সাহাবাবৃন্দ কি মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন করেছিলেন?

মূল: সুফফাহ ফাউন্ডেশন

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[Bengali translation of Suffah Foundation's Online article "Did the Sahaba celebrate Mawlid?" Translator: Kazi Saifuddin Hossain]


সূচিপত্রঃ


❏সাহাবাবৃন্দের আমলের আলোকে মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের শরয়ী বৈধতা

❏মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর সংজ্ঞা

❏১/ - ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে কোনো নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নির্ধারণ

❏২/ - আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর যিকর-তাযকেরার উদ্দেশ্যে সমাবেশ

❏যিকরের সমাবেশ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার অভিমত

❏৩/ - দান-সদকাহ

❏৪/ - মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ

❏৫/ - পদ্য, নাশীদ ও না’ত আবৃত্তি 

❏৬/ - প্রিয়নবী (ﷺ)-এর প্রতি মহব্বত প্রকাশ ও জশনে জলূস

❏৭/ - মসজিদ আলোকসজ্জা 


ওপরের এই রেওয়ায়াত থেকে চারটি বিষয় উপলুব্ধ হয়:



আল্লাহর নামে অরম্ভ, যিনি অত্যন্ত দয়ালু, দাতা।

আমাদের আকা ও মওলা হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ), তাঁর আহলে বায়ত (رضي الله عنه) ও আসহাবে কেরাম (رضي الله عنه)-এর প্রতি সালাত ও সালাম।


সাহাবা-বৃন্দের আমলের আলোকে মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের শরয়ী বৈধতা  


আমাদের মধ্যে একটি সংখ্যালঘু দল সাহাবা-এ-কেরাম (রা.) কর্তৃক মীলাদুন্নবী (ﷺ) পালনের প্রমাণ প্রদর্শনের জন্যে প্রায়ই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতকে চ্যালেন্জ করে থাকে। এসব সংকীর্ণ মস্তিষ্কের লোক যা উপলব্ধি করে না তা হলো, প্রতিটি এবাদত-বন্দেগী, প্রতিটি পুণ্যদায়ক কর্ম যা আমরা অনুশীলন করি, তা প্রকৃতপক্ষে মীলাদেরই উদযাপন তথা যিকর-তাযকিরাহ। কেননা, প্রিয়নবী (ﷺ)-এর বেলাদত তথা মীলাদ না হলে আমরা এমন কি মুসলমানও হতে পারতাম না। ইসলামের পথে আমরা যদি এমন কি মুসলমান-ই না হতে পারি, তাহলে আমাদের হৃদস্পন্দনের কী-ই বা মূল্য থাকবে? আমাদের নেয়া প্রতিটি নিঃশ্বাস যে মহানবী (ﷺ)-এর মীলাদ (ধরাধামে শুভাগমন)-এর কারণে আল্লাহতা’লার দানকৃত এক রহমত (করুণা)-বিশেষ, সে কথা যারা বুঝতে পারে না, আল্লাহতা’লা যেন তাদেরকে হেদায়াত দান করেন।


সাহাবা (রা.)-বৃন্দ এই বিষয়ে যে আমল পালন করেছেন, এ দলটি তার সপক্ষে প্রামাণ্য দলিল দেখতে চায়। আমরা মীলাদের বিষয়টি আপাততঃ স্থগিত রেখে এই সংখ্যালঘু দলকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনারা পালন করেন এমন যে কোনো একটিমাত্র আমল দেখান, যেটি মহানবী (ﷺ)-এর সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দের আমলের মতো একই জযবাত, শক্তি ও মহিমা ধারণ করে? সত্যি, তারা এর জবাব কখনোই দিতে সক্ষম হবে না; কারণ সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে ছিলেন আসীন, যাঁদের এবাদত ও আমল সরাসরি মহানবী (ﷺ)-এর শিক্ষা দ্বারা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছিল।


হয়তো এসব লোক অনুধাবন করতে পারে না যে মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদত না হলে হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) নবী দাবিদার ভণ্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ই করতেন না; হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) আফ্রিকা ও ইউরোপে মুসলিম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন-ও করতেন না; হযরত উসমান (رضي الله عنه) তাঁর সমস্ত সম্পদ মুসলমানদের জন্যে দান-ও করতেন না; আর হযরত আলী (رضي الله عنه)-ও খারেজী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তেন না।


আজকে কেউই বাস্তবিকভাবে শীর্ষস্থানীয় সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর আমল অনুসরণের দাবি করতে পারে না, কেননা ইসলামের জন্যে তাঁদের খেদমত ও ত্যাগ অতুলনীয় ছিল। তবে আমরা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমাদের আমলকে নিশ্চিত করতে পারি। অতএব চলুন, আমরা সত্যকে মিথ্যে দাবি হতে এক্ষণে পৃথক করি; মীলাদ-সংক্রান্ত যাবতীয় আমলকে আমরা যাচাই করি এবং পর্যবেক্ষণ করি সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) কখনো এগুলো পালন করেছিলেন কি না।


জরুরি জ্ঞাতব্য: প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপনের আগে পাঠকদের অনুরোধ করা হচ্ছে শরীয়তের বিধানের এই বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে যে, মহানবী (ﷺ)-এর সামনে কোনো ঘটনা বা কর্ম সংঘটিত হওয়ার সময় তাঁর মৌনতা-ই ওই বিষয়ের প্রতি তাঁর সমর্থন বলে বিবেচিত হবে (যদি না তিনি তাতে বাধা দেন বা স্পষ্টভাবে নিষেধ করেন); অার সেটি তাঁর অনুমোদিত আমল (সুন্নাতে তাকরিরী) হিসেবেও সাব্যস্ত হবে। বর্তমানকালে এটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক যে মীলাদ মাহফিলে বা মজলিশে মুসলমানদেরকে শেরেক (অংশীবাদ) সংঘটনের দোষারোপ করা হচ্ছে। এই দোষারোপ একেবারেই বৃথা, কেননা মুসলমান হওয়ার মানেই হলো এক আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করা, যিনি সর্বশক্তিমান।


উদাহরণস্বরূপ, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহঃ)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন:


আমাদের সময় মওলিদ বা মীলাদের যে সমাবেশ হয়, সেগুলো মূলতঃ নেক আমল। যেমন, এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দান-সদকাহ, যিকর-আযকার, মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি দরুদ-সালাম পাঠ ও তাঁর প্রশংসা......আর মীলাদের দ্বিতীয় ধরনের মজলিশ হলো সুন্নাত, যা যিকর-আযকার সংক্রান্ত হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: মানুষেরা আল্লাহর যিকির-তাযকেরায় উপবিষ্ট থাকাকালীন ফেরেশতাকুল তাদের ঘিরে রাখে এবং তাদের ওপর শান্তি নেমে আসে। [ফাতাওয়া অাল-হাদিসীয়্যা, ২০২ পৃষ্ঠা; এই ফতোওয়ায় নিষিদ্ধ কাজগুলো সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়েছে, তবে ওপরের এ বক্তব্য সারা বছর ওই হারাম কাজ থেকে বাঁচার এক মানদণ্ড বটে] 


মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর সংজ্ঞা


মীলাদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে (আরবী) ‘বেলাদত’ শব্দটি থেকে। সুতরাং আরবী ভাষায় মীলাদ শব্দটির অর্থ জন্মের স্থান ও সময়। শরীয়তের অালোকে আমরা বুঝি, মহানবী (ﷺ)-এর ধরাধামে শুভাগমনের সময় যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তা-ই হচ্ছে মীলাদ; আর আমরা এই শুভলগ্নে তাঁর সীরাহ (জীবন ও কর্ম) আলোচনার সুযোগও পেয়ে থাকি। এছাড়াও মীলাদে আমরা মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি হাদীয়া হিসেবে দরুদ ও সালাম পেশ করে থাকি। মানুষের কাছে প্রিয়নবী (ﷺ)-এর অনুপম বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা এবং তাঁর প্রশংসাও করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি না যে মীলাদ মাহফিল কোনো নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ রাখা চাই, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যিকর-তাযকেরা (স্মরণ) প্রতিটি মিনিট ও প্রতিটি সেকেন্ডেই করা চাই। মীলাদুন্নবী (ﷺ) হচ্ছে ধর্মপ্রচারের এক মহা উৎস। এটি দাওয়াহ কার্যক্রমের একটি মোক্ষম সুযোগ এবং এই শুভলগ্নে উলামাবৃন্দ মুসলমানদেরকে ধর্মশিক্ষা দিতে পারেন; মহানবী (ﷺ)-এর নৈতিক আচার-ব্যবহার, সৌজন্য, তাঁর বিষয়াদি ও সীরাত, তাঁর লেনদেন ও শামায়েল সম্পর্কেও তাঁরা শেখাতে পারেন।


১/ - ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে কোনো নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নির্ধারণ 


মুসলিম উম্মাহ (জাতি) ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ যেভাবে উদযাপন করে থাকেন, সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-ও কি ইসলাম প্রচারের জন্যে এরকম দিন-তারিখ ঠিক করতেন? সহীহ বোখারী শরীফের উদ্ধৃতিটি দেখুন:


❏ হাদিস ১ : 


আবূ ওয়াইল বর্ণনা করেন যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) প্রতি বৃহষ্পতিবার মানুষের কাছে ধর্মীয় ওয়ায-নসীহত করতেন। একবার এক ব্যক্তি আরয করেন, “এয়া আবা আবদ্ আর্ রাহমান, আল্লাহর কসম! আমি চাই আপনি যদি আমাদের মাঝে প্রতিদিনই ধর্মের বাণী প্রচার করতেন।” তিনি উত্তর দেন, “আমাকে এ কাজে বাধা দিচ্ছে একমাত্র যে জিনিসটি, তা হলো আমি তোমাদের বিরক্তির কারণ হওয়াকে অপছন্দ করি; আর নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের মাঝে ধর্মের বাণী প্রচারে যত্নবান বিধায় এমন উপযুক্ত সময়ই বেছে নিয়েছি, যেমনটি একই বিরক্তির আশঙ্কায় মহানবী (ﷺ) আমাদের (সাহাবীদের) মাঝে ধর্মপ্রচারের সময়-ক্ষণ বেছে নিয়েছিলেন।” [সহীহ বোখারী, ১ম খণ্ড, ৩য় বই, হাদীস নং ৭০]


অবশ্যঅবশ্য মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন কেবল ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়, বরং সর্বদা আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর যিকর-তাযকেরায় আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে স্মরণ করা উচিত।


২/ - আল্লাহতা’লা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর যিকর-তাযকেরার উদ্দেশ্যে সমাবেশ


❏ হাদিস ২ :


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত যে, একবার একদল সাহাবী (رضي الله عنه) সমবেত হয়ে মজলিশে বসেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের দিকে আসার সময় তাঁদেরকে বলাবলি করতে শুনতে পান। তাঁদের কেউ কেউ বলছিলেন যে আল্লাহতা’লা হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-কে বন্ধু (খলীলউল্লাহ) হিসেবে গ্রহণ করেন; আবার অন্য সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দ বলাবলি করছিলেন যে আল্লাহ পাক হযরত মূসা (عليه السلام)-কে কালীমউল্লাহ (আল্লাহর সাথে সরাসরি আলাপকারী) হিসেবে গ্রহণ করেন; আরো কিছু সাহাবী (رضي الله عنه) বলেন যে অাল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তা’লা হযরত ঈসা (عليه السلام)-কে ‘আল্লাহর বাক্য’ হিসেবে গ্রহণ করে নেন; অপর কিছু সাহাবী (رضي الله عنه) মতামত ব্যক্ত করেন যে আল্লাহতা’লা হযরত আদম (عليه السلام)-কে পছন্দ করে নেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদেরকে বলেন, “আমি তোমাদের এ আলাপ শুনতে পেয়েছি। তোমরা আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর খলীলউল্লাহ হওয়ার বিষয়ে, এবং এটি সত্য; আর হযরত মূসা (عليه السلام)-এর নাজীউল্লাহ (আল্লাহ কর্তৃক নাজাতপ্রাপ্ত) হওয়ার বিষয়েও, এবং এটিও সত্য; আর হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর রূহুল্লাহ হওয়ার বিষয়েও, এবং এটিও সত্য; আর হযরত আদম (عليه السلام)-এর আল্লাহ কর্তৃক পছন্দকৃত হওয়ার বিষয়েও, এবং এটিও সত্য; কিন্তু আমি হলাম হাবীবউল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু), এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি (হাবীবুল্লাহ ওয়া লা ফাখর); আর শেষ বিচার দিবসে আমি-ই হবো প্রশংসার পতাকাবাহক; আর হযরত আদম (عليه السلام) ও তাঁর বংশের (অর্থাৎ, মানবকুলের) সবাই ওই দিন আমার পতাকাতলে থাকবেন, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি; শেষ বিচার দিবসে আমি-ই হবো প্রথম শাফায়াত তথা সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম সুপারিশ আমি-ই করবো, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি; আর আমি-ই সর্বপ্রথম বেহেশতের দরজার চাবি খুলবো এবং আল্লাহ আমার জন্যে বেহেশত উন্মুক্ত করবেন, আর আমি-ই সর্বপ্রথম তাতে প্রবেশ করবো; আর আমার সাথে থাকবে আমারই উম্মতের গরিব ও বিনয়ী ঈমানদারবৃন্দ, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি; আর সৃষ্টিকুলের মাঝে প্রথম হতে শেষ জনের মধ্যে আমাকেই সর্বপ্রথম সম্মানিত করা হবে, এবং আমি এ কথা গর্ব না করেই বলছি।” [তিরমিযী শরীফ: কিতাবুল মানাকিব; বাবুন্ ফী ফযল আন্ নবী (অনুপম বৈশিষ্ট্যাবলী অধ্যায়); ইমাম দারিমী, হাফেয ইবনে কাসীর, ইমাম সৈয়ুতী ও অন্যান্য উলামাও এ হাদীস বর্ণনা করেন]


