ই‘তিকাফঃ ফাযায়েল ও মাসায়েল
-মুফতি আলমগীর হোসাইন আন-নাজিরী
------------------

‘ই‘তিকাফ’-এর শাব্দিক অর্থ- অবস্থান করা, কোন বস্তুর উপর স্থায়ীভাবে থাকা।

শরীয়তের পরিভাষায়- ই‘তিকাফ বলা হয়, পুরুষের জন্য নিয়্যতসহ এমন মস্জিদে অবস্থান করা, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামা‘আত অনুষ্ঠিত হয়। আর মহিলাদের জন্য ই‘তিকাফ হল, নিয়্যতসহ ঘরের ভিতর নামাযের জন্য নির্দিষ্ট কোন স্থানে অবস্থান করা।

ই‘তিকাফ শরিয়াসম্মত একটি আমল হওয়ার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
-“আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে (কা‘বা) তাওয়াফকারীদের জন্য, ই‘তিকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকু‘-সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখে।” (সুরা বাকারা: ১২৫)

অন্য আয়াতে এসেছে:
وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ
-“আর মসজিদে যখন তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় থাকবে তখন স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত থেকো। সিয়ামের ব্যাপারে এগুলোই হলো আল্লাহর সীমারেখা।” (সুরা বাকারা: ১৮৭)

★ ই‘তিকাফ কেন করব বা এর ফযিলত ও গুরুত্ব কী?

* যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ই‘তিকাফ করবে, আল্লাহ্ তাঁর এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও জমিনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (ইমাম হাকিম, আল-মুসতাদরাক: ৪/৩০০; ইমাম বায়হাক্বি, শু‘আবুল ঈমান, হাদিস: ৩৯৬৫; ইমাম হাকিম, মুনযিরি ও হাইছামি হাদিসটির সনদকে শক্তিশালী বলেছেন)

* হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
من اعتکف عشرا فی رمضان کان کحجتین و عمرتین
-“যে ব্যক্তি রমাদ্বান মাসের দশদিন ই‘তিকাফ করলো, সে যেন দু’টি হজ্জ ও দু’টি উমরা আদায় করলো। (বায়হাক্বি)

* হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত,
عن ابن عباس’ عن النبی صلی اللہ علیہ وسلم انہ قال فی المعتکف; انہ معتکف الذنوب.ویجری لہ من الاجر کاجر عامل الحسنات کلہا
-“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই‘তিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে গুনাহ পরিত্যাগকারী। সমবসয় কোন পূণ্যের কাজে অংশগ্রহনকারীর মতো সে ছাওয়াব পাচ্ছে। (শু‘আবুল ঈমান, হাদিস নং- ৩৬৭৮)

★ ই‘তিকাফ কখন করব?

* হযরত আবু সা‘ঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুর্কি তাবুতে রমাদ্বান মুবারকের প্রথম দশ দিন ই‘তিকাফ করেছেন। এরপর দ্বিতীয় দশ দিন, তারপর তাবু থেকে মাথা মুবারক বের করে বললেন, আমি এ (ক্বদরের) রাতের অনুসন্ধানে প্রথম দশ দিন ই‘তিকাফ করেছি, এরপর দ্বিতীয় দশ দিনও। আর স্বপ্নে একজন ফেরেশতা এসে আমাকে বললেন যে, এ রাতটি রমাদ্বানের শেষ দশকে। কাজেই যে আমার সঙ্গে ই‘তিকাফ করেছে, সে যেন শেষ দশ দিনও ই‘তিকাফ করে। আমাকে এ রাতটি দেখানো হয়েছিল এবং তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। (আমি স্বপ্নে) দেখেছি যে, এ রাতের সকালে ফজরের নামাযে আমি পানি ও কাঁদা মাটিতে সিজদা করেছি। তোমরা এ রাতের অনুসন্ধান করবে শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে।

* রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমাদ্বানে দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফে কাটান। (তিরমিযী: ৮০৮)

* মুসলিম শরিফের বর্ণনায় এসেছে:
عَنْ عَائِشَةَ – رضى الله عنها – أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ
-“হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ওফাত শরিফ পর্যন্ত রমাদ্বানের শেষ দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। অতঃপর তাঁর পরে তাঁর সম্মানিত বিবিগণ ই‘তিকাফ করতেন।” (মুসলিম)



