দ্বিতীয় অধ্যায়

এ মাসআলা প্রসঙ্গে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ ও এসবের জবাব

   

এ প্রসঙ্গে বিরোধিতাকারীগণ নিম্নলিখিত আপত্তিসমূহ উত্থাপন করে থাকে। ইনশাআল্লাহ এর থেকে আর বেশী কিছু তাদের বলার নেই।


১নং আপত্তিঃ 

জানাযার সাথে উচ্চস্বরে যিকর করাকে ফকীহগণ নিষেধ করেন। 


❏ যেমন, ফতওয়ায়ে আলমগীরীর প্রথম খণ্ড কিতাবুল জনায়েযে دفن الميت শীর্ষক পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে-

وَعَلَى مُتَّبِعِي الْجِنَازَةِ الصَّمْتُ وَيُكْرَهُ لَهُمْ رَفْعُ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ، كَذَا فِي شَرْحِ الطَّحَاوِيِّ، فَإِنْ أَرَادَ أَنْ يَذْكُرَ اللَّهَ يَذْكُرُهُ فِي نَفْسِهِ، كَذَا فِي فَتَاوَى قَاضِي خَانْ.

-‘‘জানাযার সাথে গমনকারীদের নিশ্চুপ থাকা ওয়াজিব এবং উচ্চস্বরে যিকর করা ও কুরআন তেলাওয়াত করা মাকরূহ। এমনটি তাহাভী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে রয়েছে। যিনি আল্লাহর যিকর করতে চান, যেন মনে মনে করে না। এমনটি ফাতওয়ায়ে কাযি খানে রয়েছে।’’ ৫১১

➥511. নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, ১/১৬২ পৃ:


❏ ফাতওয়ায়ে সিরাজিয়াতে حمل الجنازة শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-

ويكره النياح والصوت خلف الجنازة وفى منزل الميت رَفْعُ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ، وقولهم كل حى يموت ونحو ذالك خلف الجنازة بدعة

জানাযার পিছনে এবং মইয়তের ঘরে বিলাপ করা, শোরগোল করা এবং উচ্চস্বরে যিকর করা ও কুরআন পাঠ করা মাকরূহ। এবং জানাযার পিছনে ‘প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করবে’ উচ্চারণ করে গমন করা বিদআত।


❏ দুর্রুল মুখতারের প্রথম খণ্ড কিতাবুল জনায়েয دفن الميت শীর্ষক আলোচনায় উল্লে­খিত আছে-

كَمَا كُرِهَ فِيهَا رَفْعُ صَوْتٍ بِذِكْرٍ أَوْ قِرَاءَةٍ

যেমন জানাযায় উচ্চস্বরে যিকর করা বা কুরআন তেলওয়াত মাকরূহ।  ৫১২

➥512. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৩।


❏ এর প্রেক্ষাপটে শামীতে বর্ণিত আছে-

قُلْت: وَإِذَا كَانَ هَذَا فِي الدُّعَاءِ وَالذِّكْرِ فَمَا ظَنُّك بِالْغِنَاءِ الْحَادِثِ فِي هَذَا الزَّمَانِ.

যখন দুআর বেলায় এতটুকু কঠোরতা জ্ঞাপন করা হয়, তখন গানের কি অবস্থা হবে, যা বর্তমান যুগে সৃষ্টি হয়েছে।  ৫১৩

➥513. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৩।


❏ ইবনে মনযর “আশরাফ” গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন-

قال قيس ابن عبادة كان اصحاب رسول الله ﷺ يكرهون رفع الصوت عند القتال وفى الجنازة وفى الذكر

অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম জিহাদ, জানাযা ও যিকরের বেলায় উচ্চস্বর নাপছন্দ করতেন।


উপরোক্ত ফকীহ ইবারতসমূহ থেকে বোঝা গেল যে মইয়তের সাথে উচ্চস্বরে যিকর করা নিষেধ। বিশেষ করে সেই গান, যাকে আজকাল না’ত খানি বলা হয়, খুবই দূষণীয় (বিরোধিতাকারীদের এটাই হচ্ছে চরম আপত্তি)


উত্তরঃ ফকীহগণের উপরোক্ত ইবারতসমূহে কয়েক ধরনের বক্তব্য রয়েছে।


প্রথমতঃ 

তারা মইয়তের সাথে উচ্চস্বরে যে যিকরকে মকরূহ লিখেছেন, সেটা কি মাকরূহ তানযীহ, নাকি তাহরীমি? (মাকরূহ তানযীহ জায়েযের অর্ন্তভূক্ত অর্থাৎ ওটা করা জায়েয তবে না করাটাই ভাল।)


দ্বিতীয়তঃ 

তাদের এ হুকুম সেই যুগের জন্য ছিল, নাকি প্রত্যেক যুগের জন্য?


তৃতীয়তঃ 

তারা যে কোন কথাবার্তা বলা নিষেধ বলেছেন, নাকি কেবল উচ্চস্বরে যিকর করা বা বিলাপ ইত্যাদি নিষেধ বলেছেন?


