দ্বিতীয় অধ্যায়

(‘হাযির-নাযির’ সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের বিবরণ)



১ নং আপত্তিঃ 

প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ হওয়া খোদার একটি গুণ।


❏ কুরআনে উক্ত হয়েছেঃ


 عَلَى كُلِّ شَيْئٍ شَهِيْدً 


অর্থাৎ- তিনিই প্রত্যেক কিছুর সাক্ষী।  

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৩৩, পারাঃ ৫}

  

❏ অন্যত্র বলা হয়েছেঃ 

 بِكُلِّ شَيْئٍ مُحِيْطُ


অর্থাৎ- তিনিই প্রত্যেক কিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছেন।  

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১২৬, পারাঃ ৫}

  

এমতাবস্থায় খোদা ছাড়া অন্য কারো মধ্যে এগুণ স্বীকার করা খোদার গুণে অপরকে শরীক করা হয় বৈকি।

উত্তরঃ প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ হওয়া আদৌ খোদা তা’আলার গুণ নয়। আল্লাহ তা’আলা স্থানের সীমাবদ্ধতার গন্ডি থেকে মুক্ত। 


❏ আকায়েদের কিতাবসমূহের উলে­খিত আছেঃ


لاَيَجْرِيْ عَلَيْهِ زَمَانَّ وَّلاَيَشْتَمِلُ عَلَيْهِ مَكَانٌُ


-‘‘আল্লাহর উপর কালের কোন প্রভাব নেই। কেননা, কালের প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে, নিম্নজগতের শরীরী জীব ও বস্তুর উপর। এদেরই বয়স বা কাল নিরূপিত হয়। আর চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, হুর ও গিলমান, ফিরিশতা এমনিক, আসমানের উপর অবস্থানকারী হযরত ঈসা (عليه السلام) এবং মি’রাজের সময় হুজুর (ﷺ) কালের প্রভাব থেকে মুক্ত। অনুরূপ, কোন স্থানও খোদা তা’আলাকে পরিবেষ্টন করে না। তাই আল্লাহ তা’আলা ‘হাযির’ কিন্তু স্থানের গন্ডীর বাইরে। 


❏ এজন্য কুরআনে উলে­খিতঃ


 ثُمَّ اسْتَوَي عَلَى الْعَرْشِ 


(অতঃপর আল্লাহ আরশের উপর অধিষ্ঠিত হন)  

{সূরাঃ রা’দ, আয়াতঃ ২, পারাঃ ১৩}

  

আয়াতটিকে ‘আয়াতে মুতাশাবিহাত’ বা অবোধগম্য আয়াতসমূহের অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। আর بِكُلِّ شَيْئٍ مُحِيْطٌُ অর্থাৎ- তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।  ইত্যাদি আয়াতের তাফসীরে সর্বজনমান্য মুফাস্সিরগণ বলেন- عِلْمًا وَّقُدْرَةً

অর্থাৎ, খোদার জ্ঞান ও শক্তির দিক থেকেই সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন। 

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ১২৬, পারাঃ ৫}


❏ কবির ভাষায়ঃ


وهي لامكان كے مكين هوے سرعرش تخت نشين هوے

وه نبى هيں جنكے بيں يه مكان وه خدا هے جس كامكان نهيں


[প্রিয় নবী (ﷺ)ই ‘লামকানে’ অবস্থান গ্রহণকারী ছিলেন, আরশের শীর্ষে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে প্রিয় নবীর নির্ধারিত স্থান বা ‘মকানে’। খোদা তো কোন স্থানের গন্ডীতে আবদ্ধ নন।]


খোদাকে প্রত্যেক জায়গায় স্বীকার করা ধর্মহীনতা। প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যমান হওয়া খোদার রাসূলেই বৈশিষ্ট্য। আর প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার গুণকে খোদার জন্য স্বীকার করা হলেও হুজুর (ﷺ) এর ক্ষেত্রে এ গুণকে অস্বীকার করা যায় না। বরং বলা চলে, হুজুর (ﷺ) এর গুণ খোদা প্রদত্ত, অচিরন্তন, সৃষ্ট ও খোদা তা’আলার নিয়ন্ত্রণাধীন। আর, খোদার ক্ষেত্রে এ গুণটি সত্ত্বাগত, চিরন্তন, কারো দ্বারা সৃষ্ট বা কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। এত সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ‘শির্ক’ হয় কিরূপে? জীবন, শ্রবণ, দর্শন প্রভৃতি গুণাবলী সমূহ নিজের জন্য স্বীকার করলে যেমন ‘শিরক’ হয় না, তেমনি ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার গুণকেও হুজুর (ﷺ) এর জন্য স্বীকার করলে ‘শির্ক’ হতে পারে না। 


❏ ফত্ওয়ায়ে রশীদিয়া’ প্রথম খন্ডের আল-বিদআত শীর্ষক আলোচনার ৯১ পৃষ্ঠায় উলে­খিত আছেঃ


فخر دو عالم عليه السلام كو مولود ميں حاضر جا ننا بهى غير

ثابت هےاگر باعلام الله تعالي جانتاهے تو شرك نهيں ورنه شرك هے


অর্থাৎ- সরকার দোআলম আলাইহিস সালামকে মওলুদ শরীফে ‘হাযির’ জানার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত নয় বটে, তবে খোদা প্রদত্ত শক্তির বদৌলতে তাঁকে হাযির জ্ঞান করলে ‘শির্ক’ নয়, এর অন্যথা হলে ‘শির্ক’। 


একথাটুকু ‘বারাহীনে কাতেয়া’ গ্রন্থের ২৩ পৃষ্ঠায়ও উলে­খিত আছে। মওলবী রশীদ আহমদ সাহেবতো এ কথাটুকু রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন যে, খোদা ছাড়া অপর কাউকে খোদা প্রদত্ত শক্তির বদৌলতে ‘হাযির-নাযির’ জানা ‘শির্ক’ নয়। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, একথা থেকে অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতীয়মান হয় যে, ‘ওয়াজিবুল ওযুদ’ (যার অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয়) ও ‘চিরন্তন’ হওয়ার বিশেষ গুণাবলীও পয়গাম্বরদের জন্য খোদা প্রদত্ত গুণাবলীরূপে স্বীকার করা যাবে এবং সে দিক দিয়ে হুজুর (ﷺ)কেও স্রষ্টা, ‘ওয়াজিবুল ওযুদ’ (যার অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয়) এ ‘চিরন্তন’ বলা যাবে। এ প্রশ্নের উত্তর উত্তর হচ্ছে, খোদা তা’আলার চারটি বিশেষ গুণ অন্য কাউকে দান করা হয় না। কারণ, সেগুলোর উপরই ‘একমাত্র উপাস্য হওয়ার বিষয়টি নির্ভরশীল। এগুলো ছাড়া খোদার অন্যান্য গুণাবলী সৃষ্টজীবের মধ্যে বিকশিত হতে পারে, যেমন শ্রবণ, দর্শন, জীবন ইত্যাদি। তবে খোদার গুণাবলীর সাথে সৃষ্টজীবের এসব গুণের যথেষ্ট প্রভেদ লক্ষ্যণীয়। মহা প্রভু আল্লাহ তা’আলার সে সব গুণ হবে সত্ত্বা্গত, অত্যাবশ্যকীয় ও অবিনশ্বর; আর মাখলুকের ওসব গুণ হবে খোদা প্রদত্ত, সম্ভবপর ও নশ্বর। 


