নজদ অঞ্চলবিষয়ক হাদীসটি সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা 


নজদ অঞ্চলবিষয়ক হাদীসটি সম্পর্কে সাধারণভাবে বোধগম্য যে অর্থ বিদ্যমান, নজদকে সেই প্রাথমিক যুগের উপলব্ধির আওতামুক্ত রাখতে বর্তমানকালের নজদীপন্থী লেখকেরা যথেষ্ট উদ্ভাবনী ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। কতিপয় আত্মপক্ষ সমর্থনকারী এই হাদীসটিকে বেশ কিছু হাদীসের সাথে মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন, যেগুলোতে ‘শয়তানের শিং’-কে ‘পূর্বাঞ্চলের’ সাথে সম্পৃক্ত করা হয়; পূর্বাঞ্চল বলতে সাধারণতঃ ইরাককে বোঝায়। মধ্যযুগের শেষলগ্নের কিছু ব্যাখ্যা এই ধারণার বশবর্তী হলেও আধুনিক ভৌগোলিক জ্ঞান স্পষ্টতঃ এই ধারণাকে নাকচ করে দেয়। আধুনিক মানচিত্রের (গোলকের) দিকে এক নজর বুলালেই পরিদৃষ্ট হবে যে মদীনা মোনাওয়ারা থেকে পূর্ব দিকে টানা এক সরল-রেখা ইরাকের ধারে-কাছে কোথাও যায় না, বরং রিয়াদের কিছুটা দক্ষিণে স্থিত হয়। অর্থাৎ, নজদ অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত হয়। অতএব, এ প্রসঙ্গে যে সব হাদীসে ‘পূর্বাঞ্চলের’ কথা উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলো নজদ অঞ্চলকেই ইঙ্গিত করে, ইরাককে নয়।


সুযোগ পেলেই নজদীপন্থী আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা আরবী ‘নজদ’ শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ তুলে ধরে; এ শব্দের মানে হলো ‘উঁচু স্থান’। তবে আবারও আধুনিক মানচিত্রের (গোলকের) শরণাপন্ন হলে এই বিষয়টির চূড়ান্ত ফয়সালা পাওয়া যায়। আজকের উত্তর ইরাক, যাকে বর্তমান শতাব্দীর আগ পর্যন্ত কোনো মুসলমান-ই ইরাকের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন নি (একে বলা হতো ‘আল-জাযিরা’), তার ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র ইরাক অঞ্চল-ই লক্ষণীয়ভাবে সমতল ও নিচু ভূমি; আজও এর অধিকাংশ এলাকা নিচু জলাভূমি, আর বাকি বাগদাদ পর্যন্ত বা তারও উত্তরে রয়েছে সমতল, নিচু মরু এলাকা বা কৃষি জমি। এর বিপরীতে নজদ অঞ্চল হলো বেশির ভাগই মালভূমি, যা’তে ’জাবাল শাম্মার’ পর্বতমালার উঁচু শৃঙ্গ ‘জাবাল তাঈয়ী’ (১৩০০মিটার)-ও অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণ ইরাকের সমতল ভূমির প্রতি কীভাবে আরবীয়রা নিত্যনৈমিত্তিকভাবে প্রাকৃতিক বিবরণমূলক ‘উঁচু ভূমি’ সংজ্ঞাটি আরোপ করতে পারেন তা বোঝা এক্ষণে দুষ্কর। [এই একই এলাকা ১৯৯১ সালের’ উপসাগরীয় যুদ্ধ’ চলাকালে ট্যাংক-লড়াইয়ের উপযোগী হিসেবে প্রমাণিত হয়, আর এটি-ই রিয়াদের ‘ক্যাভেলিয়ার্স’ (রাজতন্ত্রপন্থী) ও ‘রাউন্ডহেডস্’ (গণতন্ত্রপন্থী)-দের মধ্যে দ্বন্দ্বের কুখ্যাত উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়]


নজদ অঞ্চলকে সহজভাবে শনাক্ত করা যায় হাদীসশাস্ত্র দ্বারা, যা’তে অসংখ্যবার নজদের কথা বিবৃত হয়েছে; আর এগুলোর সবই পরিষ্কারভাবে মধ্য আরব অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছে। কয়েক ডজন উদাহরণের মাঝে কিছু এখানে তুলে ধরা হলো: 


❏ হাদিস 2:


আবূ দাউদ শরীফ (সালাত আল-সফর, ১৫) বর্ণনা করে,

 عَنْ أَبِي  هُرَيْرَةَ، قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى نَجْدٍ حَتَّى إِذَا كُنَّا بِذَاتِ الرِّقَاعِ مِنْ نَخْلٍ لَقِيَ جَمْعًا مِنْ غَطَفَانَ، فَذَكَرَ مَعْنَاهُ- 

“আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-সহ নজদ অঞ্চলে যাই এবং ‘যাত আল-রিকা’ পৌঁছাই, যেখানে গাতফান (নজদী) গোত্রের একটি দলের সাথে তাঁর (ﷺ) দেখা হয়।” [২.]  