চতুর্থতঃ 

উচ্চস্বরে যিকর প্রত্যেকের জন্য নিষেধ, নাকি বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য বলেছেন?


এ চারটি বিষয় চূড়ান্ত হলে, মাসআলা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। আসলে, যে সব ফকীহ মইয়তের সাথে উচ্চস্বরে যিকরকে মাকরূহ বলেছেন, তাতে তারা মাকরূহ তনযীহকে বোঝাতে চেয়েছেন। যেমন,


❏ আল্লামা শামীর উদ্ধৃত ইবারতের পরে বর্ণিত আছে-

قِيلَ تَحْرِيمًا، وَقِيلَ تَنْزِيهًا كَمَا فِي الْبَحْرِ عَنْ الْغَايَةِ. وَفِيهِ عَنْهَا: وَيَنْبَغِي لِمَنْ تَبِعَ الْجِنَازَةَ أَنْ يُطِيلَ الصَّمْتَ

-জানাযার সাথে উচ্চস্বরে যিকর করাটা কারো কারো পক্ষ থেকে মাকরূহ তাহরীমী বলা হয়েছে, আবার কারো কারো পক্ষ থেকে মাকরূহ তানযীহ বলা হয়েছে, যেমন বাহারুর রায়েকে গায়ত থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সেই বাহারুর রায়েকে গায়তের বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে-যে ব্যক্তি জানাযার সাথে যাবে, নিশ্চুপ থাকাটাই তার জন্য ভাল। ৫১৪

➥514. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৩।


এতে বোঝা গেল নিশ্চুপ থাকাটাই ভাল এবং নিশ্চুপ না থাকা তথা উচ্চস্বরে যিকর করা ভাল নয় তবে জায়েয। অধিকন্তু মাকরূহ তানযীহ এবং মাকরূহ তাহরীমীর বিবরণ স্বয়ং আল্লামা শামী (رحمة الله) মাকরূহ সমূহের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বর্ণনা করেছেন। 


❏ শামীর প্রথম খণ্ড কিতাবুত তাহারতে মাকরূহের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন-

فَحِينَئِذٍ إذَا ذَكَرُوا مَكْرُوهًا فَلَا بُدَّ مِنْ النَّظَرِ فِي دَلِيلِهِ، فَإِنْ كَانَ نَهْيًا ظَنِّيًّا يُحْكَمُ بِكَرَاهَةِ التَّحْرِيمِ إلَّا لِصَارِفٍ لِلنَّهْيِ عَنْ التَّحْرِيمِ إلَى النَّدْبِ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ الدَّلِيلُ نَهْيًا بَلْ كَانَ مُفِيدًا لِلتَّرْكِ الْغَيْرِ الْجَازِمِ فَهِيَ تَنْزِيهِيَّةٌ

-যখন ফকীহগণ কোন কিছুকে মাকরূহ বলেন, তখন মাকরূহের দলীলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। যদি এর দলীল সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছাড়া অনুমান ভিত্তিক নিষেধাজ্ঞার হয়, তাহলে মকরূহ তাহরীমী বলে ধরে নিতে হবে আর যদি নিষেধাজ্ঞার কোন দলীল না থাকে, কেবল নিষ্প্রয়োজন, ‘না করাটাই ভাল’ বলা হয়, তাহলে মাকরূহ তানযীহ মনে করতে হবে। ৫১৫

➥515. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩২।


এতে বোঝা গেল, যদি ফকীহগণ মাকরূহের প্রমাণ স্বরূপ-শরয়ী নিষেধাজ্ঞা পেশ করেন, তাহলে মাকরূহ তাহরীমী; অন্যথায় মাকরূহ তানযীহ। উল্লে­খ যে, যে সব ফকীহ উচ্চস্বরে যিকর নিষেধ বলেছেন, তারা নিষেধাজ্ঞার কোন হাদীছ বা আয়াত পেশ করেন নি। 


❏ আল্লামা শামী কেবল এ দলীলটা উল্লে­খ করেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-

إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

-আল্লাহ সীমা লঙ্ঘন কারীদেরকে পছন্দ করেন না। ৫১৬

➥516. সূরা বাক্বারা, আয়াত, ১৯০


❏ এর ব্যাখ্যা করেছেন-

اى المجاهرين بالدعاء

-উচ্চস্বরে প্রার্থনাকারীদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কোন সুস্পষ্ট হাদীছ পাওয়া যায়নি। সুতরাং, এটা মাকরূহ তানযীহ এবং মাকরূহ তানযীহ জায়েযই হয়ে থাকে। 


❏ অধিকন্তু, ইমাম শারানী عهود مشائخ নামক কিতাবে জানাযার সাথে যিকর করা প্রসঙ্গে বলেছেন - 

وقد رجح النووى ان الكلام خلاف الاولى

ইমাম নববী (رضي الله عنه) জানাযার সাথে যাবার সময় কথা না বলাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন) 

