মানযুর আহমদ রিফায়ী (রহ.) এক অমরসত্ত্বা
Manjur Ahmed Refayi (R.A)

 
পরিচিতি: আল্লামা শায়খ সায়্যিদ মানযুর আহমদ উয়েসী রিফায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন একজন আশেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সুফিসাধক। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী, নবীপ্রেমে নিবেদিত অসংখ্য ক্বাসিদা নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখেছেন।

জন্ম: শায়খ মানযুর আহমদ রিফায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ১৯৪২ সালের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আল্লামা শায়খ সায়্যিদ মুহাম্মাদ বোরহানুদ্দীন উয়েসী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন সুফি সাধক, মাতা জামিলা খাতুন। বংশীয়ভাবে তাঁরা ছিলেন শায়খ সায়্যিদ। জানা যায়, তাঁদের পুর্বপুরুষ আরব দেশ থেকে দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে হিজরত করেন। পরবর্তীতে চাঁদপুর মতলবের ফরাজীকান্দী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
 
শিক্ষা জীবন: তিনি ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে মুমতাযুল মুহাদ্দিস, মুমতাযুল ফুকাহা (মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে) কৃতিত্বের সাথে উত্তির্ণ হন। পাশাপাশী প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজে কৃতিত্বের সাথে (ফাস্ট ক্লাস) অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে এল.এল. বি সম্পন্ন ও “ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দি ও নকশবন্দিয়া তরিকা” শীর্ষক উচ্চতর গবেষনামূলক থিসিস রচনা করেন।

তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উর্দু ভাষার উপর ডিপ্লোমা এবং এস.সি.পি ইন পারসিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ সম্পন্ন করেন। এছাড়া মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশী আরবী, ইংরেজী ও হিন্দী ভাষাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন।

ইসলামে অবদান: তাঁর পিতা শায়খ বোরহানুদ্দীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ৯ মে, ১৯৬৪ইং ইন্তেকালের পর ১৯৬৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ৪৮ বছর অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতার সাথে তিনি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ফরাজীকান্দী ঊয়েসীয়া শরীফের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

শায়খ বোরহানুদ্দীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রায় বিশটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য আল আমিন ইয়াতিমখানা, ঊয়েসীয়া আলীয়া মাদ্রাসা, খাজা গরীবে নেওয়াজ হাসপাতাল, জিলানীয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল ইত্যাদি।

সেই আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহনের এক বছরের মধ্যে রাজধানী ঢাকার মধ্যে শায়খ মানযূর আহমাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রতিষ্ঠা করেন একুশতম প্রতিষ্ঠান “শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ”। যা ঢাকা মহানগরীর প্রথম বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এছাড়া তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে দেশ বিদেশে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইয়াতিম খানা, হেফজ খানা, মসজিদ, যুব প্রশিক্ষণ, মহিলা মাদ্রাসা, পাঠাগার, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, কিন্ডারগার্টেন, চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র ও কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে।

তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা (১৯৭৮- ৮০) ও অন্যান্য জাতীয় দায়িত্ব পালন করেন। সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অপরিসীম। বিশেষকরে বাংলাদেশে হানাফী মাযহাব ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা প্রতিষ্ঠায় তাঁর কার্যক্রম ছিলো বহুমাত্রিক।

 
পদকপ্রাপ্ত: বাংলাদেশের সর্বত্র সমাজ সেবায় অসমান্য অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে তিনি কুমিল্লা ফাঊন্ডেশন কর্তৃক “স্বর্ণপদক” প্রাপ্ত হন। সমাজ সংস্কার ও উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর থেকে স্বীকৃতি প্রাপ্ত হন। ২০১৫ সালে সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদানের জন্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইসলামী ছাত্র সেনা তাঁকে মরণোত্তর বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।

