলমানদের তিনগুণ। কাফেরদের সংখ্যা হাজারের ঊর্ধ্বে ছিলো। তদুপরি অস্ত্রশস্ত্রে তারা ছিলো সম্পূর্ণ সুসজ্জিত। আর মুসলমানগণের সংখ্যা তিনশ তেরো। তাদের নিকট ছিলো মাত্র দুটি ঘোড়া, একটি হজরত যুবায়র (رضي الله عنه) এর নিকট। আরেকটি হজরত মেকদাদ (رضي الله عنه) এর নিকট।


নগণ্যসংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্তায়ালা মুসলমানদেরকে সাহায্য করলেন এবং বিজয় দান করলেন। তাঁরা বড় বড় কাফের সরদারকে কতল করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তাদের দ্রব্য সামগ্রীকে গনিমত হিসেবে পেয়েছিলেন।


গায়েবী খবর সংক্রান্ত আয়াতে আরও বলা হয়েছে, ‘অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তর শংকাগ্রস্ত করে দেবো।’ এই আয়াতে উহুদযুদ্ধের দিন কাফেরদের অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করা হয়েছে। অথচ ঐদিন এক পর্যায়ে তাদের জয় হয়েই গিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ্তায়ালা কাফেরদের অন্তরে ভয়ভীতি ঢেলে দিলেন। যার ফলে তারা মক্কার দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। প্রত্যাবর্তনের সময় সেনাপতি আবু সুফিয়ান, যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, উচ্চস্বরে ঘোষণা দিচ্ছিলেন, হে মোহাম্মদ! যদি চাও তাহলে আগামী বৎসর বদরের প্রান্তরে আবার শক্তি পরীক্ষা হবে। রসুলেপাক (ﷺ) বলেছিলেন, ইনশাআল্লাহ্।


কাফেরেরা উহুদ প্রান্তর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পথিমধ্যে আক্ষেপ করেছিলো এবং মনে মনে চিন্তা করছিলো, কাজটা বোধ হয় ঠিক হয়নি, মুসলমানদের একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার দরকার ছিলো। তাই তারা ফিরে এসে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে মূলোৎপাটিত করে দিতে মনস্থ করেছিলো। কিন্তু আল্লাহ্তায়ালা তাদের অন্তরে ভয়ভীতি ঢুকিয়ে দিলেন। ফলে পুনরায় আক্রমণ করার সাহস তাদের হয়নি।


গায়েবী খবর সংক্রান্ত অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কাফেরেরা বিজয় লাভের পর কয়েক বৎসরের মধ্যেই পরাজিত হবে।’ শেষে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্তায়ালা তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না।’ এই আয়াতে কারীমার শানে নুযুল হচ্ছে, রোম ও পারস্য সম্রাটের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। কেসরা বা পারস্যের বাদশাহ্ যখন কায়সার বা রোমক সম্রাটকে পরাজিত করলো, তখন মক্কার কাফেরেরা আনন্দিত হলো। কারণ পারস্যসম্রাট ছিলো অগ্নিপূজক। আর কায়সার বা রোমক সম্রাট ছিলো নাসারা আহলে কিতাব। মক্কার মূর্তিপূজকেরা বললো, আমাদের ভাই অগ্নিপূজকেরা তোমাদের ভাই আহলে কিতাবদেরকে পরাজিত করেছে। এভাবে আমরাও তোমাদের উপর বিজয়ী হবো। কিন্তু সাত বৎসর পর দেখা গেলো, হুদায়বিয়া অভিযানের সময় রোমকরা পারস্য জয় করলো এবং অগ্নিপূজকদেরকে দেশান্তরিত করে দিলো।


গায়েবী খবর সংক্রান্ত আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ, তারা তাদের দুহাতের অর্জিত কর্মের কারণে মৃত্যুকে কামনা করবে না। ইহুদীরা যে মৃত্যুকে কখনও কামনা করবেনা, এ সম্পর্কে আয়াতে কারীমা খবর প্রদান করেছে। মৃত্যুকামনা ইচ্ছাধীন ব্যাপার। ইচ্ছে করলে করতে পারে। কিন্তু তারা এটা করেনি। কোরআন ভবিষ্যতের এই খবরটি দিয়েছে। তারা মৃত্যুকে কামনা করেনি। করে থাকলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পেতো।


এক মারফু হাদীছে উক্ত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, মৃত্যুকামনা করলে তারা সঙ্গে সঙ্গে মরে যেতো। ধরাপৃষ্ঠে একটি ইহুদীও জীবিত থাকতো না। ভবিষ্যতেও তারা কোনোদিন এ কাজটি করলে নবী করীম (ﷺ) এর বাণী সত্য প্রমাণিত হবে। ইহুদীদের সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা আরও এরশাদ করেন, ইহুদীদের উপর অপমান ও দারিদ্র আরোপ করে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক জামানায় ইহুদীরা অপমানিত ও লাঞ্ছিত জীবন যাপন করেছে। কোরআন মজীদে যেমন বলা হয়েছে, বাস্তবে তাই হয়েছে।


গায়েবী খবর সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা আরও এরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ্ অঙ্গীকার করেছেন, তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দিবেন, যেমন তাদের পূর্ববর্তীগণকে দিয়েছিলেন।’ এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ্তায়ালা রসুলে মকবুল (ﷺ) এর কাছে এই মর্মে অঙ্গীকার করেছেন যে, তাঁর উম্মতগণকে তিনি পৃথিবীর প্রতিনিধি, ইমাম, শাসক এবং সংস্কারক বানাবেন। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ সংশোধনী পাবে। আল্লাহ্র বান্দাগণ আল্লাহ্র দরবারে আযেজী এনকেছারী করার প্রয়াস পাবে। ভয়ভীতি ও বিপদাপদ দূর করে দিয়ে তাদেরকে নিরাপদ, নিশ্চিন্ত, নির্ভীক ও শক্তিশালী বানিয়ে দিবেন। যাবতীয় দুর্বলতা ও অপারগতা দূর করে দিয়ে পৃথিবীর শাসক বানিয়ে দিবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্তায়ালা তাঁর কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন। ‘আল্লাহ্র চেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি পূরণকারী আর কে হতে পারে?’ ওই সময় পর্যন্তরসুলেপাক (ﷺ) ইহজগত থেকে বিদায় গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ না আল্লাহ্তায়ালা মক্কা, খয়বর, বাহরাইন, ইয়ামন ও অন্যান্য আরব উপকূলের উপর মুসলমানদের পরিপূর্ণ বিজয় ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাছাড়া শাম দেশের অগ্নিপূজকেরা জিযিয়া দানে বাধ্য হয়। রোমের বাদশাহ্ হারকল এবং মিশর ও ইস্কান্দারিয়ার বাদশাহ্ রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে হাদিয়া পেশ করতে বাধ্য হয়েছিলো। আসলান, নাজ্জাশী এবং হাবশার বাদশাহ্গণ ইমান গ্রহণ করেছিলেন। 


