বৃটিশ শাসনামলের ভারতীয় উপমহাদেশ "দারুল হারব" নাকি "দারুল ইসলাম": আ'লা হজরতের (রাহ:) ফতুয়ার তাত্ত্বিক ও বাস্তবতাভিত্তিক বিশ্লেষন
----------------------------------------
সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী

মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে চলুন দারুল হারব ও দারুল ইসলাম কি জিনিস প্রথমে তা জেনে নিই। 
দারুল ইসলাম: শেখ আব্দুল কাহির আল বাগদাদির এক সংজ্ঞামতে, 
‎كل بلد يعتنق أهله الإسلام ويتبع شرعه, يعتبر دار الإسلام
১."প্রত্যেক সেই দেশ যার জনগন (অপর সংজ্ঞায় এসেছে "সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন") ইসলাম গ্রহন করে নিয়েছে এবং ইসলামি আইন অনুসরন করে সেটাই দারুল ইসলাম।"

২.আবার অনেক ফোকাহা বলেন, 
‎ وهناك فقهاء آخرون يرون أنه يكفي أن يكون بوسع المسلمين القيام بواجباتهم الدينية لتسمية البلد دار الإسلام. إذا تمكن المسلمون من القيام بصلاة الجمعة بحريّة يُعتبر معياراً لكون البلد دار الإسلام أو دار الحرب. 

"অনেক ফোকাহা বলেছেন, দারুল ইসলাম বা দারুল ইমান হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যদি মুসলমানগন সেই দেশে তাদের ধর্মীয় আবশ্যক কাজগুলো আদায় করতে সমর্থ হন। যদি মুসলমানগন জুমআর নামাজ আদায় করতে পারেন স্বাধীনভাবে (তাতে কোন বাঁধা বিপত্তি না আসে) তবে এটাই হচ্ছে দারুল ইসলাম বা দারুল হারব হওয়ার মানদন্ড।"

দারুল হারব বা দারুল কুফর: 
১.وهي الأرض التي لا سلطان للمسلمين عليها

এক সংজ্ঞামতে, "যে দেশে মুসলমানদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই সেই দেশই দারুল হারব।"

২.অপর সংজ্ঞামতে, "যে দেশে মুসলমানগন স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় কাজগুলো আদায় করতে পারেন না সেই দেশই  দারুল হারব।"

 চলুন আমরা এখন উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে, আলা হজরত আজীমুল বারাকাত ইমাম আহমদ রেজা খান ফাজিলে বেরেলভী (রাহ:) এঁর সময়ে উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিই। তাঁর আরেকটি তাজদিদি খেদমতের আমরা বিশ্লেষন করার চেষ্টা করি। বৃটিশ শাসনামলে যখন "অসহযোগ আন্দোলন" (তাহরিকে তরকুল মুওয়ালা , Movement of abstaining Loyalty) শুরু হলো তখন অনেক রাজনীতিক ও উলামায়ে কেরাম এই বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশকে দারুল হারব (কাফিরের সাথে যুদ্ধ বিবাদমান দেশ) ঘোষণা দিয়ে সাধারন মুসলমানকে এই উপমহাদেশ ছেড়ে অন্য দেশে হিজরত করতে নির্দেশ প্রদান করেন। হিজরত করে চলে যাওয়ার আগে ঐ সমস্ত উলামায়ে কেরাম এবং রাজনীতিকগন বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ইংরেজ আহলে কিতাবদের সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক ত্যাগ করতে আদেশ দেন। অনেক বড় বড় আলিম এই আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এই ফলাফলে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন যে, কুরআন-হাদিস ও ফিকহি উসুলের ভিত্তিতে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত  ছিল নাকি বেঠিক! তার কারন ঐ একটাই, সত্যিকারের ইলমি বিশ্লেষন ও সামগ্রিক প্রয়াসের অভাব। ঐ বিষয়টি সম্পর্কিত "কুরআনের সকল আয়াত, সকল হাদিস, ফিকহি উসুল এবং পূর্ববর্তী ইমামগনের সকল মতামত এবং ঐ সময়কার বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন" এই সবগুলো গুরুত্বপূর্ন উপাদান এক জায়গায় জমা করে সত্যিকারের ইলমি বিশ্লেষনের অভাবই তাদেরকে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে (এই উপমহাদেশকে দারুল হরব বা দারুল কুফর ঘোষনা) পৌঁছাতে সাহায্য করে। 

কুরআন সবাই পড়েন এবং বুঝেন, হাদিস শরীফ সবাই পড়েন এবং বুঝেন , ফিকহের কিতাবও সবাই পড়েন এবং বুঝেন কিন্তু সবকিছুকে বিশ্লেষন করে একটি সুন্দর সিস্টেমে কোন বিষয়ের সমাধান যেভাবে আলা হজরত দিতে পারতেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম আলিমই দিতে পেরেছেন। যাইহোক, আলা হজরত ইমাম আহমদ রেজা খান ফাজিলে বেরেলভী (রাহ:) তখনকার সময়ের ঐ জটিল বিষয়টি নিয়ে একখানা কিতাব রচনা করেন যার নাম, "আল মুহাজ্জাতুল মু'তামিনা ফি আয়াতিল মুমতাহিনা"। ঐ কিতাবের মধ্যে আ'লা হজরত তাঁর ফিকহি জ্ঞানের এমন সুন্দর সিস্টেমেটিক বহি:প্রকাশ করেছেন যা আমার বিচারে আধুনিক আন্তর্জাতিক নাগরিক আইন (Public International Law) এবং  আন্তর্জাতিক ব্যক্তিগত আইন (Private International Law) এর ভূমিকাস্বরুপ কাজ করেছে। এই বিষয়ের উপর এই কিতাবটি অদ্বিতীয়। 

