দৈনন্দিন জীবনে আমল
সকল শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য জরুরী

উভয় জগতে কামিয়াবীর জন্য হক্কানী উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীনের সাথে মুহাব্বত ও শ্রদ্ধা রাখা জরুরী। আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়া এবং হেদায়েতের উপর কায়েম থাকার জন্য আল্লাহওয়ালাদের সোহবত অপরিহার্য বিষয়। (সুরায়ে তাওবা ১১৯, সূরায়ে নাহল ৪৩)

নিচের কাজগুলো সারাজীবন আনজাম দিতে হবেঃ

ক. ঈমানী বিষয়ের তা‘লীমের মাধ্যমে নিজের ঈমান ও আক্বীদা বিশ্বাসকে সঠিক করতে হবে এবং ঈমানকে কুফরী ও শিরকী বিশ্বাস থেকে হেফাজত করতে হবে এবং ঈমানী দাওয়াতের মাধ্যমে ঈমানকে মজবুত ও পোক্তা করতে হবে। (সূরায়ে নিসা ১১৫, সূরায়ে বাকারা ১৩)

খ. ইবাদাত তথা নামায, রোযা, কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত, যাকাত, হজ্জ্ব ইত্যাদি ইবাদাতসমূহ সুন্নাত মুতাবিক সুন্দরভাবে করতে হবে। এর জন্য হক্কানী আলেমদের মজলিসে শরীক হয়ে নামায ও অন্যান্য আমলের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। (সূরায়ে আলে ইমরান ৩১, তিরমিযী ২৬৭৮, মুয়াত্তা মালেক ৪৩৩)

গ. মু‘আমালাত তথা হালাল রিযিকের পাবন্দী করবে। সুতরাং ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, কৃষিজীবীসহ সকল স্তরের উপার্জনকারী স্ব-স্ব পেশার হালাল-হারাম কোন হক্কানী মুফতী থেকে ভালভাবে জেনে নিবে। কারো ইনতিকাল হলে মীরাছ বণ্টনে দেরী করবে না, তার কোন ইয়াতীম বাচ্চা থাকলে তার অংশ খুব হেফাজত করবে, তার মাল খাওয়া থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকবে। হালাল রিযিক ইবাদতের দিকে ধাবিত করে আর হারাম রিযিক গোনাহের দিকে ধাবিত করে। (সূরায়ে মুমিনূন-৫১, সূরায়ে বাকারাহ-১৬৮)

ঘ. মু‘আশারাত তথা বান্দার হক বিশেষ করে পিতা-মাতা, বিবি বাচ্চা ও অন্যান্যদের হক হক্কানী উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিয়ে তা পরিপূর্ণভাবে আদায় করবে। কারো হক নষ্ট করবে না। কাউকে অনর্থক কষ্ট দিবে না। এমনকি জীব-জন্তুকে কষ্ট দেয়া থেকেও বিরত থাকবে। নিজের হক উসুলের তুলনায় অন্যের হক আদায় করাকে প্রাধান্য দিবে। আল্লাহর হক আল্লাহ হয়তো মাফ করে দিবেন কিন্তু বান্দার হক তিনি মাফ করবেন না। হাশরের ময়দানে পাওনাদারকে নেকী দিতে হবে কিংবা তার গোনাহের বোঝা বহন করতে হবে। (সূরায়ে নিসা ৩৬, বুখারী শরীফ ৬৪৮৪)

ঙ. তাযকিয়াহ তথা আত্মশুদ্ধির ফিকির রাখবে। কুরআনে কারীমে আত্মশুদ্ধির গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে যত কসম ব্যবহৃত হয়েছে অন্য কোন হুকুমের ব্যাপারে তা হয়নি। সুতরাং অন্তরের দশটি মন্দ স্বভাব তথা আধ্যাত্মিক রোগ বা গুনাহ সংশোধনের মাধ্যমে যাবতীয় গুনাহ পরিত্যাগ করার জন্য এবং অন্তরের দশটি ভাল স্বভাব অর্জনের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট কোন আল্লাহওয়ালা শাইখের সাথে সরাসরি অথবা চিঠিপত্রের মাধ্যমে ইসলাহী সম্পর্ক রাখাকে ফরয মনে করবে। এবং সুযোগমত তাদের মজলিসে বসতে চেষ্টা করবে। (সূরায়ে শামস-৯-১০, মুসলিম শরীফ হাঃ নং ১৫৯৯)