★ রমাদ্বানের শেষ দশকের ই‘তিকাফের শুরু এবং শেষ

* রমাদ্বান মাসের শেষের দশ দিনের সুন্নাত ই‘তিকাফের জন্য রমাদ্বানের বিশ তারিখ আছরের পর সূর্যাস্তের পূর্বে নিয়্যত করে মস্জিদে প্রবেশ করবে এবং চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে ই‘তিকাফ খতম করবে। সুন্নাত ই‘তিকাফের নিয়্যত রমাদ্বানের বিশ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বেই করতে হবে। যদি সূর্যাস্তের পর নিয়্যত করে, তবে এ ই‘তিকাফ সুন্নাত থাকবে না বরং নফল হয়ে যাবে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২০ রমাদ্বানের সূর্যাস্তের পূর্বেই মসজিদে বসে ঘোষনা দিয়েছেন, যে আমার সাথে ই‘তিকাফ করতে ইচ্ছুক, সে যেন শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে। (বুখারি: ২০২৭; মুসলিম: ১১৬৭; ফাতহুল বারী: ৪/২৮৩; মুহাল্লা: ৫/১৯৮)

কোন কোন হাদিসে বাদ ফজর রাসুলুল্লাহর মসজিদে প্রবেশের বর্ণনা রয়েছে, সে হাদিস ইমামগণ গ্রহণ করেন নাই।

* ই‘তিকাফ শেষ করবে শাওয়ালের চাঁদ দেখার সংবাদ শুনার পর। (বাহরুর রায়িক, ইবনু নুজাইম: ২/৩২৯, শামী: ২/৪৫২)

★ ই‘তিকাফ কোথায় করব?

ই‘তিকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো-
* মসজিদুল হারাম।
* এরপর মসজিদে নববী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
* এরপর মসজিদে আক্বসা।
* এরপর ঐ জুমু‘আর মসজিদ- যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা‘আতের সাথে আদায় করা হয়।
* এরপর সে মসজিদ- যেখানে মুসল্লির সংখ্যা অধিক হয়ে থাকে। (শামী)

★ ই‘তিকাফের প্রকারভেদ ও হুকুম

ই‘তিকাফ তিন প্রকার:
১. ওয়াজিব ই‘তিকাফ।
২. সুন্নাত ই‘তিকাফ।
৩. নফল ই‘তিকাফ।

১. ওয়াজিব ই‘তিকাফ:

কেউ ই‘তিকাফ করার মানত করলে তা আদায় করা ‘ওয়াজিব ই‘তিকাফ’। মানত দুই ধরনের হতে পারে:
* সাধারণ মানত।
* কোন শর্তের সাথে সম্পর্কিত মানত।

সাধারণ মানত হলো- যেমন কেউ বলল, আমি একদিন বা অমুক দিন ই‘তিকাফ করার মানত করলাম। আর শর্তের সাথে সম্পর্কিত মানত হলো- যেমন কেউ বলল, আমার অমুক উদ্দেশ্য পূরণ হলে আল্লাহ্’র ওয়াস্তে ই‘তিকাফ করব।

* মাস্আলা: মানতের ই‘তিকাফ সহিহ্ হওয়ার জন্য রোযা রাখা শর্ত। আর মানত সহিহ্ হওয়ার জন্য মানতের কথা মুখে উচ্চারণ করা শর্ত, মনে মনে নিয়্যত করার দ্বারা মানত হয় না।

২. সুন্নাত ই‘তিকাফ:

রমাদ্বান মাসের শেষ দশ দিনের ই‘তিকাফ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্ কিফায়া। মহল্লাবাসীর একজন তা আদায় করলে অন্য সকলে দায়মুক্ত হবে। আর কেউ আদায় না করলে তরকে সুন্নাতের জন্য সকলে দায়ী হবে। এ ই‘তিকাফের জন্যও রোযা রাখা শর্ত।

৩. নফল ই‘তিকাফ:

মানত ও রমাদ্বান মাসের শেষ দশ দিনের ই‘তিকাফ ব্যতীত অন্য সময়ের ই‘তিকাফ হল নফল। নফল ই‘তিকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত নয়। সময়ের ব্যপারেও কোন সীমাদ্ধতা নেই। দিনে বা রাতে যে পরিমাণ সময়ের জন্য ইচ্ছা নিয়্যত করে ই‘তিকাফ করা যাবে।

