মহামারী কখন আসে? কেন আসে?


মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে ছিল না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)


মহামারী ছড়ানো কিয়ামতের নিদর্শন


সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। অশ্লীলতা থেকে বিরত ও সর্বদা পবিত্র-পরিচ্ছন্ন থাকা। কারণ কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর একটি মহামারী। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, অতঃপর তোমাদের মধ্যে বকরির পালের মহামারীর মতো মহামারী ছড়িয়ে পড়বে, সম্পদের প্রাচুর্য, এমনকি এক ব্যক্তিকে ১০০ দিনার দেওয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে। অতঃপর এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে। অতঃপর যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য।’ (বোখারি, হাদিস : ৩১৭৬)


হাদিসের ভাষ্যের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে মিলে যায়। বিশ্বব্যাপী ধনীদের মধ্যে প্রাচুর্য ও সম্পদ বেড়েই চলছে। নতুন নতুন রোগের প্রকোপ হচ্ছে, যেগুলো প্রতিরোধ করার সাধ্য কারও নেই। তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথ অনুসরণ করতে পারি।


কোরআনে বর্ণিত মহামারীতে আক্রান্ত জাতি


পাপাচারের শাস্তি হিসেবে অতীতেও আল্লাহতায়ালা মহামারী দিয়েছেন। অবাধ্য জাতিকে ধ্বংস করেছেন। দাউদ (আ.)-এর যুগের একটি ঘটনা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তুমি কি তাদের দেখোনি যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় আবাসভূমি ত্যাগ করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদের বলেছিলেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। তারপর আল্লাহ তাদের জীবিত করেন।...’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৪৩) 


তাফসির ইবনে কাসিরে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা সংখ্যায় ছিল চার হাজার। মহামারীর ভয়ে পালিয়ে ছিল। তারা বলেছিল, আমরা এমন ভূমিতে যাব যেখানে মৃত্যু নেই। তারপর তারা এক স্থানে একত্র হলে আল্লাহ তাদের ওপর মৃত্যুর ফরমান জারি করেন।’


হাদিসের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় আল্লাহতায়ালা অতীতের বিভিন্ন জাতি-গোত্রকে মহামারীর মাধ্যমে শাস্তি দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘এটি আল্লাহর গজব বা শাস্তি বনি ইসরাইলের এক গোষ্ঠীর ওপর এসেছিল, তার অবশিষ্টাংশই মহামারী।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)


মহামারী দেখা দিলে করণীয়


বেশির ভাগ মহামারীই সংক্রামক। তাই রাসুল (সা.) মহামারীর সংক্রমণ রোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। মুমিন ইমান ও ইখলাসের সঙ্গে ধৈর্য ধারণ করবে। তাই মহামারীর ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোথাও মহামারী দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে চলে এসো না। আবার কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করে থাকলে, সে জায়গায় গমন করো না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)


একটি বর্ণনায় দেখা গেছে, সিরিয়ায় মহামারী দেখা দিলে ওমর (রা.) তার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর স্থগিত করেন। (বোখারি, হাদিস : ৫৭২৯)


তাই যেখানে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে, সেখানে যাতায়াত উচিত নয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র সরকারিভাবে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে যাতায়াতে সতর্কতা জারি করেছে। চিকিৎসকদের মতে এ ভাইরাসটি একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে ছড়ায়, অন্যজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, হাত মেলানো ও কথাবার্তায় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।


মহামারীতে মৃত ব্যক্তি শহীদ


মহামারীতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামি মনে করা যাবে না। মহানবী (সা.) মহামারীতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহীদ গণ্য করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ মহামারীতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করেছে।’ (বোখারি, হাদিস : ২৮২৯)


আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মহামারীর কারণে মারা যাওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত।’ (বোখারি, হাদিস : ২৮৩০)


মহামারী থেকে বাঁচার দোয়া


হাদিসে রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার বলবে ‘বিসমিল্লা-হিল্লাজি লা ইয়াদ্বুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিস সামা-ই, ওয়াহুয়াস সামি উল আলিম’। সকাল হওয়া পর্যন্ত তার প্রতি আকস্মিক কোনো বিপদ আসবে না। আর যে তা সকালে তিনবার বলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর আচমকা কোনো বিপদ আসবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৮৮)


দোয়ার অর্থ : ‘আল্লাহর নামে যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।’


আরেকটি দোয়ায় রয়েছে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনু-নি, ওয়াল জুজামি, ওয়া মিন সাইয়িইল আসকাম।’ 