সন্দেহ পোষণকারীদের বোঝা উচিত, মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর প্রকৃত মজলিশ হলো মসজিদে (বা অন্যত্র) সমবেত হয়ে সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের যিকর-তাযকেরা করা, ঠিক যেমনটি সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) অন্যান্য নবী-রাসূল (عليه السلام)-বৃন্দের যিকর-তাযকেরা করেছিলেন।  


❏ হাদিস ৩ :


হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন মহানবী (ﷺ)-এর বাণী, যিনি বলেন: “আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, ‘আমার (প্রিয়) বান্দা আমার প্রতি যে আকাঙ্ক্ষা রাখে, আমি তা পূরণ করি; সে আমার যিকর করলে আমি তার সাথে থাকি; সে নিভৃতে আমায় স্মরণ করলে আমিও তাকে নিভৃতে স্মরণ করি; অার দলবদ্ধভাবে স্মরণ করলে অামি তার চেয়েও উত্তম এক দলে তাকে স্মরণ করি...।” [একটি বড় বর্ণনার অংশ এটি; সহীহ বোখারী, ৯ম খণ্ড, ৯৩তম বই, হাদীস নং ৫০২]


❏ হাদিস ৪ :


হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) মসজিদে অনুষ্ঠিত একটি হালাকায় (যিকরের সমাবেশে) উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কী কারণে এই মজলিশে বসেছো?” তারা উত্তর দেন, “আমরা আল্লাহতা’লার যিকর করতেই এখানে উপবিষ্ট।” তিনি বলেন, “আমি তোমাদের শপথ করেই বলতে বলছি (তোমরা এই উদ্দেশ্যেই এখানে বসেছো কি)?” তারা উত্তর দেন, “আল্লাহর নামে শপথ, আমরা এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই বসেছি।” এমতাবস্থায় হযরত মোয়াবিয়া (رضي الله عنه) বলেন, “আমি এ কারণে তোমাদেরকে শপথ করতে বলিনি যে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে, বা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর দৃষ্টিতে হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে আমার কোনো মর্যাদার খাতিরেও তা দাবি করিনি, যেহেতু আমি এতো স্বল্প সংখ্যক হাদীসের রাবী। (কিন্তু) সত্য হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একবার তাঁর সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দের হালাকায় উপস্থিত হয়ে তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কেন এখানে বসেছো?’ তাঁরা উত্তর দেন, ‘আমরা এখানে আল্লাহতা’লার যিকর ও প্রশংসা করতে জমায়েত হয়েছি, কেননা তিনি-ই আমাদেরকে ইসলামের দিকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং আমাদের প্রতি রহমত তথা করুণা বর্ষণ করেছেন।’ এমতাবস্থায় হুযূর পাক (ﷺ) আল্লাহর নামে শপথ করে তাঁদেরকে বলতে বলেন তাঁরা সত্যি ওই উদ্দেশ্যে সেখানে উপবিষ্ট হয়েছেন কি না। তাঁরা শপথ করে বলেন, ‘আমরা আল্লাহর নামে কসম করছি, এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে এখানে বসিনি।’ অতঃপর মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘আমি শপথ করতে বলেছি এ কারণে নয় যে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে; বরং এ কারণে যে জিবরীল (عليه السلام) আমার কাছে এসে আমাকে জানিয়েছেন, মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের কাছে তোমাদের (অর্থাৎ, সাহাবীদের) শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন’।” [সহীহ মুসলিম, ৩৫তম বই, হাদীস নং ৬৫৩১]  


ভালোভাবে লক্ষ্য করুন যে সাহাবা (عليه السلام)-বৃন্দ আল্লাহর যিকর, হেদায়াত, ইসলাম ও রহমত তথা করুণার কথা উল্লেখ করেছিলেন; আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রিয়নবী (ﷺ) হলেন আল্লাহতা’লার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা (রহমত) এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের এই করুণাপ্রাপ্তিতে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, তিনিও তার প্রতি সন্তুষ্ট হন। এটি নিশ্চিত যে ওই সাহাবা (রা.)-বৃন্দকে এই ধরনের যিকরের দল গঠনের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়নি - আর তাঁদের সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং মহানবী (ﷺ) যিনি তাঁদেরকে এই নেক আমলের ব্যাপারে (নেয়ামতের) সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকেও (অর্থাৎ, মুসলমানদেরকেও) অনুরূপ জ্ঞান-প্রজ্ঞা মঞ্জুর করুন, আমীন।


যিকরের সমাবেশ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার অভিমত


ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় সেসব মানুষ সম্পর্কে যারা মসজিদে সমবেত হয়ে যিকর করেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করেন; আর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করার সময় মাথা থেকে পাগড়ী অপসারণ করেন (খালি মাথায় থাকেন)। এ সময় তাঁদের নিয়্যত অহঙ্কার নয়, বা রিয়া তথা প্রদর্শনীও নয়, বরঞ্চ আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করাই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। এটি গ্রহণযোগ্য কি না?

ইবনে তাইমিয়া উত্তর দেয়: এটি গ্রহণযোগ্যই শুধু নয়, বরং উত্তম ও প্রশংসনীয় (নেক) আমল। [মজমু’আয়ে ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, ২২তম খণ্ড, ২৫৩ পৃষ্ঠা, বাদশাহ খালেদ বিন আবদ্ আল-আযীয সংস্করণ] 


৩/ - দান-সদকাহ


❏ হাদিস ৫ :


হযরত আসমা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলে পাক (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “দান-সদকাহ করো এবং অনিচ্ছাসহ তা করো না, যাতে আল্লাহতা’লা তোমাদের প্রতি তাঁর দান সীমিত না করে দেন; আর তোমাদের অর্থ (দান-খয়রাত হতে) আটকে রেখো না, যাতে আল্লাহতা’লা তোমাদের কাছ থেকে তা আটকে না রাখেন।” [সহীহ বোখারী, ৩য় খণ্ড, ৪৭তম বই, হাদীস নং ৭৬৪]    

 

❏ হাদিস ৬ :


হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; একবার এক ব্যক্তি মহানবী (ﷺ)-কে প্রশ্ন করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! কোন্ ধরনের দান-সদকাহ সবচেয়ে ভালো?” তিনি উত্তর দেন, “দান-সদকাহ করা ঠিক ওই সময়ে, যখন তুমি স্বাস্থ্যবান এবং সম্পদ আহরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখো, আর গরিব হওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত থাকো। দান-সদকাহ করায় বিলম্ব করো না যতোক্ষণ না তুমি মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়ে বলো, ‘অমুককে এইটুকু দেবে, তমুককে ওইটুকু দেবে’; কেননা ওই সময় সহায়-সম্পত্তি আর তোমার নেই, বরং তা অমুক-তমুকের হয়ে গিয়েছে (মানে উত্তরাধিকারীদের মালিকানাধীন হয়েছে)।” [সহীহ বোখারী, ৪র্থ খণ্ড, ৫১তম বই, হাদীস নং ১১]    


তাহলে দান-সদকাহ করা কি বেদআত? অবশ্যই নয়! আর এই দান করার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি যে কখন হালাল হবে আর কখন তা হারাম হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে দান-সদকাহ করা বছরের প্রতিটি দিন-ই জায়েয। এই নেক তথা পুণ্যদায়ক কাজ হতে মানুষদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করাই হলো খোদ এক বেদআত! অতএব, আপনারা নিজেরাই দেখুন কারা বেদআতী!


৪/ - মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ 


আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ দরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্য বক্তা (নবী)-এর প্রতি। হে ঈমানদার মুসলমান সকল! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ ও (ভক্তিসহ) সালাম প্রেরণ করো।” [আল-কুরআন, ৩৩:৫৬; তাফসীরে কানযুল ঈমান বাংলা সংস্করণ]


❏ হাদিস ৭ :


হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আল-’আস্ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে তিনি মহানবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন, “কেউ আমার প্রতি একবার সালাওয়াত পাঠ করলে আল্লাহতা’লা তার প্রতি দশটি নেকী বর্ষণ করেন।” [সহীহ মুসলিম] 


তাহলে মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ করা কি বেদআত? অবশ্যই নয়! আর এই সালাওয়াত পাঠ করার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি যে কখন হালাল হবে আর কখন তা হারাম হবে (কিছু নির্দিষ্ট সময় ছাড়া)। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ করা বছরের প্রতিটি দিন-ই জায়েয। এই নেক তথা পুণ্যদায়ক কাজ হতে মানুষদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করাই হলো খোদ এক বেদআত! অতএব, আপনারা নিজেরাই দেখুন কারা বেদআতী!


বস্তুতঃ কেউ যতো বেশি সালাত-সালাম পাঠ করবেন, তিনি ততোই পুরস্কৃত হবেন, যেমনটি বিবৃত হয়েছে নিচের হাদীসটিতে:


❏ হাদিস ৮ :


হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী, যিনি বলেন, “নিশ্চয় কেয়ামত ময়দানে আমার সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে সে-ই, যে ব্যক্তি আমার প্রতি সর্বাধিক দুরূদ-সালাম প্রেরণ করেছে।” [তিরমিযী, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৪৮৪]


৫/ - পদ্য, নাশীদ ও না’ত আবৃত্তি 


❏ হাদিস ৯ :


হযরত উবাই বিন কা’আব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন নবী পাক (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “কিছু কাব্য জ্ঞান ধারণ করে।” [সহীহ বোখারী, ৮ম খণ্ড, ৭৩তম বই, হাদীস নং ১৬৬] 


❏ হাদিস ১০ :


সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ করে একে অপরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শানে কবিতা (না’ত শরীফ) শোনানোর অনুরোধ করতেন। এতে প্রমাণিত হয় যে মীলাদ সাহাবা (রা.)-বৃন্দের সুন্নাত (রীতি)। সাইয়্যেদুনা আতা’ ইবনে এয়াসার (رضي الله عنه) বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স (رضي الله عنه)-এর সাথে দেখা করে তাঁকে তৌরীত ঐশীগ্রন্থে পাওয়া যায় প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শানে এমন একখানি না’ত শোনানোর অনুরোধ করি। তিনি আমাকে তা আবৃত্তি করে শোনান।” [মেশকাত, বাবু ফাদায়েলিস্ সাইয়্যেদিল মুরসালীন, ১ম অনুচ্ছেদ] 


❏ হাদিস ১১ :


হযরত সালামা বিন আল-আকওয়া (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে খায়বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি এবং রাতে ভ্রমণ করি। মানুষদের মধ্যে এক ব্যক্তি আমির বিন আল-আকওয়া (رضي الله عنه)-কে বলেন, “আপনি কি আমাদের আপনার কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবেন না?” আমির ছিলেন কবি, তাই তিনি (সওয়ার থেকে) নেমে মানুষের জন্যে হেদায়াতমূলক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন; এই কাব্যের গতি উটের পা ফেলার সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে থাকে আর বলতে থাকে, “হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া আমরা সঠিক পথে পরিচালিত হতাম না, দান-সদকাও করতাম না, নামায-দোয়াও পড়তাম না। অতএব, অনুগ্রহ করে আমাদের কৃতকর্ম ক্ষমা করে দিন। আপনার উদ্দেশ্য সাধনে আমাদের উৎসর্গ করুন। আর আমরা যখন শত্রুর মোকাবেলা করবো, তখন আমাদের পাগুলোকে সুদৃঢ় রাখুন এবং আমাদের মাঝে শান্তি ও স্থিরতা মঞ্জুর করুন। আর যদি শত্রুরা আমাদেরকে অন্যায় কোনো কিছুর প্রতি আহ্বান করে, তবে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করবো। কাফেররা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের কাছে সাহায্য চাওয়ার বেলায় অনেক হৈচৈ করেছে।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, “(উটের) ওই চালক কে?” সাহাবা (রা.)-বৃন্দ উত্তর দেন, “তিনি আমির বিন আল-আকওয়া।” এমতাবস্থায় রাসূল (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।” [সহীহ বোখারী, ৮ম খণ্ড, ৭৩তম বই, হাদীস নং ১৬৯]  


❏ হাদিস ১২ :


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) একটি কবিতা রচনা করেন যা’তে তিনি হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর বেলাদত শরীফের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ওই পদ্যে নিচের কয়েকটি চরণ পাওয়া যায় -

  

“(হে নবী) আপনার বেলাদত হয়েছিল যবে, 

ভুবন ও দিগন্ত আলোকিত হয়েছিল আপনারই নূরের বৈভবে,

সেই নূরের আলোয় ও ন্যায়ের পথেই চলেছি আমরা সবে।”