২.  . আবু দাঊদ : আস সুনান, বাবু মান কালা ইয়ুকাব্বিরুনা জামিয়ান, ২:১৪ হাদীস নং ১২৪১।


❏ হাদিস 3:


তিরমিযী শরীফে (হজ্জ্ব, ৫৭) মহানবী (ﷺ)-এর সাথে আরাফাতে এক নজদী প্রতিনিধিদলের দেখা হওয়ার বিবরণ রয়েছে (আরও দেখুন ইবনে মাজাহ, মানাসিক, ৫৭)। 


এ সব ক্ষেত্রের কোনোটিতেই সুন্নাহ থেকে এই আভাস পাওয়া যায় না যে ইরাক রাজ্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ভাষ্যানুযায়ী নজদের অন্তর্গত ছিল। হাদীসসমূহের এক গুচ্ছ থেকে আরও প্রামাণ্য দলিল পেশ করা যায়, যেগুলো হাজ্বীদের জন্যে ‘মিকাত’-স্থানগুলো চিহ্নিত করে। 


❏ হাদিস 4:


ইমাম নাসাঈ বর্ণিত একখানা হাদীসে (মানাসিক আল-হাজ্জ্ব,২২) হযরত মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ঘোষণা করেন, 

وَقَّتَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ ذَا الْحُلَيْفَةِ، وَلِأَهْلِ الشَّامِ الْجُحْفَةَ، وَلِأَهْلِ نَجْدٍ قَرْنًا، وَلِأَهْلِ الْيَمَنِ يَلَمْلَمَ.- 

‘হুযূর পাক (ﷺ) মদীনাবাসীদের জন্যে যুল-হুলায়ফা-তে ‘মিকাত’-স্থান নির্ধারণ করেছেন, সিরিয়া ও মিসরবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন আল-জুহফাতে, ইরাকবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন যাত এরক-এ, নজদবাসীর জন্যে করেছেন কার্ন-এ, আর ইয়েমেনবাসীর জন্যে নির্ধারণ করেছেন ইয়ালামলাম-এ।[৩.] ’ 

৩. নাসায়ী : আস সুনান, মিকাতু আহলিল ইরাক, ৪:১৯ হাদীস নং ৩৬২৩।

(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ৪:১০৯ হাদীস নং ২২৩৯।

(খ) ইব্ন খুযায়মা : ৪:১৫৯ হাদীস নং ২৫৯১।

(গ) ত্ববরানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১১:২১ হাদীস নং ১০৯১১।


❏ হাদিস 5:


ইমাম মুসলিম-ও (হজ্জ্ব,২) অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেন,

 وَقَّتَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ ذَا الْحُلَيْفَةِ، وَلِأَهْلِ الشَّامِ الْجُحْفَةَ، وَلِأَهْلِ نَجْدٍ قَرْنَ الْمَنَازِلِ، وَلِأَهْلِ الْيَمَنِ يَلَمْلَمَ، -

‘মদীনাবাসীর জন্যে হলো যুল-হুলায়ফা, অপর রাস্তার জন্যে এটি আল-জুহফা; ইরাকবাসীর জন্যে হলো যাত এরক, নজদবাসীর জন্যে কার্ন; আর ইয়েমেনবাসীর জন্যে এটি হলো ইয়ালামলাম।[৪.]

৪. মুসলিম : আস সহীহ, বাবু মাওয়াকিতিল হজ্জ্ব ওয়াল উমরা, ২:৮৩৯ হাদীস নং ১১৮১।

(ক) ইব্ন আবী শায়বা : আল মুসান্নাফ, ফি মাওয়াকিতিল হজ্ব, ৩:২৬৫ হাদীস নং ১৪০৬৮।

(খ) আহমদ : আল মুসনাদ, ১:২৫২ হাদীস নং ২২৭২।

(গ) দারেমী : আস সুনান, ২:১১২৬ হাদীস নং ১৮৩৩।

(ঘ) বুখারী : আস সহীহ, ৬:৬৩ হাদীস নং ১৫২৪।


এই হাদীসগুলো তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে মহানবী (ﷺ) নজদ ও ইরাকের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন, এমনই পার্থক্য যে তিনি এই দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্যে আলাদা আলাদা ‘মিকাত’-স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে স্পষ্টতঃ ইরাক নজদ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

 
Top