এক সঙ্গে তিন তালাক প্রদান সম্পর্কিত আলোচনা


যদি কোন ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে যদিওবা সে অন্যায় করেছে, কিন্তু এ অবস্থায় এক তালাক নয়, তিন তালাকই কার্যকারী হবে, এবং এ মহিলা সেই পুরুষের জন্য হালাল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে দ্বিতীয় স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত না হয়। বর্তমান যুগের লা-মযহাবী ও ওহাবীরা এ হুকুমকে অস্বীকার করে এবং নিজেদের মনের কামনা অনুসারে বলে যে এ অবস্থায় এক তালাকই কার্যকরী হবে এবং সেই মহিলার সাথে পুনরায় ঘর-সংসার করা যাবে। এ জন্য এ আলোচনাকে একটি ভূমিকা ও দু’টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আলোচ্য মাসআলার দলীলসমূহ পেশ করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে লা-মযহাবীদের উত্থাপিত আপত্তি সমূহের উত্তর দেয়া হয়েছে।


ভুমিকা


স্ত্রীকে যদি তালাক দিতে হয়, তাহলে পবিত্র কালে কেবল এক তালাক দেওয়াটাই শ্রেয়। যদি তিন তালাক দিতে হয়, তাহলে তিন তোহরে (তিন পবিত্র কালে) তিন তালাক দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি কেউ ঋতু কালে তালাক দিয়ে দেয় বা এক সাথে তিন তালাকই দিয়ে দেয়, তাহলে যদিওবা সে অন্যায় করেছে, তালাক কার্যকরী হবে। এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার তিনটি পর্যায় আছে-


(১) যদি স্বামী নিজের স্ত্রীকে যার সাথে কেবল বিবাহ হয়েছে কিন্তু কোন দৈহিক সর্ম্পক হয়নি, এক সাথে তিন তালাক এ ভাবে দেয়-তোমাকে তালাক দিলাম, তালাক, তালাক, এই অবস্থায় কেবল এক তালাকই কার্যকরী হবে এবং শেষের দু’তালাক, গণ্য হবে না। কেননা প্রথম তালাক উচ্চারণ করার সাথে সাথে সেই মহিলার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে এবং তার উপর ইদ্দতও ওয়াজিব নয়। তালাকের জন্য বিবাহ বা ইদ্দতের প্রয়োজন। তবে সেই মহিলাকে যদি এ রকম বলে-তোমাকে তিন তালাক দিলাম, তখন তিন তালাকই কার্যকরী হবে। কেননা তখন তিন তালাক বিবাহ বলবৎ থাকা কালীন কার্যকরী হয়েছে। (প্রায় ফিক্হের কিতাবে তা বর্ণিত আছে।)


২। যদি স্বামী স্ত্রীকে, যার সাথে দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে, এভাবে তালাক দেয়- তোমাকে তালাক দিলাম, তালাক, তালাক। যদি শেষের তালাক শব্দদ্বয় দ্বারা পহেলী তালাকের প্রতি জোর দেয়ার নিয়ত করে থাকে এবং স্বতন্ত্র তালাকের নিয়ত না করে, তাহলে এক তালাক কার্যকরী হবে (কিন্তু কাজির দরবারে তা অগ্রাহ্য হবে) কেননা সে এক তালাককে দু’বার জোর দিয়েছে। যেমন কেউ বললো, পানি পান করে নিন, পানি, পানি; খাবার খেয়ে নিন, খাবার, খাবার, আমি কালকে গিয়েছিলাম, কালকে, কালকে। এসব অবস্থায় শেষের শব্দদ্বয়ের প্রথম শব্দের প্রতি জোর দেয়া বুঝায়।


৩। যদি কোন ব্যক্তি স্বীয় স্ত্রীকে, যার সাথে দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে, এক সংগে তিন তালাক দেয়- হয়তো বলেছে তোমাকে তিন তালাক দিলাম বা এ রকম বললো- তোমাকে তালাক দিলাম, তালাক দিলাম, তালাক দিলাম, যে কোন অবস্থায় তিন তালাকই কার্যকরী হবে। এ মহিলা দ্বিতীয় স্বামী পরিত্যাক্তা না হওয়া পর্যন্ত এ পুরুষের জন্য হালাল হবে না। এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা, শাফেঈ, মালেক, আহমদ ও আগের পরের সমস্ত উলামা একমত। তবে কতেক যাহির পন্থী আলিম শেষ পর্যায়ের তালাকের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। 


✦ যেমন তাফসীরে সাবীতে দ্বিতীয় পারার فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ আয়াতের ➥662. সূরা বাক্বারা, আয়াত নং-২৩০। তফসীর প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-

