৪র্থ অধ্যায়ঃ

তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার দলীলাদির বিবরণ


এ অধ্যায়কে দু’টো পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম পরিচ্ছেদে সাধারণ তাকলীদের দলীল সমূহ এবং ২য় পরিচ্ছেদে ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ সম্পর্কে দলীল উপস্থাপন করা হয়েছে।


১ম পরিচ্ছেদ

তাকলীদ যে ওয়াজিব, এটা কুরআনের আয়াত, সহীহ হাদীছ, উম্মতের কর্মপন্থা ও তাফসীরকারকদের উক্তিসমূহ থেকে প্রমাণিত। সাধারণ তাকলীদ হোক বা মুজতাহিদের তাকলীদ হোক, উভয়ের প্রমাণ মওজুদ রয়েছে। (নিম্নে ওগুলো উপস্থাপন করা হল)


আয়াত নং ১:


اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (৬) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ.(১) 


❏ “আমাদেরকে সোজা পথে পরিচালিত কর। ওনাদের পথে যাঁদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ।” 

{সূরাঃ ফাতেহা, পারাঃ ১, আয়াতঃ ৫}

     

এখানে সোজা পথ বলতে ওই পথকে বোঝানো হয়েছে, যে পথে আল্লাহর নেক বান্দাগণ চরেছেন। সমস্ত তাফসীরকারক, মুহাদ্দিছ, ফিকহবিদ ওলীউল্লাহ গাউছ কুতুব ও আবদাল হচ্ছেন আল্লাহ নেক বান্দা। তাঁরা সকলেই মুকালি­দ বা অনুসারী ছিলেন। সুতরাং, তাকলীদই হলো সোজা পথ। কোন মুহাদ্দিছ, মুফাস্সির ও ওলী লা-মাযহাবী ছিলেন না। লা-মাযহাবী হলো ঐ ব্যক্তি যে মুজতাহিদ না হয়েও কারো অনুসারী নয়। অবশ্য মুজতাহিদ হয়ে কারো অনুসরণ না করলে তাকে লা-মাযহাবী বলা যাবে না। কেননা মুজতাহিদের জন্য তাকলীদ নিষিদ্ধ।



আয়াত নং ২:


لاَيُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا اِلاَّ وَسْعَهَا.(২) 


❏ ‘‘আল্লাহ তা’আলা কারো উপর ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।’’ 

{সূরা বাক্বারা, আয়াত নংঃ ২৮৬, পারাঃ ২}


এ আয়াত থেকে বোঝা গেল, আল্লাহ তা’আলা কারো উপর সাধ্যাতীত কার্যভার চাপিয়ে দেন না। সুতরাং, যে ব্যক্তি ইজতিহাদ করতে পারে না; কুরআন থেকে মাসাইল বের করতে পারে না, তার দ্বারা তাকলীদ না করিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধান বের করতে পারে না, তার দ্বারা তাকলীদ না করিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধান বের করানো তার উপর ক্ষমতা বহির্ভূত কার্যভারব চাপানোর নামান্তর। যখন গরীবের উপর যাকাত ও হজ্জ ফরয নয়, তখন অজ্ঞ লোকের মাসাইল বের করার কোন প্রয়োজন থাকতে পারে কি?



আয়াত নং ৩:


وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ

 -(৩) 

❏ ‘‘যে সকল মুহাজির এবং আনসার অগ্রগামী-যারা প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক পথে অগ্রসর হয়েছেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে যারা সৎ উদ্দেশ্যে পূর্ববর্তীদের অনুগামী হয়েছেন, আল্লাহ তা’আলা তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও তার (আল্লাহর) প্রতি সন্তুষ্ট।’’ 

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১০০, পারাঃ ১১}


বোঝা গেল যে, যারা মুহাজির ও আনসারগণের অনুসরণ বা তাকলীদ করেন, আল্লাহ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট। এখানেও তাকলীদের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।


আয়াত নং ৪:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ  


-‘‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর, তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ প্রদানকারী রয়েছেন, তাদেরও।’’  

{আল কুরআন, সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৫, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসرضي الله تعالي عنه বলেন- 

قال على بن ابى طلحة عن ابن عباس (واولى الامر منكم) يعنى اهل الفقه الدين. 

