বিষয় নং-১২: কারও সম্মানে না দাঁড়ানো বিষয়ক হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা:


আমাদের কতিপয় আলেম দাবীদার ভাইগণ কতিপয় অত্যন্ত যঈফ দ্বারা কারও সম্মানে কিয়াম করার নিষেধের পক্ষে দলিল হিসেবে দাঁড় করাতে চান। কিয়ামের বিরোদ্ধে কোনো হাদিসই সহীহ নয়। নিম্নে তাদের পেশকৃত কয়েকটি হাদিসের সনদ পর্যালোচনা তুলে ধরছি।


প্রথম হাদিস:


ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-


حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ نُمَيْرٍ، عَنْ مِسْعَرٍ، عَنْ أَبِي الْعَنْبَسِ، عَنْ أَبِي الْعَدَبَّسِ، عَنْ أَبِي مَرْزُوقٍ، عَنْ أَبِي غَالِبٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، قَالَ: خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَوَكِّئًا عَلَى عَصًا فَقُمْنَا إِلَيْهِ فَقَالَ: لَا تَقُومُوا كَمَا تَقُومُ الْأَعَاجِمُ، يُعَظِّمُ بَعْضُهَا بَعْضًا


-“হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) লাঠিতে ভর করে ঘর হতে বের হলেন। সাহাবীরা তখন দাঁড়িয়ে গেল। নবীজি বললেন, আজমীরা একে অন্যের সম্মানে যেভাবে দাঁড়ায় তোমরা ঐভাবে দাঁড়িও না।” (ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ৪/৩৫৮ পৃ. হা/৫২৩০)। 


এই হাদিস উল্লেখ করে তারা বলে থাকেন, এ হাদিস থেকে বুঝা যায় স্বয়ং রাসূল (ﷺ) এর সম্মানেও দাঁড়াতে নবীজি নিষেধ করেছেন। 


পর্যালোচনা:


উক্ত হাদিসে বলা হয়েছে ‘আজমীরা যেভাবে দাঁড়ায় ঐভাবে দাঁড়িও না’ আজমী হলো অনারবী, সুতরাং তৎকালিন অনারবীদের মত দাঁড়াতে নবীজি নিষেধ করেছেন বরং আরবের অধিবাসীরাদের মত দাঁড়াতে নবীজি নিষেধ করেননি। যদি ঢালাও ভাবে দাঁড়ানো নিষেধ হতো তাহলে আল্লাহর নবী (ﷺ) আজমী বা অনারবীদের কথা উল্লেখ করতেন না। যেমন হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে: “তোমরা নামাজে কুকুরের মত বসিও না”। এই হাদিসের অর্থ এ নয় যে, নামাজে বসা নিষেধ, বরং এর অর্থ হবে কুকুর যেভাবে বসে নামাজে ঐভাবে বসবেনা। ঢালাও ভাবে বসা নিষেধ নয়। আজমীরা সাধারণত কুনুশ ধরে অর্থাৎ হিন্দুরা যেমন মূর্তির সামনে মাথা নত করে হাত জোড় করে দাঁড়ায়, আজমীরা ঐভাবে দাঁড়াতেন। তাই নবী পাক (ﷺ) ঐভাবে দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন। 


সনদ পর্যালোচনা:


হিজরী অষ্টম শতাব্দির মুজাদ্দিদ, সহীহ বুখারী শরীফের তিনজন ব্যাখ্যাকার, আল্লামা হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) ও ইমাম বদরুদ্দিন আইনী (رحمة الله) এবং ইমাম কাস্তাল্লানী (رحمة الله) এই হাদিস সম্পর্কে উল্লেখ করেন-


قَالَ الطَّبَرِيّ: هَذَا حَدِيث ضَعِيف مُضْطَرب السَّنَد فِيهِ من لَا يعرف،


-“ইমাম আবু জাফর তাবারী (رحمة الله) বলেন, এই হাদিস যঈফ ও মুজত্বারিব এর সনদে এমন অপরিচিত লোক রয়েছে যাদেরকে আমরা চিনি না।” 

(ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ১১তম খণ্ড, ৫৪ পৃ:; ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী, ১৫তম খণ্ড; ইমাম কাস্তালানী: ইরশাদুস সারী, ৯ম খণ্ড, ১৫৩ পৃ:)


স্বয়ং নাসিরুদ্দিন আলবানী তদীয় ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ’ কিতাবের ৩৪৬ নং হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন: وفي إسناده اضطراب وضعف وجهالة، -

“এই হাদিসের সনদ মুজতারিব, যঈফ ও জেহালতপূর্ণ।” 

এই হাদিসের সনদে ৩ জন রাবী সমস্যা। প্রথমত. ‘আবুল আদবাস’ মাজহুল বা অপরিচিত। দ্বিতীয়ত: ‘আবু মারজুক’ দুর্বল রাবী। তৃতীয়ত. ‘আবু গালিব’ মুজত্বারিব ও দুর্বল রাবী। 


‘আবুল আদব্বাস’ এর মূল নাম হল ‘তুবাঈ ইবনে সুলাইমান’। আহলে হাদিসদের নাসিরুদ্দিন আলবানী ‘আবু আদব্বাস’ সম্পর্কে বলেছেন,


وأبو العدبس مجهول كما في الميزان للذهبي و التقريب لابن حجر


-“আবুল আদব্বাস’ অপরিচিত রাবী, যেমনটি যাহাবীর ‘মিযান’ গ্রন্থে ও ইবনে হাজার আসকালানী এর ‘তাকরীব’ গ্রন্থে রয়েছে। ইমাম যাহাবী (رحمة الله) ‘আবুল আদব্বাছ’ সম্পর্কে বলেন: لا يعرف -“তাকে চিনি না।” (ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ৬৭০)


আরেকজন রাবী হল ‘আবু মারজুক তাজিবী’ সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন:قال ابن حبان: لا يجوز الاحتجاج بما انفرد به. -“ইবনে হিব্বান (رحمة الله) বলেন: ‘আবু মারজুক’ এর একক বর্ণনা গ্রহণ করা জায়েয নেই। 

(ইমাম যাহাবী: মিযানুল ই’তিদাল, রাবী নং ১০৫৯১; ইমাম যাহাবী: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ৪র্থ খণ্ড, ৩৯৬ পৃ:)


এর সনদে আরেকজন রাবী হল ‘আবু গালিব’। তার ব্যাপারে একদল ইমাম সমালোচনা করেছেন। যেমন লক্ষ্য করুন:- 


وفي إسناده أبو غالب واسمه حزوّر وفيه مقال، -“এর সনদে ‘আবু গালিব’ রয়েছে, তার নাম ‘হাজাওয়ার’ এবং তার ব্যাপারে প্রচুর সমালোচনা রয়েছে।” 

(হাছান ইবনে আহমদ সান‘আনী: ফাতহুল গাফ্ফার জামেউ লি’আহকামিল সুন্নাতি নাবিইনা আল মুখতার, ৬৩৫৫ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)


ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার ব্যাপারে বলেন-


ضعفه النسائي وقال ابن حبان: لا يحتج به.


-“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) বলেছেন: তার হাদিস দলিলযোগ্য না। ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) তাকে যঈফ বলেছেন।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল ই‘তিদাল, রাবী নং ১৭৯৯)


ইমাম আবু হাতিম (رحمة الله) তাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। (হাফিজ ইবনে কাসির: তাকমীল ফি জারহু ওয়া তা‘আদীল, রাবী নং ২৩০১)


ইমাম ইবনে সাদ (رحمة الله) তাকে ‘মুনকারুল হাদিস’ বলেছেন। (ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৭৫৬১)


