অনেকেই বলে - আলা হযরত (রহ.) হচ্ছেন ইংরেজদের পক্ষে। তাই 'দারুল হরব’ মানেননি। অথচ ইমাম ছিলেন ঘােরতর ইংরেজ উপনিবেশ বিরােধী। ইমামের উপনিবেশ বিরােধিতার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।

এরদোগানের দেশ তুরস্ক। সে দেশেই জন্মায় ওসমানি সামাজ্য, ১২৯৯ সালে। ছড়ায় কয়েকটি মহাদেশে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটাতে। মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব - ইউরােপ, উত্তর - আফ্রিকায়। শাসন করে ছয় শতাব্দীর বেশি এবং এরাই মুসলিমদের শেষ প্রকৃত অভিভাবক। সুলতান সুলেমান সিরিয়াল দেখে ওসমানিদের চিনলে হবে না আবার। কানার হাতী দেখার অবস্থা হবে। কানকে কুলা ভাববাে পা - কে ভাববাে কারেন্টের খাম্বা।

যাকগে, ১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ। যুদ্ধে ছিল দুটি দল। এক দলে ওসমানি সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া - হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়া। একে কেন্দ্রীয় শক্তি বলে। অন্যদিকে মিত্রশক্তি - সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য বা ইংরেজ, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, রােমানিয়া ও অ্যামেরিকা। যুদ্ধে জিতে মিত্রশক্তি। এরপরে শুরু হয় বীভৎসতা। ওসমানিরা হেরেছে। বিপরীতে ছিল ধবলকুষ্ঠ ইংরেজ। এরা ওসমানি সাম্রাজ্যকে টুকরাে টুকরাে করে। জবাই হয় গালফ অঞ্চল। সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান সহ বহু তার জন্যতে থাকে। গর্ভস্থ হয় আজকে ইজরাইল।

১৯৪৮ এ হয় ভূমিষ্ট। এরই ধারাবাহিকে ১৯৩১ সালে সৌদ গোত্রবাদীরা সৌদি রাজা বানায়। সৌদদের উত্থানে ইংরেজরাই ইঞ্জিনিয়ার। "লরেন্স অব অ্যারাবিয়া" বিষয়টি পড়লেই সব স্পষ্ট হয় চোখের সামনে। এছাড়াও তুরস্কের হাকিকত কিতাবেভি থেকে প্রকাশিত "কনফেশন্স অভ আ ব্রিটিশ পাই" বইটি এক অনবদ্য প্রমাণ এ বিষয়ে। 

ইংরেজরা জানতাে বিশ্বমুসলিম বন্দুক - বােমায় থামবে না। তাই ইসলামের আবেগের আরবকে হাতিয়ার বান্যয়। কাটা দিয়ে কাঁটা তােলে। ধর্মের ভেতর ধর্ম ঢােকায়। মুসলিম উম্মাহর শরীরে ওহাবিতন্ত্রের ইঞ্জেকশন ঠোকে। দিশাহীন করে মুসলিমদের দর্শন, চেতনা ও একতার কেন্দ্রবিন্দু। ওহাবিবাদের জন্মদাতা ও রাখাল সৌদিরা এবং ইংরেজদের পুতুল।

এভাবেই শুরু মুসলিমদের লজ্জার ইতিহাস। যা আজও বয়ে চলছে। প্রসঙ্গে আসি ১৯০৯ সাল সিংহাসন হারান সুলতান আব্দুল হামিদ। তিনি ছিলেন ‘আস - সানী ' বা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। প্রদীপ নেভার আগে দপ করে জ্বলে। ওসমানিদের শেষ সময়ে তিনিও ছিলেন তেমন। ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন বিশ্বরাজনীতি। অসম্ভব মেধাবী, অকৃত্রিম মদিনাপ্রেমিক ছিলেন। অনেক বুজর্গ তাঁকে অলি - আল্লাহও বলেছেন।

১৯১৩ সাল। ভারতের উত্তরপ্রদেশে বারেলি শহর। এ শহরেই থাকতেন ইমাম(আলা হযরত)। ইমামের কাছে চিঠি আসত। বিশ্বের প্রায় প্রতি - প্রত্যেক প্রান্তের চিঠি। দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, রেঙ্গুন থেকেও চিঠি গিয়েছিল। চিঠিতে থাকত প্রশ্ন। ইমামের কাছে সমাধান চাইত। এই সমাধানকে এক পরিভাষায় ফতােয়া বলতে পারেন। 

তো এমনি এক চিঠি আসল। প্রশ্ন করেছে এক জনৈক যায়েদ। এটি ছদ্মনাম। মাজারে আলো জ্বালানো জায়েজ কি না - এটাই আসল প্রশ্ন। কিন্তু যায়েদ আলো জ্বালানোর বিপক্ষে অনেক যুক্তি ও যুক্ত করেছে। এবং এ কথাও জোর দিয়ে লিখেছে যে - মদীনা মুনাওয়ারা তে আলো জ্বলে এই যুক্তি সে মানে না।