রসুলেপাক (ﷺ) দুনিয়া থেকে প্রস্থানের পর আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ) এর সম্মানের উপযোগী পদমর্যাদায় প্রথম খলীফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه)কে অভিষিক্ত করেন। তিনি সংশোধন ও সংস্কারের কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। যারা রসুলেপাক (ﷺ) এর তিরোধানের পর বিহ্বল ও চঞ্চল হয়ে ধর্মীয় চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো, তাদেরকে ইমানী দৃঢ়তায় একত্রিতি দান করলেন। 


তিনি বীরত্ব ও সাহসিকতার এমন কর্মসূচী গ্রহণ করলেন, যা শ্রেষ্ঠ সাহাবীরাও মোকাবেলা করতে সাহস করেননি। 


সকলেই মৌনতার নীতি অবলম্বন করেছিলেন। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে সমস্ত ফেতনা দূর করতে উদ্যত হলেন। আরব উপকূল থেকে ফেতনার মূল উৎপাটন করে পারস্য অভিমুখে হজরত খালেদ ইবনে ওলীদ (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলেন। সেখানে বিজয়ের ঝাণ্ডা উড্ডিন করলেন। 


আরেক বাহিনী হজরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বাধীনে শাম দেশে প্রেরণ করলেন। আরেক বাহিনী প্রেরণ করলেন মিশর সাম্রাজ্য অভিমুখে হজরত আমর ইবনুল আস (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বে। 


শাম দেশে প্রেরিত বাহিনী বসরা, দামেস্ক এবং তার নিকটবর্তী দেশসমূহ জয় করেন। ইসলামের অগ্রযাত্রা এ পর্যন্ত আসার পর আল্লাহ্তায়ালা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه)কেও উঠিয়ে নিলেন। 


মুসলমানগণের নিকট আল্লাহ্তায়ালা এলহামের মাধ্যমে একথা জানিয়ে দিলেন যে, হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) দ্বীনের হুকুম প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর উত্তরসুরী হিসেবে হজরত ওমর (رضي الله عنه)কে পছন্দ করেছেন। সুতরাং দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে ওমর (رضي الله عنه) নিয়োজিত হলেন। চারিত্রিক শক্তি ও ন্যায়বিচারের পূর্ণতায় তিনি দ্বীনের হুকুম বাস্তবায়ন করতে লাগলেন। অল্পদিনের মধ্যেই পুরো শামদেশ, মিশরের সমস্ত অঞ্চল এবং অধিকাংশ পারস্য অঞ্চল জয় করলেন। পারস্যের বাদশাহ্ কেসরার শান শওকত ভূলুণ্ঠিত করে দিলেন। সে চূড়ান্ত লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হলো। রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলে মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। 


অন্যদিকে রোমক সম্রাট কায়সারকে শাম দেশ থেকে বহিষ্কার করা হলো। কুস্তুন্তুনিয়া পর্যন্ত মুসলমানদের বিজয় কেতন উড়ানো হলো। বিজিত রাজ্যের ধনসম্পদ গনিমত হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টিত হলো। আল্লাহ্তায়ালা তাঁর রসুল (ﷺ) কে যেরূপ সংবাদপ্রদান করেছিলেন, হুবহু তাই বাস্তবায়িত হলো। 


হজরত ওছমান (رضي الله عنه) এর খেলাফতের সময় ইসলামী রাজ্যের পরিধি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে আরও বৃদ্ধি পেলো। তাঁর খেলাফতের সময় উন্দুলুস, কিরওয়ান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল বাহরে মুহীত্ জয় করে পূর্ব প্রান্তে চীন সাম্রাজ্য পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা প্রশস্তহলো। পারস্য অধিপতি কেসরাকে হত্যা করে পরিপূর্ণভাবে রাজত্বকে খতম করে দেয়া হলো। মাদায়েন, ইরাক, খোরাসান এবং আহওয়ায জয় করে মুসলমানগণ তুর্কিদের সঙ্গে এক যবরদস্ত যুদ্ধে লিপ্ত হলো। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলসমূহ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের কর আসতে শুরু করলো। 


এসব কিছুই হয়েছে কোরআনে করীমের তেলাওয়াত ও তার বরকতে। হজরত ওছমান (رضي الله عنه) কুরআনে করীমের অতুলনীয় খেদমত করেছেন। আর সে কারণেই বেশীর ভাগ রাজ্য জয় হয়েছিলো। 


তারপর খলীফা নির্বাচিত হলেন সাইয়্যেদুনা আলী মুর্তযা (رضي الله عنه)। কিন্তু মানুষ তাঁর মর্যাদা নিরূপণ করতে ব্যর্থ হলো। তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলো। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন। হানাফী মাযহাবের ফেকাহ্ ও হাদীছ শাস্ত্রের বিশিষ্ট আলেম ইমাম তাওরিশী তাঁর স্বরচিত কিতাব আকায়েদে উল্লেখ করেছেন, সাইয়্যেদুনা হজরত আলী (رضي الله عنه) এর বিরুদ্ধাচরণকারীদের মধ্যে তিনটি দল ছিলো। একদল যারা তাঁকে চিনতে পারেনি। দ্বিতীয় দল যারা দুনিয়ার মহব্বতে লিপ্ত ছিলো। আর তৃতীয় দল যারা এজতেহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه), হজরত তালহা (رضي الله عنه) ও হজরত যুবায়ের (رضي الله عنه) প্রমুখ সাহাবীগণের ব্যাপারে আলোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। তাঁদের ব্যাপারে সংযমী হওয়া উচিত। 


গায়েবী খবর পরিবেশনের দিক দিয়ে আল্লাহ্ আরও এরশাদ করেন, ‘তিনি হচ্ছেন ওই আল্লাহ্ যিনি তাঁর রসুলকে হেদায়েত ও সৎধর্ম সহকারে প্রেরণ করেছেন, সমস্ত ধর্মের উপর সত্য ধর্মকে বিজয়ী করার জন্য।’ এই কথায় বারী তায়ালার বাক্যের তাৎপর্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবেই ইসলাম অন্য ধর্মের উপর প্রবল হয়ে রয়েছে। গায়েবী খবর পরিবেশনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্তায়ালা আরও এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ্র সাহায্য এবং বিজয় যখন আসবে, তখন দেখতে পাবে, মানুষ দলে দলে আল্লাহ্র ধর্মে প্রবেশ করছে।’ রসুলেপাক (ﷺ) এই দুনিয়া থেকে প্রস্থানের প্রাক্কালে, আরব দেশসমূহের এমন কোনো স্থান বাকি ছিলো না যেখানে ইসলামের বিধান প্রবেশ করেনি। ওয়ালিল্লাহিল হামদ। 