شرح طريقه محمديه কিতাবে উল্লে­খ করা হয়েছে-

وهو يكره على معنى انه تارك الاولى

-জানাযার সাথে উচ্চস্বরে যিকর করা মাকরূহ অর্থাৎ ভাল নয়।’’ 


যে কোন অবস্থায় মানতেই হবে, যে সব ফকীহ মাকরূহ বলছেন তারা মাকরূহ তানযীহ বোঝাতে চেয়েছেন।


দ্বিতীয়তঃ এ নিষেধাজ্ঞা তৎকালীন যুগের জন্য ছিল। বর্তমান যুগে যেহেতু মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেহেতু মাকরূহের এ হুকুমটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। কেননা তখনকার যুগে যাঁরা জানাযার সাথে যেতেন, তারা নিশ্চুপ থাকতেন, এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং মৃত ব্যক্তির শোক-সন্তপ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন। শরীয়তের অভিপ্রায়ও তাই অর্থাৎ মইয়তের জুলুস থেকে মানুষ যেন শিক্ষা গ্রহণ করে। 


❏ ছৈয়্যদেনা হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন-

واذا حملت الى القبور جنازة. فاعلم بانك بعدها محمول

"যখন তুমি কবরস্থানে জানাযা নিয়ে যাও, তখন মনে করো, একদিন তোমাকেও এভাবে নিয়ে যাওয়া হবে।"


সেই অবস্থায় অন্য কোন কথা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা কথা বলার ফলে মন অন্যদিকে চলে যাবে। সুতরাং, ফকীহগণ তখন নিশ্চুপ থাকতে বলেছেন। 


❏ ইমাম নববী (رحمة الله) এর রচিত কিতাবুল আযকারের بابُ ما يقولُه الماشي مع الجَنَازة অধ্যায়ে উল্লে­খিত আছে -৫১৭

والحكمة فيه ظاهرة، وهي أنه أسكنُ لخاطره، وأجمعُ لفكره فيما يتعلق بالجنازة، وهو المطلوبُ في هذا الحال

➥517. ইমাম নববী, কিতাবুল আযকার, ১৬০ পৃ:


❏ মিশকাত دفن الميت শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে সাহাবায়ে কিরাম বলেন-আমরা কবরস্থানে মইয়ত দাফন করতে গেলাম। 

وَجَلَسْنَا حوله كَأَن على رؤوسنا الطَّيْرَ

কবর তৈরি হতে দেরি ছিল। তাই আমরা এমনভাবে নিশ্চুপ বসে রইলাম যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছে। (পাখি শিকারী যখন ফাঁদ পাতে, তখন একেবারে নিশ্চুপ বসে থাকে, যেন শব্দে পাখিটা উড়ে না যায়।) ৫১৮

➥518. খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫১২ পৃ: হা/১৬৩০, পরিচ্ছেদ: بَاب مَا يُقَال عِنْد من حَضَره الْمَوْت , ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৩০/৪৯৯ পৃ:, হা/১৮৫৩৪, মুয়াস্সাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবানন।


কিন্তু বর্তমান যুগে জানাযার সাথে গমনকারীরা দুনিয়াবী কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা ও মুসলমানদের গীবতে নিয়োজিত থাকে। যদি কবরস্থানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে পরস্পর খোশগল্পে মশগুল হয়ে যায়। তাই ওদেরকে খোদার যিকরে মশগুল করতে পারলে, এসব বেহুদা কথাবার্তা থেকে অনেক ভাল হয়। অতএব বর্তমান যুগের মইয়তের সাথে গমনকারীর উচ্চস্বরে কলেমা ইত্যাদি পড়া মুস্তাহাব। অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে হুকুমও পাল্টে যায়। যে মুফতী নিজের যুগের অবস্থা সম্পর্কে বেখবর, সে অজ্ঞ। 


❏ ইমাম শায়ারানী (رحمة الله) স্বীয় কিতাব عهود مشائخ এ বলেছেন-

وانما لم يكن الكلام والقرأة والذكر امام الجنازة فى عهد السلف لانهم كانوا اذا مات لهم ميت اشتركوا كلهم فى الحزن عليه حتى كان لا يعرف قرابة الميت الميت من غيره فكانوا لايقدرون على النطق الكثير لماهم عليه من ذكر الموت بل خرست السنتهم عن كل كلام فاذا وجدنا جماعة بهذه الصفة فلك يا اخى علينا ان لا تأمرهم بقرءة ولاذكر

-‘‘আগের যুগে জানাযার সাথে গমন করার সময় কথা বলা, কুরআন পাঠ ও যিকর এ জন্য ছিল না যে যখন কেউ মারা যেত, তখন সবাই শোক প্রকাশ ও সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন। এমন কি মইয়তের নিকট আত্মীয় ও অন্যান্যদের মধ্যে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো না। মৃত্যুর ধ্যানে সবাই এ রকম বিভোর হতো যে কথা বলার শক্তিও কারো থাকতো না। তাদের মুখ বাকহীন হয়ে যেত। যদি আজকাল আমরা সেই রকম লোক পাই তাহলে ওদেরকে কুরআন পাঠ ও যিকর করার নির্দেশ দেব না।’’


সুবহানাল্লাহ! কি সুন্দর রায় দিয়েছেন। বলুন, আজকাল কি মানুষের সেই মনমানসিকতা আছে? 