❏ কবির ভাষায়ঃ


جوهوتى خدائ بهى دينے كى قابل

خدابن كے آتاوه بنده خدا كا


 -‘খোদা হওয়ার যোগ্যতা যদি কাউকে দান করা হতো, তাহলে খোদার বান্দাই খোদা হয়ে আবির্ভুত হত।’



২নং আপত্তিঃ 


❏ কুরআনুল করীম ইরশাদ করছেঃ


وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلَامَهُمْ


-‘‘আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন তাঁরা নিজেদের কলম পানিতে ফেলছিলেন।’’  

(সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ৪৪, পারাঃ ৩}

  

হযরত মরিয়ামকে পাওয়ার জন্য পানিতে কলম নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত স্থিরীকৃত হয়েছিল। 


❏ সে প্রসঙ্গে উক্ত হয়েছে


وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ


-‘‘আপনি তাঁদের কাছে ছিলেন না, যখন তাঁরা তাদের নিজেদের ব্যাপারটি মীমাংসা করার ক্ষেত্রে মতৈক্য পৌঁছেছিলেন।’’  

{সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ১০২, পারাঃ ১৩}

  

❏ এ ধরনের আরো আয়াত রয়েছে। যেমনঃ


وَمَا كُنْتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَى مُوسَى


-‘‘আপনি সে উন্মুক্ত প্রান্তরের পশ্চিম প্রান্তে ছিলেন না, যখন আমি হযরত মুসা (عليه السلام) এর নিকট আমার নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম।’’ 

{সূরাঃ কাসাস, আয়াতঃ ৪৪, পারাঃ ২০}

  

وَمَا كُنْتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا


-‘‘আপনি তুর পাহাড়ের পাশের্ব ছিলেন না, যখন আমি হযরত মুসা (عليه السلام) কে সম্বোধন করছিলাম।’’ 

{সূরাঃ কাসাস, আয়াতঃ ৪৬ঃ পারা ২০}


এসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, বিগত যুগে উলে­খিত ঘটনাবলী ঘটার সময় হুজুর (ﷺ) ঘটনাস্থলে বিদ্যমান ছিলেন না। তাই পরিষ্কাররূপে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ নন।


উত্তরঃ 

‘হাযির-নাযির’ এর মানে কি, সে সম্পর্কে অঙ্গতার কারণে এ আপত্তিটি উত্থাপন করা হয়েছে। আমি আগেই আরয করেছি যে, ‘হাযির-নাযির’ এর তিন ধররেন অর্থ আছেঃ 


এক, এক জায়গায় অবস্থান করে সমগ্র জগত দেখা; 

দুই, এক মুহুর্তের মধ্যে সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করা; 

তিন, একই সময়ে কয়েক জায়গায় দৃশ্যমান হওয়া। 


উলে­খিত আয়াত সমূহে বলা হয়েছে, তিনি এ পার্থিব শরীর নিয়ে ঘটনাস্থলে বিদ্যমান ছিলেন না। একথা কোথায় বলা হয়েছে যে, তিনি ঐ সমস্ত ঘটনাবলী অবলোকন করেন নি? স্বশরীরে তথায় উপস্থিত না থাকা এক কথা এবং তাঁর সে সব ঘটনা অবলোকন করা ভিন্ন কথা। এবং উপরোক্ত আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে, হে মাহবুব আলাইহিস সালাম, আপনি তথায় স্বশরীরে বিদ্যমান ছিলেন না। তবে সে সব ঘটনা সম্পর্কে আপনি অবহিত ও অবলোকনও করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, তিনি (ﷺ) সত্য নবী। উক্ত আয়াতগুলো বরং হুজুর (ﷺ) এর ‘হাযির-নাযির’ হওয়ার বিষয়টি সপ্রমাণ করছে।


❏ সুপ্রসিদ্ধ ‘তাফসীরে সা’বীতে وَمَا كُنْتَ بِجَانِبِ الطُّوْر الاية এর তাফসীরে উলে­খিত আছেঃ


وَهَذَا بِالْنَّظَرِ اِلَى الْعَالَمِ الْجِسْمَانِيِّ لاَقَامَةِ الْحُجَّةِ عَلَي الْخَصْمِ وَاَمَّا بِالنَّظَرِ اِلىَ الْعَالَمِ الرُّوْحَنِيِّ فَهُوَ حَاضِرٌُ رِسَالَةَ كُلِّ رَسُوْلٍ وَمَاَ وَقَعَ مِنْ لَّدُنِ ادَمَ اِلَى اَنْ ظَهَرَ بِجِسْمِهِ الشَّرِيْفِ (سوره قصصى تفسير صاوي)


-‘‘এখানে যে বলা হয়েছে, আপনি হযরত মুসা (عليه السلام) এর সে ঘটনাস্থলে ছিলেন না, তা শারীরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে। রূহানীভাবে তো হুজুর (ﷺ) প্রত্যেক রাসূলের রিসালাত ও হযরত আদম (عليه السلام) এর আদি সৃষ্টি থেকে শুরু করে তাঁর স্বশরীরে আবির্ভূত হওয়ার সময় পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সমস্ত ব্যাপারে মওজুদ ছিলেন।’’ 

{ইমাম সাভীঃ তাফসীরে সাভীঃ সূরাঃ কাসাস}

  

❏হিজরতের দিন হুজুর (ﷺ) সত্যের প্রতীক হযরত সিদ্দীক আকবর  (رضي الله عنه) কে নিয়ে ছওর নামক গুহায় অবস্থান করছিলেন। এদিকে মক্কার কাফিরগণ উক্ত গুহার মুখে এসেই উপস্থিত। হযরত সিদ্দীক  (رضي الله عنه) অবস্থা দৃষ্টে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এসময় হুজুর (ﷺ) ইরশাদ করেন لاَتَحْزَنْ اِنَّ اللهَ مَعَنَا (চিন্তা কর না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।) 

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৪০, পারাঃ ১০}


এখানে কি এ আয়াতের লক্ষ্যার্থ এ যে, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন, কিন্তু কাফিরদের সাথে নেই? যদি তাই হয়, তাহলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ প্রত্যেক জায়গায় মওজুদ নেই। কাফিরগণও তো এ জগতেই ছিল।


❏অনুরূপ উহুদ যুদ্ধের পর কাফিরদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ﷺ) বলেছিলেন اللهُ مَوْلَنَا وَلاَمَوْلَى لَكُمْ (আল্লাহ আমাদের মওলা, তোমাদের মওলা কেউ নেই।)  

