আপনি কি মাজহাবী না সালাফী?

সময়বার্তা২৪/ আদনান ফায়সাল:
২০১৪ সালের কথা। প্রায় ২ বছর পর কানাডা থেকে বাংলাদেশ গিয়েছি। মসজিদে জুম’আর নামাজ পড়তে যেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। ইমাম সাহেব তাঁর খুতবার একটা বিশেষ অংশ জুড়ে অত্যন্ত অপ্রাসংগিকভাবে বলতে লাগলেন – “মাজহাব কেন মানতেই হবে?” যারা মাজহাব মানে না তাদের সম্পর্কে তিনি আপত্তিকর ও আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলা শুরু করলেন। আর বক্তব্য শেষ করলেন এই বলে যে – নামাজ শেষে বাসায় যাওয়ার আগে মসজিদের গেটের সামনে থেকে (ইমাম সাহেব বা তাঁর কোনো উস্তাদের লেখা) “মাজহাব কেন মানতেই হবে ?” বইটা অবশ্যই কিনে নিয়ে যাবেন।
ঘটনা এখানেই শেষ না। এই জুম’আয় “মাজহাবী” ইমামের বক্তব্যে বিরক্ত হয়ে পরের জুম’আয় “সালাফী” মসজিদে গেলাম নামাজ পড়তে। এই ইমাম সাহেব খুব সুন্দর কথা বলে খুতবা শুরু করলেন। কিন্তু, একটু পরে যখন অজুর নিয়মাবলী বর্ণনা শুরু করলেন তখন বলে উঠলেন – “আরে হানাফীদের নবী তো মুহাম্মাদ(ﷺ) না, ওদের নবী হচ্ছে আবু হানিফা!” তারপর মাজহাবী আলেমদের খুব করে ঝাড়লেন! “মাজহাবী” ইমামের মতো “সালাফী” ইমাম সাহেবও আমাকে ব্যথিত করলেন।
আমি প্রায় ৫ বছর ধরে কানাডায় আছি। এখানে আমরা যখন নামাজ পড়ি তখন হানাফী, মালিকি, শাফেঈ, হাম্বালী, সালাফী এমনকি শিয়ারা পর্যন্ত একসাথে নামাজ পড়ি – কোনদিন ঝগড়া-ঝাঁটি করি না। ইসলাম তো ঐক্যের কথা বলে, ভ্রাতৃত্বের কথা বলে, মধ্যপন্থী হওয়ার কথা বলে। আমার মনে প্রশ্ন এলো – এই তথাকথিত মাজহাবী/সালাফী বিতর্কের মধ্যম পথটা কোথায়? হাজার বছরের ঐতিহ্য “মাজহাব” বাদ দিয়ে সহীহ হাদিস অনুসরণের পক্ষে সালাফীদের যুক্তি কি? আর মাজহাবীরাই বা কেন সহীহ হাদিস এর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাদের ইমামের মত অনুসারে আমল করে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই হলো এই লেখা।
এই লেখায় আমি দুই পক্ষেরই যুক্তিগুলো তুলে ধরব, অন্য পক্ষের হয়ে সেই যুক্তিকে খন্ডন করব, এবং একটা ঐক্যে আসার চেষ্টা করব। লেখাটি আমি শুরু করব এমন কিছু শর্ত দিয়ে (Common Conditions) যাতে মাজহাবী-সালাফী দুই পক্ষই একমত। এরপর সালাফীদের বিভিন্ন যুক্তি ও সেগুলোর প্রতি-যুক্তি তুলে ধরব। তারপর, মাজহাবীদের বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরব এবং সেগুলিরও প্রতি-যুক্তি দিব। মাজহাবী-সালাফীর এই বিতর্কে একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের কি করণীয় – সেই দিকনির্দেশনা দিয়ে লেখাটি শেষ করব।



 সালাফী-মাজহাবী যেখানে একমত
“মাজহাব” শব্দের অর্থ হলো পথ বা মত। ইসলামী আইনের পরিভাষায়, মাজহাব (School of Thought) হলো এমন কিছু “উসুল” (Set of Principles) যা অনুসরণ করে কোনও কাজের শারঈ’ বিধান (অর্থাৎ হালাল, হারাম, ফরজ, নফল ইত্যাদি) নির্ধারণ করা হয় [৭]।  ইসলামের ইতিহাসে ২০টিরও বেশী মাজহাব এর সন্ধান পাওয়া যার। তার মধ্যে ৪ টি মাজহাব প্রসিদ্ধ। এগুলো হলো – ইমাম আবু হানিফার (মৃত্যু ১৪৮ হিজরী) দেয়া উসুল অনুসারে হানাফী মাজহাব, ইমাম মালিকের (মৃত্যু ১৭৯ হিজরী) দেয়া উসুল অনুসারে মালিকি মাজহাব, ইমাম শাফেঈর (মৃত্যু ২০৪ হিজরী) দেয়া উসুল অনুসারে শাফেঈ’ মাজহাব ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (মৃত্যু ২৪১ হিজরী)  এর উসুল অনুসারে হাম্বালী মাজহাব। যারা এই মাজহাবগুলোর অনুসরণ করেন তাদেরকে “মাজহাবী” বলা হয়।
