প্রিয়নবী (ﷺ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
🖋ইমরান বিন বদরী

নাহমাদুহু ওয়া নুসল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বা’দ
যে বিষয়ে কলম ধরতে অনেকবার পিছপা হয়েছি, শতবার ভেবেছি আমার মতো অযোগ্য গুনাহগারের দ্বারা কি এ বিষয়ে কলম ধরা শোভা পায়, যার প্রশংসায় স্বয়ং রাব্বুল আলামীন নাম রেখেছেন (محمد) মুহম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), অর্থাৎ, প্রসংশিত, সেই দু’জাহানের সরদারের প্রশংসামূলক সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখতে গিয়ে বারবার সাহস হারিয়ে ফেলেছি আমি। তারপরও এই গোলামের নামটি কাল কিয়ামতের কঠিন সময়ে শাফায়াতে রাসূলের তালিকায় স্থান পাওয়ার আশায় আগ্রহী হয়েছি। আল্লাহপাকের দরবারে এই আশাটি রইলো। পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে, ৫৭০ ঈসায়ী সালের সোমবার, মরুপ্রান্তরে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে সোবিহ সাদিকে মা সৈয়্যদা আমিনার কোল আলোকিত করে স্র্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জন ধরার বুকে আগমন করেছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, জাহেলিয়াতকে আলোকিত করতে স্র্রষ্টার মহান ঐশীবাণী (আল-কুরআন) পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে ছৈয়্যদুল মুরছালীন শফিউল মুজনেবীন রহমাতুল্লিল আলামীন নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম। লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করছি আমি অধম সেই মহান নবীর একজন গুনাহগার উম্মত হতে পেরে।
অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তাদের মতে তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেরই চূড়ান্ত সফলতা অর্জনকারী এক ব্যক্তিত্ব। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল, তেমনি সফল সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও। জাহেলিয়াতের অমানিশা দূর করে বিশ্বজগতকে আলোকিত করে সমগ্র বিশ্ব-মানবতার জাগরণে তিনি-ই অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ। আমার আল্লাহপাকও বলেন –

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

“হে মাহবুব ! আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া-১০৭)

 প্রিয়নবী ﷺ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আসলে রাসুলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের প্রতিটা মুহূর্তের বর্ণনা করাটাও কোনো মানবের সাধ্য নেই। তাঁর একেকটা অংশের বর্ণনা করা আদৌ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তারপরও ৬৩ বছরের দুনিয়াবী হায়াতের বিশেষ বিশেষ কয়েকটি বর্ণনা করতে চেষ্টা করবো, ইনশাহ্ আল্লাহ।

 শৈশব কাল
হয়রত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব রসুল সল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ায় নুরানি শুভাগমনের প্রায় ছয় মাস পূর্বে পরলোকগমন করেন। তৎকালীন আরবের রীতি অনুসারে হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) সেবাযত্নে দেয়া হয়। তিনি তাঁকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা সেই ছোট্ট বয়সেই মানবকুলে ইনসাফের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন আমার দয়াল নবী, তা হচ্ছে তিনি কেবল হালিমার বুকের একটি দুধ-ই পান করতেন এবং অপরটি তাঁর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা তাঁকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লামকে আবারো দুধমা হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন তাঁকে ফিরে পেতে। এতে মা হালিমার আশা পূর্ণ হলো। এর কিছুদিন পর ৪ বছর বয়সে ঘটে যায় এমন এক অলৌকিক ঘটনা, যা মানবীয় জ্ঞানের ঊর্ধ্বে! সাধারণ আর অসাধারণের পার্থক্য নির্ণয়ে সহজতর পথ সুগম করতে তাঁর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেন ফেরেশতা হযরত জিব্রিল ও মিকাইল (আ:)। এই ঘটনাটি ইসলামী ইতিহাসে বক্ষ বিদারণের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।
এই ঘটনার পরই হালিমা রাসুলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লামকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের কাছে কাটান। এই সময় একদিন মা আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোনো আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর যিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। মা আমিনা, ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব-ই তাঁর দেখাশোনা করতে থাকেন। বয়স যখন ৮ বছর তখন দাদা-ও মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পুত্র আবু তালিবকে রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লাম-এর দায়িত্ব দিয়ে যান। এরপর মহানবী (দ:)-এর ১০ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার মক্কার অদূরে অলৌকিকভাবে বক্ষ মুবারক বিদারণ হয়।