গায়েবী খবর সরবরাহের দ্বিতীয় প্রকার বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন হাদীছ শরীফে। তন্মধ্যে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন হজরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান (رضي الله عنه)। বলেছেন, রসুলপাক (ﷺ) একদিন খোতবা প্রদান করলেন। সে খোতবায় তিনি (ﷺ) কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিতব্য সকল কিছুই জানিয়ে দিলেন। ওই সমস্ত কথা কারও কারও স্মরণে আছে। আবার কেউ ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়ার বিষয়গুলো এরকম, যেমন বাহ্যিকভাবে আমরা কোনো ব্যাপার ভুলে যাই। আবার সে বিষয়ের সামনাসামনি হলে স্মরণ হয়। যেমন কেউ কিছুুকাল অনুপস্থিত থাকলে তার কথা ভুলে যাই। আবার সামনে এলে চিনতে পারি। হজরত হুযায়ফা (رضي الله عنه) বলেন, আমি এরূপ মনে করি না যে, আমার সাথীগণ জেনে বুঝে ইচ্ছা করে ভুলে গেছেন। বরং আল্লাহ্র কসম! তাদেরকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই রসুলেপাক (ﷺ) কিয়ামত পর্যন্ত ধর্মের মধ্যে যেসমস্ত ফেতনা দেখা দিবে তার পরিষ্কার বিষদ বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এমনকি ফেতনাকারীর নাম, পিতার নাম এবং বাসস্থানের নাম পর্যন্ত বলে গেছেন। 


তিনি বলেছেন, প্রাথমিক অবস্থায় ফেতনাবাজদের সংখ্যা তিনশ’ পর্যন্ত হবে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের অনুসারীদের সংখ্যা হবে অনেক। হজরত আবু যর (رضي الله عنه) বলেন, রসুলেপাক (ﷺ) এরকম সব বিষয়েরই আলোচনা করেছেন। এমনকি আকাশে যে পাখিটি পাখা মেলে উড়ে যায়, তার সম্পর্কেও আমাদেরকে জানিয়েছেন। দাজ্জালের আলোচনায় ইমাম মুসলিম হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন। 


নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, মুসলমানদের মধ্যে দশজন অশ্বারোহী রেসালতের দাবীদার হবে। তাদের নাম, তাদের বাপ দাদার নাম পর্যন্ত আমার জানা আছে। তাদের ঘোড়ার রঙ কী হবে, তাও আমি বলে দিতে পারি। পৃথিবীতে তারা উত্তম অশ্বারোহী হবে। হাদীছ শাস্ত্রের ইমামগণ এই বর্ণনা বিভিন্ন সহীহ্ হাদীছে করেছেন। 


নবী করীম (ﷺ) তাঁর উম্মতকে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা একদিন দুশমনদের উপর বিজয়ী হবে। মক্কা মুকাররমা, বাইতুল মুকাদ্দাস, ইয়ামন, শাম ও ইরাকে মুসলমানদের বিজয় সূচিত হবে এবং সেখানে এমন শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করবে যে, একজন রমণী একাকী হীরা থেকে মক্কা পর্যন্ত সফর করলে আল্লাহ্র ভয় ছাড়া তার মনে অন্য কোনোকিছুর সামান্যতম ভয় ও আশংকার উদ্রেক হবে না। 


হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) এক সময় মদীনায় অবস্থান করবেন। আল্লাহ্তায়ালা তাঁর উম্মতকে বিজয় দান করবেন। কায়সার ও কেসরার ধনভাণ্ডার মুসলমানদের মধ্যে বণ্টিত হবে। তারা চলে যাওয়ার পর পুনরায় কোনো কেসরা এবং কায়সার হবেনা। কেসরার রাজত্ব ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিলো যেমন নবী করীম (ﷺ) এর মোবারক পত্র সে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিলো। কায়সার শাম থেকে পলায়ন করেছিলো এবং তার অধীনস্থ রাজ্যসমূহ ইসলামী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। মুসলমানগণ তার অধীনস্থ অন্যন্য রাজ্যগুলোও দখল করেছিলো। এসব হয়েছিলো হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) এর খেলাফতকালে। 


রসুলেপাক (ﷺ) খবর দিয়েছেন, মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ফেতনার উদ্ভব হবে। প্রবৃত্তিপূজারী হবে মুসলমানগণ। অতীতকালের ইহুদী নাসারাদের পদাংক অনুসরণ করে চলবে। উম্মতের মধ্যে তেহাত্তর ফেরকা হবে। তন্মধ্যে একটি মাত্র ফেরকা নাজাতপ্রাপ্ত হবে। মুসলমানেরা আরাম আয়েশ ভোগ বিলাসের পিছনে ছুটবে। সকাল সন্ধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরিধান করবে। জমকালো পোশাক পরবে। ঘরের ভিতর ভালো ভালো ফরাশ ব্যবহার করবে। ঘরের ছাদ বানাবে। দেয়ালে ঝুলাবে রঙ বেরঙের পর্দা। অহংকার ও দম্ভভরে চলাফেরা করবে। নানা প্রকারের আহার্যের দিকে ঝুঁকে পড়বে। পারস্য ও রোম দেশের নারীদের মতো মুসলিম রমণীদের থেকে খেদমত গ্রহণ করবে। 


তিনি আরও বলেছেন, মুসলমানদের মধ্যে যখন এগুলো বিস্তার লাভ করবে, তখন আল্লাহ্তায়ালা তাদের উপর আযাব নাযিল করবেন এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হয়ে যাবে। নেককারদের স্থান দখল করে নিবে গোনাহ্গারেরা। এমতাবস্থায় আল্লাহ্তায়ালা নেককার লোকদেরকে তাদের ভিতর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবেন। তিনি আরও বলেছেন, সে সময় অতিদ্রুত গতিতে চলবে। কিয়ামতের কাছাকাছি সময়ে এলেম উঠে যাবে এবং আহলে এলেম দুনিয়া থেকে চলে যাবে। ফেতনা প্রকাশিত হবে। গান বাজনা ও হাসি তামাশার উপকরণের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। 


মুসায়লামা কাযযাবের ফেতনার খবর দেয়া হয়েছে এবং তার অনিষ্ট হতে সাবধান করা হয়েছে। এ মর্মে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আরবদের জন্য আক্ষেপ, ফেতনার আলামত নিকটবর্তী। তিনি আরও এরশাদ করেছেন, পৃথিবীর পরিমণ্ডলকে একাকার করে আমাকে দেখানো হয়েছে। যে পর্যন্ত আমাকে দেখানো হয়েছে, সে পর্যন্তআমার উম্মতের অধিকারই দেখেছি। দেখেছি মাশরিক মাগরিব ও তৎমধ্যবর্তী স্থানের ভারতের হুকুমতও ইসলামের ছায়াতলে সুদীর্ঘ হবে। তার দৈর্ঘ্য পূর্বের প্রান্ত থেকে নিয়ে বাহরে এজনা পর্যন্ত বিস্ত ৃত হবে, যার শেষে আর কোনো জনবসতি নেই। 


অতীতের কোনো উম্মতের রাজ্য এতো বড় ও সুদীর্ঘ হয়নি। উত্তরেও নয়। দক্ষিণেও নয়। তিনি আরও বলেছেন, আরবরা সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তারা হকের উপরেই থাকবে। আরবদের বলতে এখানে কতিপয় আরবীয় লোককে বুঝানো হয়েছে। কেনোনা আরব শব্দের অর্থ হচ্ছে বালতি। আরবরা বালতি দিয়ে পানি উঠিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতো বলে তাদেরকে আরব বলা হয়েছে। কেউ কেউ আবার আহলে আরব বলতে আরবের পাশ্চাত্য অঞ্চলকে বুঝিয়ে থাকেন। কেনোনা আরবের পশ্চিমা দেশগুলো অধিকাংশ হকের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। 