“সালাফ” শব্দের অর্থ হলো পূর্বসূরী। ইসলামী পরিভাষায় “সালাফ” বলতে ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের মানুষকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ, সাহাবারা, তাঁদের পরের প্রজন্ম (তাবিঈ’ন) ও তাঁদের পরের প্রজন্মের (তাবা’ আত-তাবিঈ’ন) সবাই হলেন সালাফ [১৩,১৪]। বর্তমান সময়ে যে সব ইমাম প্রচলিত চার মাজহাবের একটিকে নির্দিষ্টভাবে অনুসরণ না করে, চার মাজহাবের মতামত ও অন্যান্য প্রখ্যাত ইমামের মতামতগুলোকে তুলনা করে যে মতামতটিকে কুরআন  ও সহীহ হাদিসের সাথে সবচেয়ে বেশী সংগতীপূর্ণ মনে করে থাকেন – সেটাকে অনুসরণ করেন তাঁরা নিজেদেরকে “সালাফী” হিসাবে পরিচয় দেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন তাঁরা সালাফদের পদ্ধতিতে ইসলাম পালন করেন।
এক মাজহাব থেকে অন্য মাজহাব স্বকীয় হয় তার উসুল (“Set of Principles”) এর কারণে। আবার, “মাজহাব” থেকে “সালাফী তত্ত্ব” স্বকীয়ও হয় তার উসুল (“Set of Principles”) এর কারণে।  মাজহাবী/সালাফীদের মধ্যে আজকে আমরা যতই বিরোধীতা দেখি না কেন, উসুল (“Set of Principles”) সংক্রান্ত নিচের বিষয়গুলোতে দুই পক্ষই কিন্তু একমত:
সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবে কুরআন ও সহীহ হাদিস (এদেরকে একত্রে আন-নাস বলে)
এর পর মর্যাদা পাবে ইজমা’ (সাহাবা বা কোনও যুগের সকল আলেমের ঐক্যমত)
উপরের তথ্যগুলির সাহায্যে কোনো বিষয়ের ফিকহ (Islamic Ruling / Understanding) নির্ধারণ না করা গেলে কিয়াস (Analogy) ব্যবহার করা যাবে।
কুরআন ও হাদিসকে সেভাবে বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবী ও সালাফরা বুঝেছিলেন। কারণ, তাঁরা যেহেতু রাসূলুল্লাহ(সা) এর সরাসরি ছাত্র ছিলেন তাই তাঁদের চাইতে ভালো আর কেউ এই বিষয়গুলো বুঝতে পারবে না।  (এই চতুর্থ পয়েন্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা মনের মধ্যে গেঁথে ফেলুন, এই ব্যাপারটা বারে বারে আসবে।)



সালাফী-মাজহাবী যেখানে দ্বিমত
মাজহাব এর সাথে সালাফি তত্ত্বের একটা অন্যতম পার্থক্য হলো মাজহাবীদের কাছে তাদের ইমামের মতামতও একটি দলীল [৪]। এর যুক্তি হলো – যেহেতু ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফারা তাবেঈ’দের সরাসরি ছাত্র ছিলেন, কাজেই তাঁরা যদি কোনো মতামত দিয়ে থাকেন সেটা অবশ্যই তাবেঈ’ ও সাহাবাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কাজেই তাঁদের মতের সমর্থনে শুদ্ধ হাদিস না পাওয়া গেলেও খুব সহজেই তাদের মতামত বাদ দেয়া যাবে না (এ বিষয়ে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)। বরং, তাঁদের মতামতকে বাদ দেয়ার জন্য সেই মত-বিরোধী শক্ত কোনো হাদিস বা অন্য প্রমাণ থাকতে হবে। অন্যদিকে, সালাফীরা সাধারনত শুদ্ধ সনদ (বর্ণনাকারীর ধারা) ছাড়া কোনো হাদিস গ্রহণ করে না।

মাজহাব এর সাথে সালাফি তত্ত্বের আরেকটা পার্থক্য হলো – প্রত্যেক মাজহাবের পক্ষেই গত ১১০০ বছরের হাজার হাজার ইমাম আছেন। শরীয়তের কোনও আদেশ পালনের ক্ষেত্রে কোনও মাজহাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামের ঐক্যমতকে ঐ মাজহাবের ফিকহ (Understanding) বলা হয়। অন্যদিকে সালাফী মতবাদ শুরু হয়েছে মাত্র দুই-আড়াইশ বছর আগে। ফলে, সালাফী মতবাদের ইমামদের মধ্যে সেরকমভাবে কোনো ঐক্যমত এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি [৭]। যেমন – শাইখুল হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানী মনে করেন একজন মুসলিম নিজেকে “সালাফী” পরিচয় দিতে পারবে, কিন্তু শেইখ উথাইমিন মনে করেন একজন মুসলিম নিজেকে “মুসলিম” হিসাবেই পরিচয় দিবে [২১]। কাজেই, একজন সালাফী ঐতিহাসিক ইমাম-গোষ্ঠির ফিকহ (Understanding) অনুসরণ করে না, সে আধুনিক সময়ের একজন ব্যক্তি-ইমামের ফিকহ অনুসরণ করে। তাই আপনি একজন সালাফীকে বলতে শুনবেন – “আমি নাসিরুদ্দীন আলবানির বই/ফিকহ অনুসারে নামাজ পড়ি”। অন্যদিকে একজন মাজহাবী হয়তো বলবে – “আমি মালিকি মাজহাব অনুসারে নামাজ পড়ি”।

এই দুই মতবাদের আরো পার্থক্য জানার জন্য এই [৭] লেকচারটি শুনতে পারেন।



সালাফীদের যুক্তি ও প্রতি-উত্তর
লেখার এই অংশে আমরা সালাফীদের বিভিন্ন যুক্তি [১,২,৩] সম্পর্কে জানবো – কেন তাঁরা মনে করেন মাজহাব বাদ দিয়ে কুরআন আর সহীহ হাদিসের অনুসরণ করতে হবে? একই সাথে আমি সালাফীদের যুক্তিগুলোকে খন্ডন করারও চেষ্টা করব। যুক্তি-খন্ডন করতে যেয়ে আমি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মালিকি মাজহাবের উসুল (“Set of Principles”) কে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করব। কারণ, যুক্তি-খন্ডনের কথাগুলো আমি মূলত: শেইখ হামযা ইউসুফের লেকচার [৪] থেকে নিয়েছি যিনি একজন মালিকি ইমাম।
সালাফী যুক্তি ১: সকল বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে আমাদের কুরআন ও সহীহ হাদিস মানতে হবে। কিন্তু, প্রচলিত মাজহাবগুলোতে আমরা এমন অনেক বিধান দেখি, যেগুলো সহীহ হাদিস বিরোধী। কাজেই মাজহাবের অনুসরণ করা যাবে না।
যুক্তি-খন্ডন: এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের সব ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মানতে হবে। কিন্তু এমন অনেক সুন্নাহ আছে, যা হাদিস আকারে লিপিবদ্ধ হয়নি কিন্তু মদীনার সাহাবাদের মধ্যে সেই সুন্নাহগুলোর প্রচলন ছিল। ইমাম মালিক এই ক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের বিপরীতে সাহাবাদের আমলকে প্রাধান্য দিয়েছেন।  যেমন – শুক্রবারে নফল রোযা রাখা যাবে না, এটা সহীহ হাদিস। কিন্তু, ইমাম মালিক মদীনায় তাবেঈ’নদের মধ্যে শুক্রবারে নফল রোযা রাখার প্রচলন দেখেছেন। এই তাবেঈ’নরা সরাসরি সাহাবাদের থেকেই এই আমল শিখেছেন। ইমাম মালিকের মতে, হয়তো পরবর্তীতে “শুক্রবারে নফল রোজা রাখা যাবে না” হাদিসের বিপরীতে “শুক্রবারে নফল রোজা রাখা উচিত” এর হুকুম রাসূলুল্লাহ(সা) দিয়েছিলেন, ফলে আগের হুকুমটি বাতিল (Abrogate) হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ঐ হুকুমটি হাদিস আকারে আমাদের কাছে পৌঁছায়নি, পৌঁছেছে সাহাবাদের আমলের (Practise) মাধ্যমে।  কাজেই, মালিকি মাজহাব অনুসারে শুক্রবারে নফল রোযা রাখা সুন্নাত, যদিও এর বিপরীতে সহিহ হাদিস আছে [৪]! সুতরাং,  চতুর্থ পয়েন্টের  “কুরআন ও হাদিসকে সেভাবে বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবী ও সালাফরা বুঝেছিলেন” – মাজহাবীরা মনে করে এই মূলনীতি সালাফীরা যতটা অনুসরণ করে, তারা তার চেয়েও বেশী অনুসরন করে।


সালাফী যুক্তি ২: মাজহাবগুলো যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন ইমাম বুখারী (মৃত্যু ২৫৬ হিজরী) ও ইমাম মুসলিমের (মৃত্যু ২৬১ হিজরী) মতো সহীহ হাদিস গ্রন্থগুলো লেখা হয়নি। ফলে, মাজহাবের ইমামরা অনেক সহীহ হাদিস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। অথবা, কোনো হাদিসকে উনারা হয়তো দুর্বল বলে বাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ হাদিসটি অন্য কোনো সনদে সহীহ ছিল, যা জানা গিয়েছিলো পরবর্তী সময়ে। এই কারণে মাজহাবগুলোতে এমন অনেক মতামত দেখা যায়, যা সহীহ হাদিস বিরোধী।