★ ই‘তিকাফ সহিহ্ হওয়ার শর্তাবলী

১. নিয়্যত করা; নিয়্যত ছাড়া ই‘তিকাফ সহীহ্ হবে না।
২. পুরুষর জন্য এরকম মসজিদ হতে হবে, যেখানে জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করা হয়। মহিলাগণ নিজেদের ঘরে সালাত আদায়ের স্থানে ই‘তিকাফ করবে। তারা প্রয়োজন ব্যতীত এ স্থান থেকে বের হবে না। আল্লাহ বলেন:
وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ
-“তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে সহবাসে মিলিত হয়ো না। (সুরা বাকারা: ১৮৭)
হাদিসে এসেছে:
وَلَا اعْتِكَافَ إلَّا فِي مَسْجِدٍ جَامِعٍ
-“জামে‘ মসজিদ ছাড়া ই‘তিকাফ হবে না।” (আবু দাউদ: ২৪৭৩)

৩. রোযা রাখা; তবে নফল ই‘তিকাফের জন্য রোযা শর্ত নয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: وَلَا اعْتِكَافَ إلَّا بِصَوْمٍ  -“রোযা ছাড়া ই‘তিকাফ হবে না।” (আবু দাউদ: ২৪৭৩)

৪. মুসলমান হওয়া; কেননা কোন অমুসলিম ব্যক্তি ইবাদতের যোগ্যতা রাখে না।
৫. আকিল ও জ্ঞানবান হওয়া। বালিগ হওয়া ই‘তিকাফের জন্য শর্ত নয়।
৬. নারী-পুরুষ সকলের জানাবাত বা গোসল ফরয হয় এমন অপবিত্রতা থেকে এবং নারীদের হায়য ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া। (আলমগীরী)

★ ই‘তিকাফের নিয়ম

* কেউ যদি একদিনের ই‘তিকাফ করার মানত করে, তবে তার উপর শুধু দিনের ই‘তকাফই ওয়াজিব হবে। সুতরাং সে সুবহে সাদিকের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবে এবং সূর্যাস্তের পর বের হবে। আর যদি রাতসহ মান্নত করে, তবে রাতসহ অবস্থান করবে। শুধু রাতে ই‘তিকাফের মানত করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এর জন্য রোযা শর্ত আর রাতে রোযা নেই। আর দুই, তিন বা ততোধিক দিনের মানত করলে দিন-রাত উভয় সময়ই ই‘তিকাফ করবে। নির্দিষ্ট দিন-তারিখে ই‘তিকাফের মানত করলে শরয়ি ওযর ব্যতীত দেরী করা বা আগে পরে করা জায়িয নেই। (বাহরুর রায়িক)

* নফল ই‘তিকাফের জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট নেই এবং রোযা রাখাও শর্ত নয়। কাজেই যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে এভাবে নিয়্যত করে নিবে যে, “হে আল্লাহ্! যতুটুকু সময় আমি এ মস্জিদে থাকব ততুটুকু সময়ের জন্য ই‘তিকাফের নিয়্যত করছি।”

★ যে যে কারণে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়

* ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি শরয়ি এবং মানবীয় প্রয়োজন ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে মসজিদের বাহিরে গেলে, ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। শরয়ি প্রয়োজন যেমন- জুমু‘আর নামাযের জন্য বের হওয়া। মানবীয় প্রয়োজন যেমন- মলমূত্র ত্যাগ করার জন্য যাওয়া। মহিলাগণ যদি ই‘তিকাফের জন্য নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঘরের অন্যত্র যায় তবে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

* প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পর অল্প সময় বাহিরে থাকলেও ই‘তিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। ইচ্ছাকৃত বা ভুলে বের হলেও এ হুকুম প্রজোয্য হবে।

* স্ত্রী সঙ্গম বা এর আনুসাঙ্গিক কার‌্যাবলী যেমন- চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি ই‘তিকাফ অবস্থায় হারাম। এগুলোর মাধ্যমে বীর্যপাত হলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। সহবাস করলে বীর্যপাত হোক বা না হোক ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে স্বপ্ন দোষের কারণে বীর্যপাত ঘটলে ই‘তিকাফ ফাসিদ হবে না।

