চতুর্থ অধ্যায়: কিতাবুল মানাকিব বা ব্যক্তি ফযিলত


বিষয় নং-১: আমি ইলমের শহর আলী সে শহরের দরজা:


হাদীসের নামে জালিয়াতি গ্রন্থের ৪০৯ পৃষ্ঠায় ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর উক্ত হাদিস শরীফ সম্পর্কে লিখেন-‘‘আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত হাদীস।’’ তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে এটা প্রচলিত হাদিস, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এটি হাদিস নয়। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! এ হাদিসটির অনেকগুলো সূত্র রয়েছে, কোন সূত্র যঈফ, কোন সূত্র হাসান, কোন সূত্র সহীহ। অথচ তিনি এতগুলো সূত্র কৌশলে অস্বীকার করে সবচেয়ে দুর্বল সূত্র সম্পর্কে লিখেন-‘‘ইমাম তিরমিযি এ অর্থে একটি হাদীস বর্ণনা করে নিজেই হাদীসটি দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী,  আবু হাতিম,  ইয়াহইয়া বিন সায়ীদ, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে উলে­খ করেছেন।’’ 


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আমি ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের সম্পূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেছি, তিনি সবচেয়ে দুর্বল সনদের আলোচনা করে চলে গেলেন, অথচ এটির অনেকগুলো সূত্র রয়েছে। আমরা এ সনদের দুর্বলতা অস্বীকার করি না। 

কেননা ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) এ সনদ সম্পর্কে লিখেছেন-

الترمذي من حديث عليّ وقال منكر، وأنكره البخاري

-‘‘ইমাম তিরমিযি (رحمة الله) হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর সনদ সম্পর্কে বলেছেন, এটি মুনকার বা আপত্তিকর, ইমাম বুখারী (رحمة الله)ও সেটিকে ইনকার করেছেন।’’ (ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মুনতাসিরাহ ফি আহাদিসিল মুশতাহিরাহ, ১/৫৭ পৃ. হা/৩৮)


আমি আপনাদের সামনে সবগুলো সূত্রই ইন শা আল্লাহ তুলে ধরবো এবং সনদ পর্যালোচনা করবো। অপরদিকে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত “প্রচলিত জাল হাদীস” গ্রন্থের ৬১ পৃষ্ঠায় ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের ন্যায় তাল মিলিয়ে হযরত আলী (رضي الله عنه)-হতে বর্ণিত সবচেয়ে দুর্বল সনদ সম্পর্কে লিখেন-‘‘হাদীসটি মিথ্যা এর কোন ভিত্তি নেই।’’ অনুরূপ বক্তব্যের মাধ্যমে উক্ত হাদিসকে জাল প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু এটি লিখলেও তিনি সর্বশেষ সামান্য সত্য তুলে ধরেন এভাবে-‘‘তবে ইবনে আব্বাস (রাজিঃ) হতে বর্ণিত উপরোক্ত বাক্যটি ‘হাসান’।’’ 

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব তো কিছুটা হলেও সত্য প্রকাশ করলেন, কিন্তু ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পূর্বেও পঞ্চম সংস্করণেও সত্য বা প্রকৃত কথা লিখে যাননি। তিনি কি জবাব দিবেন আল্লাহর কাছে!


প্রথম সূত্র:


ইমাম তিরমিযি (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ مُوسَى، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عُمَرَ بْنِ الرُّومِيِّ، قَالَ: حَدَّثَنَا شَرِيكٌ، عَنْ سَلَمَةَ بْنِ كُهَيْلٍ، عَنْ سُوَيْدِ بْنِ غَفَلَةَ، عَنِ الصُّنَابِحِيِّ، عن على ؓ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : أَنَا دَارُ الْحِكْمَةِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ ـ

-‘‘হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, আমি হলাম হিকমত বা জ্ঞানের গৃহ আর আলী তার দরজা।’’  ১

১. 