যুক্তি-খন্ডন: এই যুক্তিটা বিভিন্ন কারণে [৪] দুর্বল। যেমন –
প্রথমত:  হাদিস সংকলন শুরু হয়েছিলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবিতকালেই। একথা সুপ্রসিদ্ধ যে, আবু হুরাইরা(রা), ইবনে আব্বাস(রা), আমর ইবনুল আস(রা) সহ প্রচুর সাহাবী লিখিত আকারে হাদিস সংরক্ষণ করেছিলেন [১৫]। এই সব কিতাবের হাদিসগুলি পরবর্তী যুগের হাদিসগ্রন্থগুলোর (যেমন – বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ইত্যাদি) মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। তাই, মদীনার সাহাবারা-তাবেঈনরা বুখারী-মুসলিমের হাদিসগুলো জানতেন না, এ কথা অমূলক।
দ্বিতীয়ত: বেশীরভাগ হাদিসের উৎস মূলত মদীনা শহর, আর ইমাম মালিক তাঁর সারাটা জীবন মদীনায় কাটিয়েছেন তাবেঈনদের কাছে পড়াশুনা করে। ইমাম মালিক সরাসরি ৬০০ তাবেঈনের কাছ থেকে হাদিস ও ফিকহ শিখেছেন, আর এই ৬০০ তাবেঈন শিখেছেন সরাসরি সাহাবীদের কাছ থেকে, মদীনায় তখন ১০ হাজার সাহাবী ছিল।  ইমাম মালিক হাদিস শিখেছেন ঐ যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিশাম ইবনে ‘উরওয়া, ইবনে শিহাব আল-যুহরীর মতো বাঘা মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে আহকাম (হালাল-হারাম) সংক্রান্ত হাদিসের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশী নয়। কাজেই, ইমাম মালিক কোনো বিষয়ের আহকাম সংক্রান্ত সহীহ হাদিসগুলো জানতেন না এই সম্ভাবনা খুবই কম।
তৃতীয়ত: যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে ইমাম মালিক ১০%-১৫% সহীহ হাদিস জানতেন না, তবুও আপনি বলতে পারবেন না যে, মালিকি মাজহাব সহীহ হাদিস এর উপর আমল করে না। এর কারণ হলো, আমরা আগেই বলেছি “মাজহাব” বলতে বুঝায় “উসুল” বা Set of Principles, মাজহাব বলতে কোনো নির্দিষ্ট শারঈ’ বিধানকে বুঝায় না। ইমাম মালিকের মৃত্যুর পর থেকে যখনই নতুন কোনো হাদিস পাওয়া গেছে তখনই মালিকি মাজহাবের আলেমরা সেই নতুন হাদিসের আলোকে তাঁদের বিধানে পরিবর্তন এনেছেন, কিন্তু ইমাম মালিকের দেয়া “উসুল” অনুসরণ করেছেন। একই ব্যাপার অন্য মাজহাবগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন – ইমাম আবু হানিফার ছাত্র শাইবানী (মৃত্যু ১৮৯ হিজরী) বহু ক্ষেত্রে নতুন হাদিসের আলোকে ইমাম আবু হানিফার মতের বিরোধী মতামত দিয়েছেন। কিন্তু, তারপরেও ইমাম শাইবানী হানাফী মাজহাবের অনুসারী, কারণ তিনি ইমাম আবু হানিফার “উসুল” অনুসরণ করেছেন। গত ১১০০ বছর ধরে বিভিন্ন মাজহাবের আলেমরা এভাবে করেই নতুন পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাঁদের মতামতে পরিবর্তন এনেছেন।
উল্লেখ্য যে, হানাফী মাজহাবের উসুল অনেক অংশেই নেয়া হয়েছে কুফার সাহাবাদের কাছ থেকে [২৮]। আলী(রা) তাঁর খিলাফত মদীনা থেকে কুফায় সরিয়ে নেয়ার পর, বহু সংখ্যক সাহাবী কুফায় চলে আসেন। আলী (রা) সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদকে কুফার কাজী নিযুক্ত করেন। আর কুফার সাহাবীদের উসুলই হানাফী মাজহাবের উসুল।






সালাফী যুক্তি ৩: মাজহাবগুলি তাদের ইমামের মতামত এর বিপরীতে সহীহ হাদিস পাওয়া যাওয়ার পরেও সহীহ হাদিসের অনুসরণ না করে তাদের ইমামের মতামতকে অনুসরণ করে। কিন্তু, সকল মাজহাবের ইমামই কি বলেননি “সহীহ হাদিসই আমার মাজহাব”?