তার দাবী - এটি অটোমান বা টার্কি সুলতান আব্দুল হামিদ চালু করেছেন। সুলতানের কোনাে কাজ নাকি বৈধ নয়। এমনকি সুলতানকে প্রকাশ্য পাপী বলেও উল্লেখ করে। ইমাম তৎক্ষণাৎ বিরােধিতা করেন। এবং ৪০টি দলীল দাঁড় করান। যা প্রমাণ করে যায়েদের যুক্তির নিরেট মূর্খতা। 

ইমাম বলেন - ইসলামের সুলতানকে মিথ্যে দােষারোপ করা গুরুতর অপরাধ, যায়েদ এজন্য দোষী সাব্যস্ত। এও বলেন - যায়েদ পুরাে চিঠি খুব মনােযোগ দিয়ে লিখেছে। পুরো চিঠি উর্দু ভাষায়। কিন্তু সুলতানের নামের আগে লিখেছে টার্কি সুলতান ’ যা নিতান্তই ধৃষ্টত।

মিশরকে ইংরেজিতে বলে ইজিপ্ট। ভারতকে ইন্ডিয়া। ঠিক সেভাবে তুর্কিকে বলে টার্কি। ইমাম এটাই বুঝিয়েছেন - পুরাে চিঠি উর্দুতে লিখল। কিন্তু সুলতানের নামের আগে ইংরেজিতে টার্কি লিখল কেন? এটা শুধুই সুলতানের প্রতি বিদ্বেষ। আর ইংরেজদের তুর্কিকে টার্কি বলার পেছনে একটি বাজে মনােভাব কাজ করত।

 এজনাই ইমাম ‘ টার্কি ব্যবহারকে উদ্দেশ্যপ্রসূত সাব্যস্ত করেন। এরপর সুলতানের প্রশংসা করেন এবং আত - তাবারানি ও আল - বায়হাকির একটি হাদিস উল্লেখ করেন। যার অর্থ - সুলতান (ন্যায়পরায়ন শাসক) পৃথিবীর। মাটিতে আল্লাহর ছায়া। যারা সুলতানকে সম্মান করে আল্লাহ তাদের সম্মান দিক এবং তাদের অপমানিত করুক যারা সুলতানকে অপমান করে। 

(পুরাে চিত্রটি বারিক উল মানার বি শুমু'ইল মাযার নামে লিপিবদ্ধ হয়। পাবেন ফতোয়ায়ে রেজভিয়া , ৯ম খনৃড, ৫৩৮ পৃষ্টায়)

এখন কয়েকটি পয়েন্ট করি। এক. ব্রিটিশ উচ্চারণে টার্কি লেখাতে ইমাম তীব্র বিরােধিতা করেছেন। দুই. ইমাম সুলতানের প্রশংসা করেছেন। তিন. সুলতানের চিরশত্রু ছিল ইংরেজ বা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ।

তাহলে কী কী পেলাম? এক - সুলতানের সমর্থক কখনাে ব্রিটিশপ্রেমি হতে পারে না। দুই - ইমাম ইংরেজি ঢঙে, স্টাইলে সুলতানের নাম লেখাটা পর্যন্ত মেনে নেননি। এতটাই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ছিলেন। এখানেই কী প্রমাণ হয় না, ইমাম ছিলেন সুলতান আব্দুল হামিদের একনিষ্ঠ সমর্থক? আর সুলতানের একনিষ্ঠ সমর্থক ব্রিটিশ পক্ষের হয় কী করে? প্রশ্নটা আপনাদের কাছেই রাখলাম।

 সে সময়ে ডাকটিকিট ছিল। চিঠির গায়ে লাগাতে হত। সেটা ছাড়া চিঠি যেত না। ইমামও চিঠি পাঠাতেন। ডাকটিকিট তাঁকেও লাগাতে হত, উপায় ছিল না। সেই ডাকটিকিটে ছিল রাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি। তিনি করতেন কী, রাণীর ছবি উল্টে দিতেন। মাথা নিচে, ঘাড় উপরে করতেন (জ্ঞানীর জন্য ইশারাই যথেষ্ট)। 

ইংরেজদের কোর্টেও যাননি কখনাে ইমাম। বলেছেন - আমার জুতোও ইংরেজদের আদালতে যাবে না। এটি দম্ভ না ; আত্মসম্মান, স্বকীয়তা, জাতীয়তাবােধ। আরবিতে আদল মানে ন্যায়। আদল থেকে আদালত এসেছে। ইমাম বলেছিলেন - ইংরেজদের আদালতে আদল নেই, তাই সেটি আদালতই নয়। ইমাম ইংরেজ আদালতকে বলতেন কাচারি।

পরিশেষে এটাই প্রমাণ হয় ইমাম আলা হযরত (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন কঠোরভাবে ইংরেজ বিরোধী। 

সূত্র- পথিকৃৎ।  
 
Top