ক. খতিব তিবরিযী : মিশকাতুল মাসাবীহ : ৪/২৪২ পৃ: হা/৫৮৩৭

খ. ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী : আস-সুনান : ৫/৫৯৬, হা/৩৭৯০

গ. মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৬০০পৃ. হা/৩২৮৮৯

 

পর্যালোচনা:


ইমাম তিরমিযী  হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন- هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ مُنْكَرٌ. -‘‘হাদিসটি গরীব, মুনকার বা আপত্তিকর।’’

উক্ত হাদিসের সনদ নিয়েই বিভিন্ন মুহাদ্দিগণ কঠোর সমালোচনা করেছেন। উসূলে হাদিসের পরিভাষায় সনদ মুনকার হওয়া যঈফের অর্ন্তভুক্ত, যা কিতাবের শুরুতে আলোকপাত করা হয়েছে। তবে অন্য সনদগুলোর হুকুম এ সনদের ন্যায় নয়। 


দ্বিতীয় সূত্র: 


ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

أَبُو الصَّلْتِ عَبْدُ السَّلَامِ بْنُ صَالِحٍ، ثنا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الْأَعْمَشِ، عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؓ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا، فَمَنْ أَرَادَ الْمَدِينَةَ فَلْيَأْتِ الْبَابَ 

-‘‘হযরতে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।  রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, আমি ইলমের শহর আর আলী তাঁর দরজা, কেউ যদি ইলম তালাশ করতে চায় সে যেন দরজার (আলী) নিকটই অন্বেষণ করে।’’ ২

২. 

ক. হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ৩/১৩৭ পৃ. হা/৪৬৩৭

খ. ইমাম তাবারানী, মু‘জামুল কাবীর, ১১/৬৬ পৃ. হা/১১৬১

গ. মুত্তাকি হিন্দী. কানযুল উম্মাল, ১১/৬০০পৃ. হা/৩২৮৯ 

ঘ. হাইসামী, মাযমাউয যাওয়াইদ, ৯/১১৪ পৃ.

ঙ. সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, ১২১ পৃ. হা/১৮৯

চ. আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/১৮৪পৃ. হা/৬১৮

ছ. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত, ১১/২৫৩ পৃ. হা/৬০৯৬

জ. সুয়ূতি, জামিউস সগীর, ১/২০১পৃ. হা/২৭০৫ ও জামিউল আহাদিস, ১/২৭২ পৃ. হা/৮৬৪৯

ট. ওকাইলী, দ্বঈফাউল কাবীর, ৩/১৫০ পৃ. 

ঠ. ইবনে আদি, আল-কামিল, ৩/১২৪৭ পৃ.

ড. তাবরানী, তাহযিবুল আছার, হাদিস, ১৭৩-১৭৪ 


পর্যালোচনা:


ইমাম হাকিম নিশাপুরী (رحمة الله) হাদিসটি সংকলন করে লিখেন-

هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ، وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ ـ

-‘‘এ হাদিসটির সনদ সহীহ, যদিওবা শাইখাইন সংকলন করেননি।’’ (হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ৩/১৩৭ পৃ. হা/৪৬৩৭) 


এই হাদিসের সনদে-

عَبْد السلام بْن صالِح بْن سُلَيْمَان بْن أيّوب بْن ميسرة، أَبُو الصَّلْت

(আব্দুস সালাম ইবনে ছালেহ্ ইবনে সুলাইমান ইবনে আইয়ুব ইবনে মাইছারাহ আবুস সালত) নামক রাবী রয়েছে। অনেকে তার ব্যাপারে সমালোচনার সুযোগ করে এটিকে যঈফ বলতে চান। অথচ ইমামদের একদল তার হাদিসের উপর নির্ভর করতেন। 


●ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন-

وقال الدوري سمعت ابن معين يوثق أبا الصلت 

-“দাওরী বলেন, আমি ইবনে মাঈন (رحمة الله) কে ‘আবু সালত’ কে বিশ্বস্ত বলতে শুনেছি।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, ৬/৩৬১ পৃ. রাবী নং ৬১৯) 


●তিনি আরও লিখেন-

وقال الحاكم وثقة أمام أهل الحديث يحيى بن معين 

-“ইমাম হাকেম  বলেছেন, হাদিসের জগতের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, ৬/৩২২ পৃ. রাবী নং ৬১৯)


●ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন-

وقال عباس الدوري: سمعت يحيى يوثق أبا الصلت.