* এই পাঁচটি বিষয়ের ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন এবং এ পাঁচ বিষয়ের উপর আমলকারীকে মুত্তাকী বা আল্লাহওয়ালা বলা হয় এবং প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য আল্লাহওয়ালা হওয়া ফরয। (বাকারা-১৭৭)

আল্লাহর দীনের জন্য সময় ফারেগ করা

উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের উপর আমল করার লক্ষ্যে সারা জীবন দাওয়াত, তা‘লীম, তাযকিয়াহ-এই তিন প্রকার মেহনতের জন্য সময় বের করবে। এর কোন একটির জন্য মেহনত করাকে যথেষ্ট মনে করবে না। এ তিনটির ব্যাখ্যা হক্কানী উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিবে। (বাকারা-১২৯, আলে ইমরান-১৬৪)

দৈনন্দিন আমল

জামা‘আতের সাথে নামায আদায় করা

পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায জামা‘আতের সাথে আদায় করবে। জামা‘আতের সাথে নামায পড়া ওয়াজিব। জামা‘আত তরককারী ফাসিক হিসেবে গণ্য হবে। তাহাজ্জুদ সহ অন্যান্য নফল নামায পড়বে। মহিলাদের জন্য বিনা উযরে মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে শরীক হওয়া নাজায়িয ও গুনাহ। (বাকারা-৪২, বুখারী-৯৬)

গুনাহ বর্জন

শিরক বিদ‘আত ও গুনাহ থেকে কঠোরভাবে বেঁচে থাকবে। একটি গুনাহই মানুষকে দোযখে নিয়ে যেতে পারে। নেক কাজ দুধের মত আর গুনাহ হল বিষের মত। উভয়টি একত্রিত হলে বিষের ক্রিয়াই প্রকাশ পায়। (আনআম-১২০, মিশকাত-২২৮)

সুন্নাতের অনুসরণ

প্রতিটি কাজ নবীজীর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাত অনুযায়ী করার জন্য সুন্নাত শিখতে থাকবে, সুন্নাতের প্রশিক্ষণ নিবে এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সহজ সুন্নাতকে (তথাঃ ক. পরস্পর সালাম আদান প্রদান। খ. উপরে উঠতে আল্লাহু আকবার বলা। নিচে নামতে সুবহানাল্লাহ বলা। সমতলে চলতে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যিকির করা। গ.প্রত্যেক ভাল কাজে ডানকে প্রাধান্য দেওয়া। নিম্ন কাজে বামকে প্রাধান্য দেওয়া) আমলে আনবে। যাতে করে অবশিষ্ট সকল সুন্নাতের উপর আমল করা সহজ হয়ে যায়। (আলে ইমরান-৩১)

কুরআন শরীফ তিলাওয়াত

কুরআনে কারীমের সহীহ শুদ্ধ তিলাওয়াত করবে। এটা ফরয। সূরা কিরা‘আত অশুদ্ধ তিলাওয়াত করা বড়ই আফসোসের বিষয়। ফরয তরককারী কখনো আল্লাহর ওলী হতে পারে না। প্রতিদিন এক পারা করে কুরআন তিলাওয়াত করতে চেষ্টা করবে। এজন্যই কুরআনকে ত্রিশ পারায় বিভক্ত করা হয়েছে। যারা হাফেয তারা তিন পারা করে তিলাওয়াত করবে। তবে সাধারণ অবস্থায় সাত দিন বা তিন দিনের কমে খতম করবে না। কেননা, হাদীস শরীফে তাড়াহুড়া করে খতম করতে নিষেধ করা হয়েছে। বাদ ফজর সূরায়ে ইয়াসীন, বাদ মাগরিব সূরায়ে ওয়াক্বিয়াহ ও শোয়ার পূর্বে সূরায়ে মুলক তিলাওয়াত করবে। (আবু দাউদ-১৩৮৮)