সিরিয়া গমন

ব্যবসায়ী আবু তালিব আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বয়স যখন ১২ বছর, তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেননা। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস নামের এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লামকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের কারণে পরিচিত মহলের সবাই তাঁকে “আল-আমিন”الامين (বিশ্বস্ত) বলে সম্বোধন করতেন। বিশ্বনবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রের উত্তম প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেন –

وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ

অর্থাৎ: নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। (সূরা আল-কালাম ৪)

হিলফুল ফুযুল
মহানবী (দ:) আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা, খেয়ানতপ্রবণতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্যই হিলফুল ফুযুল গঠন করেন এবং ১৬ বছর বয়সে এই সংঘকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বড় ভূমিকা রাখেন।

ব্যবসা এবং বিবাহ
তিনি ১৭ বছর বয়সে ব্যবসায় শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে সফর করেন। রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লাম-এর সুখ্যাতি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ তা অবহিত হয়েই তাঁকে নিজের ব্যবসার জন্য সফরে যাবার অনুরোধ জানান এবং মহানবী (দ:)-ও তাঁর ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৫ বছর বয়সে বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার সাথে রাসূল (দ:)-এর বিয়ে হয়। বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপরে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লাম বলেন যে তিনি তাঁর অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় হযরত খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার বয়স ছিল ৪০। মা ফাতিমাতুজ জহরা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁরই সন্তান।

হাজরে আসওয়াদ স্থাপন
আমাদের কমলিওয়ালা নবী (দ:)-র বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কা’বা গৃহের পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি কারণে কাবা গৃহের সংস্কার কাজ শুরু হয়। পুরোনো ইমারত ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়। এখানে পাথর স্থাপন নিয়ে গোত্রিক সমস্যা দেখা দিলে সিদ্ধান্ত হয় যিনি সকালে কাবা ঘরে আসবেন তিনি-ই পাথর স্থাপন করবে। সেদিন সকালে সবার আগে আমাদের দয়াল নবী (দ:)-এর আগমন হয়েছিলো। এভাবে পুনঃনির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) যথাস্থানে তিনি স্থাপন করেন।

নবুয়তের ঘোষণা
দয়াল নবীর ৩৭ বছর বয়সে নূর পাহাড়ের হেরা গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ধ্যানে মগ্ন থেকে ৪০ বছর বয়সে হযরত জিব্রাইল (আ:) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রেরিত (প্রথম অহি) বাণী নিয়ে আসেন এবং পড়তে বলেন –
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন;
خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ

সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে;
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ

পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু,
الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ

যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না। (সুরা আলাক ১-৫)
সে সময় ওয়ারাকা বিন নওফেল ভবিষ্যৎ বাণী করেন। বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি প্রথম (মহিলা) মুসলমান। মহানবী (দ:)-এর ৪১ বছর বয়সে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত জায়িদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি সাফা পাহাড়ের পাশে, হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহুর গৃহে অবস্থান ও গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। অতঃপর হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু-সহ ৪০ জন নারী-পুরুষের ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবেই প্রথম পর্যায়ে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং এই প্রচারকাজ চলতে থাকে সম্পূর্ণ গোপনে। নবুয়তের তৃতীয় বর্ষে প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন এবং কুরাইশরা এর বিরোধিতা করে। তাদের বিরোধিতার মূল কারণ ছিল একত্ববাদ নিয়ে। তারা মূলতঃ বহু ইলাহ্ তথা উপাস্যের প্রতি বিশ্বাসী ছিলো। বহু দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করতো তারা। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লাম যখন তাদের মাঝে এক ইলাহ্-এর কথা বললেন, তখন শুরু হলো বিরোধিতা। ফলে মক্কায় বিরোধিতার সম্মুখীন হন এবং বয়স যখন তাঁর ৪৬ বছর, তখন সংঘবদ্ধভাবে দয়াল নবীর ওপর কুরাইশরা নির্যাতন চালায়। ধীরে ধীরে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চরম রূপ ধারণ করে, তখন নবীﷺ কিছু সংখ্যক মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়ায়) হিজরত করতে পাঠান। সেখান থেকেও কুরাইশরা মুসলিমদের ফেরত আনার চেষ্টা করে, যদিও তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর কারণে তা সফল হয়নি। যাঁর গায়েবানা জানাজা পড়েছিলেন আমাদের গায়েবের খবর-দাতা নবীﷺ।