এই কিতাবে আলা হজরত এমন সব সর্বজনগ্রাহ্য কিতাবের রেফারেন্স দিয়েছেন যা ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি এখানে ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী (রাহ:) এঁর আল জামিউস সগির, সিয়ারুল কাবির ইমাম মুহাম্মদ (রাহ:)এঁর জাহিরুর রিওয়ায়াহ্, মুআত্তা ইমাম মুহাম্মদ, শরহে সাখসি, হেদায়া, নাতায়িজুল আফকার, ইনায়া, গায়াতুল বায়ান, কেফায়া, ফতহুল কাদির, বাহরুর রায়িক, গুনিয়াহ ইত্যাদি সর্বজনগ্রাহ্য কিতাবের রেফারেন্স এনে ব্যাপক এবং সার্বিক আলোচনা করেন। বিচ্ছিন্নভাবে এই বিষয়ের সমাধান ফিকহের কিতাবগুলোতে ছিল, কিন্তু সিস্টেমেটিক একাডেমিক সার্বিক আলোচনা (comprehensive academic criticism) তেমন কোন কিতাবে আসেনি। 

অত:পর আলা হজরত তাঁর কিতাব "আল মুহাজ্জাতুল মু'তামিনা ফি আয়াতিল মুমতাহিনা" তে বলেন, "হে ভাইয়েরা! মুওয়ালাহ, আনুগত্য বা Loyalty এর দুটি রুপ রয়েছে। একটি হচ্ছে হাকিক্বি (বাস্তবিক আনুগত্য) আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সুওয়ারি (বাহ্যিক আনুগত্য)। অত:পর এই দুটি রুপের দশটি ব্যবহারিক প্রয়োগ বর্ননা করেছেন যার নয়টি আসে মুওয়ালাহ, আনুগত্য বা Loyalty এর আওতাধীনে এবং অপর একটি রুপ আছে যা আসে মুআমালাত বা লেনদেনের আওতাধীনে। তারপর তিনি বলেন, তিনি বলেন, "হে ভাইয়েরা! আপনারা এখানে কোন মুওয়ালাহ, আনুগত্য বা Loyalty ত্যাগ করে হিজরত এর ফতুয়া দিচ্ছেন যার ফলে বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জীবিকা নির্বাহগত এবং শিক্ষার্জনের অধিকারগত ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছেন?" [প্রিয় পাঠক চিন্তা করুন,  আমরা যদি সেই সময়ে দারুল হরব ঘোষনাকারী উলামাগনের ফতুয়া শুনে সকল মুসলমান বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যেতাম তবে আজ এই স্বাধীন মুসলিম দেশগুলো(বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) কিভাবে পেতাম? কাজেই বাস্তবতাই প্রমান করে যে,  বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশকে দারুল ইসলাম বলে ঘোষনা করা আলা হজরতের সেই ফতুয়া ছিল তাঁর দূরদৃষ্টির ফসল। আর বৃটিশদের (আহলে কিতাব খ্রীষ্টান) শাসনাধীন ভারত যদি দারুল হরব হয়ে থাকে তবে বর্তমানে হিন্দু মেজরিটির (মুশরিক) শাসনাধীন ভারত কেন দারুল হারব হবে না? তখন যারা ভারতকে দারুল হরব বলে অসহযোগ আন্দোলন এবং ভারতত্যাগে মুসলমানদেরকে উৎসাহীত করেছিলেন তাদের অনুসারীরা এখন কেন এই হিন্দু শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করছেন না? কেন ভারত ত্যাগের ফতুয়া ইস্যূ করছেন না? এখন তো বহু জায়গায় মুসলমানগন হিন্দুদের হাতে নির্যাতিতও হচ্ছেন তাদের ধর্ম পালনের কারনে। এখন সেই ফতুয়া কেন পূনর্বহাল হচ্ছে না? এসব কিছুই প্রমান করে যে আলা হজরতের ফতুয়া কুরআন হাদিস এবং ফিকহি উসূল  মোতাবিক ছিল এবং এই ফতুয়া ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার ফসল। কারন লেখার শুরুতে উল্লেখিত দারুল হরব ও দারুল ইসলামের দ্বিতীয় সংজ্ঞাদ্বয় অনুযায়ী বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশ তখনও দারুল ইসলাম ছিল এবং এখনো দারুল ইসলামই আছে। তখনো স্বাধীনভাবে আমরা আমাদের ধর্মীয় ইবাদত বন্দেগী করতে পেরেছি এবং এখনো পারছি। বরং এখন মুসলমানগন ভারতে হুমকির সম্মূখীন বৃটিশ শাসনামলের চেয়ে। ]

আমাদেরই অনেক বড় বড় ইমামগন অনেকেই বৃটিশ ভারতকে দারুল হরব বলেছেন কারন তাদের কাছে প্রথমে উল্লেখিত দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের ১নং সংজ্ঞাদ্বয় প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত সংজ্ঞাদ্বয় এবং তখনকার ও বর্তমান বাস্তবতাই প্রমান করে যে আলা হজরত (রাহ:) এঁর বৃটিশ ভারত দারুল ইসলাম ঘোষনাকারী ফতুয়াই ছিল সঠিক ফতুয়া এবং তা ছিল দূরদর্শী। 

(শায়খুল ইসলাম আল্লামা প্রফেসর ড.মুহাম্মাদ তাহিরুল কাদেরী মা জি আ এঁর লেকচার অনুসরনে)
 
Top