অর্থাৎ- হযরত আলী বিন তালহা (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস  (رضي الله عنه) কুরআনের আয়াত উলিল আমরি মিনকুম এর ব্যাখ্যায় বলেন তার মর্মার্থ হলে দ্বীনের মুজতাহিদ ফকীহগণ।

১। আল্লামা ইবনে কাসীরঃ তাফসীরে ইবনে কাসীরঃ ২/২৪৫ পৃ.

২। ইমাম জারীর তবারীঃ তাফসীরে তবারীঃ ৫/১৪৯ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বৈরত।

৩। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কাবীরঃ ৪/১১৩ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরত।

অনুরুপ আরোও মতামত হুবহু যারা ব্যাখ্যা করেছে তারা হলেন হযরত হাসান বসরী, হযরত মুজাহিদ, হযরত আতা, হযরত আবুল আলিয়া, ইমাম রাজী (رحمة الله), ইবনে কাসীর, ইমাম তবারী (رحمة الله)

তথ্যসূত্রঃ

১। আল্লামা ইবনে কাসীরঃ তাফসীরে ইবনে কাসীরঃ ২/২৪৫ পৃ.

২। ইমাম জারীর তবারীঃ তাফসীরে তবারীঃ ৫/১৪৯ পৃ.

৩। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কাবীরঃ ৪/১১৩ পৃ.

৪। ইমাম দারেমী আস-সুনানঃ ১/৮৩ পৃ. হাদীসঃ ২১৯ দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।

৫। আল্লামা শাওকানীঃ তাফসীরে ফতহুল কাদীরঃ ১/৩৮০ পৃ.

অপরদিকে ইমাম যাহাক (رحمة الله) বলেন, উক্ত আয়াতের মর্মার্থ হলো যারা শরীয়তের রায় পেশ করেন এমন আলেম সম্প্রদায়।

১। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীঃ তাফসীরে কাবীরঃ ৪/১১৩ পৃ.

অপরদিকে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ  (رضي الله عنه) উক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেন-

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ: {أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ} قَالَ: ্রأُولِي الْفِقْهِ وَالْخَيْرِ

-‘‘হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ  (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আল্লাহর বাণী “তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূরের আনুগত্য কর আর (উলিল আমরি মিনকুম) ফকীহগণের আনুগত্য কর। 

১। ইমাম হাকেমঃ আল-মুস্তাদরাকঃ ১/২১১ পৃ. হাদীসঃ ৪২২, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরত।

২। ইমাম তবারীঃ তাফসীরে তবারীঃ ৫/১৪৮ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বৈরত, লেবানন।

ইমাম হাকেম নিশাপুরী ও ইমাম জালালুদ্দীন সুয়তী (رحمة الله) বলেন, ইমাম বুখারী ও মুসলিমের নিকট সাহাবীদের তাফসীর মারফু হাদীসের মত গ্রহণযোগ্য এমনকি তাবেয়ীদের তাফসীরও।

১। ইমাম হাকেম নিশাপুরীঃ আল-মুস্তাদরাকঃ ১/৭৯ পৃ. হাদীসঃ ৭৩

২। ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ুতীঃ তাদরীবুর রাবীঃ ১/১৯২-১৯৩ পৃ.}


এ আয়াতে তিনটি সত্ত্বার আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে,

(১) আল্লাহর (কুরআনের) আনুগত্য, 

(২) রসূলের (হাদীছের) আনুগত্য এবং 

(৩) আদেশ দাতাগণের (ফিকহবিদ মুজতাহিদ আলিমগণ) আনুগত্য। 


লক্ষ্যণীয় যে, উক্ত আয়াতে اَطِيْعُوا (আতীউ) শব্দটি দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে, আল্লাহর জন্য একবার এবং রসূল (ﷺ) ও আদেশ প্রদানকারীদের জন্য একবার। এর রহস্য হলো আল্লাহ যা হুকুম করবেন, শুধু তাই পালন করা হবে, তার কর্ম কিংবা নীরবতার ক্ষেত্রে আনুগত্য করা যাবে না। তিনি কাফিরদেরকে আহার দেন, কখনও কখনও তাদেরকে বাহ্যিকভাবে যুদ্ধে জয়ী করান। তারা কুফরী করলেও সাথে সাথে শাস্তি দেন না। এসব ব্যাপারে আমরা আল্লাহকে অনুসরণ করতে পারি না। কেননা এতে কাফিরদেরকে সাহায্য করা হয়। কিন্তু নবী (ﷺ) ও মুজতাহিদ ইমামের প্রত্যেকটি হুকুমে, প্রত্যেকটি কাজে, এমন কি যে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁরা নীরবতা অবলম্বন করেন, সে সমস্ত ক্ষেত্রেও তাঁদের আনুগত্য করা যায়। এ পার্থক্যের জন্য اَطِيْعُوا (আতীউ) শব্দটা দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে।