কুরাইশদের অবরোধ এবং চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত করা
নবুয়তের ৭ম বর্ষে ইসলামের ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে, তা হলো চাচা হযরত হামযা রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু এবং কুরাইশ নেতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তালা আনহুর ইসলাম গ্রহণ। এরপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে বয়কট ও শে’আব উপত্যকায় চাচা আবু তালেবসহ অন্যান্যদের ৩ বছর একঘরে ও অবরোধ করে রাখে তারা। ওই সময় ঘটেছিলো আরেক মুজেজায়ে রাসুল, যার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আধুনিক যুগে নয় শুধু, ১৪০০ বছর অতিবাহিত হলেও আদৌ তার বর্ণনা মানবমণ্ডলীর করা সম্ভব হয়নি। বস্তুতঃ নবীদের মুজেজা তাকেই বলে যা সাধারণ জ্ঞানে ব্যাখ্যার বাইরে। আর তা হলো, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লাম-এর শাহাদত আঙ্গুলের ইশারায় আকাশের চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত করা (শক্বক্বুল ক্বামার)। অবিশ্বাসীরা বলেছিল, মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসল্লাম আপনি যদি আকাশের পূর্ণিমার চন্দ্রটিকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আমরা আপনার নবুওয়াতে বিশ্বাস করবো। তখন আল্লাহর নির্দেশে শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা মাত্র চন্দ্র দ্বি-খণ্ডিত হয়ে এক খণ্ড সাফা পাহাড়ে, আরেক খণ্ড মারওয়া পাহাড়ে এসে পড়লো। তখন অবিশ্বাসীরা এটাকে জাদু বললো।
পবিত্র কুরআনের সূরা কমরের ১,২ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন –
اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ

কেয়ামত আসন্ন,চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।
وَإِن يَرَوْا آيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ

তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা তো চিরাগত জাদু।

 

তায়িফ গমন
মহানবী (দ:)-এর ৫০ বছর বয়সে কুরাইশদের সামাজিক বয়কটের সমাপ্তি হয়। বয়কটের পরের বছর ছিল দুঃখের বছর, কারণ এই বছরে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চাচা আবু তালিব ও হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্তি) হয়। এরপর ইসলাম প্রচারের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে তিনি তায়িফ গমন করলেও সেখানে তিনি বিরূপ আচরণ ও উপহাসের শিকার হয়ে নির্মমভাবে নির্যাতিত হন। তবুও তিনি একত্ববাদের হাল ছাড়েননি; বরং সেখানেও তিনি ইসলাম প্রসারের সম্ভবনার কথা চিন্তা করতে থাকেন।

 

মি’রাজে গমন
মক্কায় মে’রাজের রাত্রে আবারো মানব মস্তিষ্ক ও জ্ঞানের ঊর্ধ্বে তাঁর বক্ষ মুবারক বিদারণ করা হয় এবং মক্কা থেকে ২৬ রজব সোমবার দিবাগত রাত্রে তিনি মিরাজে গমন করেন। প্রথমে তিনি মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসায় যান; এই ভ্রমণ ইসলামে ‘ইসরা’ নামে পরিচিত। মসজিদুল আকসা থেকে তিনি একটি বিশেষ যানে করে উর্ধ্বারোহণ করেন এবং মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেন এবং এ সময় তিনি বেহেশ্‌ত ও দোযখ-সহ মহাবিশ্বের সকল স্থান প্রত্যক্ষ করেন। মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের বিধান তিনি এ সময় নিয়ে আসেন। এটি এমন এক অভাবনীয় বিশ্ময়কর ঘটনা যার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহপাক বলেন –
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ

পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত – যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। (সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত ১)