❏ হযরত শেখ উছমান বুহাইরী (رحمة الله) শরহে একনার হাশিয়া দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লে­খ করেছেন-

﴿قوله وكره لفظ فى الجنازة﴾ قوله لفظ اى رفع صوت ولو بقران او ذكر او صلوة على النبى  ﷺ وهذا باعتبار ما كان فى الصدر الاول و الا فالان لابأس بذالك لانه شعارا الميت لانه تركه مزدرية به ولو قيل بوجوبه لم يبعد كما نقله المدابغى    

-‘‘জানাযার সাথে যাওয়ার সময় শোরগোল করা মাকরূহ। এর শোরগোল কুরআনখানির ফলে হোক বা যিকরের দ্বারা বা দরূদ পাঠের ফলে হোক। এ হুক্মটা প্রথম যুগের মুসলমানদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে এসব করলে কোন ক্ষতি নেই। কেননা বর্তমান যুগে উচ্চস্বরে যিকর করা মইয়তের প্রতি সম্মানের লক্ষণ এবং না করাটা হচ্ছে মইয়তের প্রতি অবজ্ঞাপোষণ। সুতরাং, যদি একে জরুরীও বলা হয়, তা বাড়াবাড়ি বলা যাবে না, যেমন আল্লামা মুদাবেগী (رحمة الله) বলেছেন।’’ 


❏ ইমাম শারানী (رحمة الله) তাঁর عهود مشائخ কিতাবে বলেছেন-

فمما احدثه المسلمون واستحسنوه قولهم امام الجنازة لا إله إلاَّ اللهُ محمَّدٌ رسولُ الله او وسيلتنا يوم العرض على الله لا إله إلاَّ اللهُ محمَّدٌ رسولُ الله  نحو ذالك فمثل هذا لايجب انكاره فى هذا الزمان لانه ان لم  يشتغلوا بذالك استغلوا بحديث الدنيا وذالك لانه قبلهم فارع من ذكر الموت بل رئيت بعضهم يضحك امام الجنازة ويمزح

অর্থাৎ মুসলমানগণ যে কাজটা ভাল মনে করে আবিষ্কার করেছেন, সেটা হচ্ছে জানাযার আগে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ বলা বা ‘কিয়ামতের দিন খোদার সামনে আমাদের উসীলা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ বা এ রকম অন্যান্য যিকর করা। এ যুগে এর থেকে বারণ করা অনুচিত। কেননা এ যুগের লোকেরা যদি সেই যিকরে নিয়োজিত না হয়, তাহলে দুনিয়াবী কথাবার্তায় মশগুল হয়ে যাবে। কারণ তাদের মন মৃত্যু ভয় থেকে উদাসীন। বরং আমি কতেক লোককে জানাযার সাথে হাসিঠাট্টা করে যেতে দেখেছি।’’


ইমামে শায়ারানী (رحمة الله) তো তার যুগের কথা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আজকের যুগ তো এর থেকেও খারাপ। আমি নিজেই দেখেছি যে, কোন এক জানাযার কবর দিতে একটু দেরি হচ্ছিল। তখন উপস্থিত জনতা পৃথক পৃথক জটলা পাকিয়ে বসে এমনভাবে গল্প-গুজবে মশগুল হয়ে পড়ে, মনে হচ্ছিল যেন বাজার বসেছে। কতেক লোক মাটিতে আঁক টেনে পাথর দ্বারা খেলতে বসেছিল। এ অবস্থা দেখে আমি সবাইকে একত্রিত করে ওয়াজ করতে শুরু করলাম। লোকদেরকে কাফন-দাফনের আহকাম বর্ণনা করলাম। ওসব থেকে এটা নিশ্চয়ই উত্তম ছিল।


একটি সূক্ষ্ম মন্তব্যঃ 


বিরোধিতাকারীগণ জানাযার সাথে আল্লাহর যিকরকে তো বিদআত ও হারাম বলে থাকে। কিন্তু কথা বলা, কোন মাসায়েল বর্ণনা করাকে কোন সময় শিরক ও বিদআত বলে না এবং জনগণের মধ্যে পরস্পর হাসিঠাট্টা করাকে নিষেধও করে না এবং খারাপও বলে না। অথচ ফকীহগণ একেবারে নিশ্চুপ থাকার কথাই বলেছেন, যেমন উপরোক্ত আপত্তিতে উদ্ধৃত ইবারত সমূহ থেকে তাই বোঝা গেছে। গংগা উলটো দিকে কেন প্রবাহিত হচ্ছে? কালাম-সালাম, হাসি উপহাস, ওয়াজ ফাতওয়া সবই জায়েয; কেবল যিকর ইলাহী বুঝি হারাম? হে আল্লাহ, তাদেরকে বোধ শক্তি দিন।