 কোনো কোনো বিবরণে আহলে মাগরেবও উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, আহ্লে মাগরেবরা হকের উপরে থাকবে। এখানে আহ্লে মাগরেব বলতে কল্যাণকামী লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যারা কল্যাণকামী হবে, তারা সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবে। হজরত আবু উমামা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সবসময়ই একটি দল সত্যের উপরে থাকবে এবং দুশমনের উপরে প্রবল থাকবে। কেয়ামত এসে গেলেও তারা হকের উপরেই থাকবে। সাহাবা কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! এধরনের লোক কোথায় থাকবে? তিনি বললেন, বাইতুল মুকাদ্দাসে। 


নবী করীম (ﷺ) বনু উমাইয়ার হুকুমত এবং হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর শাসনের খবর দিয়েছেন। এরশাদ করেছেন, হে মুয়াবিয়া! শুনে রাখো, শেষ জীবনে তুমি আমার উম্মতের শাসক হবে। যখন শাসক হবে, তখন নেককারদের সাহচর্যে থেকো আর বদ লোকদের সংসর্গ বর্জন করো। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়াতে উল্লেখ আছে, হজরত ইবনে আসাকের (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, মুয়াবিয়া কখনও পরাজিত হবে না। হজরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) সিফফীনের যুদ্ধের দিন বলেছিলেন, আমি এই হাদীছ আগে জানলে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতাম না। আল্লাহ্পাকই ভালো জানেন। 


নবী করীম (ﷺ) একদা হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর মাকে বলেছিলেন, তোমার গর্ভে পুত্রসন্তান রয়েছে। সে জন্মগ্রহণ করলে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার পর রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে আনা হলো। রসুলেপাক (ﷺ) তার ডান কানে আযান এবং বাম কানে একামত দিলেন এবং মুখের লালা মোবারক শিশুর মুখে দিলেন। তারপর তার নাম রাখলেন আবদুল্লাহ এবং বললেন এ শিশু আবুল খোলাফা হবে। 


আরবেরা তুর্কিদের উপর বিজয়ী হবে এ খবরও তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, বনু আব্বাস গোত্র কালো পতাকা নিয়ে বের হবে, তারা বহু এলাকা অধিকার করবে। আহলে বাইতকে দেখামাত্র হত্যা করবে এবং তাদের উপর বিভিন্ন প্রকারের অত্যাচার চালাবে। 


সাইয়্যেদুনা আলী মুর্তযা (رضي الله عنه) এর শাহাদতের খবরও তিনি দিয়ে গেছেন। বলেছেন, কওমের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বদবখত্ যে তার মাথা ও দাড়িকে রক্তে রঞ্জিত করবে। তিনি আরও বলেছেন, আলী মুর্তযা জান্নাত জাহান্নাম বণ্টনকারী হবে। সে তার দোস্তদেরকে জান্নাতে আর দুশমনদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে। আশশেফা কিতাবে বলা হয়েছে, হজরত আলী মুর্তযা (رضي الله عنه) এর দুশমন দুটি সম্প্রদায়- একটি খারেজী, অপরটি নাসেবী। আর রাফেযীদের ওই দলটিও, যারা নাসেবীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আলেমগণ এদেরকে কাফের সাব্যস্ত করেছেন। হজরত আলী (رضي الله عنه) এর মর্যাদা সম্পর্কে এক হাদীছে বর্ণিত আছে, হজরত ঈসা (عليه السلام) ও মরিয়ম (عليه السلام) এর সঙ্গে হজরত আলী (رضي الله عنه) এর এক ধরনের মিল রয়েছে। ইহুদীরা হজরত ঈসা (عليه السلام) এর সঙ্গে শত্রুতা করতো এবং তাঁর মাতা হজরত মরিয়ম (عليه السلام)কে অপবাদ দিতো। অপরপক্ষে নাসারারা তাঁর প্রতি বিকৃত মহব্বতের কারণে তাঁকে এমন মর্যাদা দিতো, যা তিনি নন। 


হজরত আলী (رضي الله عنه) বলেছেন, আমার ব্যাপারে দুধরনের লোক ধ্বংস হয়ে যাবে। এক, আমার অতিরঞ্জিত প্রেমিক। আমার সীমাহীন প্রশংসা করে করে তারা আমাকে এমন স্থানে নিয়ে যাবে, যা আমার মধ্যে নেই। দ্বিতীয়, যারা অযথা আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, শত্রুতা করে এবং আমাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়। 


রসুলেপাক (ﷺ) হজরত ওছমান (رضي الله عنه) এর শাহাদতের খবর দিয়েছেন। বলেছেন, ওছমান কোরআন তেলাওয়াতরত অবস্থায় শহীদ হবে। তাঁর শাহাদতের সময় কোরআনে করীমের আয়াতের উপর তাঁর রক্ত ঝরে পড়েছিলো। তাই দেখে লোকেরা মন্তব্য করেছিলো, অবশ্যই তাঁকে যুলুম করে শহীদ করা হয়েছে। 


হজরত ওছমান (رضي الله عنه) এর খেলাফত সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) আরও খবর দিয়েছেন, আল্লাহ্তায়ালা ওছমানকে একটি কামীয পরিধান করাবেন, অথচ লোকেরা সে কামীয খুলে ফেলতে চাইবে। কামীয পরিধান করানোর অর্থ খেলাফত প্রদান করা। এক বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ﷺ) হজরত ওছমান (رضي الله عنه)কে বলেছিলেন, আল্লাহ্াতায়ালা তোমাকে কামীয পরিধান করাবেন। কামীযটি খুলো না। তিনি তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন এবং তিনি যে পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন, সে সম্পর্কে তাঁকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি (ﷺ) আরও বলেছিলেন, যতক্ষণ ওমর জীবিত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফেতনার উদ্ভব হবে না। হজরত ওমর (رضي الله عنه) শহীদ হবেন বলেও তিনি খবর জানিয়েছিলেন। হজরত আলী (رضي الله عنه) এর সঙ্গে হজরত যুবায়ের (رضي الله عنه) এর যুদ্ধ হবে এবং সে যুদ্ধের পর হজরত যুবায়র (رضي الله عنه) অনুতপ্ত হবেন এ সম্পর্কেও খবর জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের একজন সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি যখন মক্কা ও বসরার মধ্যবর্তী হাওয়াব নামক স্থানে পৌঁছবেন, তখন কুকুরদেরকে আওয়াজ করে কিছু বলতে শুনবেন এবং সেখানে নিহতদের স্তুপ হয়ে যাবে। 