ইয়াশ্রাবে হিজরত
হুজুরপাক সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ৫১ বছর, তখন মক্কায় যে খোদাপ্রদত্ত দায়িত্ত্ব নিয়ে আসেন তা প্রচার-প্রসারে বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে পরবর্তিতে ৫৩ বছর বয়সে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তালা আনহুকে সাথে নিয়ে তিনি ইয়াশ্রাবে হিজরত করেন যা বর্তমান মদিনা নামে খ্যাত। এদিকে এর মাঝে অনেক মদিনাবাসী গোপনে আকাবা নামক স্থানে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে দয়াল নবীﷺ -কে তাদের সেখানে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে যান, যা ‘আকাবার শপথ’ নামে সুপরিচিত। এখানে আরো অনেক ঘটনা রয়েছে: মক্কার কুরাইশরা চিরতরে ইসলামের আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্য ‘দারুন নদোয়ার’ বৈঠকে সিদ্বান্ত নিয়েছিল তারা ১০ কি ১২জন যুবককে পুরস্কৃত করার লোভ দেখিয়ে পাঠিয়েছিলেন; এমনকি হুজুরে পাকের ঘর ঘেরাও করেও হতাশ হয়েছিল এসব যুবক। অন্যদিকে হিংস্রদের কালো থাবা থেকে রক্ষার আশায় মক্কার অদূরে ‘গারে সওরে’ আশ্রয় নেন আমাদের দয়াল নবী তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী মা আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার বাবা সিদ্দীকে আকবরকে নিয়ে। সেখানেই ঘটেছিলো ইসলামের আরেক অলৌকিক ঘটনা। গর্তের মুখে মাকড়সার বাসা দেখে ওই সমস্ত নালায়েক কাফিরের বাচ্চা বুঝতেই পারেনি এখানে পয়গম্বর (দ:)-এর অবস্থান আছে। এভাবেই হুজুরপাক সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের মক্কী যুগের সমাপ্তি ঘটে।
সম্মানিত বন্ধুরা, আমি এভাবে যদি লিখতে যাই তবে আদৌ শেষ করতে পারবোনা। তাই সংক্ষেপে ইতি টানতে হবে। হিজরত পরবর্তী ঘটনাটি হযরত আয়ুব আনসারী সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পোস্টে তুলে ধরেছি। ওখানে বিস্তারিত রয়েছে।

 

মাদানী জীবন
এরপর শুরু হয় মাদানী জীবন। যে ইয়াশ্রাবে ছোটবেলায় গিয়েছিলেন আম্মাজান মা আমিনার সাথে, তা আমাদের দয়াল নবীর পদার্পণে নাম পরিবর্তন করে হয়ে গেল (مدينة رسول )মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। প্রভাতে সূর্যের উদয় হলে যেমন রাতের অাঁধার বিদায় নিতে বাধ্য হয়, তেমনি নূর নবী আল্লাহর পেয়ারা হাবিবের শুভ পদার্পণে ইয়াশ্রাব আলোকিত হয়ে যায়।
➲ হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু তখন অল্পবয়সী বালক ছিলেন। তিনি বলেন, যেদিন রাসুল ﷺ মদিনা শরিফে তাশরিফ আনেন, সেদিনের চেয়ে আলোকোজ্জ্বল এবং অনিন্দ্য সুন্দর দিন আমি আর দেখিনি।
সে সময়ে মদীনায় বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল বনু আওস ও বনু খাজরাজ। আমাদের রাসূল ﷺতার মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ৫৪ বছর বয়সে মদীনা শরীফে ইহুদী ও পৌত্তলিকদের সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতিসহ ৫০দফার মতো একটি লিখিত সনদ স্বাক্ষরিত হয় (পৃথিবীর ইতিহাসে এটি প্রথম লিখিত সনদ) যা ইসলামের ইতিহাসে মদীনার সনদ নামে পরিচিত। এই সনদের মাধ্যমে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে আওস, খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র বনু কাইনুকা, কুরাইজা এবং বনু নাদির-সহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে পরবর্তীকালে মদীনা একটি ইসলামী স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ওই বছর আমাদের রাসূল ﷺ মদিনায় ছোট্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা বর্তমান (المسجد النبوي) মসজিদে নববী শরীফ নামে পরিচিত।
➲ হযরত আবদুল্লাহ ইবনুূু উমর রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় মসজিদ তৈরি হয় কাঁচা ইট দিয়ে, তার ছাদ ছিল খেজুরের ডালের, খুঁটি ছিল খেজুর গাছের। খলীফা হযরত আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু এতে কিছু বাড়ান নি। অবশ্য খলীফা হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু বাড়িয়েছিলেন। আর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে যে ভিত্তি ছিল তার ওপরই কাঁচা ইট ও খেজুরের ডাল দিয়ে তার ভিত্তি নির্মাণ করেন এবং তিনি খুঁটিগুলো পরিবর্তন করে কাঠের (খুঁটি) লাগান। তারপর খলীফা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু তাতে পরিবর্তন সাধন করেন এবং অনেক বৃদ্ধি করেন। তিনি দেয়াল তৈরি করেন নকশী পাথর ও চুন-সুরকি দিয়ে। খুঁটিও দেন নকশা করা পাথরের, ছাদ বানান সেগুন কাঠ দিয়ে। (সহীহ বুখারী)
এরপর ২য় হিজরিতে আযান, ইকামত ও জামাতের প্রবর্তন, যাকাত দেওয়া, আর রমযানের রোযা ফরয করা হয়। রোজা ফরয করা প্রসঙ্গে আল্লাহতা’লা বলেন –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারো। (সূরা বাক্বারাহ ১৮৩)