{বুখারীঃ আস-সহীহঃ কিতাবুল মাগাজীঃ ২/৫৭৯ পৃ.}


একথা থেকে বোঝা গেল যে, খোদার রাজত্ব ও নিয়ন্ত্রণ কেবল মাত্র মুসলমানদের উপরই আছে, কাফেরদের উপর নেই। ‘মওলা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কার্যনির্বাহক। উক্ত কালামের অন্তর্গত বাক্য দু’টির অর্থের সমন্বয় সাধন করলে প্রথমোক্ত বাক্যের ভাবার্থ দাঁড়ায়ঃ আল্লাহ তা’আলা দয়া ও রহমত সহকারে আমাদের সাথে আছেন, আর কহর ও গযব সহকারে আছেন কাফিরদের সাথে। দ্বিতীয় বাক্যটির সারমর্ম হলো, আমাদের মওলা আছেন সাহায্যকারীরূপে, হে কাফিরগণ, তোমাদেরও মওলা আছেন বটে, তবে তোমাদের সাহায্যকারী হিসেবে নন। অনুরূপভাবে ওসব আয়াতের ক্ষেত্রেও বলা হবে যে, রাসূল (ﷺ) বাহ্যিকভাবে স্বশরীরে সে সময় তাদের কাছে উপস্থিত ছিলেন না।



৩নং আপত্তিঃ 


❏ কুরআনুল করীম ইরশাদ করছেঃ


وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ


-‘‘মদীনাবাসীদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, ‘নিফাক’ বা কপটতা যাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। আপনি তাদেরকে চিনেন না, আমি তাদেরকে চিনি।’’  

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১০১, পারাঃ ১১}

  

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, হুজুর (ﷺ) প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির’ নন। তাই যদি হতেন, মুনাফিকদের অন্তর্নিহিত গোপনীয় অবস্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত হতেন; অথচ তিনি ছিলেন তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একেবারে অনবহিত।


উত্তরঃ 


এর বিস্তারিত উত্তর ‘ইলমে গায়ব’ শীর্ষক আলোচনার সে একই আয়াতের প্রেক্ষাপটে প্রদান করেছি।



৪নং আপত্তিঃ 


❏ সুপ্রসিদ্ধ বুখারী শরীফের ‘কিতাবুত তাফসীরে’ উলে­খিত আছে, হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম  (رضي الله عنه) কুখ্যাত মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবন উবাই এর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন যে, সে জনগণকে বলে যেঃ


لاَ تُنْفِقُوْا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ 


-‘‘মুসলমানদেরকে কোনরূপ আর্থিক সাহায্য সহায়তা করবেন না।’’  

{সূরাঃ মুনাফিকুন, আয়াতঃ ৭, পারাঃ ২৮}

  

সে হুজুর (ﷺ) এর মহান দরবারে এসে মিথ্যা শপথ করে বলেছিলো, ‘আমি এরূপ উক্তি করিনি।’ এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে হুজুর (ﷺ) তাঁকে সত্যবাদী সাব্যস্ত করলেন, আর আমাকে গণ্য করলেন মিথ্যুকরূপে।

{বুখারীঃ কিতাবুত্-তাফসীরঃ ৪/১৮৫৯ হাদিসঃ ৪৬১৭}


যদি হুজুর (ﷺ) প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ হয়ে থাকেন, তাহলে ইবনে উবাইকে সত্যবাদী ধরে নিলেন কিরূপে? যখন কুরআনের এ আয়াতটি (যা’ হাদীছে উলে­খিত আছে) অবতীর্ণ হল, তখনই হযরত যায়দ ইবন আরকাম  (رضي الله عنه) সত্যবাদীরূপে গণ্য হলেন।



উত্তরঃ 


❏আবদুল্লাহ ইবন উবাইকে সত্যবাদী সাব্যস্ত করার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ এ কথা প্রমাণিত হয় না যে রাসূল (ﷺ) প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত। কোন বিষয়ে ফয়সালা করার শরীয়ত নির্ধারিত রীতি হচ্ছে, বাদী তার দাবীর স্বপক্ষে সাক্ষী উপস্থাপন করবে। অন্যথায় বিবাদী শপথ করে মুকাদ্দমায় জিতে যাবে। বিচারক যে কোন মুকাদ্দামায় বাদী পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণ বা বিবাদীর শপথের উপর ভিত্তি করেই বিচারের রায় ঘোষণা করেন, তাঁর ভ্যক্তিগতভাবে জ্ঞাত তথ্যের আলোকে নয়। এখানে হযরত যায়েদ ইব্ন আরকাম  (رضي الله عنه) ছিলেন বাদী যার দাবী ছিল ইবনে উবাই অবমাননাকর উক্তি করেছে। আর ইবনে উবাই ছিল উক্ত অভিযোগ অস্বীকারকারী বিবাদী। যেহেতু হযরত যায়েদ  (رضي الله عنه) এর পক্ষে কোন সাক্ষী দিল না, সেহেতু আবদুল্লাহ ইবন উবাই এর শপথের ভিত্তিতেই রায় ঘোষিত হয়েছিল। এরপর যখন কুরআন করীম যায়েদ  (رضي الله عنه) এর পক্ষে সাক্ষ্য দিল তখনই সেই সাক্ষ্যের ফলশ্রুতিতে তাঁকে সত্যবাদীরূপে গণ্য করা হয়। কিয়ামতের মাঠেও পূর্ববর্তী যুগের কাফিরগণ তাদের নবীগণের ধর্মপ্রচারের কথা অস্বীকার করবে। আর নবীগণ নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করেছেন বলে দাবী করবেন। আল্লাহ তা’আলা তাদের দাবীর ব্যাপারে উম্মতে মুস্তাফার সাক্ষ্য গ্রহণ করে তাঁদেরকে সত্যবাদীরূপে গণ্য করবেন। অনুরূপ, কাফিরগণ আরয করবেঃ


 واللهِ رَبِّنَا مَاكُنَّا مُشْرِكِيْنَ


‘‘আল্লাহর শপথ, আমরা মুশরিক ছিলাম না।’’  

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ২৩, পারাঃ ৭}

  

তখন তাদের আমলনামা, ফিরিশতাগণের উক্তি এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সাক্ষ্য গ্রহণ পূর্বক তাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হবে। তা’হলে কি আল্লাহরও প্রকৃত অবস্থা জানা ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। তবে, সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করার কারণ হচ্ছে নির্ধারিত নিয়মেরই অনুসরণ মাত্র। আর উপরোক্ত হাদীছে ব্যবহৃত শব্দ كَذَّبِنِيْ এর লক্ষ্যার্থ হচ্ছে, ‘আমার বক্তব্য গ্রহণ করেন নি।’ এ অর্থ নয় যে, ‘আমাকে মিথ্যুক গণ্য করেছেন।’ কেননা, মিথ্যুক শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য হয়। আর সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম হচ্ছেন, ‘আদেল’ বা ন্যায়পরায়ণ এবং কোন মুসলমানকে বিনা প্রমাণে ‘ফাসিক’ বলা যায় না। দেওবন্দীগণ এখানে এ আপত্তি উত্থাপন করেন যে, তাহলে নবী (আলাইহিস সালাম) অপবিত্র স্থানসমূহেও ও নরকেও ‘হাযির’ পোষণ আদবের বরখেলাপ নয় কি? এর উত্তর হচ্ছে, হুজুর (ﷺ) এর প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির’ হওয়ার ব্যাপারটি হলো প্রত্যেক জায়গায় সূর্যের কিরণ, দৃষ্টির আলো বা ফিরিশতাগণের বিদ্যমানতার মত, স্থানের নোংরা পরিবেশ ও অপবিত্রতার প্রভাবমুক্ত। বলুন তো আপনারা ওসব জায়গায় মহাপ্রভু আল্লাহকে ‘হাযির’ জ্ঞান করেন কিনা, এরূপ জ্ঞান করা আদব এর খেলাফ কি না? সূর্যের আলো যদি পবিত্র স্থান সমূহে পতিত হলে অপবিত্র না হয়, তাহলে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফার (ﷺ) মৌলসত্ত্বা, যাকে আল্লাহ তা’আলা ‘নূর’ বলে অভিহিত করেছেন, তাঁর উপর কেন অপবিত্রতার হুকুম বর্তাবে?