গবেষনা ও প্রকাশনা: শায়খ মানযূর আহমদ উয়েসী নকশবান্দী রিফায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হচ্ছেন বাংলা ভাষায় নবী প্রেমে নিবেদিত সর্বাধিক ক্বাসিদার রচয়িতা। তাঁর মৌলিক ক্বাসিদার গ্রন্থ- পরশ মনি,আশিক্বী (দুই খন্ড)। এছাড়া ইলমে তাসাউফের ঊপর ‘আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রনয়ণ করেন।

খিলাফত প্রাপ্তি: আশির দশকের দিকে টানা এগারো বছর (১৯৭৮-১৯৮৯) মদীনা শরীফের বিখ্যাত শায়খ মুহাম্মাদ আদিল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর শিক্ষালয়ে অনুবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাগদাদ শরীফে দরবারের বড়পীর গাউসে পাক আব্দুল ক্বাদির জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর আউলাদ সায়্যিদ ইউসুফ আল জিলানী সাহেব কিবলা কর্তৃক কাদিরিয়া ত্বরিকায় এবং শায়খ ফাহমী শাজুলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক তিনি শাজুলিয়া ত্বরিকায় বায়াত ও খিলাফত প্রাপ্ত হন।

শায়খ মানযূর আহমাদ উয়েসী নকশবান্দী রেফায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মাধ্যমেই প্রথম রিফাইয়া, সাম্মানিয়া, তিযানিয়া তরিকা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তিনিই ছিলেন রিফাইয়া তরিকার শায়খ আউলাদে রাসূল সায়্যেদ ইউসুফ হাশেম আল রিফায়ী’র (মা.জি.আ) বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান খলিফা। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন তরিকায় খিলাফতপ্রাপ্ত হন। সেগুলো হলো- ক্বাদেরিয়া, চিশতিয়া (চিশতিয়া আলীয়া, চিশতিয়া সাবেরিয়া, চিশতিয়া নিযামিয়া), নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, আহমাদীয়া, মুহাম্মাদীয়া, উয়েসীয়া, সোহরাউয়ারদিয়া, রিফাইয়া, উসমানীয়া, শাযুলিয়া, জাযুলিয়া, সাম্মানিয়া, তিযানিয়া তরিকা।

 
সফর: দ্বীন,সুন্নিয়ত ও ত্বরিকা প্রচারে তিনি প্রায় ১৩ টি দেশ ভ্রমণ করে বিশ্ববিখ্যাত আউলিয়া কেরামের রওদ্বা শরীফ যিয়ারত এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশেষ দাওয়াত প্রাপ্ত হয়ে অংশগ্রহন করেন। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ঈদে মিলাদুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কনফারেন্সে’ তিনি বাংলায় স্বরচিত কাসিদা পাঠ করে বাঙলা ভাষার মর্যাদাকে বিশ্ব দরবারে সমুন্নত করেন।

কারামত: তিনি আশেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লামা শায়খ মানযুর আহমদ রিফায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আজীবন সাধনা ছিলো হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামার কদম মুবারকে স্থান পাওয়ার। বিভিন্ন ক্বাসিদার মাঝে তাঁর এই নেক ইচ্ছা বারংবারই পরিলক্ষিত হয়। বিস্ময়করভাবে তাঁর এই আরজু যে কবুল হয়েছে এবং শেষ ঠিকানা যে জান্নাতুল বাকীতে হবে সেই সুসংবাদের ইশারাও তিনি তাঁর অসংখ্য ক্বাসিদাতে বর্নিত করেছিলেন।

ওফাত: তাঁর সাধনা, আরজু বাস্তবে পরিণত করে হাজ্বের সফরে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর ১৫ জিলক্বদ সোমবার সকালে মদীনা শরীফে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাদ আসর মাদীনা শরীফের প্রখ্যাত সুন্নী আলেম শায়খ হুজাইফী (মা.জি.আ) এর ইমামতীতে মসজিদে নববীতে নামাজে জানাজা শেষে জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে দাফন করা হয়।

ইসলামী গবেষণা বিভাগ
বাগদাদী ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা- ৩৫০০, বাংলাদেশ।
 
Top