-‘‘মুহাদ্দিস আব্বাস দূরী (رحمة الله) বলেন, আমি ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) কে  ‘আবু ছালত’ কে সিকাহ বা বিশ্বস্ত বলতে শুনেছি।’’ (ইমাম যাহাবী, মিযানুল ই‘তিদাল, ২/৬১৬ পৃ., ক্রমিক. ৫০৫১)


●আল্লামা মুগলতাঈ (رحمة الله) লিখেন- وقال العجلي ثقة. -“ইমাম ইজলী (ওফাত. ২৬১ হি.) বলেন, সে সিকাহ বা বিশ্বস্ত রাবী।” (ইমাম মুগলতাঈ: ইকমালু তাহজিবুল কামাল, ৮/২৭৪ পৃ. রাবী: ৩২৯৬)


●ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) ইমাম হাকেমের অভিমত উল্লেখ করে লিখেন-

وَأَبُو الصَّلْت ثِقَة مَأْمُون وَهَذَا حَدِيث صَحِيح الْإِسْنَاد سَمِعْتُ أَبَا الْعَبَّاس يَقُول سَمِعت الْعَبَّاس بْن مُحَمَّد الدوري يَقُولُ سألتُ ابْن معِين عَن أَبَا الصَّلْت فَقَالَ ثِقَة

-‘‘আবু ছালত বিশ্বস্ত, নিরাপদ ব্যক্তি, এ হাদিসটির সনদ সহীহ, আমি মুহাদ্দিস আবু আব্বাস (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি মুহাদ্দিস আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ দূরী (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) কে আবু ছালত’ রাবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে অতঃপর তিনি বলেন, সে সিকাহ বা বিশ্বস্ত।’’ (ইমাম সুয়ূতি, আল-লাআলিল মাসনূ, ১/৩০৪ পৃ.)


এ সনদের অন্যতম রাবী ‘আবূ মুয়াবীয়া’ রয়েছেন তাঁর বিষয়ে 


●ইমাম সাখাভী (رحمة الله) লিখেন-

وأبو معاوية ثقة حافظ

-‘‘আবূ মুয়াবিয়া সিকাহ বা বিশ্বস্ত, হাফেযুল হাদিস।’’ (ইমাম সাখাবী, মাকাসিদুল হাসানা, ১৭০ পৃ. হা/১৮৮) 


●এমনকি আল্লামা আজলূনী (رحمة الله) লিখেন-

وقال في اللآلئ بعد كلام طويل والحاصل أن الحديث ينتهي بمجموع طريقي أبي معاوية وشَريك إلي درجة الحسن المحتج به انتهى

-‘‘লাআলিল মাসনূ প্রণেতা ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) দীর্ঘ পর্যালোচনার পর বলেন, পরিশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে রাবী শারীক এবং আবূ মুয়াবীয়া এর বর্ণনার হাদিস সমূহ অনেক পদ্ধতিতে বর্ণিত হওয়ায় এটির মান ‘হাসান’ এবং এর দ্বারা দলিল দেয়ার উপযোগী।’’ (আল্লামা আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/২০৪ পৃ. হা/৬১৮) 

অতএব, এই রাবীর হাদিস ‘হাসান’ বা ‘সহীহ’ পর্যায়ের। 


●এজন্যই ইমাম সাখাভী (رحمة الله) লিখেন-

وأحسنها حديث ابن عباس، بل هو حسن

-‘‘এ বিষয়ক হাদিসের মধ্যে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর সনদটিই হল উত্তম, বরং সেটির মান ‘হাসান’।’’ (ইমাম সাখাবী, মাকাসিদুল হাসানা, ১৭০ পৃ. হা/১৮৮) 


কারণ ইমামগণের অনেকে তার উপর নির্ভর করেছেন ও বিশ্বস্ত বলেছেন। তবে হাদিসটি ‘আবুস সালত আব্দুস সালাম’ ছাড়াও ভিন্ন আরেকটি সনদে বর্ণিত আছে।