৫নং আপত্তিঃ 


❏ তিরমিযী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মসউদ  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছেন


لَا يُبَلِّغُنِي أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ مِنْ أَصْحَابِي شَيْئًا؛ فَإِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَخْرُجَ إِلَيْهِمْ وَأَنَا سَلِيمُ الصَّدْرِ


-‘‘কেউ যেন আমাকে আমার সাহাবীদের কারো সম্পর্কে আমার অন্তরে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করতে পারে এরূপ খবর না দেয়। আমি চাই, কারো সম্পর্কে কোনরূপ বিরূপ ধারণা অন্তরে না নিয়েই স্বচ্ছ মন নিয়ে আপনাদের নিকট আসি।’’ 

{ইমাম তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ ৫/৭১০পৃ. হাদিসঃ ৩৮৯৬, এ হাদিসটিকে আহলে হাদিস আলবানী পর্যন্ত দ্বঈফ বলেছেন। তাই এ ধরনের হাদিস দ্বারা কখনই দলিল দেয়া চলে না।}


যদি হুজুর (ﷺ) প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির’ হতেন, তাহলে তাঁকে কোন কিছুর খবর দেয়ার প্রয়োজনীয়তাই বা রইল কোথায়? তিনিতো এমনিতেই সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।



উত্তরঃ 


আম্বিয়ায়ে কিরামের অন্তর দৃষ্টিলবব্ধ আধ্যাত্মিক জ্ঞান ভান্ডারে সমস্ত বিষয়ের খবর আছে। তবে প্রতিটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা নিষ্প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে ইলমে গায়ব এর আলোচনায় হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবের  (رضي الله عنه) উদ্ধৃতি পেশ করেছি। উক্ত হাদীছের ভাবার্থ একদম পরিষ্কার। হাদীছে বলা হয়েছে, লোকের কথার প্রতি আমার মনযোগ আকর্ষণপূর্বক কারো প্রতি আমাকে যেন অসন্তুষ্ট করে তোলা না হয়। এক জায়গায় ইরশাদ করেছেন ذَرُوْنِىْ مَاتَرَكْتُمْ

অর্থাৎ যতক্ষণ আমি আপনাদেরকে ছেড়ে দিয়ে থাকি, ততক্ষণ আপনারাও আমাকে ছেড়ে দিবেন। যতক্ষণ আমি কারো সম্পর্কে কিছু না বলি, আপনারাও কারো সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবেন না।



৬নং আপত্তিঃ 


❏ সুপ্রসিদ্ধ হাদীছ গ্রন্থ ‘সুনানে বায়হাকী’ তে আছে -


مَنْ صَلَّى عَلَيَّ عِنْدَ قَبْرِي سَمِعْتُهُ وَمَنْ صَلَّى عَلَيَّ نَائِيًا أُبْلِغْتُهُ


-‘‘যে ব্যক্তি আমার কবর শরীফের পাশের্ব দরূদ পাঠ করে, তার দরূদ আমি নিজেই শুনি। আর যে দূরে থেকেই দরূদ পাঠ করে, তার দরূদ আমার কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।’’ 

{ক. বায়হাকীঃ শু’আয়াবুল ঈমানঃ ২/২১৮ হাদিসঃ ১৫৮৩

খ. বায়হাকীঃ সুনানে কোবরাঃ ১/৪৪ হাদিসঃ ১৯৯

গ. ইবনে হাজার আসকালানীঃ ফতলুল বারীঃ ৬/৪৮৮ পৃ.

ঘ. খতিব তিবরিযী, মিশকাত, ১/২৯৫পৃ. হাদিসঃ ৯৩৪}


এ থেকে জানা গেল যে, দূরের আওয়াজ রাসূল (ﷺ) শুনতে পান না। অন্যথায় দরূদ পৌঁছিয়ে দেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে?



উত্তরঃ 


এ হাদীছে এ কথা কোথায় আছে যে, ‘আমি দূরের দরূদ শুনতে পাই না?’ হাদীছের মর্মার্থ একেবারে সুস্পষ্ট-নিকটবর্তী লোকদের দরূদ শরীফ তিনি নিজেই শুনেন, আর দূরবর্তীদের দরূদও তিনি শুনেন, আবার তাঁর দরবারেও পৌঁছানো হয়। ‘হাযির-নাযির’ এর প্রমাণে দালায়েলুল খাইরাত গ্রন্থের যে রিওয়ায়াতটি পেশ করেছি, সেখানে বলা হয়েছে, যাদের অন্তরে আমার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা রয়েছে, তাদের দরূদ আমার নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।  আর যাদের অন্তরে এরূপ ভালবাসা নেই, তাদের দরূদ আমার নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। তাহলে ‘দূর’ ও ‘নিকটের’ শব্দটি দ্বারা হৃদয়ের দিক থেকে দূরত্ব বা নৈকট্যের কথাই বোঝানো হয়েছে; স্থানের দূরত্ব বা নৈকট্য নির্দেশ করা হয়নি। যেমনঃ


❏ জনৈক কবি বলেছেন


گر ربے مني وپيش منى دريمنى – گر بامني دوريمنى پيش منى


অর্থাৎ- পরম প্রিয়জনের সাথে যদি আমার হৃদ্যিক সম্পর্ক না থাকে, তা’হলে তার আমার সামনে বিদ্যমান থাকা যে কথা, সুদূর ইয়ামন দেশে অবস্থান করাও একই কথা। পক্ষান্তরে তার সাথে যদি আমার হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক থাকে, তা’হলে সে ইয়ামন দেশে থাকলেও আমার সামনে আছে বলে মনে হয়।


দরূদ পৌঁছিয়ে দেয়া হয় বলে অবশ্যম্ভাবীরূপে একথা বোঝা যায় না যে, রাসূল (ﷺ) তাঁ শুনতেই পান না। ফিরিশতাগণওতো বান্দার ‘আমল সমূহ খোদার দরবারে পেশ করেন’ তাহলে কি আল্লাহও তা’ জানেন না? দরূদ শরীফ পেশ করার মধ্যে বান্দাদের মান সম্মান নিহিত। অর্থাৎ দরূদ-পাকের বরকতে তারা এ স্তরে উপনীত হয় যে, তাদের মত দীন-হীন লোকদের নামও জগতের শাহানশাহ হুজুর (ﷺ) এর মহান দরবারে উচ্চারিত হল।


