❏ 'সুন্নাহ' ও হাদীসের মধ্যে পার্থক্যঃ
❏ প্রত্যেক বিদ্'আত গোমরাহী'র প্রকৃত অর্থঃ
❏ সাহাবীদের আবিষ্কার সুন্নাত, নাকি বিদ্'আত? 
❏ খিলাফত শুধু ক্বোরায়শেই; 'ইমামত' (বাদশাহী) ব্যাপক।
________________________________________________

❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৫৮)]
○ অধ্যায়ঃ [ ক্বোরআন ও সুন্নাহ্'কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা ]

[ وعنه قال صلى بنارسول الله ﷺ ذات يوم ثم اقبل علينا بوجهه فوعظنا موعظة بليغة ذرفت منها العيون ووجلت منها القلوب فقال رجل يا رسول الله كان هذه موعظة مودع فاوصنا فقال اوصيكم بتقوى الله والسمع والطاعة وان كان عبدا حبشيا فانه من يعش منكم بعدى فسيرى اختلافا فعليكم بسنتى وسنة الخلفآء الراشدين المهديين تمسكوابها وعضوا عليها بالنواجذ واياكم ومحدثات الامور فان كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة .] 
: (رواه احمد وابو داؤد والترمذى وابن ماجة الا انهما لم يذكر الصلوة) 

📖 তাঁরই (হযরত 'ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়াহ্ رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেছেন, "একদিন আমাদেরকে রাসূলাল্লাহ্ [ﷺ] নামায পড়ালেন। তারপর আমাদের দিকে চেহারা মুবারক ফিরিয়ে বসলেন এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ওয়ায করলেন, যার প্রভাবে অশ্রু প্রবাহিত হলো, ভয়ে অন্তর কেঁপে ওঠলো। (টীকাঃ ১) এক ব্যক্তি আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ! সম্ভবত এটাই বিদায়-ভাষণ। (টীকাঃ ২) সুতরাং কিছু ওসীয়ত করুন! হুযূর এরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্'কে ভয় করার, বাদশাহ্'র কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছি, (টীকাঃ ৩) যদিও সে হাবশী গোলাম হয়। (টীকাঃ ৪) কেননা, আমার পরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে প্রচুর মতপার্থক্য হতে দেখবে। (টীকাঃ ৫) সুতরাং তোমরা আমার এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফা-ই রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। (টীকাঃ ৬) তা দাঁত দ্বারা মজবুতভাবে চেপে ধরো। প্রত্যেক নতুন কথাবার্তা থেকে দূরে থাকো। কেননা, প্রতিটি নতুন জিনিস বিদ্'আত এবং প্রত্যেক বিদ'আত গোমরাহী।" (টীকাঃ ০৭) 

[এটা আহমদ, আবূ দাঊদ এবং তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্ বর্ণনা করেছেন; কিন্তু (তাঁরা তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্) উভয়েই নামাযের ঘটনা বর্ণনা করেন নি।]

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ 
    ___________________________________ 

১| (একদিন আমাদেরকে রাসূলাল্লাহ্ [ﷺ] নামায পড়ালেন। তারপর আমাদের দিকে চেহারা মুবারক ফিরিয়ে বসলেন এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ওয়ায করলেন, যার প্রভাবে অশ্রু প্রবাহিত হলো, ভয়ে অন্তর কেঁপে ওঠলো।)

◇ টীকাঃ ১.
এমনিতেই হুযূর [ﷺ] -এর প্রতিটি ওয়াযই চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী হতো। কিন্তু বিশেষ করে এ ওয়ায অত্যন্ত প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিলো। যা'তে খোদাপ্রেম ও আল্লাহ্'র ভয়ের সাগরে ঢেউ খেলছিল। ইশক্ব বা প্রেমের কারণে অশ্রু ঝরে এবং ভয়ের কারণে অন্তরে ভীতি সৃষ্টি হয়। بليغ (বালীগ) শব্দ দ্বারা 'প্রভাবপূর্ণ' বুঝায়। 

২| (এক ব্যক্তি আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ! সম্ভবত এটাই বিদায়-ভাষণ।)