* শুধুমাত্র বেহুশ বা পাগল হওয়াতে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হবে না। তবে এ অবস্থায় যদি একাধিক দিন অতিবাহিত হয় তবে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

* ই‘তিকাফ অবস্থায় যদি কোন মহিলার মাসিক এসে যায় তবে তার ই‘তিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। (আলমগীরী, শামী, বাদায়েউস্ সানায়ে)

উপরে বর্ণিত কারনসমূহ দ্বারা ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা পরবর্তীতে যথা নিয়মে কাযা করে নিতে হবে।

★ ই‘তিকাফ অবস্থায় নাজায়িয কাজসমূহ

১. ব্যবসার উদ্দেশ্যে মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করা।
২. ক্রয়-বিক্রয়ের বস্তু মসজিদে উপস্থিত করে ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদন করা।
৩. ই‘তিকাফ অবস্থায় কথা না বলাকে ইবাদত মনে করে নিরব থাকা। তবে গুনাহজনিত কথা পরিহার করা ওয়াজিব।
৪. ই‘তিকাফ অবস্থায় পারিশ্রমিক নিয়ে কোন কাজ করা মাকরূহ্। এক্ষেত্রে যে সব কাজ মসজিদে মাকরূহ্, ঐসব কাজ মসজিদের ছাদেও মাকরূহ্। (আলমগীরী, শামী, বাহ্রুর রায়িক)

★ ই‘তিকাফ অবস্থায় যে সব কাজ ই‘তিকাফকে নষ্ট করে না

১. মসজিদে পানাহার করা।
২. মসজিদে নিদ্রা যাওয়া। তবে ই‘তিকাফ ছাড়া মসজিদে পানাহার ও নিদ্রা যাওয়া নিষেধ।
৩. মসজিদের মিনারায় আরোহন করা। মসজিদের মিনার যদি মসজিদের অংশবিশেষ হয়, তাহলে সকল ই‘তিকাফকারীর জন্য তাতে আরোহন করা জায়িয। আর যদি মিনার মসজিদের অংশে না হয়, তাহলে সেখানে শুধু মুয়াযযিন ই‘তিকাফকারী আযানের জন্য আরোহন করতে পারবে। অন্য ই‘তিকাফকারীদের জন্য আরোহন করা জায়িয নয়।
৪. ই‘তিকাফকারীর মাথা ধৌঁত করার জন্য মসজিদ থেকে মাথা বের করা।
৫. ই‘তিকাফকারীর জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু ক্রয়-বিক্রয় করা। তবে পন্যদ্রব্য মসজিদে প্রবেশ করানো জায়িয নয়।
৭. ই‘তিকাফকারীর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং মাথায় তৈল লাগানো জায়িয। (শামী ও আলমগীরী)
৮. পাঞ্জেগানা মসজিদে ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি জুমু‘আর নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজ মসজিদ থেকে বের হয়ে নিকটবর্তী জুমু‘আর মসজিদে গিয়ে জুমু‘আর নামায আদায় করতে পারবে, তবে প্রয়োজনাতিরিক্ত সময় ব্যয় করবে না। জুমু‘আর মসজিদে আসা-যাওয়ার পথে যদি কোন জানাযা পেয়ে যায় বা অসুস্থ ব্যক্তি দেখে তবে দেখা জায়িয হবে, অন্যথায় জানাযা ও রোগী দেখার জন্য ই‘তিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

★ যে সব কারণে ই‘তিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারে

ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি তিন ধরনের প্রয়োজনে মস্জিদ থেকে বের হতে পারবে। তা হলো-

১. শরয়ি প্রয়োজন। যেমন- জুমু‘আ ও দুই ঈদের নামায। মিনারার দরজা মসজিদের বাহিরে থাকলেও ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি মিনারায় গিয়ে আযান দিতে পারবে।

২. মানবীয় প্রয়োজন। যেমন- মলমূত্র ত্যাগ করা এবং ফরয গোসল করা।

৩. একান্ত অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন। যেমন- মসজিদ বিদ্ধস্ত হয়ে গেলে, যালিম ব্যক্তি ই‘তিকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের করে দিলে, অথবা কোন অত্যাচারীর কারণে নিজের জান-মাল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে। তবে তখন অন্য কোন কাজে লিপ্ত না হয়ে সাথে সাথে অন্য মস্জিদে ই‘তিকাফের জন্য চলে যাবে। (মারাকীল ফালাহ, শামী)

★ মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিষয়ে লক্ষণীয়

* উযরবিহীন পুরা শরীর বের করলে ই‘তিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
وكان لا يدخُلُ البَيتَ إلَّا لحاجةٍ إذا كان مُعتَكِفًا
-“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন জরুরি উযর ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না।” (বুখারী: ২০২৯; মুসলিম: ২৯৭)

* উযরের কারণে বের হতে কোন দোষ নেই। যেমন- প্রসাব, বাথরুম, গোসলের জন্য।

* শরীরের কিছু অংশ উযরবিহীন বের করলেও সমস্যা নেই। (ইবনু হাজম, আল-মুহাল্লা ৫/১৮৭; ইবনু দাকিকিল ঈদ, ইহকামুল আহকাম ৮৯; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ ২/৮৯, সনআনী, বাদায়েয়ুস সনা‘য়ী ২/১৭৪)

কেননা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে অবস্থানকালীন শরীরের অংশকে মসজিদের বাহিরে বের করেছেন। হাদিসে এসেছে:
كانَ النَّبيُّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم…يُخرِجُ رأسَه من المسجِدِ- وهو مُعتكِفٌ- فأغسِلُه وأنا حائِضٌ
-“আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা বলেন: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই‘তিকাফরত অবস্থায় মসজিদের বাহিরে মাথা মুবারক বের করলেন, অতঃপর আমি মাথা মুবারক ধৌঁত করে দিলাম, তখন আমি ঋতুবর্তী ছিলাম।” (বুখারী: ২০৩১; মুসলিম: ২৯৭)

★ ই‘তিকাফের আদবসমূহ

১. অহেতুক কথা না বলা। যথাসম্ভব নেক আলোচনায় লিপ্ত থাকা।
২. উত্তম মসজিদ নির্বাচন করা। যেমন- মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী বা জামে‘ মসজিদ ইত্যাদি।
৩. বেশী বেশী করে কুরআন ও হাদিস পাঠ করা।
৪. যিকর ও মিলাদ-কিয়াম করা।
৫. ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়া।
৬. হুযুর পাকের পবিত্র জীবনী অধ্যয়ন ও আলোচনা করা।
৭. আম্বিয়া ও আওলিয়াগণের জীবনী পাঠ করা।
৮. শরয়ি আহকামের কিতাবাদী পাঠ ও রচনা করা।
৯. যেসব কথায় গুনাহও নেই ছাওয়াবও নেই, প্রয়োজন ছাড়া তা না বলা। (আলমগীরী, শামী, মারাকিল ফালাহ্)

★ করোনা কালীন আমরা যা করতে পারি

১. অনেক এপার্টমেন্টে ৫ ওয়াক্ত নামাযের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ থাকে। যেখানে শুরু থেকেই নামাযের পাঞ্জেগানা জামা‘আত হয়। এরকম মসজিদে ই’‘তিকাফ করতে পারবেন।

২. যারা নিয়মিত ই‘তিকাফ করে আসছেন, তারা যদি এবছর করোনার কারণে নাও করতে পারেন তাহলে আগামী বছর মোট ২০ দিন ই‘তিকাফ করে কাযাও আদায় করতে পারবেন। “রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৯ম হিজরিতে ই‘তিকাফ না করে ১০ম হিজরিতে মোট ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছিলেন।” (তিরমিযি: ৮০৩; সহিহ ইবনু হিব্বান: ৩৬৬৩)

★ ইতিকাফের কাযা

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদ্বানের শেষ দশদিনে ই‘তিকাফ পালন করতেন। এক বছর তিনি ই‘তিকাফ পালনে সক্ষম হলেন না। তাই, পরবর্তী বছরে তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফ করে নিয়েছিলেন। (তিরমিযি: ৮০৩, হাদিসটি সহিহ)

আল্লাহ্ আমাদেরকে সহিহ্ ভাবে ই‘তিকাফ সম্পন্ন করার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তির ফায়সালা দান করুন। আমীন।

 
Top