অর্থ : হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কুষ্ঠরোগ, মস্তিষ্কের বিকৃতি ও সব ধরনের দুরারোগ্য থেকে মুক্তি চাচ্ছি।’ (আদু দাউদ, হাদিস : ৫৪৯৩)


মহামারী সম্পর্কে নির্দেশনা


আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) বললেন, সংক্রমনের অস্তিত্ব নেই। তখন এক বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার উটগুলো হরিনীর ন্যায় সুস্থ থাকে। এরপর একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এগুলোর মধ্যে প্রবেশ করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত হয়ে যায়।


তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) বলেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করল? (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬১, ২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪২।


পাশাপাশি সংক্রমনের বিষয়ে সতর্ক হতেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) নির্দেশ দিয়েছেন।


তিনি বলেন, অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেয়া হবে না (রুগ্ন উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না)। (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪২-১৭৪৩)


‘যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)


এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বে সংক্রমন প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ (quarantine) ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদান করেন।


মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সকল বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।


পাশাপাশি যে সব রোগের বিস্তারে সংক্রমন একটি উপায় বলে নিশ্চিত জানা যায় সে সকল রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।


মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণ


মহামারী ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে- ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনা জাতির মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়বে তখন তাদের মধ্যে এমন এমন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ) 


যখন কোনো জনপদে অপরিচিত মহামারী দেখা দেয় তখন মানুষের জন্য ইসলামের দিক-নিদের্শনা হলো- ‘সর্ব প্রথম আল্লাহ তাআলা কর্তৃক তাকদীরের উপর খুশী থাকা। সাওয়াবের আশা নিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহর কাছে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য চাওয়া।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে এসব অবস্থায় সান্ত্বনা দিতেন। হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন, ‘মহামারি আল্লাহ তাআলার একটি শাস্তি। তবে তা মুসলমানদের জন্য আল্লাহর রহমত।’ (বুখারি) 


যারা আল্লাহ তাআলার উপর অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখে, সেসব লোকের পায়ে যদি কোনো কাটাও ফুটে, তবে তারা আল্লাহর কাছে এর বিনিময় পাবে। সুতরাং যারা মাহামারীর ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য ধারণ করবে তাদের জন্য এটি মহামারি নয়। এদের জন্য এটি আল্লাহর রহমত। এর মাধ্যমে তাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। সব সময় এ দোয়াটি পড়া-

 اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ 

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুন ওয়াল ঝুজাম ওয়া মিন সায়্যিল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি) 


অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ থেকে আশ্রয় চাই। মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। কুষ্ঠু রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। আর দূরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানিনা) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ তিরমিজিতে এসেছে, আরও একটি দোয়া পড়তে বলেছেন বিশ্বনবি-

 اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ 

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’ 

অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি) 


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ে তখন যদি তোমরা সেখানে থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হবে না। আর যদি তোমরা বাইরে থাকো তাহলে তোমরা সেই আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) 


‘হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে বা অঞ্চলে যদি কোনে প্রকার প্লেগ বা মহামারি জাতীয় সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তোমরা যারা (ওই অঞ্চলের) বাহিরে আছ তারা ওই শহরে প্রবেশ করো না। আর যে শহরে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে তোমরা যদি সে শহরে বসবাস করো তবে তোমরা সে অঞ্চল বা শহর থেকে বাহির হয়ো না।’ (বুখারি, মুসলিম) 


মহামারি মূলত আল্লাহর গজব। মহামারি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘এটি আল্লাহর গজব বা শাস্তি, যা (এ রকম শাস্তি) বনি ইসরাঈলের এক গোষ্ঠীর ওপর এসেছিল, তার বাকি অংশই হচ্ছে মহামারি। অতএব, কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা থেকে চলে এসো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় যেয়ো না।’ (তিরমিজি)


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারি আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তা ছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি।’ (ইবনে মাজাহ)


রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-‘কিয়ামতের আগে ৬টি আলামত গণনা করে রাখো->> আমার মৃত্যু; অতঃপর>> বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়; তারপর>> তোমাদের মধ্যে বকরির পালের মহামারির মতো ঘটবে মহামারি;>> সম্পদের প্রাচুর্য, এমনকি এক ব্যক্তিকে একশ দিনার দেওয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে। তারপর>>এমন সব ফেতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে। তারপর>> যুদ্ধবিরতির চুক্তি হবে; যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য।’ (বুখারি)


মহামারি নিয়ে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী

 

কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য মতে মহামারি পৃথিবীতে আল্লাহর একটি শাস্তি। যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতার মতো জঘন্য পাপ বেড়ে যায়, তখন আল্লাহ তাদের মহামারির মাধ্যমে শাস্তি দেন।  মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারি আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তা ছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা আগের লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)


আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্লেগ রোগ (মহামারি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। আল্লাহর নবী (সা.) তাঁকে জানান, এটি হচ্ছে এক ধরনের শাস্তি। আল্লাহ যার ওপর তা পাঠাতে ইচ্ছে করেন, পাঠান। কিন্তু আল্লাহ এটিকে মুমিনের জন্য রহমত বানিয়েছেন। অতএব প্লেগ রোগে কোনো বান্দা যদি ধৈর্য ধরে এবং এ বিশ্বাস নিয়ে আপন শহরে অবস্থান করতে থাকে যে, আল্লাহ তার জন্য যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোনো বিপদ তার ওপর আসবে না; তাহলে সেই বান্দার জন্য থাকবে শহীদের সাওয়াবের সমান সাওয়াব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস :  ৫৭৩৪)


মহামারি ও রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়াকে রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের অন্যতম আলামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, এরপর তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারি, বকরির পালের মহামারির মতো।...’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৭৬)


তবে এই মহামারি থেকে আল্লাহ পবিত্র নগরী মদিনাকে রক্ষা করবেন বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মদিনায় ঢুকতে পারবে না দাজ্জাল, আর না কোনো মহামারি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৩১)


দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীনতা জাতির  ধ্বংস ডেকে আনে


আল্লাহর অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘন ও অবাধ পাপাচার মহামারির অন্যতম প্রধান কারণ হলেও শুধু পাপীরাই তাতে আক্রান্ত হয় না; বরং সৎ ও নেককার মানুষও তাতে আক্রান্ত হয়। কেননা তারা দ্বিনি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে হয়তো উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের আগের যুগে আমি যাদের রক্ষা করেছিলাম তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছাড়া সজ্জন ছিল না—যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করত। তারা সীমালঙ্ঘনকারীরা যাতে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পেত তারই অনুসরণ করত এবং তারা ছিল অপরাধী।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১১৬)

 

কোরআনের বর্ণনায় মহামারিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি


অতীতেও আল্লাহ পাপাচারের শাস্তি হিসেবে মহামারি প্রাদুর্ভাব ঘটান এবং সে জাতিকে ধ্বংস করে দেন। দাউদ (আ.)-এর যুগে এমন ঘটনা ঘটেছিল। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তুমি কি তাদের দেখনি যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় আবাসভূমি ত্যাগ করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদের বলেছিলেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। তারপর আল্লাহ তাদের জীবিত করেন। ...’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৪৩)


আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তারা সংখ্যায় ছিল চার হাজার। মহামারির ভয়ে তারা পালিয়ে ছিল। তারা বলেছিল, আমরা এমন ভূমিতে যাব যেখানে মৃত্যু নেই। অতঃপর তারা এক স্থানে একত্র হলো। তখন আল্লাহ তাদের ওপর মৃত্যুর ফরমান জারি করেন।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)


এ ছাড়া একটি হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় আল্লাহ অতীতের কোনো কোনো গোত্রকে মহামারির মাধ্যমে শাস্তি দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘এটি আল্লাহর গজব বা শাস্তি বনি ইসরাঈলের এক গোষ্ঠীর ওপর এসেছিল, তার অবশিষ্টাংশই মহামারি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)


মহামারি দেখা দিলে করণীয়


যেকোনো বিপদে বান্দা আল্লাহমুখী হোক এবং তাঁর কাছে ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা করুক এটাই মহান প্রতিপালক আল্লাহর প্রত্যাশা। পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে বিপদে আল্লাহমুখী হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তাই মহামারি দেখা দিলে মুমিনের প্রধান কাজ হলো নিজের ভুল ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে বিনীত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, কিন্তু তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিনীত হলো না এবং কাতর প্রার্থনাও করে না।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৭৬)


বেশির ভাগ মহামারিই সংক্রামক। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) মহামারির সংক্রমণ রোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। মুমিন ঈমান ও ইখলাসের সঙ্গে ধৈর্য ধারণ করবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা থেকে চলে এসো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় যেয়ো না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)


সহিহ বুখারির বর্ণনায় পাওয়া যায় শামে মহামারি দেখা দিলে ওমর (রা.) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর স্থগিত করেন। (হাদিস : ৫৭২৯)


 
Top