ইমাম যাহাবী (رحمة الله) অন্যত্র তার ব্যাপারে বলেছেন: قال ابن حبان: لا يحتج به. -“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) বলেছেন: তার উপর নির্ভর করা যাবে না।” 

(ইমাম যাহাবী: দিওয়ানুদ দোয়াফা, রাবী নং ৮৭৫) 


মুসনাদে আহমদ নামক হাদিস গ্রন্থের তাহকীককারী শায়খ শুয়াইব আরনাউত লিখেন- إسناده ضعيف جداً -‘‘এ সনদটি অত্যন্ত যঈফ।’’ (তাহকীক মুসনাদে আহমদ, ৩৬/৫১৬ পৃ. হা/২২১৮১, মুয়াস্সাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবানন।)


অতএব, কিয়ামকে নিষিদ্ধ প্রমাণের জন্য এই হাদিস দলিল দেওয়ার উপযুক্ত নয়। সর্বোপরি ইহা সহীহ্ হাদিসের বিপরীত বা খেলাফ। এবার এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম হাফিজ ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله) উল্লেখ করেন:


وليس المراد به نهي الرجل عن القيام لأخيه إذا سلم عليه 


-“কোন ব্যক্তি তার ভাইকে সালাম দেওয়ার জন্যে দাঁড়াবে এই হাদিসে এরূপ নিষেধ করা হয়নি।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ১১তম খণ্ড, ৫৪ পৃ:)


অথচ সহীহ হাদিসে এসেছে, ইমাম নাসাঈ (رحمة الله)সহ এক জামাত ইমামগণ সংকলন করেন-


حَدَّثَنَا هَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، حَدَّثَنَا أَبُو عَامِرٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ هِلَالٍ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَاهُ، يُحَدِّثُ عن أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْلِسُ مَعَنَا فِي الْمَسْجِدِ يُحَدِّثُنَا فَإِذَا قَامَ قُمْنَا قِيَامًا حَتَّى نَرَاهُ قد دخل بعض بيُوت أَزوَاجه


-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, আমরা নবী করিম (ﷺ) এর সাথে বসে মসজিদে আলোচনা করতাম। যখন নবী (ﷺ) কোন প্রয়োজনে দাঁড়াতেন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাইতাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ না করতেন ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম।” 

(সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ৪৭৭৫; সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং ৪৭৭৬; ইমাম নাসাঈ: সুনানুল কুবরা, হাদিস নং ৬৯৫২; ইমাম বায়হাক্বী: আল-মাদখাল, হা/৭১৭; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াইবুল ঈমান, হাদিস নং ৮৫৩১; ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী, ১১তম খণ্ড, ৫৫ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৪০৩ পৃ: হাদিস নং ৪৭০৫; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত, ৮ম খণ্ড, ৫১৪ পৃ:; জামেউল উছুল, হাদিস নং ৮৮২৯; তুহফাতুল আশরাফ, হাদিস নং ১৪৮০১; জামেউল ফাওয়াইদ, হাদিস নং ৮৪১৬; শরফুল মুস্তফা, ৪র্থ খণ্ড, ৫২০ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৭ম খণ্ড, ২৫ পৃ:; জামেউল অছাইল ফি শরহে শামাঈল, ২য় খণ্ড, ১৩৬ পৃ:) সহীহ্ হাদিস।


এই হাদিস সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা কারী হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। সুতরাং নবী পাকের সাহাবীগণ সমষ্ঠিগত ভাবে নবীজির তাজিমে আদবের সাথে দাঁড়াতেন কিন্তু আল্লাহর নবী (ﷺ) নিষেধ করতেন না। সর্বোপরি সহীহ্ হাদিস এর মোকাবেলায় যঈফ হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। আপনাদের উল্লিখিত হাদিস খানা যঈফ ও মুজতারিব, তাছাড়া ঐ হাদিস আজমীদের মত দাঁড়াতে নিষেধ করে কিন্তু আদবের সাথে দাঁড়াতে নিষেধ করে না। 