বদরে বিজয় অর্জন
মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সাথে এর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। ফলে ২য় হিজরীর ১৭ রমজান মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ সালে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কাফিরদের আক্রমণের মোকাবেলায় আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় অর্জন করে। বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ। মক্কার কাফেররা ১ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে সমবেত হয় বদর প্রান্তরে। আর আমাদের প্রিয় রাসূল ﷺ মাত্র ৩১৩ জন সৈনিককে নিয়ে উপস্থিত হন বদর প্রান্তরে। অসম এ যুদ্ধে আল্লাহ পাক মুসলমানদের সাহায্যে করেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন –
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِينَ

আর লড়াই করো আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানে বলেন –
وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللّهُ بِبَدْرٍ وَأَنتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُواْ اللّهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

বস্তুতঃ আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। (আয়াত ১২৩)
আল্লাহ তায়ালা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও বদর প্রান্তরে মুসলমানদের বিজয় ও সফলতা দিয়েছেন।

এরপর পবিত্র কাবার দিকে মুখ করে নামায পড়ার নির্দেশ হয়। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু’র সাথে হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু তালা আনহার শুভ বিবাহ হয়।
পরবর্তী সময়ে ৬২৫ সালের ২৩ মার্চে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে প্রথম দিকে মুসলমানরা পরাজিত হলেও শেষে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। ৬২৭ সালে আবু সুফিয়ান কুরাইশদের আরেকটি দল নিয়ে মদীনা আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে তারা পরাজিত হয়। যুদ্ধ বিজয়ে উৎসাহিত হয়ে মুসলমানরা আরবে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হন। ফলে আশপাশের অনেক গোত্রের ওপরই মুসলিমরা প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হযন।

হুদাইবিয়ার সন্ধি
আমাদের দয়াল নবীরﷺ বয়স যখন ৫৯ বছর, তখন পবিত্র কুরআনে যদিও মুসলিমদের হজ্জ্বের নিয়ম ও আবশ্যকীয়তা উল্লেখ করা আছে, তথাপি কুরাইশদের শত্রুতার কারণে মুসলিমরা হজ্জ্ব আদায় করতে পারছিলেন না। দয়াল নবী হজ্জ্ব করার জন্য মনস্থির করে ৬ হিজরীতে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবা নিয়ে মক্কার পথে যাত্রা করেন। কিন্তু এবারও কুরাইশরা বাধা দেয়। অগত্যা মুসলিমরা মক্কার উপকণ্ঠে হুদাইবিয়া নামক স্থানে ঘাটি স্থাপন করেন। এখানে কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইতিহাসে (صلح الحديبية) হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। এই সন্ধি মতে মুসলমানরা সে বছর হজ্জ্ব করা ছাড়াই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেই সন্ধির বছর হযরত খালেদ ইবনে অলিদ (রা:) ও হযরত আমর রাদিয়াল্লাহু তালা আনহু ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

দাওয়াতের বছর
সপ্তম হিজরীতে আমাদের মহানবী (দ:)-এর ৬০তম দুনিয়াবী হায়াতের বছরটি ছিলো বিভিন্ন দেশে রাজা বা বাদশাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর বছর। সেই সময় খাইবার বিজয় থেকে শুরু করে তিনি মিশর, আবিশিনীয়া, রোম ইত্যাদি দেশে শান্তির বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন। প্রেরিত দূতগণের তালিকায় আছেন –

দাহিয়া ক্বালবীকে রোমসম্রাট কায়সারের (হিরাক্লিয়াস) কাছে;
আবদুল্লাহ বিন হুযায়ফা আস-সাহমীকে পারস্যসম্রাট কিসরা বা খসরু পারভেজের (খসরু ২) কাছে;
হাতিব বিন আবূ বুলতা’আ কে মিশরের (তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার) শাসনকর্তা মুকাউকিসের কাছে;

আমর বিন উমাইয়া’কে হাবশার রাজা নাজ্জাশীর কাছে;

সলীত বিন উমর বিন আবদে শামস’কে ইয়ামামার সর্দারের কাছে;