উত্তর: প্রত্যেক ইমামই যথাসাধ্য সহীহ হাদিস অনুসরণ করেছেন এবং সেই মাজহাবের আলেমরাও সবসময় সহীহ হাদিসের ভিত্তিতেই বিধান দিয়েছেন। কিন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে যে সহীহ হাদিসকে সেভাবেই বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবারা বুঝেছিলেন (৪ নং পয়েন্ট)। এমন বহু সহীহ হাদিস আছে যেগুলো অন্য সহীহ হাদিস বা কুরআনের আয়াত দ্বারা অবলুপ্ত (Abrogate) হয়ে গেছে, আবার এমনও সহীহ হাদিস আছে যেগুলো ১০০% সত্য হওয়ার পরেও সাহাবারা সেগুলির উপর আমল করতেন না, কেন করতেন না সেটা আমাদের অনেক ক্ষেত্রে জানা আছে, অনেক ক্ষেত্রে জানা নেই।
আসুন মালিকি মাজহাব থেকে একটা উদাহরণ দেখা যাক। ইমাম মালিক তার মুওয়াত্তায় নামাজে দাড়িয়ে হাত বুকে রাখতে হবে এই সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু, ইমাম মালিকই তাঁর মাজহাবে হাত ছেড়ে নামাজ পড়তে বলেছেন। কেন? কারণ, ঐ যে – “হাদিস বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবারা তা বুঝেছিলেন”। ইমাম মালিক মদীনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ তাবেঈ’নদের হাত ছেড়ে নামাজ পড়তে দেখেছেন, তাবেঈনরা এটা দেখেছেন মদীনার সাহাবাদের কাছ থেকে। ইমাম মালিকের এই মতের পক্ষের হাদিসও কিন্তু বুখারী শরীফেই আছে [২৩,২৪,২৫]। বর্ণিত হাদিসটিতে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) একজন সাহাবীকে শিখিয়েছেন কিভাবে নামাজ পড়তে হবে, কিন্তু তিনি তাকে হাত বাঁধার কথা বলেননি।  মালিকি মাজহাবের মতে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কখনো কখনো হাত বেঁধে নামাজ পড়েছেন এটা দেখানোর জন্য যে, ইচ্ছা করলে এভাবেও নামাজ পড়া যায়। উল্লেখ্য, অনেকে বলে থাকে যে, ইমাম মালিক মৃত্যুর আগের শেষ কয়দিন “হাতে ব্যথা থাকার কারণে” হাত না বেঁধে নামাজ পড়তেন – এই কথার কোনও ভিত্তি নেই [৪]।
আবার অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, অনেক সুন্নাহ/হাদিস আছে যা সালাফদের জানা ছিল, কিন্তু সেই সুন্নাহটি সহীহ হাদিস আকারে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে নাই। কারণ, ইমাম বুখারী (মৃত্যু ২৫৬ হিজরী) বা ইমাম মুসলিম (মৃত্যু ২৬১ হিজরী) যেহেতু মাজহাবের ইমামদের প্রায় ৫০/৬০ বছর পর হাদিস সংগ্রহ শুরু করেছেন, এমন হতেই পারে – যে হাদিসটি ইমাম মালিক বা ইমাম আবু হানিফার কাছে সহীহ ছিল, তা বুখারী-মুসলিমের যুগে আসতে আসতে যইফ (দুর্বল) হয়ে গেছে। কিন্তু, মাজহাবের ইমামরা সেই সুন্নাহ সম্পর্কে সহীহ সনদে অবগত ছিলেন এবং সেই অনুসারে তাদের মাস’আলা দিয়েছেন।
“হাদিসের এ সকল গ্রন্থ সংকলিত হওয়ার পূর্বে যে সব ইমাম অতিক্রান্ত হয়ে গেছেন তাঁরা পরবর্তীদের চেয়ে অনেক বেশী হাদিসের জ্ঞান রাখতেন। কারণ, তাঁদের নিকটে এমন বহু হাদিস ছিল যা আমাদের পর্যন্ত মাজহুল (অজ্ঞাত) বা মুনকাতি’ (বিচ্ছিন) সনদে পৌঁছেছে কিংবা আদৌ পৌঁছেনি”।  (রাফউল মালাম আনিল আয়িম্মাতিল আ’লাম – ইবনে তাইমিয়াহ – পৃষ্ঠা ১৮। [১৯]





সালাফী যুক্তি ৪: সাহাবাদের তো কোনো মাজহাব ছিল না, আপনারা মাজহাব পেলেন কোত্থেকে?
যুক্তি-খন্ডন: আমরা আগেই বলেছি কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে বিধান দেয়ার “উসুল” (Set of Principles) কেই মাজহাব বলে। সাহাবীরাও কিছু “উসুল” অনুসরণ করেই বিধান দিতেন। একথা সুবিদিত যে মদীনার সাহাবাদের “উসুল” (Set of Principles) , কুফার সাহাবাদের “উসুল” (Set of Principles) থেকে আলাদা ছিল [৪,৭]।
আর আপনি যদি সাহাবাদের পদ্ধতিই অনুসরণ করতে চান তাহলে আমি বলব সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে ইমাম মালিকের মাজহাব অনুসরণ করা। কারণ, ইমাম মালিকের জীবদ্দশায় এই মাজহাবের নাম কিন্তু মালিকি মাজহাব ছিল না, এর নাম ছিল “মাদানী মাজহাব”, কারণ মদীনার সাহাবী ও তাবেঈনরা এই “উসুল” অনুসরণ করতেন। ইমাম মালিক শুধু সেই “উসুল” কে একটা সিস্টেম এর মধ্যে এনে লিপিবদ্ধ করে একে মাজহাব এর রূপ দিয়েছেন।
সালাফী যুক্তি ৫: সব মাজহাব যদি একই কুরআন আর সুন্নাহ এর অনুসরণ করে থাকে, তাহলে এদের বিধানগুলো এত আলাদা কেন?