যেমন আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) উল্লেখ করেন:


 وأجاب عنه بن قتيبة بأن معناه من أراد أن يقوم الرجال على رأسه كما يقام بين يدي ملوك الأعاجم وليس المراد به نهي الرجل عن القيام لأخيه إذا سلم عليه


-“আল্লামা ইবনে কুতাইবাহ (رحمة الله) আবু উমামা (رضي الله عنه) এর হাদিসের জবাবে বলেন: অনারবীরা তাদের বাদশার সামনে যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ঐভাবে দাঁড়ানো নিষেধ করা হয়েছে। এর দ্বারা এরূপ অর্থ হবে না যে, তার ভাইকে সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে না।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: ফাতহুল বারী শরহে বূখারী, ১১তম খণ্ড, ৫৪ পৃ:)। 


সর্বোপরি আমাদের উল্লেখিত হাদিস খানা সহীহ্। তাই যঈফ হাদিস বাদ দিয়ে সহীহ্ হাদিসের উপর আমল করা উচিৎ নয় কি?


কিয়ামের বিপরীতে দ্বিতীয় হাদিসের পর্যালোচনা:


ইমাম তিরমিযি (رحمة الله)সহ আরও কতিপয় ইমাম সংকলন করেন-


حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ: أَخْبَرَنَا عَفَّانُ قَالَ: أَخْبَرَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ، عَنْ حُمَيْدٍ، عَن أنس بن مَالك قَالَ: لَمْ يَكُنْ شَخْصٌ أَحَبَّ إِلَيْهِمْ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانُوا إِذَا رَأَوْهُ لَمْ يَقُومُوا لِمَا يَعْلَمُونَ مِنْ كَرَاهِيَتِهِ لِذَلِكَ.


-“হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবীদের মাঝে নবীজির চাইতে অধিক মহব্বতের কিছুই ছিল না, অথচ তাঁরা কেউ নবীজিকে দেখলে দাঁড়াতেন না।” (ইমাম তিরমিজি, আস-সুনান, ৪/৩৮৭ পৃ. হা/২৭৫৪, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ৩/১৩৩১ পৃ. হা/৪৬৯৮, ইমাম বাগভী, শরহে সুন্নাহ, হা/৩৩২৯)। 

এই হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, নবী পাক (ﷺ) এর সম্মানে দাঁড়ানো নিষেধ। 


সনদ পর্যালোচনা:


প্রথমত. এই হাদিস কিয়ামের পক্ষে অসংখ্য সহীহ্ হাদিসের মুখালেফ। 


দ্বিতীয়ত. এই রাবী ‘হুমাইদ’ যদিও সিক্বাহ কিন্তু তার উপর ‘তাদলিস’ এর প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। যেমন হুমাইদ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেছেন-


حميد الطويل صاحب أنس مشهور كثير التدليس عنه


-“হুমাইদ তাবীল’ হযরত আনাস (رضي الله عنه) এর সংগী ছিলেন এবং তিনি আনাস থেকে প্রচুর তাদলিছ করার বিষয়ে প্রসিদ্ধ ছিল।” (ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, তাবকাতুল মুদাল্লিস, রাবী: ৭১)


‘হুমাইদ’ সম্পর্কে ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) বলেছেন-


ذكره غير واحد من المدلسين


একাধিক ইমাম তাকে তাদলিসকারীর আওতাভ‚ক্ত করেছেন।” (ইমাম সুয়ূতি: আসমাউল মুদাল্লিছিন, রাবী নং ১৪)


ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) তাকে المدلسين মুদাল্লিসিন এর অন্তর্ভূক্ত করেছেন। (ইমাম নাসাঈ: জিকরু মুদাল্লিসিন, রাবী নং ৩) 

তাই তিনি যেহেতু এ হাদিসে তাদলীস করেছেন তাই এ হাদিসকে হুজ্জাত হিসেবে দাঁড় করানো যাবে না।


