প্রিয় নবী (ﷺ) এর মুজেযা

🖋মাওলানা মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম আশরাফী

মুজেযা শব্দের অর্থ নবীদের দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ পাকের প্রেরিত সকল নবীরই কম বেশী মুজেযা রয়েছে। কিন্তু আমাদের নবী সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোজেজাসমূহ অন্যান্য নবীগণের মোজেজা থেকে অধিক পূর্ণ ও অধিক উজ্জ্বল। অন্যান্য আম্বিয়া কেরামকে সম্মিলিতভাবে যত মোজেজা দেওয়া হয়েছিল, আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একা তার চেয়ে বেশি মোজেজা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য নবীগণের মুজেযা ছিল শুধু জমিনে, কিন্তু আমাদের প্রিয় নবীর মুজেযা ছিল জমিনে, আসমানে এবং বেহেশতে। অন্যান্য নবীগণের মুজেযা ছিল নির্দিষ্ট কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেযা নির্দিষ্ট ছিলোনা, তিনি যা ইচ্ছা করতেন আল্লাহ পাক তাই বাস্তবায়ন করে দিতেন। মূলতঃ তিনি নিজেই ছিলেন আপাদমস্তক মুজেযা।

সামান্য আহারে বরকতঃ 
খাবারে বরকত সংক্রান্ত অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে এসেছে। তার মধ্যে একটি হলো- 
হযরত আবু আইউব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য খাবার প্রস্তুত করলেন। কিন্তু যথা সময় নবীজি তাকে বললেন, বড় বড় দেখে ত্রিশ জন আনসারীকে দাওয়াত কর। নবীজির হুকুম অনুযায়ী ত্রিশজন আনসারী এসে খেয়ে গেল। অবশেষে দেখা গেল, ঐ দুজনের খাবার হতে ত্রিশজন আনসারী তৃপ্তি সহকারে আহার করবার পরও খাবার বেঁচে গিয়েছে। (বায়হাকী) 
হযরত আবু আইউব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ঐ সামান্য খাবার হতে ত্রিশজন আনসারী পেট ভরে আহার করলো এবং এই মুজিযা দেখে সকলে ইসলাম কবুল করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলো। তিনি আরো বলেন, সেই দিন ঐ খাবার দ্বারা সর্ব মোট একশ আশিজন তৃপ্তি সহকারে আহার করেছিলো। 
উপরোক্ত ঘটনাটি ঐ সময়ের, যখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা হতে হিজরত করে হযরত আবু আইউব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহুর গৃহে সাময়িকভাবে মেহমান হিসেবে অবস্থান করছিলেন।

নবীজির দোয়ার বরকতঃ 
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ইবনে আব্বাসের জন্য দোয়া করলেন- ইয়া আল্লাহ! ইবনে আব্বাসকে দ্বীনের সমঝ ও তাফসীরের এলেম দান কর। নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়ার বরকতে তিনি এমন এলেম হাসিল করলেন যে, অবশেষে তাঁকে ‘বড় আলেম’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো। তাফসীরের ক্ষেত্রে তিনি ‘তরজুমানুল কুরআন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)

গাছপালার আনুগত্যঃ 
ইমাম হাকিম হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করছেন, আমরা একদা রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কোন এক সফরে ছিলাম। এক বেদুইন আমাদের সামনে পড়লো। লোকটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বললো, আমার পরিবার পরিজনের কাছে। তিনি বললেন, কোন কল্যাণ কি তুমি কামনা করো? সে বললো, সেটা আবার কী? নবীজি বললেন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই আর মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা এবং রাসুল’ এই সাক্ষ্য প্রদান করা। সে বললো, আপনি যা বললেন তার সত্যতার সাক্ষী কে? তিনি বললেন, এই বৃক্ষটিই আমার সাক্ষী। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক প্রান্তে অবস্থিত গাছটিকে ডাক দিলেন। বৃক্ষটি তৎক্ষনাত মাটি চিরে দুই ভাগ করে দৌড়ে নবীজির সামনে উপস্থিত হলো। তারপর তিনি গাছের নিকট থেকে তিনবার সাক্ষ্যগ্রহণ করলেন। গাছটি আবার যথাস্থানে ফিরে গেলো। 