যুক্তি-খন্ডন: একই কুরআন – সুন্নাহ অনুসরণ করার পরেও বিধান আলাদা হয় আলাদা “উসুল” [৪,৬,১৯] এর কারণে। “উসুল” এর এই পার্থক্যের কিছু উদাহরণ দেখুন –
ইমাম মালিক মুরসাল হাদিস (যে হাদিস সাহাবা নয় বরং তাবেঈ’ থেকে বর্ণিত হয়েছে) গ্রহণ করেছেন, আর ইমাম শাফেঈ’ শুধু নির্দিষ্ট কিছু তাবেঈ’র মুরসাল হাদিস নিয়েছেন।
ইমাম মালিক মদীনার তাবেঈ’দের আমলকে সহীহ হাদিসের বিপরীতে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি হলো – যে মদীনার মাটিতে ১০ হাজার সাহাবা শুয়ে আছেন, সেই মদীনার সাহাবা ও তাবেঈ’দের আমল সহীহ হাদিসের চাইতেও শক্ত দলীল (আবার সেই ৪ নং পয়েন্ট)। কারণ, হাদিস বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে তাঁদের জ্ঞান নি:সন্দেহে বেশী ছিল।
কিছু মুতাওয়াতির হাদিস (যে হাদিস তার সনদের প্রত্যেক স্তরে বহু মানুষ দ্বারা বর্ণিত হয়েছে) আছে যেগুলি কুরআনের আয়াতের সাথে আপাত: দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক (Apparently Conflicting)। এই ক্ষেত্রে কি কুরআনের আয়াত নেয়া হবে নাকি হাদিসকে নেয়া হবে – তা নিয়ে মাজহাবগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একেক মাজহাব এক্ষেত্রে একেকটাকে প্রাধান্য দিয়েছে।
যদি কোনও আহাদ হাদিস (যে হাদিসের সনদের প্রতিটা স্তরে তিনজনের বেশী বর্ণনাকারী পাওয়া যায় না) কুরআনের কোনো প্রতিষ্ঠিত নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে হানাফী মাজহাব হাদিস সহীহ হওয়া সত্ত্বেও, সেটা না নিয়ে কিয়াস ব্যবহার করে। এটা একটা কারণ যার ফলে আমরা হানাফী মাজহাবে সহীহ হাদিস বিরোধী এত আহকাম (Islamic Ruling) দেখতে পাই।
কোন্‌ হাদিসগুলো ‘আম (General), আর কোন্‌ হাদিসগুলো খাস (Specific/Exception) – এই বিষয়ে ইমামদের মতপার্থক্যের কারণেও ফিকহী পার্থক্য হয়।
অন্যদিকে হাম্বালী ও সালাফীরা হাদিসকে আক্ষরিক ভাবে মেনে চলেন, ফলে আমরা হাদিসের কিতাবগুলিতে যে হাদিসগুলি পাই, সেগুলোর সাথে এই মাজহাবগুলোর সরাসরি মিল সবচেয়ে বেশী।



আবু-বকর(রা) ও উমার(রা) এর মতপার্থক্য [২৯]: “উসুল” এর এই ধরনের পার্থক্য সাহাবাদের সময় থেকেই ছিল, আর তাবেঈনদের মধ্যে তো ছিলই। দুইজন সম্পূর্ন ভিন্ন বিধান এর অনুসারী হয়েও দুইজনেই সঠিক হতে পারে, যদি তাদের নিয়ত হয় আল্লাহর ﷻ হুকুমকে মনে চলা। শ্রেষ্ঠ দুই সাহাবী আবু বকর(রা) ও উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) অসংখ্য বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন, তারপরেও তারা দুইজনেই রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-কে নিঁখুতভাবে অনুসরণ করেছেন [২৭]। যেমন – আবু বকর(রা) এর খিলাফতকালে সাহাবীদের যে ভাতা দেয়া হতো, তা সকল সাহাবার জন্য সমান অংকের ছিল। আবু বকর(রা) এর যুক্তি ছিল – মহান আল্লাহ ﷻ কুরআনে বলেছেন যে তিনি সকল সাহাবার উপরই সন্তুষ্ট (http://quran.com/9/100) , তাই তাঁরা সবাই সমান ভাতা পাবেন।
অন্যদিকে, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) খলীফা হওয়ার পরেই এই নিয়মের পরিবর্তন করলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যারা ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে তা গ্রহন করেছে, তারা যে কষ্ট সহ্য করেছে সেই তুলনায় যারা পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা অনেক কম কষ্ট সহ্য করেছে, ফলে তাদের মর্যাদাও কম। কে কত আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে এর ভিত্তিতে তিনি ভাতার স্কেল নির্ধারণ করেন। এখানে আবু বকর(রা) ও উমার(রা) এর মতামত সম্পুর্ণ বিপরীত – কিন্তু তাঁরা দুইজনেরই নিয়ত ছিল রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কে  নিঁখুতভাবে অনুসরণ করা। সাহাবাদের জীবন ঘাঁটলে এরকম অগুনতি পরষ্পর-বিরোধী মতামত পাওয়া যায় [২৭]। কিন্তু, যেহেতু তাঁদের প্রত্যেকেরই নিয়ত শুদ্ধ ছিল, কাজেই যিনি যে বিধান অনুসরণ করেছেন, তাঁর জন্য সেটাই শুদ্ধ ছিল।
সালাফী যুক্তি ৬: শাফেঈ’ মাজহাব বলে অজু করে স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অজু থাকে না, হানাফী মাজহাব বলে অজু থাকে। কিন্তু, দুইটা তো একই সাথে সঠিক হতে পারে না। তার চাইতে যে মতামতটা অধিকতর সঠিক সেটা অনুসরণ করাই কি উচিত না?