◇ টীকাঃ ২. 
অর্থাৎ হুযূরের ওফাত শরীফ নিকটবর্তী এবং তিনি তেমনভাবে কথা বলছেন, যেমন- বিদায়কালে বলা হয়। তিনি যেন আপন উম্মতকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং আখেরী উপদেশমালা প্রদান করছেন। সুবহানআল্লাহ্! সাহাবা-ই কেরামের তীক্ষ্ণ মেধাশক্তির উপর আমাদের প্রাণ উৎসর্গ হোক। 

৩| (সুতরাং কিছু ওসীয়ত করুন! হুযূর এরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্'কে ভয় করার, বাদশাহ্'র কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছি)

◇ টীকাঃ ৩. 
বুঝা গেলো যে, বাস্তবিকই হুযূরের ওফাত শরীফ নিকটবর্তী ছিলো, এজন্য তাঁদের কথা প্রত্যাখ্যান করা হয় নি; বরং আকাঙ্কা পূরণ করা হয়েছে। জানা গেলো যে, হুযূর আপন ওফাতের সময় সম্পর্কে জানেন এবং এটা এমন পূর্ণাঙ্গ বাণী যে, সমস্ত বিধান এতে এসে গেছে। تقوى الله (আল্লাহ্'র ভয়)'র মধ্যে সমস্ত দ্বীনী বিধান এবং বাদশাহ্'র আনুগত্য ও সমস্ত রাজনৈতিক বিধান রয়েছে। 

৪| (যদিও সে হাবশী গোলাম হয়।)

◇ টীকাঃ ৪.
অর্থাৎ যদি তোমাদের বাদশাহ্ কালো হাবশী গোলামও হয়, তবুও তার আনুগত্য করো; তার বংশ ও গড়ন দেখো না। তার আদেশ মান্য করো। 

স্মর্তব্য যে, 'খিলাফত' ক্বোরাঈশ বংশীয়দের জন্য নির্দিষ্ট; কিন্তু 'রাজত্ব' যে কোন মুসলমান লাভ করতে পারে। সুতরাং আলোচ্য হাদীস, এ হাদীস الخلافة من قريش -এর বিরোধী নয়। তাছাড়া শাসকের আনুগত্য ওই সব বিধানে করা হবে, যেগুলো শরীয়ত বিরোধী নয়। তাছাড়া, শাসক হবার পরেই তার আনুগত্য করা হবে। ইয়াযীদ বৈধ শাসক হয় নি; হযরত হুসাইন [رضي الله عنه] তাকে শাসকই মানেন নি। সুতরাং তাঁর আমল এ হাদীসের বিরোধী নয়। শাসক বানানো এক কথা আর শাসক হবার পর আনুগত্য করা অন্য কথা। 

৫| (কেননা, আমার পরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে প্রচুর মতপার্থক্য হতে দেখবে।)

◇ টীকাঃ ৫.
রাজনৈতিক মতভেদও, ধর্মীয় মতভেদও। যেমনঃ হযরত ওসমান [رضي الله عنه]'র খিলাফতকালের শেষের দিকে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং হযরত আলী [رضي الله عنه]'র খিলাফতকালে রাজনৈতিক মতভেদের সাথে সাথে ধর্মীয় মতভেদও প্রকাশ পায়। যেমনঃ জবরিয়া, ক্বদরিয়া, রাফেযী, খারেজী (বাতিল সম্প্রদায়গুলো)'র উদ্ভব হলো। 

স্মর্তব্য যে, আল্লাহ্'র অনুগ্রহক্রমে সম্মাণিত সাহাবীদের মধ্যে দ্বীনী মতভেদ সৃষ্টি হয় নি। সম্মাণিত সাহাবী সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। হুযূরের এ পবিত্র বাণী অত্যন্ত ব্যাপক এবং তাঁর এ পূর্বাভাস হুবহু সঠিক হয়েছিলো। 

৬| (সুতরাং তোমরা আমার এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফা-ই রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো।)