প্রাণীর আনুগত্যঃ  
ইমাম আহমদ এবং নাসায়ী হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একখানা হাদীস বর্ণনা করেছেন। আনসার গোত্রের প্রত্যেকেই উট পালন করতো। এক বাড়িওয়ালা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিবেদন করলেন, আমার একটি উট রয়েছে যার পিঠে করে আমি পানি এনে থাকি। উটটি বড় বেয়াড়া হয়ে গিয়েছে। বোঝা বহন করতে চায় না। আর এদিকে আমার খেজুর বাগান পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কথা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবা কেরামকে সঙ্গে নিয়ে উটটির কাছে গেলেন। তিনি বাগানে পৌছলেন এবং একস্থানে দাঁড়িয়ে গেলেন। বাগানের এক কোণে বসা ছিলো উটটি।

আনসারী লোকটি বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এটাই আমার উট, যে কুকুরের মতো মানুষকে কামড়াতে চায়। আমার ভয় হচ্ছে, না জানি আপনাকেও সে কামড়ে দেয়। নবীজি বললেন, আমার ব্যাপারে ভয় করো না। তিনি উটের সামনে গেলেন। উটটি তাঁকে দেখা মাত্র মাথা উঠালো এবং তাঁর সামনে গিয়ে কদম মোবারকের কাছে মাথা নত করে সেজদা করলো। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটটির মাথার পশম ধরে টান দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিলেন। সাহাবা কেরাম নিবেদন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এটি একটি জানোয়ার, তার কোন জ্ঞানবুদ্ধি নেই। এই প্রাণীটি আপনাকে সেজদা করেছে। তবেতো আমরাও আপনাকে সেজদা করতে পারি। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন, কোনো মানুষের জন্য এটা উচিত নয় যে, সে অন্য একজন মানুষকে সেজদা করবে। মানুষের জন্য মানুষকে সেজদা করা বৈধ হলে আমি নারী জাতিকে তাদের স্বামীগণকে সেজদা করতে বলতাম। 

জড় পদার্থের আনুগত্যঃ 
দুনিয়ার সকল প্রাণীকুলই শুধু নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোলামী করেননি, জড় পদার্থসমূহও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুমের গোলাম ছিলো। তারাও নবীজির দরবারে সালাম নিবেদন করেছে, কথা বলেছে। এ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। 
১। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি নিঃসন্দেহে ঐ পাথরগুলোকে চিনি, যারা নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে মক্কা মুকাররামায় আমাকে সালাম জানাতো। বেশির ভাগ মুহাদ্দেসীনে কেরামের মতে এই পাথরগুলোর নাম ‘যেকাকুল হাজার’ যে পাথরগুলো নবীজির আসা যাওয়ার পথে তাঁকে সালাম পেশ করতো।
২। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, একদা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও হযরত ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে উহুদ পাহাড়ে উঠেছিলেন। উহুদ মদিনা মনোয়ারার নিকটবর্তী একটি পাহাড়। নবীজি বলেন, উহুদ এমন একটি পাহাড় যে আমাদেরকে ভালোবাসে এবং আমরা তাকে ভালোবাসি। তিনজন উহুদ পাহাড়ে আরোহন করলে সে কাঁপতে লাগলো। নবীজি স্বীয় কদম মোবারক তাঁর উপর রেখে বললেন, হে উহুদ! স্থির থাকো। তোমার উপর এ মুহুর্তে একজন নবী, একজন সিদ্দিক এবং দুজন শহীদ ব্যতীত আর কেউ নেই। সাথে সাথে পাহাড়ের কম্পন বন্ধ হয়ে যায়।  

পানি সম্পর্কিত মুজিযাঃ 
১। বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, হুদায়বিয়াতে একবার সাহাবায়ে কেরাম পিপাসায় কাতর হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আরজ করলেন, সহযাত্রীদের কারো নিকট পান করার মতো পানির কোন ব্যবস্থা নেই। আপনি অজু করার পর বদনাতে যে সামান্য পানি পড়ে আছে এখন তাই শেষ সম্বল। একথা শুনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় হস্ত মোবারক বদনার ভিতর ঢুকিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অঙ্গুলী হতে পানির ¯্রােত বইতে লাগলো। সকল সাহাবা তৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করে অজু করলেন। হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করা হলো, সাহাবাদের সংখ্যা কত ছিলো? তিনি বললেন, আমাদের সংখ্যা পনেরশ ছিলো বটে কিন্তু এই সংখ্যা যদি লক্ষও হতো তথাপি সকলের প্রয়োজন মিটাতে ঐ পানিই যথেষ্ট ছিলো।
      