জঙ্গে জামালের সময় হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) যখন মক্কা থেকে বসরার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন উক্ত স্থানে ওই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো। হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (رضي الله عنه) কে খবর দিয়েছিলেন, তাঁকে বিদ্রোহীরা শহীদ করবে। হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর সাথীরা তাঁকে শহীদ করেছিলো। এ খবর মুতাওয়াতিরের কাছাকাছি।

 

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (رضي الله عنه) কে বলেছিলেন, তোমার ব্যাপারে লোকেরা আক্ষেপ করবে আর তুমিও লোকদের তৎপরতায় আক্ষেপ করবে। হাজ্জাজের নির্দেশে তাঁর সাথে সেরকম আচরণই করা হয়েছিলো। হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কে বলেছিলেন, তোমার দৃষ্টিশক্তিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং কিয়ামতের দিন ফিরিয়ে দেয়া হবে। হজরত যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه), হজরত জাফর ইবনে আবু তালেব (رضي الله عنه) এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (رضي الله عنه) এর শাহাদতের ব্যাপারেও খবর দিয়েছিলেন তিনি। মুতার যুদ্ধে হজরত খালেদ (رضي الله عنه) মুসলমানদের বিজয় ছিনিয়ে আনবেন এ খবরও তিনি দিয়েছিলেন। 


কুরনান নামের এক ব্যক্তি সম্পর্কে রসুলেপাক (ﷺ) একবার মন্তব্য করলেন, সে জাহান্নামী। লোকটি এক যুদ্ধে বিমোহিত করলো মানুষকে। পরিশেষে দেখা গেলো, সে যখমের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজের তলোয়ার দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিলো। লোকেরা এই খবর রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই এবং আমি আল্লাহ্র রসুল। 


রসুলেপাক (ﷺ) এক দল সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। সেই দলে ছিলেন হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه), হজরত সামুরা ইবনে জুন্দুব (رضي الله عنه) এবং হজরত হুযায়ফা (رضي الله عنه)। রসুলেপাক (ﷺ) বলেছিলেন, শেষোক্ত জনের মৃত্যু হবে দুনিয়াবী আগুনের মাধ্যমে। তিনজনের মধ্যে সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেছিলেন হজরত সামুরা ইবনে জুন্দুব (رضي الله عنه)। তিনি অতি বৃদ্ধ হওয়ার কারণে এরকম দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর শরীরের উত্তাপ প্রায় ছিলোই না। শরীরকে গরম রাখার জন্য সব সময় তাঁকে আগুনের তাপ গ্রহণ করতে হতো। অবশেষে আগুনে পুড়েই তাঁকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছিলো। 


উহুদের যুদ্ধে হানযালা (رضي الله عنه) শাহাদতবরণ করলেন। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হানযালাকে ফেরেশতারা এখন গোসল দিচ্ছে। ময়দানে তাঁর লাশ পাওয়া যাচ্ছিলো না। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো, কারণ কী। তাঁর স্ত্রী বললেন, তিনি জুনুবী ছিলেন, তাই তাঁর গোসলের প্রয়োজন ছিলো। হজরত হানযালা (رضي الله عنه) যখন শুনলেন, রসুলেপাক (ﷺ) শক্ত যুদ্ধেরসম্মুখীন, তখনই দৌড় দিয়েছিলেন যুদ্ধের মাঠে। গোসল করার ফুরসত পাননি। আর এ অবস্থায়ই তিনি শহীদ হয়েছেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, আমি হানযালার মাথা থেকে পানির ফোঁটা টপ টপ করে পড়তে দেখেছি। 


নবী করীম (ﷺ) আরও খবর জানিয়েছিলেন, বনু ছাকীফ গোত্রে একজন মিথ্যাবাদী আর একজন হন্তারক জন্ম নেবে। তাই হয়েছিলো। সে গোত্রে জন্ম নিয়েছিলো মিথ্যাবাদী মুখতার ইবনে ওবায়েদ এবং হন্তারক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ।সাইয়্যেদুনা হজরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেছিলেন, আমার এ ফরযন্দ সাইয়্যেদ। তার মাধ্যমে আল্লাহ্্তায়ালা মুসলমানদের দুইটি দলের মধ্যে সন্ধি করাবেন। তাই হয়েছিলো হজরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমে। সাইয়্যেদা ফাতেমা (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেছিলেন, আহলে বাইতের মধ্যে সকলের আগে আমার সঙ্গে মিলিত হবে ফাতেমা। 


নবী করীম (ﷺ) এর দুনিয়া থেকে প্রস্থানের আট বা ছয় মাস পর হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর ইন্তেকাল হয়েছিলো। তিনি আরও বলেছিলেন, আমার স্ত্রীগণের মধ্যে সেই আমার সঙ্গে সর্বাগ্রে মিলিত হবে, যার হাত লম্বা। এ কথার দ্বারা তিনি উম্মুল মুমেনীন হজরত যয়নব (رضي الله عنه)কে বুঝিয়েছিলেন। কারণ, তিনি খুব বেশী দান করতেন। পরবর্তীতে হয়েছিলোও তাই। সাইয়্যেদুনা হজরত ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলেছিলেন, তফ নামক স্থানে তিনি শহীদ হবেন। সেস্থানের আলামতও তিনি বলে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, একটি বিষধর কুকুর তাকে শহীদ করবে। বিষধর কুকুর বলে তিনি যাকে বুঝিয়েছিলেন তার নাম ছিলো শীমার ইবনে যুল যুশন। রসুলেপাক (ﷺ) নিজের মুঠির ভিতর থেকে কিছু মাটি বের করে দেখিয়ে বলেছিলেন, এ হচ্ছে তার হত্যাস্থলের মাটি। তিনি আরও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আমার পর তিরিশ বৎসর খেলাফত বিদ্যমান থাকবে। তারপর রাজতন্ত্র এবং বাদশাহী চলবে।


এক বর্ণনায় বলা হয়েছে ‘মুলকে আযুয’ চলবে। ইসলামী প্রশাসনের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে নবুওয়াত ও রহমত। তারপর খেলাফত ও রহমত। তারপর মুলুকে আযুয। তারপর উবুদ ও জাবারুত এবং তার সাথে ফেতনা ফাসাদ। 


উক্ত স্তরগুলো আত্মপ্রকাশ করবে বলে তিনি খবর দিয়ে গেছেন। তারপর এক শিঙ বের হবে। খেলাফতের পর রাজতন্ত্র ও বাদশাহী হবে। সে সময়কার রাজা বা বাদশাহের আলামতও তিনি বলে গেছেন। তাদের পরিচয় হবে এই যে, তারা ওয়াক্ত মতো নামাজ আদায় করবে না। বিলম্ব করে নামাজ পড়বে। তিনি আরও বলেছেন, আখেরী জামানায় আমার উম্মতের মধ্যে তিরিশটি দাজ্জাল ও কাজ্জাবের জন্ম হবে। তাদের মধ্যে চারজন হবে নারী। তারা প্রত্যেকেই আল্লাহ্ ও তাঁর রসুল সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করবে। এ উম্মতের সমাপ্তি দাজ্জাল ও কায্যাবের মাধ্যমে হবে। এক বর্ণনায় এসেছে, তারা নবুওয়াতের দাবি করবে। নবী করীম (ﷺ) আরও এরশাদ করেছেন, আমার যুগই সর্বোত্তম যুগ, অতঃপর যারা আমার যুগের লোকদেরকে পেয়েছে, অতঃপর যারা তাদেরকে পেয়েছে, অতঃপর যারা তাদেরকে পেয়েছে, অতঃপর তারা যাদেরকে পেয়েছে। এ দ্বারা সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণের যুগকে বুঝানো হয়েছে। বোখারী শরীফের এক বর্ণনায় বর্ণনাকারী সন্দিগ্ধাবস্থায় ‘ছুম্মাল্লাযীনা ইয়ালুনাহুম’ চারবার বলা হয়েছে। 