যদি কেউ বলে,اُوْلِى اْلاَمْرِ  (উলীল আমর) দ্বারা ইসলামী শাসনকর্তাকে বোঝানো হয়েছে, এতে উপরোক্ত বক্তব্যে কোনরূপ তারতম্য ঘটবে না। কেননা শুধু শরীয়তসম্মত নির্দেশাবলীতেই শাসনকর্তার আনুগত্য করা হবে, শরীয়ত বিরোধী নির্দেশাবলীর ক্ষেত্রে আনুগত্য করা হবে না। ইসলামী শাসনকর্তা হচ্ছেন কেবল হুকুম প্রয়োগকারী। তাঁকে শরীয়তের যাবতীয় আহকাম মুজতাহিদ আলিমগণের নিকট থেকে জেনে নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, আসল আদেশ প্রদানকারী হচ্ছে ফিকহবিদ। ইসলামী সুলতান ফিক্হবিদ আলিমের বর্ণিত অনুশাসন জারী করেন মাত্র। সমস্ত প্রজাদের হাকিম বাদশাহ হলেও বাদশাহের হাকিম হচ্ছেন মুজতাহিদ আলিম। শেষ পর্যন্ত اُوْلِى اْلاَمْرِ  (উলীল আমর) হলেন মুজতাহিদ আলিমগণই اُوْلِى اْلاَمْرِ  (উলীল আমর) বলতে যদি কেবল ইসলামী বাদশাহ ধরে নেয়া হয়, তাতেও তাকলীদ প্রমাণিত হয়। ‘আলিমের না হলেও অন্ততঃ বাদশাহের তাকলীদতো প্রমাণিত হয়। মনে রাখতে হবে যে, এ আয়াতে আনুগত্য বলতে শরীয়তের আনুগত্যই বোঝানো হয়েছে।

এ আয়াতে এ বিষয়ের প্রতিও পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে যে অনুশাসন তিন রকমের আছে, কতগুলো সরাসরি কুরআন থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত। যেমন অন্তঃসত্ত্বা নয়, এমন মহিলার স্বামী মারা গেলে, তাকে চার মাস দশদিন ‘ইদ্দত পালন করতে হয়। এদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ اَطِيْعُوا للهَ (আতীউল্লাহ) থেকে এ অনুশাসন গৃহীত হয়েছে। আর কতগুলো অনুশাসন সরাসরি হাদীছ থেকে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত। উদাহরণস্বরূপ, সোনারূপা নির্মিত অলংকার ব্যবহার পুরুষের জন্য হারাম। এ ধরনের অনুশাসন মেনে চলার জন্য اَطِيْعُواالرَّسُوْلَ (আতীউর রসুল) বলা হয়েছে। আর কতকগুলো অনুশাসন আছে যেগুলো স্পষ্টভাবে কুরআন বা হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় না। যেমন, স্ত্রীর সঙ্গে পায়ুকামে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারটি অকাট্যভাবে হারাম হওয়ার বিধান। এ ধরনের অনুশাসন মেনে চলার জন্য-

 اُولِى اْلاَمْرِ مِنْكُمْ (উলীল আমরে মিনকুম) বলা হয়েছে। এ তিন রকম শরীয়ত বিধির জন্য তিনটি আদেশ দেয়া হয়েছে।


আয়াত নং ৫:


فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ.(৫) 


-‘‘হে লোক সকল! তোমাদের যদি জ্ঞান না থাকে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।’’ 

{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৪৩}

     

এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, যে বিষয়ে অবহিত নয়, সে যেন সে বিষয়ে জ্ঞানীদের নিকট থেকে জেনে নেয়। যে সব গবেষণালব্ধ মাসাইল বের করার ক্ষমতা আমাদের নেই, ঐগুলো মুজতাহিদগণের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হবে। কেউ কেউ বলেন যে, এ আয়াতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী জেনে নেয়ার কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে, এর পূর্ববর্তী আয়াত থেকেও এটাই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা এ আয়াতের শব্দগুরো বিশেষিত বা শর্তযুক্ত নয়। আর না জানাটাই হলো জিজ্ঞাসা করার মূল কারণ। সুতরাং, যে বিষয়ে আমরা জানি না, সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা একান্ত প্রয়োজন।