তৃতীয় সূত্র:


●ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

ثنا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ الْفَيْدِيُّ، ثنا أَبُو مُعَاوِيَةَ، عَنِ الْأَعْمَشِ، عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؓ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا، فَمَنْ أَرَادَ الْمَدِينَةَ، فَلْيَأْتِ الْبَابَ

-‘‘নিশাপুরী যথাক্রমে......মুহাম্মদ বিন জাফরিল ফায়দী তিনি আবু মু‘আবিয়া থেকে তিনি আ‘মাশ (রহ.) থেকে তিনি মুজাহিদ (রহ.) থেকে তিনি ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে।’’ ৩

৩. হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাাদরাক, ৩/১৩৭ পৃ. হা/৪৬৩৮


পর্যালোচনা:


এই হাদিসের সনদে সমালোচিত কোন রাবী নেই তাই ইহা সহীহ্। এর সনদে مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ الْفَيْدِيُّ ‘মুহাম্মদ ইবনে জাফর ফায়দী’ রয়েছে, যার ব্যাপারে নাছিরুদ্দিন আলবানী বেহুদা সমালোচনা করার চেষ্টা করেছে অথচ ইমামদের কেউ তার ব্যাপারে কোন প্রকার সমালোচনা করেননি বরং ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে ثِقَة বিশ্বস্ত বলেছেন। যেমন, 


●ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) বলেছেন-

قد حَدَّث بِهِ مُحَمَّد بْن جَعْفَر الفيدي وَهُوَ ثِقَة 

-“এমনিভাবে মুহাম্মদ ইবনে জাফর ফায়দী হাদিস বর্ণনা করেছেন আর সে বিশ্বস্ত।” (ইমাম সুয়ূতি, আল-লাআলীল মাসনুআ, ১/৩০৪ পৃ:)


ذكره بن حبان في الثقات -

“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্তদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ১২৮)


روى عنه مسلم حديثا -

“ইমাম মুসলিম (رحمة الله) তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, তাহজিবুত তাহজিব, রাবী নং ১২৮) 


এমনকি উক্ত রাবীর বিষয়ে আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী লিখেন-

محمد بن جعفر البغدادي الفيدي، قد وثقه يحيى بن معين.

-‘‘ এমনিভাবে মুহাম্মদ ইবনে জাফর ফায়দী হাদিস বর্ণনা করেছেন আর সে বিশ্বস্ত।’’ (শাওকানী, ফাওয়াইদুল মাজমূআহ, ৩৪৯ পৃ. হা/৫২)


চতুর্থ সূত্র:


ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ يَزِيدَ الْحَرَّانِيُّ، ثنا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، ثنا سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُثْمَانَ بْنِ خُثَيْمٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ بَهْمَانَ التَّيْمِيِّ قَالَ: سَمِعْتُ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ ؓ يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ، وَعَلِيٌّ بَابُهَا، فَمَنْ أَرَادَ الْعِلْمَ فَلْيَأْتِ الْبَابَ

-‘‘ইমাম নিশাপুরী যথাক্রমে .....আবদুর রহমান বিন বাহমানা তায়মী তিনি হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, আমি ইলমের শহর আর আর আলী সে শহরের দরজা। আর কেহ যদি সে ইলম অন্বেষণ করতে চায় সে যেন দরজায় তালাশ করে।’’  ৪

৪. 

(ক) হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ৩/১৩৭ পৃ. হা/৪৬৩৮ 

(খ) ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ১/৪৪ পৃ. হা/১০৬ 

(গ) মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৬০০ পৃ. হা/৩২৮৯০


প্রথমের হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সনদসহ মোট চারটি সনদ আমার ইতি মধ্যে পেলাম।


পঞ্চম সূত্র:


এ বিষয়ে আরেকটি সূত্র পাওয়া যায় যেমন হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত রাসূল বলেন-

 قال النبى صلى الله عليه وسلم: انا مدينة العلم ، على بابهاـ رواه ابو نعيم فى المعرفة، عن على رضى الله تعالى عنه ـ 

-‘‘রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমি ইলমের শহর আর আলী (رضي الله عنه) হল তার দরজা।’ ইমাম সুয়ূতি  বলেন, হাদিসটি ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله) ‘আল মা‘রিফাহ’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।’’ ৫

৫. 