ফরয নামাযের পরে ওজীফা পড়বে

প্রত্যেক ফরয নামাযের পরে তিনবার ইস্তিগফার পড়বে। (তাবারানী কাবীর-৮৫৪১)

أَسْتَغْفِرُ الله الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ

এবং এ দু‘আটি পড়লেও ভাল হয়। (বুখারী শরীফ-১/১১৭)

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ اللَّهُمَّ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ

আরো কিছু দু‘আ কালাম আছে যা ফরযের পর সুন্নাত ও নফল থাকলে, সুন্নাত ও নফলের পরে পড়বে। আর সুন্নাত নফল না থাকলে ফরযের পরে পড়বে।

(ক) আয়াতুল কুরসী, একবার। (নাসাঈ-৯৮৪৮)

(খ) সূরা ফালাক, সূরা নাস-তিনবার করে, এর সাথে সূরায়ে কাফিরুন ও ইখলাস মিলিয়ে নিলে ভাল। (তিরমিযী-২৯০৩)

(গ) তাসবীহে ফাতেমী একবার। (৩৩ বার سُبحَا نَ ا لله, ৩৩ বার اَلحَمدُ لِلّهِ, ৩৪ বার اَللهُ اَكبَر) (মুসলিম ৫৯৭)

এগুলো পাঁচ ওয়াক্তেই পড়বে। শুধু ফজর ও মাগরিবে এ তিনটির আগে নিচের দুটি পড়বে।

(ঘ) اللَّهُمَّ أجِرْنِي مِنَ النَّارِ

(ঙ) ফজর ও মাগরিবের পর পড়বে-৩ বার اعوذ بالله السميع العليم من الشيطان الرجيم পড়ে, বিসমিল্লাহ পড়ার পর ১ বার سورة الحشر এর শেষ ৩ আয়াত পড়বে। (তিরমিযী, ২ : ১২০)

বিঃদ্রঃ হাদীসে আরো কিছু দু‘আ আছে, সুযোগ হলে সেগুলোও পড়বে। জুমু‘আর দিন আসরের পরে এই দুরুদটি ৮০ বার পড়বে।

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍن النَّبِيِّ الأُمَّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَسلم تَسْلِيمًا

* তাছাড়া প্রতিদিন যে কোন সময় একশবার দুরূদ শরীফ পড়বে। (আদদুররুল মানদূদ-১৬০)

* প্রতিদিন মুনাজাতে মকবূল থেকে এক মনযিল পাঠ করতে চেষ্টা করবে।

* আল্লাহ তা‘আলার যিকির করবে

* তাহাজ্জুদের পরে বা ফজরের পরে অথবা যখন সুযোগ হয় আসন দিয়ে বসবে। তারপরে কয়েকবার ইস্তিগফার ও কয়েকবার সহীহ দরূদ শরীফ পড়বে। (ইবনে হিব্বান-৮১৭)

* তারপরে কসদুস সাবীলের বর্ণনা অনুযায়ী যিকির করবে। যিকিরের সময় শরীর সামান্য হেলাবে। যথেষ্ট পরিমাণ সময় না পেলে বা অন্য কোন সমস্যা হলে বার তাসবীহ এর যিকির করবে।

* বার তাসবীহ এর যিকিরের বিবরণ

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ২০০ বার (১০/১৫ বার পর পর পূর্ণ কালেমা)

ইল্লাল্লাহ ৪০০ বার। (প্রত্যেকটায় একবার পরে শ্বাস ফেলবে।)

আল্লাহু আল্লাহ ৬০০ বার। (প্রথমটার শেষে পেশ।)

আল্লাহ ১০০ বার। (শেষে সাকিন।)
 
Top