তৃতীয়ত. এ হাদিসের আরেকজন বর্ণনাকারী ‘হাম্মাদ ইবনে সালামা’ যদিও কেউ কেউ তাকে সিক্বাহ বলেছেন কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত তার শেষ বয়সে স্মৃতি বিকৃতি ঘটেছিল। ইমামগণ তার বর্ণনাকে ত্রুটিযুক্ত বলেছেন। 


যেমন তার সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন: وكان ثقه، له أوهام، -“সে বিশ্বস্ত কিন্তু তার বর্ণিত হাদিসে ক্রুটি রয়েছে।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল ইতিদাল, রাবী নং ২২৫১)


যেমন বিখ্যাত আসমউর রিজালবিদ ও হাদিসের ইমাম, ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) ‘হাম্মাদ বিন সালামা’ -এর জীবনীতে লিখেন- كَانَ يخطىء-‘‘তিনি হাদিসে ভুল করতেন।’’  ৪৬

➥৪৬. ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস-সিকাত, ৬/২১৬ পৃঃ হা/৭৪৩৪, ইমাম মিয্যী, তাহযিবুল কামাল, ৭/২৬৭পৃঃ ক্রমিক-


তিনি আরও উল্লেখ করেন- قد كثر من تغير حفظه -‘‘তিনি স্মৃতি শক্তিতে অনেক দুর্বল ছিলেন।’’ ৪৭

➥৪৭. ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস-সিকাত, ৬/২১৬ পৃঃ হা/৭৪৩৪


ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন-


وقال البيهقي هو أحد أئمة المسلمين إلا أنه لما كبر ساء حفظه فلذا تركه البخاري وأما مسلم فاجتهد


-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বলেন, তিনি মুসলমানদের আইম্মাদের একজন হলেও বৃদ্ধ বয়সে তার স্মরণশক্তি ত্রুটি পাওয়া যায়। এজন্য ইমাম বুখারী (رحمة الله) তার হাদিস পরিত্যাগ করেছেন তবে ইমাম মুসলিম (رحمة الله) তার হাদিস (নেয়া যাবে কিনা) নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন।’’ ৪৮

➥৪৮. ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযিবুত-তাহযিব, ৩/১৪ পৃঃ ক্রমিক-১৪


ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) আরও উল্লেখ করেন-


قال أبو دواد: وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كِتَابٌ إِلا كِتَابَ قَيْسِ بْنِ سَعْدٍ الْمَكِّيِّ، يَعْنِي كَانَ حَافِظًا يَرْوِي مِنْ حِفْظِهِ.


-‘‘ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) বলেন, কায়েস ইবনে সা‘দ মাক্কী এর পান্ডুলিপি ব্যতিত তার অন্য  কোন পান্ডুুলিপি নেই, এর অর্থ হল তিনি ঐ পান্ডুলিপির হাফেজ ছিলেন।’’৪৯

➥৪৯. যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, ৪/৩৪২ পৃঃ


ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন-


وقال يحيى القطان: حماد بن سلمة، عن زياد الاعلم. وقيس بن سعد ليس بذاك.


-‘‘ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে কাত্তান (رحمة الله) বলেন, হাম্মাদ বিন সালামা  তিনি যিয়াদ থেকে এবং কায়েস বিন সা‘দ (رحمة الله) থেকে যে হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন তা কিছুই নয়।’’  ৫০

➥৫০. যাহাবী, মিযানুল ই‘তিদাল, ১/৫৯২ পৃঃ ক্রমিক-২২৫১


যাহাবী তার আরেকটি গ্রন্থে লিখেছেন-


قلت هو ثقة صدوق يغلط وليس في قوة


-‘‘আমি বলি যদিও তিনি সিকাহ ও বিশ্বস্ত তবে তিনি হাদিসে ভুল করতেন এবং তিনি হাদিসে তেমন শক্তিশালী নন।’’  ৫১