২। বারা বিন আজিব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, হুদায়বিয়াতে আমরা চৌদ্দশ ব্যক্তি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তথায় একটি মাত্র কূপ ছিলো। আমরা উহার সম্পূর্ণ পানি উত্তোলন করে শেষ করে ফেললাম। অবশেষে এতে আর এক ফোটা পানিও অবশিষ্ট রইলো না। সংবাদ পেয়ে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ কূপের নিকট তাশরিফ আনলেন। একটি পাত্রে কিছু পানি এনে তিনি অজু করলেন। অজু শেষে পুনরায় কুলি করে আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করলেন। অতঃপর অজু শেষে যে সামান্য পানি বেঁচে ছিলো তা কূপের ভিতরে ঢেলে দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। বর্ণনাকারী বলেন, একটি পরেই ঐ কূপে এতো পানি বৃদ্ধি পেলো যে, আমাদের গবাদী পশুগুলো সহ আমরা সকলে তৃপ্তির সাথে পানি পান করলাম। আমরা সকলে তথায় বিশ দিন অবস্থান করলাম। ঐ সময় ঐ কূপ থেকেই আমাদের পানির চাহিদা পূরণ হয়। 

রোগীদের আরোগ্য করাঃ
১। যায়েদ বিন আবী ওবায়দা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সালামা বিন আকওয়ার পায়ের যখমের চিহ দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার পায়ে কি হয়েছিল? জবাবে সে বললো, খায়বরের যুদ্ধে প্রতিপক্ষের আঘাতে আমার পায়ে জখম হয়। জখমের ভয়াবহতার কারণে মানুষের মধ্যে রটে গেল যে, আমি শাহাদাত বরণ করেছি। কারণ ঐ আঘাতের পর বেঁচে থাকা স্বাভাবিক ছিলো না।
সালামা বিন আকওয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে ঐ জখম নিয়ে হাজির হলে তিনি ক্ষতস্থানে তিনবার দম করলেন। ফলে তার জখম সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেলো। 

২। হযরত কাতাদা ইবনে নোমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখে উহুদের যুদ্ধের দিন আঘাত লেগেছিলো। চোখের মণি বের হয়ে গাল পর্যন্ত নেমে এসেছিলো। তিনি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে নিবেদন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্ত্রীকে আমি খুব ভালোবাসি। আমার চোখের এরুপ যখম নিয়ে তার নিকট যেতে আমি অস্বস্থিবোধ করছি। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তার চোখের মণিটি হাত দিয়ে ধরে কোটরে বসিয়ে দিলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ চোখটি ভালো করে দাও। তাঁর চোখটি অপর চোখের চেয়ে অধিকতর সুন্দর ও উত্তম দৃষ্টিসম্পন্ন হয়েছিলো। কখনো অপর চোখে যন্ত্রণা হলেও এই চোখটি সবসময় সুস্থ থাকতো।

নবীজির বদদোয়াঃ 
১। সালামা বিন আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে মুসলিম বর্ণনা করেন, নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে এক ব্যক্তি বাম হাতে আহার করছিলো। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নসীহত করে বললেন, ডান হাতে আহার করো। কিন্তু ঐ হতভাগ্য এ বলে নসীহত প্রত্যাখ্যান করলো যে, আমি ডান হাতে খেতে পারি না। অথচ তার ডান হাতে কোন অসুবিধা ছিলো না। তার ঐ বেপরোয়া উত্তরের জবাবে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি ডান হাত দিয়ে খেতে পারবে না। অতঃপর তার ডান হাত এমন অকেজো হয়ে গেলো যে, তা আর মুখ পর্যন্ত উঠাতে পারতো না। 