ফকীহগণ বলেন, নবীর অবমাননাকারীদের তওবা কবুল হয় না। সুবিখ্যাত ‘ফত্ওয়ায়ে শামী’র ‘আল মুরতাদ’ শীর্ষক অধ্যায় দেখুন। এ তওবা মকবুল না হওয়ার কারণ হলো, নবীর অবমাননা হচ্ছে ‘হক্কুল ইবাদ’ (যে সব ধর্মীয় কার্য বান্দাদের অধিকার হিসেবে শরীয়ত সমর্থিত ও পালনীয়) এর পর্যায়ভুক্ত, যা তওবা দ্বারা মাফ হবার নয়। এ অবমাননার খবর যদি হুযুরের (আলাইহিস সালাম) না থাকে, তা ‘হক্কুল ইবাদ’ এর পর্যায়ভুক্ত হল কিরূপে? পরনিন্দা ঐ সময়েই ‘হক্কুল ইবাদের’ পর্যায়ভুক্ত হয়, যখন তার খবর নিন্দিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে। অন্যথায় ‘হক্কুল্লাহ’ (যে সব ধর্মীয় বিধি নিষেধ একমাত্র আল্লাহর ‘অধিকার’ হিসেবে পালনীয়। যেমন- রোযা, নামায ইত্যাদি) হিসেবে গণ্য হয়। এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) রচিত ‘শরহে ফিকহে আকবর’ দেখুন।


❏ ইবনে তাইমিয়ার সুযোগ্য শাগরিদ ইবনে কাইয়ুম {ওফাত.৭৫১হি.} রচিত ‘জিলাউল ইফহাম’ গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন-


قَالَ الطَّبَرَانِيّ حَدثنَا يحيى بن أَيُّوب العلاف حَدثنَا سعيد بن أبي مَرْيَم حَدثنَا يحيى بن أَيُّوب عَن خَالِد بن يزِيد عَن سعيد بن أبي هِلَال عَن أبي الدَّرْدَاء قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم أَكْثرُوا الصَّلَاة عَليّ يَوْم الْجُمُعَة فَإِنَّهُ يَوْم مشهود تشهده الْمَلَائِكَة لَيْسَ من عبد يُصَلِّي عَليّ إِلَّا بَلغنِي صَوته حَيْثُ كَانَ قُلْنَا وَبعد وفاتك قَالَ وَبعد وفاتي إِن الله حرم على الأَرْض أَن تَأْكُل أجساد الْأَنْبِيَاء


-‘‘ইমাম তাবরানী (رحمة الله) বর্ণনা করেন, হযরত আবূ দারদা  (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা জুমার দিন আমার উপর অধিক পরিমানে দরুদ পড়। .......যে কোন স্থানে কেউ দরূদ পাঠ করলে পাঠকের আওয়াজ আমার কানে পৌঁছে। এ রীতি আমার ওফাতের পরেও বলবৎ থাকবে। কেননা নিশ্চয় নবিদের দেহকে মাটির জন্য বক্ষন করাকে হারাম করে দিয়েছেন।’’  

{ইবনুল কাইয়্যুম, জিলাউল ইফহাম, ১/১২৭ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ১০৮,দারুলউরুবাত, কুয়েত, তৃতীয় প্রকাশ.১৪০৭হি.}


❏ ‘তবাআতুল মুনীরিয়াহ’ নামক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছাপানো সেই ‘জিলাউন ইফহাম’ গ্রন্থের ৭৩ পৃষ্ঠায় ও আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (رحمة الله) রচিত ‘আনিসুল জলীস’ গ্রন্থের ২২৭ পৃষ্ঠায় উলে­খিত আছে হুজুর (ﷺ) বলেছেনঃ


اَصْحَابِيْ اِخْوَ انِىْ صَلُّوْا عَلَىَّ فِىْ كُلِّ يَوْمِ الْاِثْنَيْنِ وَالْجُمْعَةِ بَعْدَ وَفَاتِيْ فَاِنِّى اَسْمَعُ صَلَى تَكُمْ بِلاَ وَاسِطَةٍ


-‘‘প্রতি সোমবার ও শুক্রবার আমার ওফাতের পর বেশী করে দরূদ পাঠ করবেন। আপনাদের দরূদ আমি সরাসরি শুনি।’’



৭নং আপত্তিঃ 


❏ ‘ফত্ওয়ায়ে বয্যাযিয়াহ’তে আছেঃ


مَنْ قَالَ اِنَّ اَرْوَاحَ الْمَشَائِخِ حَاضِرَةٌُ تَعْلَمُ يَكْفُرُ


-‘‘যে ব্যক্তি বলে যে, মাশায়েখের রূহসমূহ ‘হাযির’ ও সবকিছু জানে, সে ব্যক্তি ‘কাফির’।’’


❏ আল্লামা শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস সাহেব (رحمة الله) ‘তাফসীরে ফতহুল আযীয’ এর ৫৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ


انبياء ومرسلين را لوازم الو هيت ازعلم غيب وشنيدن فر يادهر كس درهر جاوقدرت بر جميع مقدورات ثابت كنند


অর্থাৎ- এরা নবী ও পয়গাম্বরদের জন্য ‘মাবুদ’ এর অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলী, যেমন অদৃশ্য বিষয়াদির জ্ঞান, যে কোন স্থান থেকে যে কোন লোকের ফরিয়াদ শুনা এবং সম্ভবপর সবকিছুৃ করার ক্ষমতা ইত্যাদি প্রমাণ করেন। এ থেকে জানা গেল যে, অদৃশ্য জ্ঞান, প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ হওয়া খোদারই একমাত্র বৈশিষ্ট্য। অন্য কারো মধ্যে এ গুণ আছে বলে স্বীকার করা সুস্পষ্ট কুফর। ‘বয্যাযিয়া’ হচ্ছে ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম নির্ভরযোগ্য কিতাব। আর সে কিতাবই এ ব্যাপারে কুফ্রের ফত্ওয়া দিচ্ছে।



উত্তরঃ


❏ফত্ওয়ায়ে বয্যাযিয়াহ এর উপরোলি­খিত ইবারতের বাহ্যিক ভাব ধারার আওতায় ভিন্নমতাবলম্বীগণও এসে যাচ্ছেন। কেননা, প্রথমতঃ মওলবী রশীদ আহমদ সাহেব রচিত ‘ইমদাদুস সুলুক’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি ইতিপূর্বে উলে­খ করেছি, যেখানে তিনি পরিষ্কার ভাষায় পীরের রূহকে মুরীদদের কাছে ‘হাযির’ জ্ঞান করার শিক্ষা দিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ বয্যাযিয়াহর উপরোক্ত ইবারতে সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়নি যে, কোন জায়গায় পীরের রূহকে হাযির জ্ঞান করা ‘কুফর’ সব জায়গায়, না কোন এক জায়গায়। বিশেষত কোন স্থানের উলে­খ না থাকায় এ কথাই জানা যায়, যদি কেউ মাশায়েখের রূহকে এক জায়গায়ও হাযির মনে করে, কিংবা যে কোন একটি বিষয়েও জ্ঞাত বলে ধারণা করে, তাহলে সে ‘কাফির’ হয়ে যাবে। তাঁরাও মাশায়েখের রূহসমূহকে তাঁদের কবরের মধ্যে কিংবা ‘আলমে বরযখের’ ইল্লীয়ীন’ নামক স্থানে যেখানে তাঁদের রূহ অবস্থান করেন’, অবশ্যই হাযির বলে স্বীকার করবেন। অতএব, যে কোনখানে স্বীকার করা হোক না কেন, কুফরের গণ্য হল। তৃতীয়তঃ এ ‘হাযির-নাযির’ এর আলোচনায় সুপ্রসিদ্ধ ফত্ওয়ায়ে শামী’র উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্বেই উলে­খ করেছি যে, ইয়া হাযির! ইয়া নাযির! বলা কুফর নয়। চতুর্থতঃ ‘আশিআতুল লুমআত, ইহয়াউল উলুম প্রভৃতি গ্রন্থ, এমনকি নওয়াব সিদ্দিক হোসেন খান ভুপালী ওহাবীর উদ্ধৃতি সমূহ উলে­খ করে আগেই বলেছি যে, নামাযী (আত্তাহিয়াত’ পাঠের সময়) নিজ অন্তরে  হুজুর (ﷺ) কে হাযির মনে করেই اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ اَيُّهَا النَّبِىُّ (হে নবী, আপনার প্রতি সালাম) কথাটুকু বলবেন। এখন প্রশ্ন হলো- এ ফকীহগণের বেলায় বয্যাযিয়াহর এ ফত্ওয়া প্রযোজ্য হবে কি না? যেহেতু তাঁদেরকে ‘কাফির বলে আখ্যায়িত করা যাবে না’। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বয্যাযিযাহ যে হাযির-নাযির জ্ঞান করাকে কুফর আখ্যায়িত করেছে, তা ওই হাযির-নাযির এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যা’ খোদারই একমাত্র গুণ হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ যা সত্ত্বাগত চিরন্তন, অত্যাবশ্যকীয় ও স্থানের গন্ডীমুক্ত। এ ধরনের হাযির-নাযির হওয়াটা খোদারই একমাত্র বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রত্যেক জায়গায় আছেন, কিন্তু কোন স্থানে সীমাবদ্ধ নন। 