আয়াত নং ৬:


وَاتَّبِعْ سَبِيْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَىَّ. (৬)  


-‘‘যিনি আমার দিকে (আল্লাহর দিকে) রুজু করেছেন তার পদাঙ্ক অনুসরণ কর। 

{সূরাঃ লোকমান, আয়াতঃ ১৫}

 

এ আয়াত থেকে এও জানা গেল যে আল্লাহর দিকে ধাবিত ব্যক্তিবর্গের অনুসরণ (তাকলীদ) করা আবশ্যক। এ হুকুমটাও ব্যাপক, কেননা আয়াতের মধ্যে বিশেষত্ব জ্ঞাপক কোন কিছুর উল্লে­খ নেই।



আয়াত নং ৭:


وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا (৭)


-‘‘এবং তাঁরা আরয করেন,হে আমাদের প্রভু! আমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের দ্বারা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দাও এবং আমাদেরকে পরহেযগারদের ইমাম বানিয়ে দাও। 

{সূরাঃ ফুরকান, আয়াতঃ ৭৪, পারাঃ ২৯}


❏ ‘তাফসীরে মাআলিমুত তানযীলে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


فَنَقْتَدِىْ بِالْمُتَّقِيْنَ وَيَقْتَدِى بِنَا الْمُتَّقُوْنَ.


-‘‘যাতে আমরা পরহেযগারদের অনুসরণ করতে পারি, আর পরহেযগারগণও আমাদের অনুসরণ করার সুযোগ লাভ করতে পারেন।’’ 

{ইমাম বগভীঃ তাফসীরে মাআলিমুত তানযীলঃ ৩/৩৭৯ পৃ.}

     

❏ এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহ ওয়ালাদের অনুসরণ বা তাকলীদ করা একান্ত আবশ্যক.


فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ


-‘‘সুতরাং এমন কেন করা হয় না যে তাদের প্রত্যেক গোত্র হতে একটি দল ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষণের জন্য বের হয়ে পড়তো এবং ফিরে এসে নিজ গোত্রকে ভীতি প্রদর্শন করতো। যাতে গোত্রের অন্যান্য লোকগণ মন্দ, পাপ কার্যাবলী থেকে দূরে সরে থাকতে পারে।’’ 

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১২২, পারাঃ ১১}

     

এ আয়াত থেকে বোঝা গেল প্রত্যেকের মুজতাহিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ ফিকহবিদ হবেন, অন্যরা কথায় ও কর্মে তাঁদের অনুসরণ করবে।


আয়াত নং ৯:


وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ (৯) 


-‘‘এবং যদি এ ক্ষেত্রে তারা রাসূল (ﷺ) ও আদেশদানকারী যোগ্য ব্যক্তিদের প্রতি রুজু করতো তাহলে নিশ্চয় তাদের মাঝে যারা সমস্যার সমাধান বের করার যোগ্যতা রাখেন, তাঁরা এর গুঢ়তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারতেন।’’ 

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৮৩, পারাঃ ৫}


এ আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল যে, হাদীছ, ঘটনাবলীর খবর ও কুরআনের আয়াত সমূহকে প্রথমে মুজতাহিদ আলিমদের আছে পেশ করতে হবে। এরপর তাঁরা যে রকম বলবেন, সেভাবে আমল করতে হবে। শ্রুত খবর থেকে কুরআন-হাদীছের স্থান অনেক উর্ধে। সুতরাং উহাকে মুজতাহিদের কাছে পেশ করা দরকার।



আয়াত নং ১০:


يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ (১০) 


-‘‘যে দিন আমি প্রত্যেক দলকে নিজ নিজ ইমাম সহকারে ডাকবো...।’’  ‘

{সূরাঃ বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ৭১, পারাঃ ১৫}

  

❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


اَوْمُقَدَّمٍ فِى الدِّيْنِ فَيْقَالْ يَا حَنْفِىُّ يَاشَافِعِىُّ


অর্থাৎ- কিংবা ইমাম হচ্ছে ধর্মীয় পথের দিশারী, তাই কিয়ামতের দিন লোকদিগকে ‘হে হানাফী’ হে শাফেঈ! বলে আহবান করা হবে।"

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্বীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ৫/২২১।}

     

এ থেকে বোঝা গেল, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ইমামের সাথে ডাকা হবে। ডাকা হবে হে হানাফী মতাবলম্বীগণ! হে মালিকী মাযহাবের অনুসারীগণ! চলো। এখন প্রশ্ন হলো, যে ইমাম মানেনি, তাকে কার সাথে ডাকা হবে? 