শুজা ইবনে ওয়াহাব আসাদী’কে গাসসানী শাসক হারিসের কাছে; এবং
আল আলা আল হাদরামিকে বাহরাইনের শাসক মুনজির ইবন সাওয়া আল তামিমি’র কাছে।
শাসকদের মধ্য হতে বাদশাহ নাজ্জাসী ও মুনজির ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এরপর হজ্ব ফরয হওয়ার হুকুম হয়। মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন –
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا

মানুষের মধ্যে যারা কাবা শরীফ পৌঁছুতে সক্ষম, তাদের প্রতি আল্লাহর ঘর জিয়ারত করা ফরজ।
(সূরা আলে ইমরান ৯৭)

 

মক্কা বিজয়
ইসলামের ইতিহাসে মক্কা বিজয়ের ঘটনা এমন একটি আযীমুশ শান ঘটনা, যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর দ্বীন এবং তাঁর রসূল (দ:)-কে শক্তিশালী করেছেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে দয়াল নবী ﷺ দশ হাজার সাহাবীর বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। সেদিন ছিল অষ্টম হিজরীর রমজান মাসের দশ তারিখ। বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘর্ষ ছাড়া মোটামুটি বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজিত হলো এবং আমাদের দয়াল নবীﷺবিজয়ীবেশে সেখানে প্রবেশ করলেন। আর বারবার উঁচু আওয়াজে পড়ছিলেন –
إِنَّا فَتَحۡنَا لَكَ فَتۡحٗا مُّبِينٗا

‘নিশ্চয় আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি। (সূরা ফাতহ,আয়াত -১)
তিনি মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। অতঃপর আমার নবী সর্বপ্রথম কাবাঘরে আগমন করে সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস (৩৬০টি) করেন। এ সময় তিনি এই আয়াতটি পাঠ করছিলেন –

وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا

‘‘বলো: সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।’’ (সূরা বানী ইসরাঈল ৮১)
মুসলমানদের শান-শওকত আর আমাদের নবীরﷺ ক্ষমার গুণে মুগ্ধ হয়ে অধিকাংশ মক্কাবাসী-ই ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লাহ পাক মুসলমানদের বিজয়ের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন –
إِذَا جَاء نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ

যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়
وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا

এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন । (সূরা নছর ১-২ আয়াত)

 

হজ্জাতুল-বিদা বা বিদায় হজ
মহানবী (দ:) দশম হিজরীর জিলক্বদ মাসে মানুষদেরকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি এবার হজ্জে যাচ্ছেন। এতদশ্রবণে মুসলমানরা আমাদের নবীরﷺসঙ্গে হজ্জ্বে গমনের আশায় প্রস্তুতিগ্রহণ শুরু করে দেন। এই খবর মদিনার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেসব এলাকার লোকেরাও দলে দলে মদিনায় এসে উপস্থিত হন। পথিমধ্যে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ কাফেলায় শামিল হন যে, এর সংখ্যা নিরূপণও কষ্টসাধ্য ছিল। এ ছিল যেন এক মানব সমুদ্র! সামনে পিছনে ডানে বামে যতোদূর দৃষ্টি যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ মহানবীকে ﷺ ঘিরে রেখেছে। তিনি মদিনা থেকে ২৫ জিলক্বদ বাদে জোহর তালবিয়া পাঠ করতে করতে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হন।
لبيك اللهم لبيك ، لاشريك لك لبيك ، إن الحمد والنعمة لك والملك لاشريك

মক্কায় তিনি কয়েকদিন অবস্থান করে মিনায় গমন করেন। অতঃপর সেখান থেকে আরাফাত প্রান্তরে রওয়ানা হয়ে ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করলেন। এই সময় সূরা মায়েদার এ আয়াতটি নাজিল হয় –
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا

আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার দান সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।(সূরা মায়েদাহ ৩)
অবশেষে বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার ৮০ দিন পর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ৬৩ বছর বয়সে সন্ধ্যায় তিনি মদিনায় হযরত মা আয়িশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে বেসাল লাভ তথা পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হন এবং সেই ঘরেই সকল মু’মিনের প্রাণের মধ্যমণি পবিত্র রওজা-এ-পাক অবস্থিত; যেখানে শুয়ে আছেন আমাদের কমলিওয়ালা নবী (দ:)।

 

পরিশেষে, আমার অজ্ঞতার কারণে ভুল হলে রহমাতুল্লীল আলামীন (দ:)-এর দিকে তাকিয়ে আল্লাহপাক যেন আমায় ক্ষমা করেন

– ইমরান বিন বদরী

 
Top