   

বিঃদ্রঃ সম্ভবতঃ কেউ যদি বলে ইসলামী আহকাম তো পরিবর্তন হয় না কিন্তু এখানে পরিবর্তন কেন? এর জবাব আমি প্রথমেই দিয়েছি যে, যেসব আহকাম কোন ইল­তের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া হয়, ইল­তের পরিবর্তনের সাথে সে সব আহকামও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন প্রথম যুগে নামায পড়ান, কুরআন শিক্ষা ইত্যাদির জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হারাম ছিল। কিন্তু এখন জায়েয। অনুরূপ আওলিয়া কিরামের কবরসমূহের উপর চাদর ছড়ানো বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে জায়েয। তদ্রুপ রমযান মাসে খতমে কুরআনের পর দুআ প্রার্থনা করাকে জায়েয বলা হয়েছে। কুরআন শরীফে আয়াত, রূকু সূরা সমূহের নাম প্রথম যুগে ছিল না। কিন্তু সাধারণ লোকের উপকারের কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে জায়েয বলা হয়েছে। 


❏ ফতওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবুল কারাহিয়াত اداب المصحف শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লে­খিত আছে।

لَا بَأْسَ بِكِتَابَةِ أَسَامِي السُّوَرِ وَعَدَدِ الْآيِ وَهُوَ وَإِنْ كَانَ إحْدَاثًا فَهُوَ بِدْعَةٌ حَسَنَةٌ، وَكَمْ مِنْ شَيْءٍ كَانَ إحْدَاثًا وَهُوَ بِدْعَةٌ حَسَنَةٌ، وَكَمْ مِنْ شَيْءٍ يَخْتَلِفُ بِاخْتِلَافِ الزَّمَانِ وَالْمَكَانِ، كَذَا فِي جَوَاهِرِ الْأَخْلَاطِيِّ

-অর্থাৎ সূরাসমূহের নাম, আয়াতসমূহের সংখ্যা লেখার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই, যদি ও বা এটা বিদআত কিন্তু বিদআতে হাসনাই বটে। এ রকম অনেক ভাল বিদআতে প্রচলিত আছে। অনেক কিছু যুগ ও স্থান পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত হয়ে যায়।’’  ৫১৯

➥519. নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩২৩।


এর দীর্ঘ বিশ্লেষণ আমি প্রথম অধ্যায়ে করছি।


তৃতীয়তঃ কাথিয়াওয়ার্ড ও অন্যান্য স্থানে জানাযার আগে: এমন করুণ সুরে না’ত শরীফ পাঠ করা হয় যে শ্রোতাদের ন কেড়ে নেয়। এ রকম নাত শরীফ পাঠ করে কোন জানাযা নিয়ে গেলে, ঘরের মধ্যে যারা থাকে, তারাও জানাযার নামাযের জন্য বের হয়ে আসে। ফলে নাতখানি দ্বারা মইয়তের প্রচার হলো। জনগণকে জানাযার নামায ও দাফনে শরীক করানোর জন্য প্রচার করা জায়েয। 


❏ যেমন দুর্রুল মুখতারের دفن الميت শীর্ষক আলোচনায় উল্লে­খিত আছে:

وَلَا بَأْسَ بِنَقْلِهِ قَبْلَ دَفْنِهِ وَبِالْإِعْلَامِ بِمَوْتِهِ وَبِإِرْثَائِهِ بِشَعْرٍ أَوْ غَيْرِهِ

-মইয়তের দাফন করার আগে স্থানান্তরিত করা, এর জানাযার প্রচার করা, মইয়তের শোকগাথা পদ্যে হোক বা অন্যভাবে পাঠ করা জায়েয।’’ ৫২০

➥520. হাসকাফী, দুররুল মুখতার, পৃষ্ঠা-১১৫, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৯


❏ ফতওয়ায়ে শামীতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে:

أَيْ إعْلَامِ بَعْضِهِمْ بَعْضًا لِيَقْضُوا حَقَّهُ هِدَايَةٌ. وَكَرِهَ بَعْضُهُمْ أَنْ يُنَادَى عَلَيْهِ فِي الْأَزِقَّةِ وَالْأَسْوَاقِ لِأَنَّهُ يُشْبِهُ نَعْيَ الْجَاهِلِيَّةِ وَالْأَصَحُّ أَنَّهُ لَا يُكْرَهُ إذَا لَمْ يَكُنْ مَعَهُ تَنْوِيهٌ بِذِكْرِهِ

অর্থাৎ একে অপরকে খবর দেয়া, যাতে লোকেরা মইয়তের হক আদায় করতে পারে, তা জায়েয। কতেক লোক অলি-গলি এবং বাজারে প্রচার করাকে মাকরুহ মনে করে। কিন্তু বিশুদ্ধ অভিমত হলো: এ ধরনের প্রচার মাকরুহ নয়, যদি উক্ত প্রচারে মইয়তের অতিরিক্ত প্রশংসা করা না হয়।’’ ৫২১