১.ইবনে সাইয়্যেদ আল-নাস নিজের এসনাদ-সহ আত্ তাবারানী ও আল-বাযযার হতে এটি বর্ণনা করেন তাঁরই ‘মিনাহ আল-মায’ গ্রন্থে (১৯২-৩ পৃষ্ঠা); 

২.এছাড়াও ইবনে কাসীর নিজের ‘আল-সীরাহ আন্ নাবাউইয়্যা’ (মোস্তফা আবদ্ আল-ওয়াহিদ সংস্করণ ৪:৫১) পুস্তকে এটি উদ্ধৃত করে; 

৩.মোল্লা আলী কারী নিজ ‘শরহে শেফা’ গ্রন্থে (১:৩৬৪) বলেন যে, এ বর্ণনা আবূ বকর শাফেঈ ও আত্ তাবারানীর; 

৪.আর এটি উদ্ধৃত করেছেন আবদুল বার তাঁর ‘আল-এস্তে’য়াব’ পুস্তকে, 

৫.ইবনে কাইয়্যেম নিজ ‘যাদ আল-মা’আদ’ বইয়ে এবং 

৬.ইবনে হাজর তাঁর ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে।


ওপরোক্ত পদ্যে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه)-এর উল্লেখিত ‘নূর’ তথা জ্যোতি শব্দটি স্বয়ং নবী পাক (ﷺ) নিশ্চিত করেছেন তাঁরই বেলাদত-সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদীসে। 


❏ হাদিস ১৩ :


হযরত এরবাদ ইবনে সারিয়্যা (رضي الله عنه) ও আবূ উমামা (رضي الله عنه) বলেন যে মহানবী (ﷺ) এরশাদ করেন: “আমি হলাম পিতা ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর দোয়া এবং আমার ভাই হযরত ঈসা (عليه السلام)-এর প্রদত্ত শুভ সংবাদ। যে রাতে আমার বেলাদত হয়, সে সময় আমার মা একটি নূর দেখতে পান, যেটি দামেশকের প্রাসাদগুলোকে এমনভাবে আলোকিত করেছিল যে তিনি সেগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন।” 

এ হাদীস বর্ণনা করেনঃ

১.আল-হাকীমঃ মুস্তাদরাক আল হাকীম, (২:৬১৬-১৭), 

২.ইমাম আহমদ নিজ ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে; আরো বর্ণনা করেন 

৩.আল-বায়হাকী তাঁর ‘দালাইল আন্ নবুওয়া’ পুস্তকে (১:১১০, ২:৮), 

৪ ইবনে জাওযী উদ্ধৃত করেন নিজ ‘আল-ওয়াফা’ বইয়ে; 

৫.আর ইবনে কাসীর উদ্ধৃত করেছে নিজ ‘মওলিদ-এ-রাসূল আল্লাহ’ এবং ‘তাফসীরে কাসীর’ গ্রন্থে (৪:৩৬০)। 

৬.আল-হায়সামী (৮:২২১) বলেন যে আত্ তাবারানী ও ইমাম আহমদ এটি বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে ইমাম আহমদের এসনাদ তথা সনদ ‘হাসান’। 

৭.এছাড়াও ইবনে হিশাম নিজ ‘সীরাতে রাসূল-আল্লাহ’ (দারুল উইফাক সংস্করণ ১/২:১৬৬) এবং 

৮.আত্ তাবারী তাঁর ইতিহাস পুস্তকে এই রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেন।


❏ হাদিস ১৪ :


প্রিয়নবী (ﷺ) বিখ্যাত খন্দকের যুদ্ধের সময় হযরত আনাস (رضي الله عنه) ও অন্যান্য সাহাবী (رضي الله عنه)-দের নবী-বন্দনাসূচক কবিতা ও গান শোনেন, যা’তে তাঁরা বলছিলেন: “আমরাই জ্বেহাদের উদ্দেশ্যে মহানবী (ﷺ)-এর হাতে বায়াত হয়েছি - যতোদিন বেঁচে আছি।” [ইমাম বোখারী এবং ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা নিজ ‘মাদারিজ আস্ সালেকীন’ পুস্তকের ১ম খণ্ড]


❏ হাদিস ১৫ :


ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা আরো উদ্ধৃত করে হযরত ইবনে রাওয়াহা (رضي الله عنه)-এর দীর্ঘ কবিতা, যা তিনি মক্কায় প্রবেশের সময় মহানবী (ﷺ)-এর শানে আবৃত্তি করেন; এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জন্যে দোয়া করেন। তিনি অপর কবি ও সাহাবী হযরত হাসান বিন সাবেত (رضي الله عنه)-এর জন্যেও দোয়া করেন, যাতে তিনি যতোদিন কবিতা দ্বারা মহানবী (ﷺ)-কে সাহায্য করবেন, ততোদিন তাঁকে আল্লাহতা’লা পবিত্র রূহ দ্বারা সমর্থন দেন। অনুরূপভাবে, তিনি হযরত কা’আব ইবনে যুবায়র (رضي الله عنه)-কে তাঁর কবিতার জন্যে খুশি হয়ে নিজ চাদর মোবারক দান করেন। ইবনে কাইয়্যেম এ প্রসঙ্গে বলে, “হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) সব সময়ই তাঁর প্রশংসাসূচক কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং তিনি তাঁর প্রতি রাজি ছিলেন।” [ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা কৃত ‘মাদারিজ আস্ সালেকীন’] 


❏ হাদিস ১৬ :


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কবি হযরত হাসান বিন সাবেত (رضي الله عنه) বলেন: আল্লাহর কসম! কোনো নারী-ই জন্ম দেয় নি পয়গম্বর ও মানুষের হেদায়াতদাতা মহানবী (ﷺ)-এর মতো কাউকে; আর অাল্লাহতা’লা-ও তাঁর সৃষ্টিকুলের মাঝে সৃষ্টি করেননি মহানবী (ﷺ)-এর মতো আমাদের (হেদায়াতের) নূরের উৎসস্বরূপ আরেকজন বিশ্বাসীকে, যিনি তাঁরই সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ও ওয়াদা (-এর বহিঃপ্রকাশ)।” [ইবনে হিশাম কর্তৃক তাঁর ‘সীরাতে রাসূল-আল্লাহ’ গ্রন্থের শেষ কয়েক লাইনে উদ্ধৃত]  


এর পরও কি আশীর্বাদধন্য রাজাধিরাজের (ধরাধামে) শুভাগমন উদযাপনে কবিতা আবৃত্তি করা বিদআত বলে মনে হয় এর বিরোধিতাকারীদের কাছে? তারা এই দালিলিক প্রমাণগুলো যখন হজম করতে ব্যস্ত, আমরা তখন সৃষ্টির সেরা মহান সত্তার প্রতি সালাওয়াত পাঠে নিজেদের প্রবৃত্ত করবো এবং সারা রাত-দিন তাঁরই নূরের বন্দনা করবোঃ