অতঃপর নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, এরপর মিথ্যাচার বিস্তার লাভ করবে। এক বর্ণনায় আছে, শেষ জামানার মানুষেরা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকা না হলেও নিজে থেকে যেচে এসে সাক্ষী প্রদান করবে। মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে। আমানতের খেয়ানত করবে এবং ওয়াদা করে ওয়াদা পূরণ করবে না। তিনি আরও বলেছেন, আমার উম্মত কুরাইশের বাচ্চাদের হাতে হালাক হবে। এ দ্বারা তাঁর সহচরদেরকে বুঝানো হয়েছে। 


হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) যিনি এই হাদীছখানার বর্ণনাকারী, তিনি বলতেন, রসুল (ﷺ) যাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন আমি ইচ্ছে করলে তাদের নাম ধাম বলে দিতে পারি। কিন্তু আমি এটা চাই না। হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) একথা বলে আল্লাহ্তায়ালার কাছে পানা চাইতেন, আমি ষাট হিজরীর হুকুমত থেকে আল্লাহ্তায়ালার সাহায্য চাই। ষাট হিজরী ছিলো এযীদের ক্ষমতা দখলের বৎসর। হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) তার পূর্বেই এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। 


রসুলেপাক (ﷺ) আরও খবর দিয়ে গেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে কদরিয়া, মুরজিয়া, রাফেযী ও খারেজী ইত্যাদি বাতেল ফেরকা আত্মপ্রকাশ করবে। খারেজীদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এরা উত্তম একটি দল থেকেই বের হবে। উত্তম দল বলতে হজরত আলী (رضي الله عنه) এর সাথীগণের দলকে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, সে দলটির আলামত এই যে, তাদের দলে কালো বর্ণের একটি লোক থাকবে, যাকে মানুষ যুছছাদিয়া বা স্তনওয়ালা বলে ডাকবে। তার একটি বাজু রমণীদের স্তনের মতো হবে, যাকে সে নাড়াচাড়া করবে। এদিক সেদিক ঘুরাবে। তার মস্তক মুণ্ডিত থাকবে। তার সঙ্গে আলী যুদ্ধ করবে। 


এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমি যদি ওদেরকে পেতাম তাহলে আদ ছামুদ জাতির মতো ধ্বংস করে দিতাম। তিনি আরও জানিয়েছেন, উম্মতের মধ্যে নবীনেরা প্রবীণদেরকে মন্দ বলবে। আধুনিকরা পূর্ববর্তীগণের সমালোচনা করবে। রাফেজীরা সেরকমই করে থাকে। তিনি আরও বলেছেন, দ্বীনের সাহায্যকারী কমে যাবে। তাদের সংখ্যা খুব কম হবে, আটার মধ্যে লবণের পরিমাণ যে রকম হয়। উম্মতের মধ্যে সর্বদাই বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা বিরাজ করবে। এ বিভেদ ও ফেরকাবাজী থেকে কোনো দলই বাঁচতে পারবে না। শাসকেরা মানুষের উপর জুলুম করবে, কঠোরতা করবে। শক্তি ও ক্ষমতার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা দখল করে নেবে। নিজেদের লোকদের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করবে, অন্যদের সাথে সেরূপ আচরণ করবে না। 


নবী করীম (ﷺ) আরও খবর দিয়েছেন, আখেরী জামানায় মানুষ চূড়ান্ত সীমার নিকৃষ্ট হবে। তারা বকরী চরাবে খালি পায়ে। চলাফেরা করবে খালি শরীরে। গগণচুম্বী ইমারত অট্টালিকা প্রস্তুত করবে। তার মধ্যে বিভিন্ন কামরা আর জানালার সমাহার ঘটাবে। এগুলো অধিক সম্পদ ও আরাম আয়েশের ইঙ্গিত। তিনি (ﷺ) আরও বলেছেন, কুরাইশরা রসুলুল্লাহ্র সঙ্গে কখনও যুদ্ধ করবে না। কেনোনা তিনি তো কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আর তা সংঘটিত হয়েছে খন্দকের যুদ্ধে। এরপর আর কুরাইশরা রসুলেপাক (ﷺ) এর সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেনি। বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের পর মুতান সর্ম্পকেও খবর দিয়েছেন। মুতান শব্দের অর্থ হচ্ছে তাউন বা প্লেগ রোগ। প্লেগরোগের উৎপত্তি অধিকাংশ সময় ইঁদুরের মৃত্যু থেকে হয়ে থাকে। 


হাদীছের জাহেরী অর্থ হিসেবে ওই প্লেগ রোগকে বুঝানো হয়েছে, যা আমীরুল মুমিনীন হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) এর জামানায় বিস্তার লাভ করেছিলো। কথিত আছে, সেসময় তিন দিনে সত্তর হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


বসরা আবাদ হওয়া সম্পর্কেও তিনি বলেছিলেন। এক সাহাবীকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন, সিংহাসনে সমারূঢ় বাদশাহ্দের মতো তিনি সমুদ্রপথে যুদ্ধযাত্রা করবেন। তাই হয়েছিলো, আমীরুল মুমেনীন হজরত ওছমান (رضي الله عنه) এর সময়ে হজরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। নবী করীম (ﷺ) আরও তথ্য দিয়েছেন, দ্বীন যদি ছুরাইয়া তারকার মতো দূরত্বে ঝুলন্ত থাকে, তবুও পারস্যের সন্তানরা সেই দ্বীনের সন্ধান পাবেই। কেউ কেউ বলে থাকেন, এর দ্বারা হজরত সালমান ফার্সী (رضي الله عنه) এর ইসলাম গ্রহণকে বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, হজরত ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) ও তাঁর সাগরেদগণকে বুঝানো হয়েছে। কেনোনা তাঁরা ছিলেন পারস্য সন্তান। এক বর্ণনায় এসেছে, পারস্যের একজন প্রকৃত পুরুষের কাছে দ্বীন পৌঁছে যাবে। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


রসুলেপাক (ﷺ) মদীনা মুনাওয়ারার একজন আলেম সম্পর্কে বলেছিলেন, আলেমগণের একটি দল তাঁর অনুসরণ করবে। উলামা কেরাম বলেন, আলেম বলতে ইমাম মালেক (رحمة الله) কে বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, আলেম বলতে একথা বুঝানো হয়েছে যে, মদীনা মুনাওয়ারার আলেমগণের নিকট মানুষ তাদের দ্বীনী প্রয়োজনে যেতে বাধ্য হবে। শেষোক্ত ব্যাখ্যা নবী করীম (ﷺ) এর জামানার জন্য প্রযোজ্য হবে। সব সময়ের জন্য নয়। হাদীছের পূর্বাপর ভাব দৃষ্টে তাই প্রতীয়মান হয়। 