২। হায়হাকী, হাকিম এবং ইবনে ইসহাক বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু লাহাবের ছেলে উতবার জন্য বদ দোয়া করে বললেন, ইয়া আল্লাহ! কুকুর জাতীয় প্রাণী হতে কোন একটি কুকুরকে তার পেছনে লেলিয়ে দাও। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বদ দোয়ার পর উতবাকে একটি বাঘ আক্রমণ করে শেষ করে ফেলেছিলো।

৩। বায়হাকী বর্ণনা করেন, হাকাম বিন আবিল আস নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে বসা ছিলো। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কথা বলতেন, তখন সে নাক মুখ ভেংচাতো এবং মুনাফিকদের দিকে চোখের ইশারা করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার উপর হাসি তামাশা করতো। নবীজি তার এই অশালীন আচরণ দেখে বললেন, তুমি এরুপই হয়ে যাবে। অতঃপর সে মৃত্যু পর্যন্ত অনবরত অনুরুপভাবে মুখ ভেংচাতে ছিলো। 

চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করাঃ 
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজিযার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিলো আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখন্ডিত করা। এটি কুরাইশদের সামনে ছিলো নবীজির নবুওয়াতের প্রমাণ এবং নবী বিদ্বেষীদের জন্য তাঁর উচ্চ মর্যাদার দলীল। অন্য কোন নবীর পক্ষ থেকে এর চেয়ে বিস্ময়কর কোন ঘটনা ঘটেনি। ঘটনাটি নিম্নরুপ-

হিজরতের পূর্বে মক্কা শরীফে আবু জাহেল, ওলীদ বিন মুগীরাহ এবং আ’স বিন ওয়ায়েল প্রমুখ কাফিররা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল যে, তুমি যদি সত্য নবী হও, তবে আকাশের চন্দ্রকে দ্বিখন্ডিত করে দেখাও। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যদি এরূপ করে দেখাতে পারি, তবে কি তোমরা ঈমান আনবে? উত্তরে তারা বললো- হ্যা। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করলেন যেন চাঁদ দুই টুকরা হয়ে যায়। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবের দোয়া কবুল করলেন। অতঃপর তিনি চাঁদের দিকে ইশারা করতেই তা দুই টুকরা হয়ে গেলো। এবার তিনি কাফিরদের এক একজনের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে বললেন, হে অমুক, সাক্ষী থাকো। হে অমুক সাক্ষী থাকো। সকল কাফিররা চাঁদের দ্বিখন্ডন ভালোভাবে দেখতে পেলো। চাঁদের খন্ড দুইটি পরস্পর থেকে এতো দূরে চলে গেলো যে এটার মধ্যদিয়ে হেরা পর্বত দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কাফিররা এই ঘটনাকে অস্বীকার করলো এবং এটাকে নিছক যাদুক্রিয়া বলে মন্তব্য করলো। এই মুজিযা সম্পর্কে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন। 
 اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ – وَاِنْ يَّرَوْا ايَةً يَعْرُضُوْنَ وَيَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُسْتَمَر-
অর্থাৎ- “কেয়ামত নিকটে এসে পড়েছে এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছে। আর যদি তারা কোন মু’জিযা দেখে তবে টাল-বাহানা করে এবং বলে এতো যাদু, এখনই তাদের অবসান ঘটবে।” 

ডুবন্ত সূর্যকে ফিরিয়ে আনাঃ 
উর্দ্ধাকাশে নবীজির মুজেযার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ডুবন্ত সূর্যকে ফিরিয়ে আনা। ইমাম তাহাভী ও তাবরানী আসমা বিনতে উমাইস রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বারের কাছাকাছি সাহ্বা নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। ঐ সময় তাঁর উপর অহী নাযিল হয়। তিনি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জানুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর তখনও আসর নামাজ পড়া হয়নি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিদ্রা ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি নড়া চড়া করছেন না। সূর্য অস্ত গেলো। নবীজি নিজেই জাগ্রত হয়ে হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, আলী! আসরের নামাজ পড়েছো? তিনি বললেন, না। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাজাত করলেন, হে আল্লাহ! তোমার আলী, তোমার এবং তোমার রাসুলের আনুগত্যে ছিলো। তুমি সূর্যকে পুনরায় উদিত করে দাও। এখানে লক্ষণীয় যে, নবীজি মুনাজাতে বললেন, আলী তোমার ও তোমার রাসুলের আনুগত্যে ছিলো। অথচ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তো শুধু নবীরই আনুগত্য করছিলেন। অতঃএব, একথা পরিষ্কার যে রাসুলের আনুগত্যই আল্লাহর আনুগত্য, রাসুলের প্রতি ভালোবাসাই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, রাসুলের প্রতি শত্রুতা পোষণই আল্লাহর প্রতি শত্রুতা পোষণ। এটা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একক মর্যাদা যা পৃথিবীর অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি।

আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরুপ এমন অসংখ্য মর্যাদা দান করেছেন। নবীজির এমন অনেক মর্যাদা হয়তো আছে যা আমাদের অজানা। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলই জানেন যে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে কত মর্যাদা দান করেছেন।
নবীজির মুনাজাতের সাথে সাথে সূর্য আকাশে উদিত হলো। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন আসরের নামাজ আদায় করে নিলেন। হযরত আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন আমি সূর্যকে ডুবে যেতে দেখেছি। তারপর আবার সে সূর্যকে আকাশে উঠতেও দেখেছি। সূর্যের রশ্নি তখন পাহাড়ের চূড়া এবং যমীনে পতিত হয়েছিলো।

হযরত জাবেরের মৃত সন্তানদেরকে জীবিত করাঃ 
একদা হযরত জাবের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। নবীজিকে মেহমানদারীর জন্য তিনি একটি বকরী জবেহ করেছিলেন। বকরী জবেহ করার দৃশ্যটি দেখে তার সন্তান দুটির মনে কৌতুহল হলো। বকরীটি জবেহ করার অনুকরণে বড় ছেলেটি তার ছোট ভাইটিকে শুইয়ে দিলো এবং তার গলায় ছুরি চালিয়ে দিলো। তাদের মা এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে আসছিলেন। রক্তাক্ত ছোট ভাইকে দেখে বড় ছেলেটি ভয় পেয়ে বাড়ির উপর তলা থেকে ঝাপ দিয়ে পড়ে গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলো। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দাওয়াত খেতে হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘরে আসলেন, এসে দেখলেন হযরত জাবেরের দুই ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে। নবীজি তখন তার দুই ছেলেকে জীবিত করে দিয়েছিলেন। 
      
হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে সাপের বিষ থেকে রক্ষাঃ
একদহিজরতের সময়ে মদিনায় যাওয়ার পথে সাওর পর্বতের চুড়ায় পৌছে একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু গুহার ভিতরে ঢুকে গুহা পরিষ্কার করে চারিদিকের ছিদ্র গুলি কাপড় ছিড়ে বন্ধ করে দিলেন। একটি ছিদ্র বন্ধ করার মতো কাপড় ছিলো না। তিনি তখন নিজের পা দিয়ে সেই ছিদ্রটি বন্ধ করে দিলেন। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকরের কোলে মাথা মোবারক রেখে শুয়ে পড়লেন এবং নবীজির তন্দ্রা এসে গেলো। হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যে ছিদ্রে পা রেখেছিলেন, তার ভিতরে ছিল একটি সাপ। এই সাপটি এক হাজার বছর ধরে নবীজির দীদারের আশায় এই গুহায় অবস্থান করছিল। সাপটি তিনবার ফোঁস ফোঁস করে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পা সরিয়ে নেওয়ার জন্য সংকেত দিচ্ছিলো। অবশেষে যখন হযরত আবুবকর পা সরালেন না তখন সাপটি হযরত আবু বকরের পায়ে দংশন করলো। সাপের বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এমতাবস্থায় তিনি নড়াচড়া করলেন না যাতে প্রিয় নবীর আরামে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। হঠাৎ করে তার দুফোটা চোখের পানি নবীজির চেহারা মোবারকের উপর পড়লো। তখনি নবীজির তন্দ্রা ভেঙ্গে গেলো। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, হে আবুবকর! কি হয়েছে? আবু বকর বললেন, সাপে দংশন করেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি থুথু মোবারক আবু বকরের দংশিত স্থানে মালিশ করে দিলেন। সাথে সাথে বিষের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু।

 
Top