◇ টীকাঃ ৬.
প্রত্যেক 'সুন্নাত' অনুসরণযোগ্য। কিন্তু প্রতিটি হাদীসের অনুসরণ করা যায় না। হুযূরের বৈশিষ্ট্যাবলী (خصوصيات) সম্বলিত হাদীস, রহিত বিধান, আমলসমূহ ও হাদীস, কিন্তু 'সুন্নাত' নয়। এ জন্য এখানে হাদীসকে আঁকড়ে ধরার আদেশ দেওয়া হয় নি; বরং সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার জন্য বলা হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্, আমরা 'আহলে সুন্নাত'। দুনিয়ায় 'আহলে হাদীস' কেউ হতে পারে না। সাহাবা-ই কেরামের আমল এবং কার্যাবলীও শাব্দিক অর্থে 'সুন্নাত'; অর্থাৎ দ্বীনের উত্তম ত্বরীকা বা পন্থা; যদিও সেগুলোর উদ্ভাবন 'বিদ্আত-ই হাসানাহ্'। ফারুকে আযম হযরত ওমর [رضي الله عنه] যথারীতি তারাভীহ্'র নামায জামাত সহকারে চালু করেছিলেন, যাকে তিনি নিজেই বিদ্'আত বলেছেন। তিনি বলেন- نعمت البدعة هذه (এটা কতই উত্তম বিদ্'আত!) তাঁর এ বাণী আলোচ্য হাদীসের বিরোধী নয়। কেননা, তা শরীয়তের ভাষায় বিদ'আত, আভিধানিক অর্থে সুন্নাত। অথচ মুসলমানদের জন্য তা একটি বাধ্যতামূলক করণীয়। 

স্মর্তব্য যে, সমস্ত সাহাবী হিদায়াতের নক্ষত্র। বিশেষতঃ খোলাফা-ই রাশিদীন। সুতরাং আলোচ্য হাদীস এই হাদীসের বিরোধী নয়- اصحابى كالنجوم (আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য)। প্রত্যেক সাহাবীর অনুসরণই নাজাতের মাধ্যম। 

৭| (তা দাঁত দ্বারা মজবুতভাবে চেপে ধরো। প্রত্যেক নতুন কথাবার্তা থেকে দূরে থাকো। কেননা, প্রতিটি নতুন জিনিস বিদ্'আত এবং প্রত্যেক বিদ'আত গোমরাহী।)

◇ টীকাঃ ৭.
এখানে 'নতুন জিনিস' দ্বারা 'নতুন আক্বীদা' বুঝানো উদ্দেশ্য, যা ইসলামে হুযূরের পরে উদ্ভাবিত হয়েছে। এ জন্য যে, এখানে সেটাকে গোমরাহী বলা হয়েছে। গোমরাহী আক্বীদাতেই হয়ে থাকে, আমলে নয়। সুতরাং এ হাদীস আপন স্থানে ব্যাপকার্থক। সুতরাং ক্বাদিয়ানী, চকড়ালভী, রাফেযী ও খারেজী -এ সবই বিদ'আত ও গোমরাহী। 

আর যদি এটা দ্বারা 'নতুন আমল' বুঝানো উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এ হাদীসটি عام مخصوص البعض অর্থাৎ প্রতিটি মন্দ বিদ্আতই গোমরাহী। 'বিদ্আত-ই হাসানাহ্' (উত্তম বিদ্'আত) কখনো মুবাহ্, কখনো মুস্তাহাব, কখনো ওয়াজিব এবং কখনো ফরযও হয়ে যায়। হাদীসের কিতাবসমূহ এবং ক্বোরআনের পারাগুলো বিদ্'আত; কিন্তু উত্তম বিদ্'আত। এর গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ ইতোপূর্বে করা হয়েছে। 

প্রচারেঃ facebook.com/SunniAqidah
□ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা সম্বলিত টীকা পেতে সার্চ করুনঃ
📚f/Ishq-E-Mustafa ﷺ 

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী বদায়ূনী, বঙ্গানুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মান্নান, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭০,১৭১ হাদীস নং-১৫৮ এর টীকাঃ (৯১-৯৭) দ্রব্যষ্ট, প্রকাশনায়ঃ ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম। সবুজ ভবন, খাজা রোড, কুলগাঁও, ডাকঘর-জালালাবাদ-৪২১৪, বায়েজীদ, চট্টগ্রাম। ফোনঃ ০৩১-৬৮৪২২৪, মোবাইলঃ ০১১৯৯-২২৪৪০৩, ০১৮৬৮-০৩১৬২১]
 
Top