➥521. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৯


যখন জানাযার প্রচারের উদ্দেম্যে শোক-গাথা পাঠ বা মইয়তের নাম প্রচার করা জায়েয তখন জানাযার প্রচারের নিয়তে নাত শরীফ বা কলেমা তৈয়্যবা উচ্চস্বরে পাঠ করা কেন হারাম হবে? এতে প্রচারও হগচ্ছে, হুযুর আলাইহিস সালামের নাতও হচ্ছে। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ফকীহগণ যা নিষেধ করেন, তা হচ্ছে বে-ফায়দা যিকর। কিন্তু এতে যদি বিশেষ ফায়দা থাকে, তাহলে জায়েয। 


❏ এ জন্য আল্লামা শামী সেই একই আলোচনায় “তাতার খানিয়া” থেকে উদ্বৃত্ত করে বলেছেন:

زَادَ فِي التَّتَارْخَانِيَّة: وَأَمَّا رَفْعُ الصَّوْتِ عِنْدَ الْجَنَائِزِ فَيُحْتَمَلُ أَنَّ الْمُرَادَ مِنْهُ النَّوْحُ أَوْ الدُّعَاءُ لِلْمَيِّتِ بَعْدَمَا افْتَتَحَ النَّاسُ الصَّلَاةَ أَوْ الْإِفْرَاطُ فِي مَدْحِهِ كَعَادَةِ الْجَاهِلِيَّةِ مِمَّا هُوَ شَبِيهُ الْمُحَالِ، وَأَمَّا أَصْلُ الثَّنَاءِ عَلَيْهِ فَغَيْرُ مَكْرُوهٍ

-‘‘কিন্তু মইয়তের পাশে উচ্চ আওয়াজ করা মানে হয়তো এর দ্বারা বিলাপ করাকে বোঝানো হয়েছে বা মইয়তের নামায হয়ে যাবার পর দুআ করানো বোঝানো হয়েছে অথবা মইয়তের অতিরিক্ত প্রশংসা করাকে বোঝানো হয়েছে। যেমন জাহেলিয়াত যুগে এ ধরনের প্রচলন ছিল। কিন্তু মইয়তের প্রশংসা করা মাকরুহ নয়।’’ ৫২২

➥522. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৯৮


মোট কথা হলো বেফায়দা উচ্চ আওয়াজ করা নিষেধ। কিন্তু ফলপ্রসুু উচ্চ আওয়াজ বিনা মাকরুহ জায়েয। বর্তমান যুগে এতে অনেক উপকার রয়েছে, যা ইতিপূর্বে উল্লে­খ করা হয়েছে।


চতুর্থতঃ উচ্চস্বরে যিকরের নিষেধাজ্ঞা বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; সাধারণ লোকেরা উচ্চ স্বরে যিকর করলে তাদেরকে বারণ করা অনুচিত। ফকীহগণ বলেন, সাধারণ লোকদেরকে যিকরে ইলাহী থেকে বাধা দিও না, কেন না তারা এমনিতে যিকর ইলাহীর ব্যাপারে অনাগ্রহী। এখন যে পরিমাণ যিকর করতে চায়, করতে দাও। 


❏ দুর্রুল মুখতারে صلوة العيدين অধ্যায়ে বর্ণিত আছে:

(وَلَا يُكَبِّرُ فِي طَرِيقِهَا وَلَا يَتَنَفَّلُ قَبْلَهَا مُطْلَقًا) (وَكَذَا) لَا يَتَنَفَّلُ (بَعْدَهَا فِي مُصَلَّاهَا) فَإِنَّهُ مَكْرُوهٌ عِنْدَ الْعَامَّةِ

-‘‘ঈদগাহের পথে তকবীর বলো না। ঈদের নামাযের আগে নফল নামায পড়ো না এবং ঈদের নামাযের পর ঈদগাহে নফল নামায পড়ো না। কেননা এটা অধিকাংশ ফকীহগণের মতে মাকরুহ।’’  ৫২৩

➥523. হাসকাফী, দুররুল মুখতার, পৃষ্ঠা-১১৫, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৬৯-১৭০


❏ পুনরায় বলেন:

وَهَذَا لِلْخَوَاصِّ أَمَّا الْعَوَامُّ فَلَا يُمْنَعُونَ مِنْ تَكْبِيرٍ وَلَا تَنَفُّلٍ أَصْلًا لِقِلَّةِ رَغْبَتِهِمْ فِي الْخَيْرَاتِ

-‘‘এ হুকুম বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য, সাধারণ লোকদেরকে এর থেকে নিষেধ করা যাবে না। তকবীর বলা এবং নফল ইবাদত কোনটার থেকে নয়। কেননা ভাল কাজে ওদের আকর্ষণ কম।’’ ৫২৪

➥524. হাসকাফী, দুররুল মুখতার, পৃষ্ঠা-১১৫, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭১


❏ এ প্রসঙ্গে ফতওয়ায়ে শামীতে বর্ণিত আছে:

أَيْ لَا سِرًّا وَلَا جَهْرًا فِي التَّكْبِيرِ

অর্থাৎ ওদেরকে নিম্নস্বরে বা উচ্চস্বরে তকবীর বলা থেকে বাধা দেবে না।’’  ৫২৫

➥525. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭১


অধিকন্তু আমি উচ্চস্বরে যিকর শীর্ষক আলোচনায় ফতওয়ায়ে শামীর ঈদাইন অধ্যায়ের বরাত দিয়ে উল্লে­খ করেছি যে,  কোন এক ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) এর কাছে জানতে চেয়েছিল: লোকেরা বাজার সমুহে যে উচ্চস্বরে তকবীর বলে, তাদেরকে নিষেধ করা যাবে কিনা।


তিনি উত্তরে, ‘না’ বলেছিলেন। উপরোক্ত ইবারত সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, কোন কোন অবস্থায় বিশেষ ব্যক্তিদেরকে কোন বিশেষ যিকর থেকে বারণ করা হয়, কিন্তু সাধারণ লোকদেরকে নিষেধ করা হয়নি। এ জন্যেই ফকীহগণ জানাযার আগে উচ্চস্বরে যিকর করো না’ বলেছেন, কিন্তু যিকরকারীদেরকে এর থেকে বাধা দাও বলেননি।

   

এ জবাবের সারকথা হচ্ছেঃ


প্রথমতঃ 

এ নিষেধাজ্ঞা মাকরুহ তানযীহ হিসেবে করা হয়েছে, দ্বিতীয়তঃ 

এ হুকুম প্রথম যুগের জন্য ছিল। এখন সেই হুকুম বদলে গেছে কারণ ইল­ত পরিবর্তিত হয়েছে। 

তৃতীয়তঃ 

যেহেতু এ যিকর দ্বারা প্রচার হচ্ছে, তাই উপকারী হেতু জায়েয। চতুর্থতঃ এ হুকম বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য। সাধারণ লোকেরা যদি যিকরে ইলাহী  করে তাহলে তাদেরকে যেন বাধা দেয়া না হয়।


    ২নং আপত্তিঃ 

জানাযার আগে উচ্চস্বরে যিকর করার মধ্যে হিন্দুদের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা ওরা রাম রাম হরি রাম বলে চিৎকার করে যায় এবং আপনারাও হৈ-হল্লা করে যান। কাফিকরদের সাথে সাদৃশ্য নাজায়েয। সুতরাং এটাও নাজায়েয।

    উত্তরঃ কাফিরগণ মুর্তিদের নাম নেয় আর আমরা খোদায়ে কুদ্দসের যিকর করি। তাহলে সাদৃশ্য কোথায় রইলো? কাফিরগণ দেবতার নামে আর আমরা খোদার নামে পশু যবেহ করি। কাফিরগণ গংগানদী থেকে গংগার পানিআনে আর আমরা মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে যমযমের পানি আনি। এটাকে সাদৃশ্য বলা হয় না। যে সব কাজ কাফিরদের জাতীয় বা সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে, এগুলোর সাথেই কেবল সাদৃশ্য নিষেধ, অন্যান্য বিষয়ে নয়। যদি কাফিরগণও তাদের জানাযার আগে কলেমা পাঠ করতে থাকে, আপনারাও সানন্দে পড়–ন। কেনটা এটা ভাল কাজ আর ভাল কাজের সাদৃশ্য দূষণীয় হতে পারে না।


    ৩য় আপত্তিঃ রাস্তায় উচ্চস্বরে কলেমা তৈয়্যবা পড়া বেআদবী কেননা তথায় ময়লা আবর্জনা থাকে। সুতরাং তা নিষেধ।


    উত্তরঃ এ আপত্তিটা নিছক গলাবাজি বৈ কিছু নয়। ফকীহগণের অভিমত হলো, রাস্তা দিয়ে চলার সময় যিকর জায়েয। তবে ময়লা আবর্জনা ফেলার নির্ধারিত জায়গায় উচ্চস্বরে যিকর নিষেধ, যেমন পায়খানা, ময়লাখানা ইত্যাদি জায়গায়। 


❏ ফতওয়ায়ে শামীতে قرأت عند الموت শীর্ষক আলোচনায় উল্লে­খিত আছে।

وَفِي الْقُنْيَةِ لَا بَأْسَ بِالْقِرَاءَةِ رَاكِبًا أَوْ مَاشِيًا إذَا لَمْ يَكُنْ ذَلِكَ الْمَوْضِعُ مُعَدًّا لِلنَّجَاسَةِ

-‘‘কোন কিছুতে আরোহণ করে বা পায়ে হেঁটে চলার সময় কুরআন তিলাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই, যদি ওই জায়গাটা ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য তৈরি করা না হয়।’’  ৫২৬

➥526. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৯৪


কুরআন বগলে নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করা জায়েয। কিন্তু পায়খানায় নিয়ে যাওয়া নিষেধ। আরও লক্ষ্যণীয় যে, কুরবানী ঈদের দিন নির্দেশ আছে যে, ঈদগাহে যাওয়ার সময় রাস্তায় যেন উচ্চস্বরে তকবীরে তশরীক বলা হয়। 