والمعنى فان ثبت طلاقها ثلاثا فى مرة او مرات فلا تحل كما اذ قال لها انت طالق ثلثا او البته وهذا هو المجمع عليه

অর্থাৎ উলামায়ে উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে তিন তালাক পৃথক পৃথক দেওয়া হোক বা এক সঙ্গে দেওয়া হোক যে কোন অবস্থায় মহিলা হারাম হয়ে যাবে।  ৬৬৩

➥663. আল্লামা সাভী, তাফসিরে সাভী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭২, দারু ইহ্ইয়াউত্-তুরাশুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।


✦ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ নববীতে الطلاق الثلث শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-

وَقَدِ اخْتَلَفَ الْعُلَمَاءُ فِيمَنْ قَالَ لِامْرَأَتِهِ أَنْتِ طَالِقٌ ثَلَاثًا فَقَالَ الشَّافِعِيُّ وَمَالِكٌ وَأَبُو حَنِيفَةَ وَأَحْمَدُ وَجَمَاهِيرُ الْعُلَمَاءِ مِنَ السَّلَفِ وَالْخَلَفِ يَقَعُ الثَّلَاثُ وَقَالَ طَاوُسٌ وَبَعْضُ أَهْلِ الظَّاهِرِ لَا يَقَعُ بِذَلِكَ إِلَّا وَاحِدَةً

অর্থাৎ যে কেউ নিজের স্ত্রীকে যদি বলে- তোমাকে তিন তালাক দিলাম, তাহলে তিন তালাকই কার্যকারী হবে বলে চারি ইমাম ও আগে পরের প্রায় উলামায়ে কিরাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে কতেক যাহির পন্থী আলিম বলেন যে এক তালাকই কার্যকরী হবে। এমন কি হুজ্জাজ ইবনে আরতাত, ইবনে মকাতেল ও মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন যে ওই রকম বলার দ্বারা এক তালাকও কার্যকরী হবে না। যেহেতু বর্তমান যুগের লা-মযহাবীরা সব জায়গায় আত্মার আরাম তালাশ করে, সেহেতু যেই জিনিসে নফসে আম্মারার তৃপ্তি মিলে, সেটা অগ্রাহ্য থেকে অগ্রাহ্যতর ও একান্ত জয়িফ রেওয়ায়েত হোক না কেন, সেটাই ওদের দ্বীন ও ঈমান। এ জন্য তারা ইবনে তাইমিয়ার অনুসরণ করে এ আকীদা পোষণ করে যে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে এক তালাকই কার্যকরী হবে।  ৬৬৪

➥664. ইমাম নববী, শরহে মুসলিম, কিতাবুত-তালাক, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৭০, দারু ইহ্ইয়াউত তুরাশুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন।


✦ তাফসীরে সাবীতে দ্বিতীয় পারা فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আছে-

واما القول بان الطلاق الثلث فى مرة واحد لا يقع الا طلقة لايعرف الا لابن تيمية ورد عليه ائمة مذهب حتى قال العلماء انه الضال المضل ونسبتها الى الامام اشهب من الائمة الملكية باطلة

-অর্থাৎ এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে যে এক তালাকই কার্যকরী হয়- এ রকম ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী ছাড়া আর কেউ বলেনি। ইবনে তাইমিয়া নিজের মযহাবের ইমামদেরকেও অগ্রাহ্য করেছে। উলামায়ে কিরাম বলেন যে, ইবনে তাইমিয়া নিজেও গুমরাহ এবং অন্যদেরকে গুমরাহকারী। এ মাসআলার ইঙ্গিত ইমাম শাহাব মালিকীর প্রতি করাটা ভুল। 


যা হোক প্রতীয়মান হলো যে বর্তমান যুগের লা- মযহাবীরা কেবল আত্মার আরামের জন্য বাতিল আকীদা আঁকড়ে ধরে বসে আছে। আমি আমার রচিত তাফসীরে নঈমীর দ্বিতীয় খণ্ড فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ আয়াতের ব্যাখ্যায় এ মাসআলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু আজকাল এ বিষয় নিয়ে খুবই বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আমার কাছে এ প্রসঙ্গে প্রশ্নাদির স্তুুপ হয়েছে। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে এ মাসআলার ফয়সালা করতে কলম ধরলাম। বর্ণনার ধরন অন্যান্য আলোচনার মতই হবে অর্থাৎ দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হবে। প্রথম অধ্যায়ে দলীলাদি প্রদান করা হবে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিরোধিতাকারীদের উত্থাপিত আপত্তি সমূহের জবাব দেয়া হবে।

 
Top