❏ হাদিস ১৭ :


যেভাবে তাঁর আনসার সাহাবা (রা.)-বৃন্দ আদর্শ স্থাপন করেছেন নিচের পদ্যে:


“হেদায়াতের পূর্ণচন্দ্র আমাদের ভাগ্যাকাশে ‘আল-ওয়াদা’য় হয়েছেন উদিত

যতোদিন আল্লাহর কোনো এবাদতকারী থাকবেন আমরা শোকর করতে হবো বাধিত।”  


[এটি বর্ণনা করেন আত্ তাবারী তাঁর ‘আল-রিয়াদ আন্ নাদিরা’ (১:৪৮০) গ্রন্থে এবং ইবনে কাসীর নিজ ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’ (মা’আরিফ সংস্করণ, ৩:১৯৭, ৫:২৩) পুস্তকে]   


৬/ - প্রিয়নবী (ﷺ)-এর প্রতি মহব্বত প্রকাশ ও জশনে জলূস


❏ হাদিস ১৮ :


হযরত সাইয়্যেদুনা আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: মহানবী (ﷺ) মদীনায় হিজরত করে এলে আবিসিনীয় (আফ্রিকী) লোকেরা এই খুশিতে বর্শা নিয়ে (ঐতিহ্যবাহী) খেলায় মেতে ওঠে। [সুনানে আবি দাউদ, ৪১তম বই, হাদীস নং ৪৯০৫]


❏ হাদিস ১৯ :


হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত: ....মদীনার মুসলমানবৃন্দ (হিজরতের সময়) যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মক্কা ছেড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সংবাদ পান, তখন তাঁরা প্রতিদিন সকালে হাররায় গমন করতে থাকেন। তাঁরা সেখানে অপেক্ষা করতেন যতোক্ষণ না মধ্যাহ্ন সূর্যের খরতাপ তাঁদেরকে ফেরত আসতে বাধ্য করতো। একদিন দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাঁরা বাড়ি ফিরলে জনৈক ইহুদী কোনো জিনিস খুঁজতে তাঁর গোত্রের দুর্গের একটি ছাদে ওঠেন এবং দূরে মরু-মরীচিকার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসা সাদা পোশাক পরিহিত আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের দেখতে পান। ওই ইহুদী তাঁর সাধ্যানুযায়ী উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলেন, “ওহে আরবকুল! তোমাদের সেই মহান ব্যক্তিত্ব এখানে উপস্থিত, যাঁর জন্যে তোমরা অপেক্ষা করছো।” এমতাবস্থায় সকল মুসলমান ব্যক্তি হাররার চূড়ায় ছুটে যান এবং সেখানে মহানবী (ﷺ)-কে স্বাগত জানান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের সাথে ডান দিকে ফেরেন এবং বনূ আমর বিন আউফ গোত্রের বসতস্থানে (সওয়ার হতে) নেমে যান; আর এটি ছিল রবিউল আউয়াল মাসের এক সোমবার দিন।.....(একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ এটি)। [সহীহ বোখারী, ৫ম খণ্ড, ৫৮তম বই, হাদীস নং ২৪৫]  


❏ হাদিস ২০ :


হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: ....হুযূর পাক (ﷺ)-এর মদীনায় আগমনের খবর প্রচার হয়ে যায়। মানুষেরা ঘর থেকে বেরিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, “আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এসেছেন! আল্লাহর নবী এসেছেন!” এমতাবস্থায় মহানবী (ﷺ) চলতে থাকেন যতোক্ষণ না তিনি হযরত অাবূ আইয়্যুব আনসারী (رضي الله عنه)-এর ঘরের সামনে (সওয়ার থেকে) নামেন।...(একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ এটি)। [সহীহ বোখারী, ৫ম খণ্ড, ৫৮তম বই, হাদীস নং ২৫০]  


❏ হাদিস ২১ :


হযরত আল-বারা’ বিন আযিব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: মদীনায় আমাদের কাছে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিবৃন্দ আসেন তাঁরা হলেন সর্ব-হযরত মুস’আব বিন উমর (رضي الله عنه) ও ইবনে উম্মে মাকতুম (رضي الله عنه); এঁরা মানুষদেরকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। এর পর এলেন হযরত বেলাল (رضي الله عنه), সা’দ (رضي الله عنه) ও আম্মার ইবনে এয়াসীর (رضي الله عنه)। অতঃপর হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) তাঁর সাথে আরো বিশজন সাহাবী (رضي الله عنه)-কে নিয়ে মদীনায় আসেন। এরই পরবর্তী পর্যায়ে মহানবী (ﷺ) মদীনায় তাশরীফ আনেন এবং তাঁর আগমন উপলক্ষে মদীনাবাসী মানুষ যতোখানি আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন, অতোটুকু উৎফুল্ল হতে আমি তাঁদেরকে আগে কখনোই দেখিনি। এমন কি দাসী মেয়েরাও গান করছিল, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আগমন করেছেন।” তাঁর তাশরীফ আনার আগেই আমি “আপন রবের নামের পবিত্রতা বর্ণনা করো, যিনি সবার ঊর্ধ্বে” (আল-কুরঅান, ৮৭:১)-সহ মুফাসসিলের অন্যান্য সূরা পাঠ করেছিলাম। [সহীহ বোখারী, ৫ম খণ্ড, ৫৮তম বই, হাদীস নং ২৬২]   


❏ হাদিস ২২ :


সহীহ বোখারী শরীফ ও অন্যান্য সীরাহ-গ্রন্থে উদ্ধৃত এসব হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে মহানবী (ﷺ) যখন মক্কা মোয়াযযমা হতে মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত করেন, তখন ওই নগরীর মানুষ তাঁকে মহা উৎসাহে স্বাগত জানান। মদীনায় এক আনন্দ-উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যার নজির ইতিপূর্বে কখনোই দেখা যায়নি। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে সর্বসাধারণ রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে জড়ো হন; নারী-পুরুষ ও শিশু সবাই উৎফুল্লচিত্তে তাঁকে সম্ভাষণ জানান। এই সময় অবিরাম দফ বাজিয়ে গান করা হয় -


“হেদায়াতের পূর্ণচন্দ্র আমাদের ভাগ্যাকাশে ‘আল-ওয়াদা’ এলাকায় হয়েছেন উদিত

যতোদিন আল্লাহর কোনো এবাদতকারী থাকবেন আমরা শোকর করতে হবো বাধিত

হে রাসূল, আপনি আমাদের মাঝেই হয়েছেন (খোদা কর্তৃক) লালিত, পালিত 

এসেছেন নিয়ে এক কর্তব্য যা হতে হবে মান্যকৃত

আপনি এনেছেন এ নগরীর জন্যে মাহাত্ম্য

তাই স্বাগতম, আল্লাহর রাস্তার দিকে সেরা (ওই) আহ্বান, উদাত্ত।"   


[রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মদিনায় হিজরত করেন মদিনাবাসি এইভাবে দলবদ্ধভাবে জুলুসে নেমেছিল আর এই নিম্নোক্ত ইসলামী কবিতা/গজলের সাথে সম্বোধন জানিয়েছিলঃ


অপর বর্ণনায়,

(ক).তা’লা আল বাদরু আলাইনা।➡طلع البدر علينا

অর্থাৎ, পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের উপর (কাছে) এসেছে।


(খ).মিন ছানি’য়া তিল–ওয়া’দা।➡من ثنيات الوداع

অর্থাৎ, ওয়া'দা‘ উপত্যকা থেকে। [যে উপত্যকা দিয়ে হযরত মুহাম্মাদ ﷺ মদিনায় প্রবেশ করেন।]


(গ).ওজাবাশ শুক’রু আলাইনা।➡وجب الشكر علينا

অর্থাৎ, এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।


(ঘ).মা দা আ লিল্লাহি দা।➡ما دعى لله داع

অর্থাৎ, যতদিন আল্লাহর অস্তিত্ব/ আল্লাহকে ডাকার মত কেউ থাকবে।


(ঙ).আইয়্যু হা’ল মাব উ’ছু ফিনা।➡أيها المبعوث فينا

অর্থাৎ, ওহ, আমাদের পথ প্রর্দশক আজকে আমাদের মধ্যে।


(চ).জি’তা বি’ল-আম্রিল -মু’তা।➡جئت بالأمر المطاع

অর্থাৎ, যিনি (আল্লাহর পক্ষ থেকে )আদেশ/উপদেশ নিয়ে এসেছেন যার প্রতি আমাদের কর্ণপাত করতে হবে।


(ছ).জি’তা শার’রাফ তা’ল-মদিনা।➡جئت شرفت المدينة

অর্থাৎ, আপনি এই শহরের জন্য প্রশংসা/মর্যাদা বয়ে নিয়ে এসেছেন।


(জ).মারহাবান ইয়া খাইরা দা'।➡مرحبا يا خير داع

অর্থাৎ, স্বাগতম আপনাকে, যিনি আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন/ সথিক পথ সমন্ধে বলবেন।➡বহিঃ সংযোজন, মাসুম বিল্লাহ সানি]


ইনশা’আল্লাহ, পুনরুত্থান দিবসেও রাস্তাগুলো মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর ভালোবাসার সাক্ষ্য প্রদান করবে।


সোবহানাল্লাহ! আর ভেবে দেখুন কতো তারিখে মহানবী (ﷺ) মদীনায় প্রবেশ করেন এবং সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) উৎসবে মাতেন! এটি ছিল সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল, ঠিক একই তারিখ যেদিন তাঁর ধরাধামে শুভাগমন হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাহাত্ম্যকে স্বীকার করার উদ্দেশ্যে এ দিনটিতে উৎসবের আয়োজন করাটা এই দলিলে সিদ্ধ ও জায়েয প্রমাণিত হয়।


সোবহানাল্লাহ! জুলূস তথা মিছিলসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসাসূচক না’ত-পদ্য-নাশীদ ইত্যাদি করা যে জায়েয, তার অনুমতি হিজরতের সময় স্বয়ং হুযূর পাক (ﷺ)-ই দিয়েছেন (কেননা, মদীনার আনসার সাহাবীবৃন্দ খুশিতে মিছিল করছিলেন - অনুবাদক)। 


❏ হাদিস ২৩ :


অধিকন্তু, মক্কা বিজয়ের সময়ও তিনি সেখানে প্রবেশ করলে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) আনন্দে  তাঁরই প্রশংসাসূচক না’ত/পদ্য উচ্চস্বরে আবৃত্তি করেন। এই শুভলগ্নে হযরত আবদুল্লাহ বিন রওয়াহা (رضي الله عنه) ইসলামী বাহিনীর অগ্রভাগে হাঁটছিলেন এবং উচ্চস্বরে না’ত-পদ্য গাইছিলেন। হযরত উমর তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে এতো জোরে না’ত গাইছো, তা কি যথার্থ?” এমতাবস্থায় খোদ মহানবী (ﷺ) হযরত উমর (رضي الله عنه)-কে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “ওকে বাধা দেবে না। কেননা, তার পদ্যগুলো কাফেরদের অন্তরে তীরের মতো বিঁধছে।” [সর্ব-ইমাম তিরমিযী, নাসাঈ ও ‘সুনানে কুবরা’; ইমাম ইবনে হাজর আসকালানীও এটি উদ্ধৃত করেন] 


৭/ - মসজিদ আলোকসজ্জা 


বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে রমজান মাস, লায়লাতুল কদর উপলক্ষে কুরআন খতম কিংবা ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ)-তে মসজিদগুলো উজ্জ্বল রাখা তথা আলোকসজ্জা করা একটি বড় এবাদত। এ সম্পর্কে অনেক প্রামাণ্য দলিল বিদ্যমান, যেগুলো এখানে আলোকপাত করা হলো।


সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “আল্লাহর মসজিদসমূহ তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম রাখে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকেও ভয় করে না; সুতরাং এটাই সন্নিকটে যে এসব মানুষ সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [আল-কুরআন, ৯:১৮; তাফসীরে নূরুল এরফান বাংলা সংস্করণ] 


মুফাসসিরীনে কুরআন (ব্যাখ্যাকারীবৃন্দ) বিবৃত করেন যে মসজিদে (জামাআতে) সালাত আদায়, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, উন্নতমানের ম্যাট বিছানো, আলোকসজ্জা করা ইত্যাদি কার্যক্রম মসজিদের উন্নয়নে সহায়ক। হযরত সোলা্য়মান (عليه السلام) ‘কিবরীত-এ-আহমার’ (এক ধরনের দাহ্য পদার্থ) দ্বারা মসজিদে বায়তুল মোকাদ্দাস আলোকিত করে রাখতেন। এর এমনই উজ্জ্বলতা ছিল যে বহু দূরে অবস্থিত মহিলাবর্গ তাদের সুতো কাটতে পারতেন! [তাফসীরে রূহুল বয়ান]  


❏ হাদিস ২৪ :


হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) বলেন: “সাহাবী হযরত তামীম দারী (رضي الله عنه)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি মসজিদগুলোতে চেরাগ জ্বালান।” [সুনানে ইবনে মাজাহ]


❏ হাদিস ২৫ :