(ক) ইমাম সুয়ূতি, জামিউল আহাদিস, ১/২৭২ পৃ. হাদিস, ৮৬৪৯ 

(খ) মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৬১৪পৃ. হা/৩২৯৭৯ ও ১১/৬১৪পৃ. হা/৩২৯৭৮


৬ষ্ঠ সূত্র:


শুধু তাই নয় ইমাম দায়লামী (رحمة الله) হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, সূত্রে আরেক সনদে এভাবে বর্ণনা করেন যা হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। যেমন :

أَنا مَدِينَة الْعلم وَعلي بَابهَا

-‘‘আমি ইলমের শহর আর আলী হলেন সে শহরের দরজা।।’’ ৬

৬.  

ক. ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ১/৪৪ পৃ. হা/১০৬ 

খ. আজলূনী : কাশফুল খাফা : ১/১৮৪ পৃ. হা/৬১৮


সপ্তম সূত্র:


এ বিষয়ে ইমাম দায়লামী (رحمة الله) আরেকটি সূত্র সংকলন করেন এভাবে-

عن عبد الله بن سعيد ﷺ قال قال رسول الله ﷺ أَنا مَدِينَة الْعلم وَأَبُو بكر أساسها وعمر حيطانها وَعُثْمَان سقفها وَعلي بَابهَا

-‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমি ইলমের শহর, আর আবু বকর (رضي الله عنه) হলো তার ভিত্তি, আর ওমর হলো তার দেয়াল, আর উসমান হলো তার ছাদ, আর হযরত আলী হলো তার দরজা।’’ ৭

৭. 

ক. ইমাম দায়লামী : আল মুসনাদুল ফিরদাউস : ১/৪৩ পৃ., হা/১০৫

খ. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাতুল মাফাতীহ : ১১/৩৪৭ পৃ: হা/৫৮৩৭

গ. ইমাম সাখাভী : আল মাকাসিদুল হাসানা : পৃষ্ঠা নং ১০২ : হা/১৮৯

ঘ. ইবনে হাজার হায়তামী আল মক্কী : আল ফতোয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ : ৩৫৫ পৃ: প্রশ্ন নং : ২৮১

ঙ. আল্লামা আজলূনী : কাশফুল খাফা : ১/১৪৮ পৃ: হা/৬১৮


অষ্টম সূত্র:


হাদিসটি আরেকটি সাহাবী থেকে ভিন্ন আরেকটি সূত্রে বর্ণিত আছে,

أخبرنا أبو المظفر عبد المنعم بن عبد الكريم وأبو القاسم زاهر بن طاهر قالا أنا أبو سعد محمد بن عبد الرحمن أنا أبو سعيد محمد بن بشر بن العباس أنا أبو لبيد محمد بن إدريس نا سويد بن سعيد نا شريك عن سلمة بن كهيل عن الصنابحي عن علي ؓ قال قال رسول الله (ﷺ) أنا مدينة العلم وعلي بابها فمن أراد العلم فليأت باب المدينة

-“হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন, আমি এলেমের শহর হযরত আলী তার দরজা। যে সেই এলেম অর্জনের ইচ্ছা করবে সে ঐ দরজা হয়েই আসবে।” (ইমাম ইবনে আসাকীর, তারিখে ইবনে আসাকির, ৪২/৩৭৮ পৃ:)


সামগ্রীকভাবে এ হাদিসটির মান:


১. মুহাদ্দিস আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন, 

وَسُئِلَ عَنْهُ الْحَافِظُ الْعَسْقَلَانِيُّ فَأَجَابَ بِأَنَّهُ حَسَنٌ لَا صَحِيحٌ كَمَا قَالَ الْحَاكِمُ وَلَا مَوْضُوعٌ.... السُّيُوطِيُّ وَقَالَ الْحَافِظُ أَبُو سَعِيدٍ الْعَلَائِيُّ الصَّوَابُ أَنَّهُ حَسَنٌ بِاعْتِبَارِ طُرُقِهِ لَا صَحِيحٌ وَلَا ضَعِيفٌ