➥৫১. যাহাবী, কাশেফ, ১/৩৪৯ পৃঃ ক্রমিক/১২২০


এজন্যই ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেছেন- وتغير حفظه بأخرة -‘‘তার শেষ বয়সে স্মৃতি শক্তিতে দুর্বল ছিল।’’ (ইবনে হাজার, তাক্বরীবুত তাহযিব, ১৭৮ পৃ. ক্রমিক.১৪৯৯) 


এ হাদিসের চতুর্থ অভিযোগ: এ হাদিসের সমালোচিত রাবী ‘হাম্মাদ বিন সালামা’ সনদটি তাদলীস করে (عَنْ) ‘আন ‘আন করে বর্ণনা করেছেন।


অতএব, কিয়ামের পক্ষে যে সকল শক্তিশালী রেওয়াত রয়েছে সে সকল রেওয়াতের মোকাবেলায় এই হাদিস কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা সহীহ্ হাদিসে উল্লেখ আছে:


حَدَّثَنَا هَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، حَدَّثَنَا أَبُو عَامِرٍ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ هِلَالٍ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَاهُ، يُحَدِّثُ عن أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْلِسُ مَعَنَا فِي الْمَسْجِدِ يُحَدِّثُنَا فَإِذَا قَامَ قُمْنَا قِيَامًا حَتَّى نَرَاهُ قد دخل بعض بيُوت أَزوَاجه


-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, আমরা নবী করিম (ﷺ) এর সাথে বসে মসজিদে আলোচনা করতাম। যখন নবী (ﷺ) কোন প্রয়োজনে দাঁড়াতেন আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাইতাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ না করতেন ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম।”  ৫২

এ হাদিসটির মান সহীহ।

➥৫২. সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ৪৭৭৫; সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং ৪৭৭৬; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৬৯৫২; ইমাম বায়হাক্বী: আল মাদখাল, হাদিস নং ৭১৭; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াইবুল ঈমান, হাদিস নং ৮৫৩১; ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী, ১১তম খণ্ড, ৫৫ পৃ:; মেসকাত শরীফ, ৪০৩ পৃ: হাদিস নং ৪৭০৫; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত, ৮ম খণ্ড, ৫১৪ পৃ:; জামেউল উছুল, হাদিস নং ৮৮২৯; তুহফাতুল আশরাফ, হাদিস নং ১৪৮০১; জামেউল ফাওয়াইদ, হাদিস নং ৮৪১৬; শরফুল মুস্তফা, ৪র্থ খণ্ড, ৫২০ পৃ:; ইমাম ইবনে ছালেহী: সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৭ম খণ্ড, ২৫ পৃ:; জামেউল অছাইল ফি শরহে শামাঈল, ২য় খণ্ড, ১৩৬ পৃ:


এ বিষয়ে আরেক হাদিসে আছে,


حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ، قَالَ: أَخْبَرَنَا إِسْرَائِيلُ، عَنْ مَيْسَرَةَ بْنِ حَبِيبٍ، عَنِ الْمِنْهَالِ بْنِ عَمْرٍو، عَنْ عَائِشَةَ بِنْتِ طَلْحَةَ، عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِينَ، قَالَتْ: مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَشْبَهَ سَمْتًا وَدَلًّا وَهَدْيًا بِرَسُولِ اللهِ فِي قِيَامِهَا وَقُعُودِهَا مِنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَتْ: وَكَانَتْ إِذَا دَخَلَتْ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَامَ إِلَيْهَا فَقَبَّلَهَا وَأَجْلَسَهَا فِي مَجْلِسِهِ، وَكَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ عَلَيْهَا قَامَتْ مِنْ مَجْلِسِهَا فَقَبَّلَتْهُ وَأَجْلَسَتْهُ فِي مَجْلِسِهَا،