❏ দুর্রুল মুখতারে: صلوة العيدين অধ্যায়ে বর্ণিত আছে: 

(وَيُكَبِّرُ جَهْرًا) اتِّفَاقًا (فِي الطَّرِيقِ)

-‘‘রাস্তাতে যেন উচ্চস্বরে তকবীর বলা হয়।’’  ৫২৭

➥527. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৬


অথচ রাস্তায় ময়লা ইত্যাদি থাকে। ফকীহগণ আরও বলেন যে,  স্নানাগারে তসবীহ তাহলীল উচ্চস্বরে পাঠ করা জায়েয। অথচ ওখানে প্রায় সময় ময়লা থাকে। 


❏ ফতওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবুল কারাহিয়াতের الصلوة والتسبيح অধ্যায়ে, উমদাতুল আবরার, মরমাউল নাওয়াযেল, খানিয়া, সিরাজিয়া ইত্যাদি কিতাবে বর্ণিত আছে:

وَأَمَّا التَّسْبِيحِ وَالتَّهْلِيلِ لَا بَأْسَ بِذَلِكَ، وَإِنْ رَفَعَ صَوْتَهُ، كَذَا فِي الْفَتَاوَى الْكُبْرَى.

অর্থাৎ স্নানাগারে উচ্চস্বরেও তসবীহ তাহলীল পড়া জায়েয।’’ ৫২৮

➥528. নিযামুদ্দীন বলখী, ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩১৬।


৪নং আপত্তিঃ জানাযার আগে উচ্চস্বরে যিকরের দ্বারা ঘরের মহিলা ও শিশুরা ভয় পেয়ে যায়। কেননা এর দ্বারা ওদের মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়, যার ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং চিকিৎসাশাস্ত্র অনুসারেও তা নিষেধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।


উত্তরঃ 


❏ কুরআন করীম ইরশাদ ফরমান:

أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

অর্থাৎ আল্লাহর যিকর দ্বারা আত্মা শান্তি লাভ করে।’’ ৫২৯

➥529. সূরা রা’দ, আয়াত নং-২৮।


মুসলমানেরাতো এর থেকে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করেন। তবে হ্যাঁ, কাফিরগণ ভয় পেতে পারে। তাদের ভয় পাওয়া দরকার। তারাতো আযানকে ভয় করে। তাই বলে কি আযান নিষেধ করে দিতে হবে? আর যদি কোন বিখ্যাত চিকিৎসক লিখে থাকেন যে কলেমা তৈয়্যবার আওয়াজ মহামারীর অন্যতম কারণ, তাহলে প্রমাণ পেশ করা হোক। অবশ্য সেই ডাক্তার নিশ্চয়ই মুসলমান ও প্রসিদ্ধ হতে হবে; কোন দেওবন্দী বা হাতুড়ে ডাক্তার হলে চলবে না। কারণ মনগড়া কথার কোন মূল্য নেই। যা’হোক, প্রমাণিত হলো যে, মইয়তের আগে উচ্চস্বরে যিকর করা অনেক উত্তম এবং বরকতময়। বিরোধীতাকারীদের কাছে ভুল ধারণা ব্যতীত অন্য কোন উল্লে­খযোগ্য আপত্তি নেই।

والحمد لله على ذالك



পরিশিষ্ট


খোদার শুকর, যে সব মাসায়েল নিয়ে দেওবন্দীরা ভিন্নমত পোষণ করে, সে সবের মোটামুটি বিশ্লেষণ করা হলো। অবশ্য সে সব মাসায়েলের মধ্যে অনেক মাসায়েল এ রকমও আছে, যে গুলো ঈমানের জন্য হুমকী নয়, কেবল মুস্তাহাব বা মাকরূহ নিয়ে মাতপার্থক্য। তবে এমন অনেক মাসায়েলও রয়েছে, যার জন্য আরব আযমের প্রখ্যাত উলামায়ে কিরাম দেওবন্দীদেরকে কাফির ফত্ওয়া দিয়েছেন এবং তাদের আকীদাকে ইসলামী আকীদার বিপরীত প্রমাণ করেছেন। মুসলমানদের অবগতির জন্য আমি তাদের বাতিল আকীদার একটি তালিকা নিম্নে পেশ করলাম। পাশাপাশি সঠিক ইসলামী আকীদাও তুলে ধরলাম। তাদের এ সব আকীদা তাদের প্রকাশিত কিতাব সমূহে মওজুদ আছে। কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ কেউ এ সব বাতিল আকীদাকে সাথে সাথে খণ্ডন করে দেয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু সম্প্রদায়ে নানা কারণে এখানে তা করতে পারলাম না। ইন্শা আল্লাহ, আমি এ কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করবো; তখন ওসব আকীদার ব্যাপক বিশ্লেষণ করা হবে। তাই এখন কেবল আকীদাটা পেশ করলাম।

 
Top