-‘‘শায়খুল ইসলাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) কে এ হাদিসটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তিনি তার জবাবে বলেন, নিশ্চয়ই হাদিসটি “হাসান’’ কিন্তু ‘সহীহ’ নয়। যেমন বলেছেন ইমাম হাকিম (رحمة الله), তিনি বলেছেন হাদিসটি মওদ্বু (জাল) নয়। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله) উলে­খ করেছেন যে হাফেয আবু সাঈদ আ‘লায়ী (رحمة الله) বলেন, যেহেতু হাদিসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে সেহেতু এই হাদিসটি নিশ্চয়ই ‘হাসান’ পর্যায়ের। তাই এটি ‘সহীহ’ও নয়, আবার দ্বঈফ ও নয় অর্থাৎ (হাসান)।’’  ৮

৮. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আল-আসারুল মারফূআহ, ১/১১৮-১১৯ পৃ. হা/৭১


২. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) মিরকাতুল মাফাতীহ কিতাবে উলে­খ করেন, 

لَكِنْ قَالَ الْحَافِظُ أَبُو سَعِيدٍ الْعَلَائِيُّ: الصَّوَابُ أَنَّهُ حَسَنٌ بِاعْتِبَارِ طُرُقِهِ لَا صَحِيحٌ وَلَا ضَعِيفٌ .....وَسُئِلَ الْحَافِظُ الْعَسْقَلَانِيُّ عَنْهُ فَقَالَ: إِنَّهُ حَسَنٌ لَا صَحِيحٌ، كَمَا قَالَ الْحَاكِمُ وَلَا مَوْضُوعٌ 

-‘‘তবে ইমাম হাফেযুল হাদিস, আবূ সাঈদ আ‘লায়ী (رحمة الله) বলেন, সঠিক কথা হলো এ হাদিসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ায় এটি কমপক্ষে ‘হাসান’ স্তরে উপনীত, তাই এটি সহীহও নয় যঈফও নয়।.......শায়খুল ইসলাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) কে উক্ত হাদিস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,  হাদিসটি নিশ্চয়ই ‘হাসান’ পর্যায়ভুক্ত সহীহ পর্যায়ের নয়। ইমাম হাকিম বলেছেন, যে হাদিসটির সনদ মওদ্বু (জাল) নয়।’’ ৯

৯. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাতুল মাফাতীহ : ৯/৩৯৪১ পৃ: হা/৬০৯৬


৩. আল্লামা আজলূনী (رحمة الله) আরও বলেন-

لكن قال في الدرر نقلا عن أبي سعيد العلائي الصواب أنه حسن باعتبار تعدد طرقه لا صحيح، ولا ضعيف، فضلا أن يكون موضوعا

-‘‘তবে ইমাম সুয়ূতি তাঁর “আদ-দুররুল মুতাসিরাহ” আল্লামা আবু সাঈদ আ‘লায়ী (رحمة الله) এর কওল নকল করে বলেন, নিশ্চয়ই উক্ত হাদিসটি ‘হাসান’ পর্যায়ের যেহেতু হাদিসটি একাধিক তরীকায় বর্ণিত হয়েছে, তাই হাদিসটি (সনদের দিক দিয়ে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায়) সহীহও নয়, দ্বঈফও নয়।’’ ১০

১০. আল্লামা আজলূনী : কাশফুল খাফা : ১/১৮৪ : হা/৬১৮


৪. আল্লামা মারঈ ইবনে ইউসুফ মুকাদ্দাসী হাম্বলী (ওফাত. ১০৩৩ হি.) এ হাদিস সম্পর্কে লিখেন-

وَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ الْعَلائِيُّ: إِنَّهُ حَسَنٌ بِاعْتِبَارِ طُرُقِهِ.