যুক্তি-খন্ডন: প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক মাজহাব তাদের “উসুল” (Set of Principles) অনুসারে যেটা সবচেয়ে সঠিক সেটাই বেছে নিয়েছে। “স্ত্রীকে স্পর্শ করলেও অজু থাকে” – হানাফী মাজহাবে এটাই সঠিক। কারণ, আবু দাউদের সহীহ হাদিসে আছে – রাসূলুল্লাহ(ﷺ) অজু করার পর আয়েশা(রা) কে স্পর্শ করা সত্ত্বেও আবার অজু না করেই নামাজ পড়েছেন। অন্যদিকে, শাফেঈ’ মাজহাব এর মতে  “স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অজু থাকে না ” –  এটাই সঠিক (এই বিষয়ে শাফেঈ মাজহাবের বিস্তারিত প্রমাণের জন্য এই লেখাটি পড়ুন)। কারণ, তাদের মতে সূরা মায়িদার ৬ নং আয়াতে আল্লাহ ﷻ বলেছেন – “স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অজু থাকবে না” এবং এই আয়াতটি আবু দাউদের হাদিসের উপর প্রাধান্য পাবে, ফলে আবু দাউদের হাদিসের বিধানটি অবলুপ্ত (Abrogate) হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। কাজেই, আপনি যদি বলে থাকেন ইমাম আবু হানিফা এর মতামত এক্ষেত্রে ইমাম শাফেঈ’র মতামতের চেয়ে বেশী সঠিক, তাহলে আপনি আসলে বলছেন যে সেটা আপনার “উসুল” অনুসারে বেশী সঠিক।





সালাফী যুক্তি ৭: আব্বাসীয় শাসন আমলে এরকম ফতোয়া ছিল যে, হানাফীরা শাফেঈদের বিয়ে করতে পারবে না। শুধু তাই না, দামেস্ক ও মক্কায় চার মাজহাবের জন্য চারটি পৃথক মিহরাব ছিল এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন জামাতে নামাজ পড়ত। কাজেই, এভাবে করে মাজহাব কি মুসলিম উম্মাহ এর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে নাই?
উত্তর: মাজহাব নিয়ে এ ধরনের বাড়াবাড়ি অতীতে হয়েছে একথা সত্য এবং মাজহাবের নামে মুসলিম উম্মাহর এইরকম বিভক্তি মোটেও কাম্য নয় [৪]। কিন্তু, আপনি যখন জানবেন কেন এরকম করা হয়েছিল, তখন পুরো বিষয়টাকে ভিন্ন দৃষ্টিভংগীতে দেখতে পারবেন।
হানাফী আর শাফেঈ’রা একে অপরকে বিয়ে করতে পারবে না —এই ফতোয়া এই জন্য দেয়া হয়েছিল যে, দুইটি ভিন্ন মাজহাবের বিয়ে সংক্রান্ত বিধি-বিধানগুলো ভিন্ন হওয়ায়, একজন মুফতীর পক্ষে কিছু কিছু ব্যাপারে মতামত (Islamic Ruling) দেয়া কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন – এক মাজহাব মনে করে ডিভোর্সের জন্য একবার তালাক বলতে হবে, আর আরেক মাজহাব মনে করে ডিভোর্সের জন্য তিনবার তালাক বলতে হবে।  স্বামী-স্ত্রী দুইজন যদি দুই ভিন্ন মাজহাবের মানুষ হয়, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, কোন্ মাজহাব অনুসারে তাদের মামলা পরিচালনা করা হবে? এই ধরনের ঝামেলা এড়ানোর জন্য তখনকার মুফতিরা “এক মাজহাবের মানুষ অন্য মাজহাবের মানুষকে বিয়ে করতে পারবে না” – জাতীয় উদ্ভট ফতোয়া দিয়েছিল, যেটা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। তাদের উচিত ছিল কিভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় রাখা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা [৪]।
মক্কায় আর দামেস্কে চার মাজহাবের জন্য চার মিহরাব স্থাপন হলো মাজহাব-সন্ত্রাসের এক চরম উদাহরণ, যা অস্বীকার করার উপায় নাই [৪]। কিন্তু এর দোষ আপনি মাজহাবকে দিতে পারেন না, এর জন্য দোষ দিতে হবে মানুষের চরমপন্থী চিন্তাভাবনাকে। চরমপন্থী চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই খারাপ, তা সে মাজহাব নিয়েই হোক, সালাফীবাদ নিয়েই হোক আর নাস্তিকতা নিয়েই হোক। মাজহাবী চরমপন্থার যে উদাহরণ আপনি দিচ্ছেন, সেই একইরকম উদাহরণ নাস্তিকেরা ব্যবহার করে এটা প্রমাণ করার জন্য যে “ধর্ম খারাপ”। কারণ, ধর্মের কারণে আগের শতাব্দীগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু, ভেবে দেখুন আগের শতাব্দীর সেই গণহত্যাগুলোর জন্য কি ধর্ম দায়ী নাকি মানুষের চরমপন্থী চিন্তা-ভাবনা আর অন্য মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দায়ী?