উম্মুল মো’মেনীন সাইয়্যেদাহ মায়মুনাহ (رضي الله عنه) মহানবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেন: “বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ সম্পর্কে আমাদের নির্দেশ দিন।” তিনি উত্তরে বলেন, “সেখানে যেয়ে সালাত আদায় করো।” ওই সময় সেখানে একটি যুদ্ধ চলছিল। এই কারণে মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা যদি মসজিদে পৌঁছুতে না পারো এবং নামায পড়তে না পারো, তবে সেখানে তেল প্রেরণ করো, যাতে তা মসজিদের প্রদীপ জ্বালাতে ব্যবহৃত হয়।” [সুনানে আবি দাউদ]

   

ওপরের এই রেওয়ায়াত থেকে চারটি বিষয় উপলুব্ধ হয়:



১/ বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে সালাত আদায়ের জন্যে ভ্রমণ করা স্বয়ং একটি সুন্নাত। সাইয়্যেদুনা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মে’রাজ রাতে অন্যান্য সকল পয়গম্বর (عليه السلام)-এর ইমাম হয়ে সেখানে নামায পড়িয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি সেখানে ভ্রমণ করে গিয়েছিলেন।


২/ মসজিদে বায়তুল মোকাদ্দাসে অনেক প্রদীপ জ্বালানো হতো; এ কথা হাদীসটিতে ব্যবহৃত ‘ক্কানাদীল’ শব্দটি থেকে বোঝা যায়।


৩/ মসজিদটিকে আলোকিত করাটা সেখানে নামায পড়ার সওয়াবের সাথে তুলনীয়। আরেক কথায়, এটি এক মহা সওয়াবদায়ক এবাদত।


৪/ মসজিদ আলোকিত করার জন্যে দূর-দূরান্ত থেকে তেল প্রেরণ করা সাহাবা (রা.)-বৃন্দের সুন্নাত।


❏ প্রমাণ :


মোহাদ্দীস ইবনে শাহীন উদ্ধৃত করেন হযরত আবূ এসহাক হামদানী (رضي الله عنه) বলেন: প্রতি রমযান মাসের প্রথম রাতে খলীফা আলী (رضي الله عنه) মসজিদে নববীতে প্রবেশ করতেন। ওতে হারিকেন/প্রদীপ জ্বলতো এবং কুরআন তেলাওয়াত করা হতো। তিনি সম্ভাষণ জানাতেন, “হে উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه)! আল্লাহ আপনার মাযার আলোকিত করুন, যেমনটি আপনি মসজিদকে আলোকিত করেছেন কুরআন তেলাওয়াতের সময়।” [ইবনে শাহীন]


এতে প্রমাণিত হয় যে রমযান মাসে মসজিদ আলোকিত করার প্রথা খলীফা উমর (رضي الله عنه)-এর শাসনামল হতেই অনুশীলিত হয়ে এসেছিল। আরো লক্ষণীয় যে অন্যান্য সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দ এতে আপত্তি উত্থাপন করেননি। যদি আল্লাহর আশীর্বাদরূপী পবিত্র কুরঅান মজীদ অবতীর্ণ হওয়ার মাস উদযাপনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও মসজিদ আলোকিত করার আয়োজন জায়েয হয়, তাহলে আল্লাহতা’লার সর্ববৃহৎ আশীর্বাদ ও করুণা আমাদের প্রিয় মহানবী (ﷺ)-কে ধরাধামে পাওয়ার মাস (রবিউল আউয়াল) উদযাপনে মসজিদগুলো আলোকিত করায় কোনো আপত্তি থাকতে পারে না।


কিছু কিছু মোহাদ্দেসীন (হাদীস-শাস্ত্র বিশারদ) হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “আল্লাহ পাক খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর মাযারকে আলোকিত করেন, যেভাবে তিনি আমাদের মসজিদকে আলোকিত করেছিলেন।” [সহিহুল বিহারী]


অতএব, আমরা জানতে পারলাম যে মসজিদগুলো আলোকিত করার প্রতিদানস্বরূপ আমাদের কবরগুলোকেও ইনশা’আল্লাহ আলোকিত করা হবে। এমতাবস্থায় এই প্রথা অনুশীলনে যে ব্যক্তি বাধা দেবে, সে শুধু তার কবরকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন করবে না, বরং সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর সুন্নাহর বিরোধিতাও করবে। আল-কুরআন এসব লোক সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে: “এবং তার চেয়ে অধিকতর যালেম কে, যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদগুলোতে বাধা দেয় সেগুলোতে আল্লাহর নামের চর্চা হওয়া থেকে, আর সেগুলোর ধ্বংস সাধনে প্রয়াসী হয়?” [আল-কুরঅান, ২:১১৪; তাফসীরে নূরুল এরফান] 


যারা মসজিদে সালাত আদায়, সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার যিকর-তাযকেরা, কুরঅান শরীফ তেলাওয়াত বা না’ত/নাশীদ আবৃত্তি করাকে নিষেধ করে এবং এর পাশাপাশি মসজিদের শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানো, আলোকসজ্জা করা, ম্যাট/কার্পেট বিছানো ইত্যাদিতে বাধা দেয়, তাদেরকে ওপরোক্ত আয়াতে করীমায় তিরস্কার করা হয়েছে; কেননা তাদের এই নিষেধ করা ও বাধা দেয়া  প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতা’লার মসজিদ ধ্বংসে ইন্ধন-ই যুগিয়ে থাকে।


বর্তমান যুগে মসজিদ অলঙ্করণ, তা সর্বদা আলোকোজ্জ্বল রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ তারিখে তাতে বিশেষ আয়োজন করা এমন কি সাধারণ জ্ঞানেও উত্তম বলে বিবেচিত হয়। তা এ কারণে যে আমরা অহরহ আমাদের বাড়িঘর সাজিয়ে রাখি এবং বিয়ে-শাদীর মতো বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণের বাইরে গিয়ে আলোকসজ্জা করে থাকি। আমাদের ঘরবাড়ি যদি সুশোভিত ও আলোকিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে, তাহলে অবশ্যঅবশ্য খোদাতা’লার মসজিদ, যা সব ঘরের মধ্যে উত্তম, তা সুশোভিত হওয়ার দাবি রাখে। কেননা, এতে মসজিদের মাহাত্ম্য মানুষের অন্তরে প্রোথিত হবে। এই প্রথা দ্বীন ইসলাম প্রচারের একটি মাধ্যম এবং মুসলমানদের মাঝে ভক্তিশ্রদ্ধার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।


এছাড়া, অনেক মানুষ মঞ্চ সজ্জিত ও আলোকিত করার বেলায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয় এবং একে ‘শান্তি সভা’ বা ‘সীরাহ (সীরাতুন্নবী) সেমিনার’ বলে ডাকে। আল-হামদুলিল্লাহ! আমরা আমাদের অনুষ্ঠানকে মীলাদুন্নবী (ﷺ) বলে থাকি।


                                                           *সমাপ্ত*   


 
Top