❏ তাফসীরে রুহুল বায়ান- ৫/২৬৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, সূফীয়ানে কিরাম (رحمة الله) বলেন যে, যার ইমাম নেই, তার ইমাম হলো শয়তান।



আয়াত নং ১১:


وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ.(১১) 


-‘‘এবং যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা ঈমান আন, যেরূপ সত্যিকার বিশুদ্ধ চিত্ত মু’মিনগণ ঈমান এনেছেন। তখন তারা বলে, আমরা কি বোকা ও বেওকুফ লোকদের মত বিশ্বাস স্থাপন করব? "

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ১৩, পারাঃ ১}


বোঝা গেল যে, ঐ ধরনের ঈমানই গ্রহণযোগ্য, যে ঈমান নেক বান্দাগণ পোষন করেন। অনুরূপ, মাযহাব ওটাই, যেটার অনুসারী হচ্ছেন নেক বান্দাগণ। উহাই হলো তাকলীদ।


তাফসীরকারক ও মুহাদ্দিছগণের অভিমত


❏ প্রখ্যাত হাদীছ গ্রন্থ ‘দারমী’র الاقتداء بالعلماء (আল ইকতিদাউ বিল উলামা) অধ্যায়ে আছেঃ


أَخْبَرَنَا يَعْلَى، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْمَلِكِ، عَنْ عَطَاءٍ: {أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ} [النساء: ৫৯] قَالَ: " أُولُو الْعِلْمِ وَالْفِقْهِ،


-‘‘আমাদেরকে ইয়া’লা বলেছেন। তিনি বলেন, আমাকে আবদুল মালিক (رحمة الله) বলেছেন, আবদুল মালিক তাবেয়ী আতা (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূল (ﷺ) ও তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ দাতা আছেন, তাদের আনুগত্য কর।’ 


❏ ‘আতা’ r বলেছেন এখানে জ্ঞানী ও ফিকহবিদগণকে আদেশ প্রদানের অধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।’’ 

{দারেমীঃ আস-সুনানঃ ইকতিদাউল উলামাঃ ১/৮৩ হাদীসঃ ২১৯}

     

❏ তাফসীরে খাযিনে,


فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ   


-‘‘যদি তোমরা না জান, জ্ঞানীদের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করো।’’  

{সূরাঃ নাহল, আয়াতঃ ৪৩}


❏ আয়াতটির ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ


 فَاسْئَلُوا الْمُؤْمِنِيْنَ الْعَلَمِيْنَ مِنْ اَهْلِ الْقُرْاَنِ 


-‘‘তোমরা ঐ সকল মুমিনদের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা কর, যারা কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী।’’ 

(ইমাম খাযিনঃ তাফসীরে খাযিনঃ ৩/৭৮পৃঃ}


❏ তাফসীরে দুররে মানসুরে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


اَخْرَجَ اِبْنُ مَرْدَوَيْهِ عَنْ اَنَسٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ يَقُوْلُ اِنَّ الرَّجُلَ يُصَلِّىْ وَيَصُوْمُ وَيَخِجُّ وَيَغْزُوْ وَاِنَّهُ لَمُنَا فِقٌُ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ بِمَاذَا دَخَلَ عَلَيْهِ النِّفَاقُ قاَلَ لِطَعْنِهِ عَلَى اِمَا مِهِ وَاِمَامُهُ مَنْ قَالَ قاَلَ اللهُ فِى كِتَابِهِ فَاْسْئَلَوْا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَاتَعْلَمُوْنَ.


-‘‘ইবনে মারদাওয়াই হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেছেন, আমি হুযুর (ﷺ) কে বলতে শুনিছি যে, কতেক লোক নামায পড়ে, রোযা রাখে, হজ্ব ও জিহাদ করে; অথচ তারা মুনাফিক গণ্য হয়। আরয করা হলঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ), কি কারণে তাদের মধ্যে নিফাক (মুনাফিকী) এসে গেল? প্রত্যুত্তরে নবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমালেন, নিজ ইমামের বিরূপ সমালোচনা করার কারণে। ইমাম কে? এ কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ ফরমান, আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, 


فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ   


আয়াতে উল্লেখিত আহলে যিক্রকে ইমাম বলা হয়।’’ 

{ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তীঃ তাফসীরে দুররে মানসূরঃ ৫/১৩৩ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}

     


❏ তাফসীরে সাবীতে ‘সুরা কাহাফের’  

{সূরাঃ কাহাফ, আয়াতঃ ২৪, পারাঃ ১৫}     

وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ


আয়াত এর ব্যাখ্যায় লিপিবদ্ধ আছে,


وَلاَ يَجُوْزُ تَقْلِيْدُ مَاعَدَا الَمَذَاهِبِ اَلاَرْبَعَةِ وَلَوْوَافَقَ قَوْلَ الصَّحَابَةِ والَحَدِيْثِ الصَّحِيْحِ وَاْلاَيَةِ فَالْخَاِرجْ عَنِ اْلمَذَاهِبِ الْاَ رْبَعَةِ ضَالُّ مُضِلُّ وَرُبَمَا اَدَّاهُ ذَالِكَ اِلَىَ الْكُفْرِ لِاَنَّ اْلاَ خْذَ بِظَوَاهِرِ الْكِتَاِب َوالسُّنَّةِ مِنْ اُصُوْلِ الْكُفْرِ  ط


-‘‘চার মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের তাকলীদ বা অনুসরণ জায়েয নয় যদিও সে মাযহাব সাহাবীদের উক্তি, সহীহ হাদীছ ও কুরআনের আয়াতের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ হয়। যে এ চার মাযহাবের কোন একটির অনুসারী নয়, সে পথভ্রষ্ট এবং পথভ্রষ্টকারী। কেননা হাদীছ ও কুরআনের কেবল বাহ্যিক অর্থ গ্রহণই হলো কুফরীর মূল।’’ 

{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ ৪/১৫ পৃ.}



সংশি­ষ্ট হাদীছ সমূহঃ


▪ মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডে ৫৪ পৃষ্ঠায় اِنَّ الدِّيْنَ نَّصِيْحَةُ এর বর্ণনা অধ্যায় আছে,


-‘‘তামীম দারী থেকে বর্ণিত, হুযুর (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, ‘ধর্ম হলো কল্যাণ কামনা। আমরা (উপস্থিত সাহাবীগণ) আরয করলাম, কার কল্যাণ কামনা? তিনি ফরমালেন, আল্লাহর, তার কিতাবের, তার রসূল (ﷺ) এর, মুসলমানদের মুজতাহিদ ইমামগণের এবং সাধারণ মুসলনাদের।’’  

{ক) মুসলিমঃ আস-সহীহঃ কিতাবুল ঈমানঃ ১/৫৪ পৃ. হাদীসঃ ৫৫

খ) বুখারীঃ আস-সহীহঃ ১/২২ পৃ. কাদীমী কুতুবখানা, করাচী।

গ) ইমাম তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ হাদীসঃ ১৯২৬

ঘ) নাসায়ীঃ সুনানে কোবরাঃ ৭/১৫৯পৃ.

ঙ) ইমাম আহমদ বিন হাম্বলঃ আল-মুসনাদঃ ২/২৯৭ পৃ.

চ) দারেমীঃ আস-সুনানঃ ২/৩১১ পৃ.

ছ) ইমাম সাখাভী  মাকাসিদুল হাসানাঃ ২৫৭ পৃ. হাদীসঃ ৪৯৮}

     

▪ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘নববীতে’ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


وَقَدْ يَتَنَاوَلُ ذَلِكَ عَلَى الْاَئِمَّةِ اَلَّذِيْنَ هُمْ عُلَمَآءُ الدِّيْنِ وَاِنَّ مِنْ نَصِيْحَتِهِمْ قَبُوْلَ مَارَوَ وَهُ وَتَقْلِيْدَهُمْ فِى اَلاَحْكَامِ وَاِحْسَانَ الظَّنِّ بِهِمْ.


-‘‘এ হাদীছ ‘উলামায়ে দ্বীন’কেও ইমামদের অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। ‘উলামায়ে দ্বীন এর কল্যাণ কামনার অর্থ হচ্ছে তাদের বর্ণিত হাদীছসমূহ (তথা তাকলিদ) গ্রহণ করা, শরীয়ত বিধিতে তাঁদেরকে অনুসরণ করা এবং তাদের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করা।’’ 

{ইমাম নববীঃ আল মিনহাজ্ব শরহে মুসলিমঃ ২/৩৯ পৃ.}

 
Top