-‘‘আল্লামা আবূ সাঈদ আ‘লায়ী (رحمة الله) বলেন, এ হাদিসটি অনেক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে এটির মান ‘হাসান’।’’ (আল-ফাওয়াইদুল মাওদ্বুআত, ১/৯৪ পৃ. হা/৫৭)


৫. আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) উক্ত হাদিস সম্পর্কে বলেন যে, 

حَدِيث أَنا مَدِينَة الْعلم وعَلى بَابهَا فَهُوَ حَدِيث حسن بل قَالَ الْحَاكِم صَحِيح -

-‘‘যেমন হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে “আমি ইলমের শহর আর আলী হল তার দরজা।” উক্ত হাদিসটি ‘হাসান’ বরং ইমাম হাকিম নিশাপুরী  বলেন,  উক্ত হাদিসটি সহীহ।’’ ১১

১১. ইবনে হাজার হায়তামী আল মক্কী : ফাতোয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ : পৃ: ১/১৯২ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।


৬. ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি  বলেন-

وقال الحافظ أبو سعيد العلائي: الصواب أنه حسن باعتبار طرقه لا صحيح ولا ضعيف، فضلا عن أن يكون موضوعا.

-‘‘এ ব্যাপারে হাফিযুল হাদিস ইমাম আবু সাঈদ আ‘লায়ী  বলেন, হাদিসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে ‘হাসান’, তবে সহীহও নয় আবার দ্বঈফও নয়।’’ ১২

১২. ইমাম সুুয়ূতী, আদ্দুরুল মুনতাসিরাহ, ১/৫৭ পৃ. হা/৩৮


৭. আল্লামা তাহের পাটনী (رحمة الله) লিখেন-

فَإِنَّهُ يَنْتَهِي بِطرقِهِ إِلَى دَرَجَة الْحسن فَلَا يكون ضَعِيفا

-‘‘নিশ্চয় এটি অনেক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে ‘হাসান’ স্তরে উন্নিত হয়েছে, তাই তাকে যঈফ বলা যাবে না।’’ (তাহের পাটনী, তাযকিরাতুল মাওদ্বুআত, ৯৫ পৃ.)


৮. আল্লামা মানাভী (رحمة الله) রিখেন-

(حسن)  بِاعْتِبَار طرفه لَا صَحِيح وَلَا ضَعِيف فضلا عَن كَونه مَوْضُوعا وَوهم ابْن الْجَوْزِيّ

-‘‘(হাদিসটির মান ‘হাসান’) হাদিসটি অনেক সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে, তাই এটি সহীহও নয়, যঈফও নয়, এটি জাল নয়, যেমনটি ইমাম ইবনে জাওযী (رحمة الله) ভুল করেছেন।’’ (মানাভী, তাইসীর বিশারহে জামেউস সগীর, ১/৩৭৭ পৃ.)


৯. আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী এ হাদিস সম্পর্কে রিখেন-

بل حسناً لغره، لكثرة طرقه كما بيناه , وله طرق أخرى ذكرها صاحب اللآلىء وغيره

-‘‘(আমি বলবো) বরং এ হাদিসটির মান ‘হাসান লিগাইরিহী’ পর্যায়ের, কেননা এটি অনেক পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে যা আমি ইতোপূর্বে বর্ণনা করে এসেছি, এ হাদিসটির আরও অনেক সূত্র লাআলিল মাসনূআ গ্রন্থাকারসহ আরও অনেকে বর্ণনা করেছেন।’’ (শাওকানী, ফাওয়াইদুল মাজমূআহ, ৩৪৯ পৃ. হা/৫২)


পরিশেষে বলা যায় যে, হাদিসটি মুতাওয়াতির পর্যায়ের নিকটবর্তী, এ ধরনের হাদিসকে অস্বীকার করা কুফরীর ন্যায়। মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসটিকে উড়িয়ে না দেওয়ার পরেও আহলে হাদিস নাসিরুদ্দীন আলবানী এটিকে জাল বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ, ৬/৫১৮ পৃ. হা/২৯৫৫)

প্রমাণিত হল এ হাদিসটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাকে জাল বলা গোমরাহী ছাড়া কিছুই নয়।

 
Top