নবী করীম (ﷺ) কুরাইশদের আলেম সম্পর্কেও বলেছেন। যেমন হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে। নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কুরাইশদেরকে গালি দিও না। কেনোনা কুরাইশ বংশের একজন আলেম সমস্ত জাহানকে এলেমে ভরপুর করে দিবে। ইমাম আহমদ প্রমুখ আলেমগণ মনে করেন, উক্ত আলেম বলতে ইমাম শাফেয়ী র .কে বুঝানো হয়েছে। যুরকানী (رحمة الله) হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন যাতে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে এক ব্যক্তির নাম হবে আবু হানীফা, সে আমার উম্মতের আলোকবর্তিকা হবে। তানযীহুশ শরীয়ত পুস্তকে বলা হয়েছে, ইমাম আহমদ (رحمة الله) কুরাইশ বংশের আলেম বলতে ইমাম শাফেয়ী সম্পর্কে যে মত পেশ করেছেন, তার সমর্থনে তিনি একটি হাদীছও বর্ণনা করেছেন, তার সূত্রশৃংখলের (সনদের) একজন বর্ণনাকারী হচ্ছেন ইয়াবারী। তিনি বর্ণনা করেছেন মামুন সালমী থেকে। এই দুইজন বর্ণনাকারীর কোনো একজন হাদীছটি বানিয়েছেন। কাজেই এটি মওযু হাদীছ। আর আবু হানীফা সম্পর্কিত হাদীছ সম্পর্কে সুফরুস সাআদত পুস্তকের লেখক বলেছেন, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আবু হানীফার ফাযায়েল ও তাঁদের নাম সম্পর্কে কোনো হাদীছ সহীহ এর স্তর পর্যন্ত পৌঁছেনি। এ সম্পর্কিত সকল বর্ণনা মওযু ও মুনকার। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


তিনি (ﷺ) আরও বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল সর্বদাই হকের উপর কায়েম থাকবে। কেয়ামত পর্যন্ত এরকমই চলবে। আরও বলেছেন, আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক শতাব্দীর শুরুতে একজন মোজাদ্দেদ প্রেরণ করবেন, যিনি দ্বীনের তাজদীদ বা সংস্কার করবেন।


এক ব্যক্তির একটি চাদর চুরি হয়েছিলো। নবী করীম (ﷺ) বলে দিয়েছিলেন, এটা অমুক ব্যক্তি নিয়েছে। অবশেষে সে চাদর উক্ত ব্যক্তির মালপত্রের ভিতর থেকেই বের হয়েছিলো। নবী করীম (ﷺ) এর উটনী এক সময় হারিয়ে গিয়েছিলো। তিনি (ﷺ) বলে দিয়েছিলেন, অমুক মরুভূমিতে একটি গাছের সঙ্গে তার রশি পেঁচ লেগে গেছে। তারপর তাকে সেখান থেকেই উদ্ধার করা হয়। একদা নবী করীম (ﷺ) বললেন, একজন মহিলা মক্কায় কুরাইশদের লিখিত একটি পত্র নিয়ে দুশমনদের কাছে যাচ্ছে। মহিলাটির সমস্ত আলামত জানিয়ে দিয়ে রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, তোমরা পত্রটি উদ্ধার করে আনো। হজরত আলী (رضي الله عنه) দু একজন সাথী সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। নবী করীম (ﷺ) যে স্থানের কথা বলে দিয়েছিলেন, তাঁরা তাকে সেখানেই পেয়ে গেলেন। হাদীছের পুস্তকে এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। সুরা মুমতাহেনাহ নাযিল হওয়ার পটভূমি এটাই। 


নবী করীম (ﷺ) আপন চাচা হজরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর ওই সম্পদের খবর বলে দিয়েছিলেন, যা তিনি বদর যুদ্ধে আসার সময় তাঁর স্ত্রী উম্মুল ফজলের নিকটে দিয়ে এসেছিলেন। সেই সম্পদের খবর তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানতো না। এই ঘটনার পর হজরত আব্বাস (رضي الله عنه) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। বিস্তারিত বর্ণনা বদর যুদ্ধের বিবরণে আসবে ইনশাআল্লাহ্।

 

হজরত সায়াদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মনে হচ্ছিলো, তিনি বাঁচবেন না। কিন্তু নবী করীম (ﷺ) তাঁকে দেখে বলেছিলেন, সম্ভবত তুমি রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাবে। তোমার দ্বারা একটি কওম উপকার লাভ করবে। আর আরেকটি কওম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ তোমার দ্বারা মুসলমানদের লাভ হবে, আর কাফেরেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একথায় তাঁর দীর্ঘজীবন লাভের সুসংবাদ রয়েছে। আশারা মুবাশ্শারাগণের মধ্যে তিনিই সকলের শেষে ইনতেকাল করেছিলেন। পঞ্চাশ বা সাতান্ন অথবা কারও মতে আটান্ন হিজরীতে তাঁর ওফাত হয়েছিলো। 


উমাইয়া ইবনে খালফ সম্পর্কে বলেছিলেন, সে আমার হাতে মারা যাবে। উতবা ইবনে আবু লাহাব সম্পর্কে বলেছিলেন, আল্লাহ্র সৃষ্ট প্রাণী তাকে ভক্ষণ করবে। তাকে বাঘে খেয়েছিলো। 


বদর যুদ্ধের সময় স্থান চিহ্নিত করে তিনি বলে দিয়েছিলেন, অমুক অমুক কাফের অমুক অমুক স্থানে নিহত হবে। যুদ্ধশেষে দেখা গেলো, রসুলেপাক (ﷺ) কর্তৃক চিহ্নিত স্থানে তারা মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। 


হজরত নাজ্জাশীর ইনতেকাল হলে রসুলেপাক (ﷺ) বলেছিলেন, নাজ্জাশী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। সাহাবীগণকে নিয়ে তিনি চার তকবীরের সাথে তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেছিলেন। ফিরোজ দায়লানী পারস্যের বাদশাহ্র দূত হয়ে এলে নবী করীম (ﷺ) তাকে বলেছিলেন, বাদশাহ্র মৃত্যু হয়েছে। ফিরোজ দায়লানী পরে একথা সত্য জানার পর মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো। হজরত আবু যর গিফারী (رضي الله عنه) কে বলেছিলেন, মদীনার লোকেরা তাঁকে মদীনা মুনাওয়ারা থেকে বের করে দেবে। 


হজরত আবু যর গিফারী (رضي الله عنه) একদিন মসজিদে নববীতে শুয়েছিলেন। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁকে বললেন, হে আবু যর! সেদিন তোমার কী অবস্থা হবে যেদিন লোকেরা তোমাকে এই মসজিদ থেকে বের করে দেবে। 