❏১নং আপত্তির উত্তরে ‘ফত্ওয়ায়ে রশীদিয়াহ’ ১ম খন্ড, ‘কিতাবুল বিদআত’ এর ৯১ পৃষ্ঠা ও’বরাহীনে কাতেয়া’ গ্রন্থের ২৩ পৃষ্ঠা হতে উদ্ধৃতি আগেই পেশ করেছি, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মওলবী রশীদ আহমদ সাহেব ও মওলবী খলীল আহমদ সাহেব ও ফত্ওয়ার ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত।


❏আর, শাহ আবদুর আযীয সাহেবের (رحمة الله) ভাষ্য একেবারে সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেন, আল্লাহর কুদরতের আওতাভুক্ত যাবতীয় বিষয়ের উপর আল্লাহর মতই মাশায়েখ ও নবীদেরকে ক্ষমতা সম্পন্ন স্বীকার করাটা কুফর, তা না হলে তিনি নিজেই وَيَكُوْنَ الرَّسُوْلُ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا আয়াতের  প্রেক্ষাপটে  হুজুর (ﷺ)কে ‘হাযির-নাযির’ স্বীকার করেন কিরূপে? ‘ইলমে গায়ব’ শীর্ষক আলোচনায় উক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপটে উনার উদ্ধৃতি লিপিবদ্ধ করেছি।

{সূরাঃ বাক্বারাঃ আয়াতঃ ১৪৩, পারাঃ ২}

  

৮নং আপত্তিঃ 

ভিন্ন মতাবলম্বীদের কেউ কেউ অন্য কোন পথ না পেয়ে একথা বলে ফেলেন যে, তারা ইবলীসকে প্রত্যেক জায়গায় পৌঁছার ক্ষমতা সম্পন্ন বলে স্বীকার করেন। অনুরূপ, আসিফ ইবন বরখিয়া, মলাকুল মউত ও অন্যান্য ফিরিশতাদেরও এ ক্ষমতা আছে বলে স্বীকার করেন। কিন্তু তারা একথা স্বীকার করেন না যে, অন্যান্য সৃষ্টজীবের পূর্ণতা জ্ঞাপন বৈশিষ্ট্য সমূহ নবীদের মধ্যে কিংবা  হুজুর (ﷺ) এর মধ্যে পুঞ্জীভূত রূপ পরিগ্রহ করেছে।


❏মৌলভি কাসেম সাহেব ‘তাহযীরুন্নাস’ কিতাবে লিখেছেনঃ ‘আমলের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সাধারণ নবীকেও মাঝেমধ্যে ডিঙ্গিয়ে যায়। মৌলভি হোসাইন আহমদ সাহেব ‘রুজুমল মুযনেবীন’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘দেখুন! রাণী বিলকিসের সিংহাসন নিয়ে আসার ক্ষমতা হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর ছিল না, কিন্তু আসিফের এ ক্ষমতা ছিল। তা না হলে তিনি নিজেই নিয়ে আসলেন না কেন? আরো দেখুন, হুদহুদ পাখী বলেছিল [হে সুলাইমান (আলাইহিস সালাম)! আমি এমন একটি বিষয়ের তথ্য উদ্ঘাটন করেছি, যার খবর আপনি রাখেন নি] অধিকন্তু হুদহুদের চোখ ভূ-গর্ভে সঞ্চিত পানি দেখতে পায়। এজন্যই সে পাখী হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর দরবারে থাকতো, বন-জঙ্গলের কোন স্থানে ভূ-গর্ভে পানি আছে, সে খবর পরিবেশন করত। হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর এ খবর ছিল না। তাই জানা যায় যে, নবীগনের জ্ঞান ও অলৌকিক ক্ষমতার চেয়েও নবী নয় এমন ব্যক্তির, এমন কি জন্তুর জ্ঞান ও ক্ষমতা বেশী হতে পারে।”


উত্তরঃ নবী নয় এমন ব্যক্তির মধ্যে নবীর তুলনায় কিংবা কোন নবীর মধ্যে হুযুরের (ﷺ) তুলনায় পূর্ণতা জ্ঞাপক কোন বিশেষ গুণ বেশী আছে পরিপন্থী। স্বয়ং ভিন্নমতাবলম্বীগণও, যাদের উক্তিসমূহ আগে উলে­খ করেছি, একথা স্বীকার করেন। এ অষ্টম আপত্তিটা তাদের নিজস্ব মতাদর্শ পরিহারের নামান্তর। ‘শিফা’ শরীফে আছে, কেউ যদি একথা বলে যে, ব্যক্তি বিশেষের জ্ঞান হুযুরের (ﷺ) তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী, তাহলে সে কাফির। যে কোন পূর্ণতা জ্ঞাপক গুণ হুযুর (ﷺ) এর তুলনায় অন্য কারো মধ্যে বেশী বলে স্বীকার করা কুফর। জ্ঞান ও আমলের দিক থেকে কেউ নবীকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে না। যদি কারো বয়স আটশ’ বছর হয় এবং সে সারা জীবনটাই ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করে বলে যে, ‘আমি ইবাদত করেছি আটশ’ বছর, আর হুযুর (ﷺ) এর ইবাদত হচ্ছে সর্বসাকুল্যে পঁচিশ বছরের। সুতরাং, ইবাদতের দিক থেকে আমি হুযুরকে ডিঙিয়ে গিয়েছি, তাহলে সে ধর্মদ্রোহী বলে গণ্য। হুযুর (ﷺ) এর একটি সিজদার ছওয়াব আমাদের লক্ষ বছরের ইবাদতের ছওয়াব থেকে ঢের বেশী। ঐ লোকটির কেবল কষ্ট বেশী হয়েছে। না হয় খোদার নৈকট্য, মর্তবা ও ছওয়াবের দিক দিয়ে নবীর সাথে তার কোন তুলনায় চলে না। নবীর মর্তবা তো অনেক উচ্চ, অনেক ঊর্ধ্বে।