সালাফী যুক্তি ৮: রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন সেভাবে নামাজ পড় যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ, তারপরেও মাজহাবীরা সহীহ হাদিসের বিপরীতে নামাজ পড়ে  কেন?
উত্তর: লক্ষ্য করুন – রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন – “সেভাবে নামাজ পড়ো যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ” (বুখারী)। মাজহাবীদের মতে – রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর মতো করে নামাজ পড়ার দাবী যতটা ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা করতে পারেন, শাইখুল হাদিস আলবানী ততটুকু করতে পারেন না [৪]। কারণ, ইমাম আবু হানিফা নামাজের মাস’আলা নিয়েছেন মূলত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ এর ছাত্রদের থেকে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ মক্কার প্রথম ১০ জন ইসলাম গ্রহনকারীদের একজন যিনি দীর্ঘ ২০ বছর রাসূলুল্লাহ(ﷺ) এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়েছেন। সাহাবারা রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কে নামাজ পড়তে “দেখেছেন”, আবার তাবেঈ’রা সাহাবাদের নামাজ পড়তে “দেখেছেন”। আপনাকে স্বীকার করতে হবে – কোন কিছু “পড়ে শেখার” চেয়ে উস্তাদের কাছ থেকে সরাসরি “দেখে শিখলে” ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
অন্যদিকে, ইমাম মালিক তাঁর নামাজের মাস’আলাগুলো নিয়েছেন [৪] প্রধানত: আব্দুল্লাহ ইবনে ‘উমার(রা) এর ছাত্র ও মুক্তিকৃত দাস নাফি’ (মৃত্যু ১১৭ হিজরী) থেকে, আর নাফি’ নিয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে ‘উমার(রা) থেকে, যিনি সব সাহাবীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কে সবচেয়ে অনুকরণ বেশী করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) সেই ধরনের জুতা পড়তেন যা রাসূলুল্লাহ(ﷺ) পড়তেন, ঠিক একই কাপড় পড়তেন যা রাসূলুল্লাহ(ﷺ) পড়তেন। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে উনি নামাজ পড়তেন যেভাবে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) পড়তেন না? ইমাম বুখারী নিজে “ইমাম মালিক -> নাফি’ -> আব্দুল্লাহ ইবনে উমার -> রাসূলুল্লাহ(ﷺ)” এর সনদ কে “স্বর্ণালী সনদ” (সিলসিলাতুল যাহাব / The Golden Chain of Narrators) বলে আখ্যায়িত করেছেন।     এখন আপনিই বলেন – রাসূলুল্লাহ(ﷺ) কিভাবে নামাজ পড়েছেন, সেই নামাজ কি ইমাম মালিক বেশী বলতে পারবেন, না ১৪০০ বছর পরের কোনও আলেম সঠিকভাবে বলতে পারবে?
আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু কিছু সুন্নাহ আছে যেগুলো লিখিত আকারে সংরক্ষিত হয়নি। সাহাবারা, তাবেঈ’রা  অনেক সুন্নাহই সংরক্ষণ করেছেন তাদের কাজের (Practise) মাধ্যমে। আর মাজহাবের ইমামরা অনেক ক্ষেত্রেই সহীহ হাদিসকে বাদ দিয়ে সালাফদের কাজকে (Practise) প্রাধান্য দিয়েছেন। এর কারণ হলো সেই ৪ নং পয়েন্ট – “হাদিস বুঝতে হবে যেভাবে সাহাবারা বুঝেছিলেন”। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – মালিকি মাজহাবে “রাফ’উল ইয়াদাইন” করা হয় না। যদিও ইমাম মালিক রাফ’উল ইয়াদাইনের হাদিস সম্পর্কে জানতেন। ইমাম মালিকের মতামত হচ্ছে রাসূলুল্লাহ(ﷺ) মাঝে মধ্যে রাফ’উল ইয়াদাইন করে দেখিয়েছেন যে, নামাজের যে কোনো আল্লাহু আকবারের সাথে চাইলে হাত তোলা যায়, এটা মাকরুহ নয়। এই মতামতের পিছনে যুক্তি কি? এর যুক্তি হলো – রাফ’উল ইয়াদাইনের হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবা আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রা) নিজেই নামাজে রাফ’উল ইয়াদাইন করতেন না, কাজেই এর থেকে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ(ﷺ)ও সাধারণত রাফ’উল ইয়াদাইন করতেন না। তাই, ইমাম মালিক রাফ’উল ইয়াদাইনের হাদিস জানা সত্ত্বেও তার পক্ষে মত দেননি।




 
Top