-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, আচার-আচরণে, চাল-চলনে এবং মহৎ চরিত্রে অপর রেওয়াতে আছে আলাপ-আলোচনায় ও কথা-বার্তায় ফাতেমা (رضي الله عنه) অপেক্ষা অন্য কাউকে আমি রাসূল (ﷺ) এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ দেখিনি। ফাতেমা (رضي الله عنه) যখন নবী পাকের কাছে আসতেন তখন নবী পাক (ﷺ) দাঁড়িয়ে তাঁর হাঁত ধরে চুমু খেতেন ও স্বীয় আসনে বসাতেন। আবার যখন রাসূল (ﷺ) ফাতেমার কাছে যেতেন তখন ফাতেমা (رضي الله عنه) দাঁড়িয়ে নবীজির হাঁতে চুমু খেতেন ও স্বীয় আসনে বসাতেন।” 

(জা’মে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৭২; সুনানে আবী দাউদ, হাদিস নং ৫২১৭; ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৯১৯৩; ছহীহ্ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৬৯৫৩; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ৭৭১৫; মেসকাত শরীফ, ৪০২ পৃ: হাদিস নং ৪৬৮৯; আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৮ম খণ্ড, ৫০৪ পৃ:)


ইমাম তিরমিজি (رحمة الله) বলেন: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ -“এই হাদিস হাসান সহীহ্।” ইমাম হাকেম (رحمة الله) ও ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ الشَّيْخَيْنِ -“এই হাদিস বুখারী-মুসলীসের শর্ত অনুযায়ী সহীহ্।”


উক্ত হাদিসে উল্লেখ রয়েছে সাহাবীরা কেউ দাঁড়াতেন না অথচ একাধিক সহীহ্ রেওয়ায়েতে প্রমাণ আছে সাহাবায়ে কিরাম নবী পাক (ﷺ) এর সম্মানে দাঁড়িয়েছেন। আর আমাদের উল্লিখিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় নবীজির সম্মানে সাহাবীরা দাঁড়িয়েছেন। এতেই বুঝা যাচ্ছে আনাস (رضي الله عنه) থেকে কিয়ামের বিপরীত বর্ণিত হাদিসটিতে ‘তাদলিস’ হয়েছে। উছুলে হাদিসের আইন হলো: যদি একই ব্যাপারে ‘হ্যাঁ বোধক’ এবং ‘না বোধক’ হাদিস থাকে, তখন ‘হ্যাঁ বোধক’ হাদিসের উপর আমল করতে হবে। ‘না বোধক’ হাদিস খানা ‘হ্যাঁ বোধক’ হাদিস দ্বারা মানসুখ বা রহিত প্রমাণিত হবে। তাছাড়া হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদিসখানা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ গ্রহণ করতে হবে। 


যেমন এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) উল্লেখ করেন,


وَقَدْ رَوَى الْبَيْهَقِيُّ فِي شُعَبِ الْإِيمَانِ عَنِ الْخَطَّابِيِّ فِي مَعْنَى الْحَدِيثِ، هُوَ أَنْ يَأْمُرَهُمْ بِذَلِكَ وَيُلْزِمَهُمْ إِيَّاهُ عَلَى مَذْهَبِ الْكِبْرِ وَالْفَخْرِ.    


-“ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) ইমাম খাত্তাবী (رحمة الله) থেকে তাঁর শুয়াঈবুল ঈমান-এ বর্ণনা করেন, এই হাদিসের অর্থ হচ্ছে, নবী করিম (ﷺ) গৌরব ও অহংকারের জন্যে দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন।” 

(মেসকাত শরীফ, ৪০৩ পৃ: হাশিয়া; ইমাম মোল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৮ম খণ্ড, ৫১১ পৃ:; ইমাম বায়হাক্বী: শুয়াইবুল ঈমান, ৮৫৩৮ নং হাদিসের শেষের দিকেفَصْلٌ فِيمَنْ كَرِهَ الْقِيَامَ لَهُ تَوَرُّعًا مَخَافَةَ الْكِبْرِ)।


হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) উল্লেখ করেন:

 
Top