❏‘মিশকাত’ শরীফের ‘ফযাইলুস সাহাবা’ শীর্ষক অধ্যায়ে উলে­খিত আছেঃ মহানবী (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, “আমার সাহাবীর যৎসামান্য যবের দান খয়রাত তোমাদের পাহাড়সম স্বর্ণ দান করার চাইতেও উত্তম।”  

{ক. খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ৪/৪১৪ পৃ. হাদিসঃ ৬০১৫

খ. ইমাম বগভীঃ শরহে সুন্নাহঃ ১৫/৭২ পৃ. হাদিসঃ ৩৮৬৩}

  

❏বনী ইসরাইলের সমউন এক হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাস এক নাগাড়ে ইবাদত করেছেন। তাঁর প্রতি মুসলমানদের ঈর্ষা হলো আমরা তাঁর সমতুল্য মর্যাদা কিরূপে পাব? তখনই নাযিল হল আয়াতে করীমাঃ


لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌُ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ


অর্থাৎ- শবে কদরের পবিত্র রজনী হাজার মাসের চেয়েও শ্রেয়।  

{সূরাঃ ক্বদর, আয়াতঃ ৩, পারাঃ ৩০}


অর্থাৎ ‘হে মুসলমানগণ, আমি তোমাদের উপহার দিচ্ছি এক মহামূল্যবান রজনী শবে কদর। এ রাতের ইবাদত বনী ইসরাইলের হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’ এরূপ  হুজুর (ﷺ) এর এক মুহূর্ত লক্ষ লক্ষ শবে কদরের চেয়েও উত্তম। যে পবিত্র মসজিদের এক কোণায় সাইয়িদুল আম্বিয়া (ﷺ) শায়িত আছেন, সেই মসজিদে অর্থাৎ মসজিদে নববীতে এক রাকআত নামায সাধারণ মসজিদের পঞ্চাশ হাজার রাকআতের সমতুল্য (ইবনে মাযাহ)। যাঁর নিকট অবস্থান করে ইবাদত করলে আমাদের ইবাদতের ছওয়াব এত গুণ বেড়ে যায়, তাঁর ইবাদত সম্পর্কে আর কীই বা বলার আছে?


❏অনুরূপ, আসিফ বিন বরখিয়ার সিংহাসন নিয়ে আসার ক্ষমতা চলি, আর হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর সেই ক্ষমতা ছিল না- এ রূপ উক্তি বাজে প্রলাপ মাত্র। 


❏কুরআন করীম ইরশাদ করছেঃ


قَالَ الَّذِي عِنْدَهُ عِلْمٌ مِنَ الْكِتَابِ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَنْ يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ


-‘‘সে মহাপুরুষ, যিনি ঐশী গ্রন্থের জ্ঞানে দীপ্ত ছিলেন বলেছিলেন “আমি বিলকীসের সেই সিংহাসনটিকে আপনার চোখের পলক মারার আগেই আপনার দরবারে নিয়ে আসব।”  

{সূরাঃ নামল, আয়াতঃ ৪৯০, পারাঃ ১৯}

  

বোঝা গেল যে, আসিফ এ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন ঐশী কিতাবের জ্ঞানের বদৌলতে। কোন কোন তাফসীরকারক বলেন যে, তাঁর ইসমে ‘আযম জানা ছিল, যার ফলে তিনি সেই সিংহাসনটি আনয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এ জ্ঞান হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর বরকতে অর্জিত হয়েছিল। এটা কি করে সম্ভব যে, তার এরূপ ক্ষমতা আছে, অথচ তাঁর উস্তাদ হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর এ ক্ষমতা নেই? এখন অবশ্য স্বভাবতই প্রশ্ন হতে পারে, তা’হলে তিনি নিজেই আনলেন না কেন এর কারণ সুস্পষ্ট। কাজ সম্পন্ন করা হয় খাদিম বা অধঃস্তন কর্মচারীদের দ্বারা, রাজা-বাদশাহরা তা করেন না। বাদশাহের মান সম্মান প্রতিপত্তির যথোপযুক্ত আচরণ হচ্ছে কর্মচালীদের দ্বারা কাজ সম্পাদন করানো। বাদশাহ নিজের কর্মচারীদের দ্বারা পানি আনয়ন করে পান করেন। ‘তাই বলে কি, বাদশাহের পানি আনয়নের ক্ষমতা নেই’ বলতে হবে? বিশ্বনিয়ন্তা দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকান্ড ফিরিশতাদের দ্বারাই সম্পাদন করান। যেমন- বৃষ্টি বর্ষণ, প্রাণহরণ, মাতৃগর্ভে শিশুর শরীর গঠন ইত্যাদি কার্যাবলী সম্পাদনের দায়িত্ব ফিরিশতাদের হাতে অর্পিত হয়েছে। তাই বলে কি ধারণা করা যায় যে, বিধাতার এসব কাজ করার ক্ষমতা নেই? ফিরিশতাগণ কি খোদার চেয়ে বেশী ক্ষমতা রাখেন?


❏তাফসীরে রূহুল বয়ানে কুরআনের পঞ্চম পারা ‘সুরা নিসার’ আয়াতঃ

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৯২, পারাঃ ৫}

  

فَصِيَامُ شَهْرَ يْنِ مُتَتَا بِعَيْنِ 


এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে যে, হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) আসিফকে বিলকিসের সিংহাসন আনার আদেশ দিয়েছিলেন এজন্য যে, তিনি তাঁর পদ মর্যাদার নিচে নামতে চাননি। অর্থাৎ সে কাজটি ছিল কর্মচারীদের। আর হুদ হুদ পাখীর কথাটুকু কুরআন হুবহু বর্ণান করেছে- হুদহুদ বলেছিল, ‘আমি এমন একটি ব্যাপার দেখে এসেছি, যার খবর আপনিও রাখেন নি।’ কুরআন কোথায় বলল যে, প্রকৃতপক্ষে হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর সে খবর ছিল না? হুদহুদের ধারণা ছিল, সম্ভবত হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর সে বিষয়ের খবর নাও থাকতে পারে, তাই সে এরূপ উক্তি করেছিল? তাই এ উক্তিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না।


এও হতে পারে যে, হুদহুদ আরয করেছিল 

اَحَطْتُّ بِمَا لَمْ تُحِطْ بِهِ 

-‘‘আমি এমন একটি ব্যাপার দেখে এসেছি, যা আপনি দেখেন নি।’’  

{সূরাঃ নামল, আয়াতঃ ২২, পারাঃ ১৯}


অর্থাৎ আপনি সে দেশে স্বশরীরে দেখতে যান নি। একথা দ্বারা জ্ঞানের অস্বীকৃতি বোঝানো হয়নি। হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর ও সব খবর ছিল, কিন্তু খোদার ইচ্ছা ছিল, এত বড় একটি কাজ হুদহুদ পাখীর দ্বারা সম্পন্ন করা হোক। যাতে একথা জানা যায় যে, নবীর সান্নিধ্য লাভে ধন্য একটি পাখী এমন কাজও করতে পারে, যা অন্যান্য সাধারণ লোকের পক্ষেও সম্ভবপর নয়। যদি হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর সে ব্যাপারে খবর না থাকত, তাহলে আসিফ ইবন বরখিয়া কারো কাছে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করা ব্যতিরেখে ইয়ামনের ‘সবা’ শহরে অবস্থিত বিলকীসের বাড়ীতে পৌঁছলেন কিভাবে? এবং নিমেষেই সিংহাসনটি নিয়ে এলেন কিরূপে? এ থেকে জানা গেল, সমগ্র ইয়ামন রাজ্য হযরত আসিফের সামনেই উন্মোচিত ছিল। তাহলে হযরত সুলাইমন (আলাইহিস সালাম) এর দৃষ্টি এড়ায় কিভাবে?


হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর জানা ছিল তাঁর পিতার ঠিকানা। ‘কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে নিজের খবর জানাননি। কারণ, তাঁর জানা ছিল যে, এক সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, তাঁর সুনাম সারা দুনিয়ার ছড়িয়ে পড়বে এবং তার পরই পিতার সাথে সাক্ষাৎ ঘটবে।

আর যমীনের নিচে পানির অনুসন্ধান করা হুদহুদেরই দায়িত্ব ছিল। বাদশা ওসব কাজ নিজে করেন না।


❏মছনবী শরীফে একটি ঘটনার উলে­খ আছে যে, একদা  হুজুর (ﷺ) ওযু করছিলেন, পায়ের মোজা দু’টি খুলে নিকটেই রেখেছিলেন। এমন সময় একটি চিল ছোঁ মেরে একটি মোজা উঠিয়ে নিয়ে গেল এবং উপরে নিয়ে গিয়ে মোজাটিকে উলটিয়ে নিচে ছুড়ে মারল। মোজার মধ্য হতে একটি সাপ বের হল।  হুজুর (ﷺ) চিলকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন আমার মোজা কেন উঠালে? আরয করলো আমি যখন উড়তে উড়তে আপনার মাথা মুবারক বরাবর উপরে এসেছিলাম, তখন আপনার মাথা থেকে সুদূর আসমান পর্যন্ত বিস্তৃত এমন এক নূর বিরাজমান ছিল, যার সংস্পর্শে আসার পর যমীনের সাতটি স্তরই আমার সম্মুখে উন্মোচিত হয়ে উঠেছিল এবং সে আলোতে আপনার মোজার মধ্যে লুকায়িত সাপটি দেখতে পেয়েছিলাম। অন্যমনস্কতা বশতঃ আপনি মোজাটি পরিধান করলে সাপের দংশনের ফলে আপনার কষ্ট হবে এ কথা ভেবে মোজাটি পরিধান করলে সাপের দংশনের ফলে আপনার কষ্ট হবে একথা ভেবে মোজাটি উঠিয়ে নিয়েছিলাম। 


❏মাওলানা রুমী (رحمة الله)  হুজুর (ﷺ) ও উক্ত চিলের সংলাপের ঘটনাটি সুন্দররূপে ব্যক্ত করেছেনঃ


ماردر موزه به بينم ازهوا – نيست از من عكس تست اے مصطفي


অর্থাৎ চিল টি বলেছিল, শূন্যে থেকে মোজার ভিতর লুকায়িত সাপটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। হে নবী মুস্তাফা (ﷺ)! আমার নিজস্ব দৃষ্টির আলোতে তা সম্ভব হয়নি, বরং আপনার নূরের আলোকন চটার ফলেই আমার দৃষ্টিশক্তি এত প্রখর হয়েছিল। 


❏এরপর  হুজুর (ﷺ) বলেছিলেনঃ


گرچه هر غيبے خدامارا نمود – دل دريں لخطه بحق مشغول بود


অর্থাৎ যদিও প্রত্যেক অদৃশ্য বিষয় বা বস্তু আল্লাহ তা’আলা আমাকে দেখিয়ে দেন, কিন্তু আমর অন্তর সে সময় আল্লাহর ধ্যানেই ব্যাপৃত ছিল।


❏হযরত আয়েশা সিদ্দীকা  (رضي الله عنه) একবার আরয করেছিলেন, হে আল্লাহর হাবীব, আপনি কবরস্থানে ছিলেন; এ দিকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। আপনার কাপড় ভিজে নাই কেন? উত্তরে প্রিয় নবী (ﷺ) বললেন, আয়েশা! তুমি কি কাপড় গায়ে দিয়েছ? আপনার তাহবন্দ শরীফ, বললেন আয়েশা  (رضي الله عنه)। 


❏এরপর প্রিয়নবী (ﷺ) যা বলছিলেন তা মছনবী শরীফের নিম্নোক্ত কবিতার চরণদ্বয়ে সুন্দররূপে বিধৃত হয়েছে।


گفت بهر اں نمودائے پاك جبيب – چشم پاكت راخدا بار ان غيب

نيست ايں بار ان ازيں ابر شما – هست بار اں ديگر ويكر سما


অর্থাৎ- হে প্রিয়তমা, উক্ত তাহবন্দ শরীফের বরকতেই তোমার চোখের পর্দা উত্তোলিত হয়েছে, যার ফলস্বরূপ অদৃশ্য বিষয় তোমার দৃষ্টি গোচর হয়েছে। যে বৃষ্টিবর্ষিত হতে তুমি দেখেছ তা জলবিন্দুর বৃষ্টি নয়, বরং তা ছিল নূরের প্রবাহ, এর মেঘ ও আকাশই ভিন্ন। হে আয়েশা  (رضي الله عنه), উহা কারো নজরে পড়ে না, তুমি আমার সে চাদরের বরকতেই তা দেখতে পেয়েছ।


হুদহুদ যমীনের গর্ভে কোথায় পানি আছে তা স্পষ্টরূপে দেখতে পায়। দৃষ্টির এ প্রখরতা হযরত ইবরাহিম(আলাইহিস সালাম) এর অগ্নিকুন্ডে পানি ঢালার বরকতে ও হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) এর সাহচর্যের ফলেই সে লাভ করেছিল।


৯নং আপত্তিঃ  

হুজুর (ﷺ) যদি প্রত্যেক জায়গায় ‘হাযির-নাযির’ হন, তা হলে আমাদের পবিত্র মদীনায় গমনের কি প্রয়োজন?


উত্তরঃ 

খোদা যখন প্রত্যেক জায়গায় বিদ্যমান, তখন কাবা শরীফে যাবার কি প্রয়োজন? মিরাজের পবিত্র রজনীতে  হুজুর (ﷺ) এর আরশের উপর যাওয়ারই বা কি প্রয়োজন ছিল? মশাই! জেনে নিন, মদীনায়ে মুনাওয়ারা হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের রাজধানীতুল্য, বিশেষ তজল্লী প্রতিফলিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট স্থান, যার ভূমিকা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শক্তির জন্য পাওয়ার হাউসের মত। বরং আল্লাহর ওলীদের কবরসমূহেও বিচিত্র শক্তি সম্পন্ন বাল্ব বিশেষ, সেগুলির যিয়ারতও একান্ত প্রয়োজন।

 
Top