তিনি বললেন, তাহলে আমি মসজিদে হারামে আশ্রয় নেবো। তিনি বললেন, সেখান থেকেও যদি বের করে দেয়। হাদীছের শেষের দিকে রয়েছে, নবী করীম (ﷺ) বললেন, এমতাবস্থায় তোমাকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে হবে এবং ওই অবস্থায়ই তোমার ইনতেকাল হবে। 


হজরত আবু যর গিফারীর অন্তিম জীবনের ঘটনা আবু যর অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্। 


নবী করীম (ﷺ) একদিন হজরত সারাকাহ (رضي الله عنه)কে বলেছিলেন, সেদিন তোমার মানসিক অবস্থা কেমন হবে, যেদিন তুমি পারস্যের বাদশাহ্র হাতের স্বর্ণের চুড়ি পরিধান করবে। হজরত ওমর (رضي الله عنه) এর খেলাফতের সময় পারস্যবিজয় হলো। গনিমতের মালের মধ্যে বাদশাহ্র স্বর্ণের চুড়ি দুটিও ছিলো। হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) হজরত সারাকাহ (رضي الله عنه) এর হাতে স্বর্ণের চুড়ি দুটি পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সমস্ত প্রশংসা ওই আল্লাহ্তায়ালার, যিনি পারস্যের বাদশাহ্র স্বর্ণের চুড়ি পরিয়ে দিলেন সারাকাহর হাতে। 


দজলা ও দজীলের মধ্যবর্তীস্থানে এক শহর আবাদ হবে বলেও তিনি খবর দিয়েছিলেন। সেই ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক বাগদাদ নগরী গড়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেছিলেন, আমার এই উম্মতের মধ্যে এক ব্যক্তির জন্ম হবে। তার নাম হবে ওলীদ। উম্মতের মধ্যে সে একজন নিকৃষ্ট ব্যক্তি হবে। হবে এই উম্মতের ফেরআউন। তিনি (ﷺ) আরও বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত হবে না, যতক্ষণ না দুটি দল পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে একই দাবি নিয়ে অর্থাৎ উভয়েরই দাবী হবে ইসলাম। 


উলামা কেরাম বলেন, নবী করীম (ﷺ) এর দ্বারা সিফ্ফীনের যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবীর মতে ইসলামে আকস্মিকভাবে সেই অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ নেমে এসেছিলো। ইমাম কুরতুবীর মতে, রসুলে করীম (ﷺ) এর পর সর্বপ্রথম দুর্ঘটনা ছিলো হজরত ওমর (رضي الله عنه) এর শাহাদত। রসুলে করীম (ﷺ) এর দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর ওহীর ধারা বন্ধ হলো। সাথে সাথে আরব ও অন্যান্য অঞ্চলে মুরতাদ হওয়ার ফেতনা সৃষ্টি হলো। হজরত ওমর (رضي الله عنه) এর শাহাদতের মাধ্যমে সে ফেতনার তরবারী কোষমুক্ত হয়ে গেলো। তারপর হজরত ওছমান (رضي الله عنه) শহীদ হলেন। 


সুহায়ল ইবনে আমর কুরাইশদের একজন সরদার ছিলেন। তিনি ছিলেন সুবক্তাও। তিনি নবী করীম (ﷺ) এর সাহাবা কেরামের নিন্দাবাদ করতেন, তাঁদেরকে গালিগালাজ করতেন। বদর যুদ্ধে তাকে বন্দী করা হলে হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এর দাঁতগুলো ভেঙে দেই।

 

একথা শুনে রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, হে ওমর! অচিরেই সে এমন অবস্থায় পৌঁছবে, যা দেখে তুমিও খুশি হয়ে যাবে। সেরকমই হয়েছিলো। তিনি ইসলাম গ্রহন করে মক্কা মুকাররমাতেই বসবাস করতে লাগলেন। অতঃপর রসুলেপাক (ﷺ) এর ওফাত ও হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এর খেলাফত লাভের খবর যখন মক্কায় পৌঁছলো, তখন তিনি বিশেষ ভাষণ দিয়ে মুসলমানদের মনে শান্তি ও দৃঢ়তা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের মাধ্যমে তিনি তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছিলেন। 


হজরত ছাবেত ইবনে কায়েস ইবনে শামাস (رضي الله عنه) কে বলেছিলেন, এতোদিন তো নিরুপদ্রব জীবন অতিবাহিত করলে, এখন শাহাদতের জন্য প্রস্তুতি নাও। তিনি ভণ্ড নবী মুসায়লামা কায্যাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইয়ামামাতে শহীদ হয়েছিলেন। 


নবী করীম (ﷺ) হজরত খালেদ ইবনে ওলীদ (رضي الله عنه)কে উকায়দার নামক এক নাসারার কাছে পাঠিয়ে বললেন, তুমি তাকে নীল গাভী শিকারে দেখতে পাবে। 


রসুলেপাক (ﷺ) এরকম বহু অদৃশ্য বিষয় ও ভবিষ্যতের খবর প্রদান করেছেন। মুনাফেকদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। মুমিনদের ব্যাপারেও বলেছেন যা তাঁদের জীবদ্দশায় সাংঘটিতব্য ছিলো। আবার তাঁদের ওফাতের পর যা ঘটবে, সে সব ব্যাপারেও তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। 


আরেকটি ঘটনাঃ রসুলেপাক (ﷺ) কে লাবীদ ইবনে আসাম নামক এক ইহুদী যাদু করেছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) এর মাথার চুলে গিরা লাগিয়ে সে যাদু করেছিলো। তিনি (ﷺ) তার নাম ধাম ও যাদুর উপাদান ও তার অবস্থান, সবকিছুই বলে দিয়েছিলেন। আখেরী জামানায় উম্মতের মধ্যে মন্দ কাজের প্রসার ঘটবে। এ সম্পর্কে তিনি (ﷺ) বলেছেন, আমানতদারী থাকবে না। শয়তানের শিঙ বের হবে। খেয়ানত ব্যাপকতর হবে। সমসাময়িকদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষের জন্ম হবে। পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে। নারীদের সংখ্যা বাড়বে। সম্পদ কমে যাবে। ফেতনা বৃদ্ধি পাবে। মানুষে মানুষে মিল থাকবে না। ভূমিকম্প হবে এবং হেজায থেকে অগ্নি বের হবে। এ সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে তারিখে মদীনা মুআযযামা গ্রন্থে। 


কিয়ামতের আলামত, হাশর নশর, কিয়ামত ও আখেরাতের অন্যান্য ভয়াবহ বিষয়াদি সম্পর্কে তিনি যা বলে গেছেন, সেগুলো লিপিবদ্ধ করলে তো একটি স্বতন্ত্র পুস্তকই হয়ে যাবে। এখানে তাঁর নবুওয়াত, নবুওয়াতের সত্যতা এবং মোজেজা প্রকাশের সাথে সম্বন্ধিত বিষয়গুলোরই অবতারণা করা হয়েছে। সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 





© | সেনানী এপ্স |

 
Top