প্রশ্নঃ ইয়াজিদ কী ফাসিক, মুনাফিক নাকি কাফির?

----------------------------------------------------------

উত্তরঃ ✍ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী 

টিকা সম্পাদনাঃ✍ মাসুম বিল্লাহ সানি 


▪ ইমাম আজম আবু হানিফা তাকে ফাসিক বলেছেন, যেহেতু সে গোনাহ করে গোনাহের ওপর অনুতপ্ত ছিল না। প্রকাশ্যে পাপাচার করত। 

▪ কেউ বা আবার তাকে মুনাফিক বলেছেন, যেহেতু সে ইমান এনেও নবীর নাতিকে শহীদ করেছিল, নামাজও পড়ত আবার নবুয়াত অস্বীকারও করত।  

▪ আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহঃ তাকে কাফির বলেছেন, কারন সে সরাসরি নবুয়াত অস্বীকার করেছে। 

▪ তাই আমার মতে সে একাধারে ফাসিক, মুনাফিক এবং কাফির। 


এখন আসুন কেন আমি তাকে কাফির বলছি তার দলিল কী? 


প্রিয় পাঠকবৃন্দ! নিচে ইয়াজিদ রচিত কবিতাটি পড়ুন যা সে ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) এঁর শির মুবারক সামনে নিয়ে গেয়েছিলঃ বিশেষ করে সর্বশেষ লাইনটি পড়ুন আর আপনিই বলুন সে কী কাফির ছিল না মুসলিমঃ  


ليت أشياخي ببدر شهدوا *** جزع الخزرج من وقع الأسل

لأهلّوا واستهلـوا فرحا *** ثم قالوا يـا يـزيـد لا تشـل

قتلنا القرم من ساداتهم *** و عـدلناه ميل بدر فــاعـتـدل 

قد اخذنا من علي ثارنا *** وقتلنا الفارس الليث البطل

 لست من خندف إن لم انتقم *** من بني أحمد ما كان فعل

لعبت هاشم بالملك فلا *** خبر جـاء و لا وحــي نزل 


ইমাম হোসাইনের (رضي الله عنه) মাথা মুবারক দামেস্কে আসার পর সারা রাত ইয়াজিদ মদ্য পান করে সকালে দরবারে উপস্থিত, মাতাল অবস্থায় মনের আসল কথা ও ঘৃনা প্রকাশ পায়, ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) এঁর শির মুবারক সামনে নিয়ে সে বলছে,


▪“বদর যুদ্ধে (আলী ও হামজা (رضي الله عنه) কর্তৃক হত্যা কৃত) আমার মুরুব্বিরা যদি আজকের এই দৃশ্য দেখত, 

তাহলে তারা খুশি হয়ে বলত হে ইয়াজিদ! তুই চালিয়ে যা, কখনো স্তব্ধ হয়োনা।

আমি প্রতিশোধ স্বরুপ তাদের (রাসূল বংশের) বড় বড় ব্যক্তিদের হত্যা করেছি আর বদর যুদ্ধের বদলা নিয়েছি। (টিকা ১)

বিশেষ করে আমি আলী থেকে বদলা নিয়ছি আর তার বাহাদুর সন্তানদের হত্যা করেছি। (টিকা ২)

▪ আমি (আমার দাদী) খিন্দফ এর ঔরসজাত নই যদি না আমি আহমদের আওলাদ থেকে বদলা না নিই, মোহাম্মদ আমাদের (পূর্বপুরুষদের) সাথে যা করেছে (বদর ও অন্য যুদ্ধে)। (টিকা ৩)

▪ আসলে বনী হাশিম [মোহাম্মদ (ﷺ) এর বংশ] আমাদের রাজত্ব কেড়ে নেয়ার জন্য নাটক করেছিল, 

▪ সে [মোহাম্মদ (ﷺ)] কোনো নবী ছিলনা আর কোন কিতাব ও ওহীও নাজিল হয় নাই(টিকা ৪)। (নাউযুবিল্লাহ)  


তথ্যসূত্রঃ 

ذكر الطبري في تاريخه 8/18

العواصم من القواصم: 232.

(2) تاريخ الطبري 10 / 60.

১. তারিখে ইবনে জারির তাবারি, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-১৮

২. তারিখে ইবনে জারির তাবারি, ১০ ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৬০

৩.আল আওয়াসিমু মিনাল কাওয়াসিম,পৃষ্ঠা নং ২৩২.


ইয়াযিদ সম্পর্কে আলিমগণের অভিমত পর্যালােচনা (ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ | আব্দুল্লাহ যােবায়ের) 


ইয়াযিদের ফাসিক হবার ব্যাপারে আলিমগণ একমত পােষণ করেছেন। অল্প কয়েকজন আলিম এক্ষেত্রে ভিন্নমত দিয়েছেন। ইয়াযিদের ব্যাপারে আলিমগণের মতপার্থক্য প্রথমত দু'ভাগে ভাগ করা যায় : 


১. ইয়াযিদকে কাফির বলা প্রসঙ্গে 


ক. ইয়াযিদ কাফির ইয়াযিদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে তাকে সরাসরি কাফের বলেছেন ইবন আকিল ও আল্লামা আলুসি (رحمة الله)। 


◼ তাফসিরে রুহুল মা'আনীতে আল্লামা আলুসি (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন, ইয়াযিদের কাছে যখন হুসাইন (رضي الله عنه) সহ শহিদগণের শিরগুলাে বর্শায় বিদ্ধ করে নিয়ে আসা হলাে, তখন সে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল। যার শেষ পঙক্তি ছিল নিম্নরূপ : 

قل أو لا تقل + قير افتضيت من الرسول یونی 

تعب الغراب فقل 

কাক ডাকল কা-কা করে বললাম, তুমি বলাে আর নাই বলাে, 

আমি তাে রসুলের কাছ থেকে আমার পাওনা আদায় করে নিয়েছি। 


◼ আল্লামা আলুসি (رحمة الله) এরপর বলেন, 

يغني أنه قتل بمن قتله رسول الله صلى الله تعالى عليه وسلم يوم بذر گجه به وخاله ولد عتبة وغيرهما وهذا كفر صريح فإذا صح عنه فقد كفر به  

“ইয়াযিদ বুঝাতে চেয়েছে, বদরের দিন রসুলুল্লাহ (ﷺ)এর (সাথে যুদ্ধ করতে এসে) তার (বাবার) নানা উতবা ও উতবার ছেলে তার (বাবার) মামা ও অন্যরা নিহত হয়েছিল। তাদের হত্যার বদলায় সে এ হত্যা করেছে। এটা স্পষ্ট কুফরি । এটা সত্যি হলে সে কুফরি করেছে। 


◼ আল্লামা আলুসি (رحمة الله) আরও বলেছেনঃ

 

الذي يغلب على ظني أن الخبيث لم يكن مصيرقا برسالة النبي صلى 

عليه وسله وأن مجموع ما فعل مع أهل حرم الله تعالى 

الله تعالى وأهل خرم تبنيه عليه الصلاة والسلام وعثريه الطيبين الطاهرين في الحياة وبعد الممات وما صدر منه من المخازي ليست بأضعف دلالة 

على عدم تصديقه من إلقاء ورقة من المصحف الشريف في قذر، ولا أظن أن أمره كان خافيا على أجلة المسلمين إذ ذاك ولكن كانوا مغلوبين مقهورين لم يسعهم إلا الصبر إيقضي الله أمرا كان مفعولا، ولو سلم أن الخبيث گان مسلما فهو مستلم جمع من الكبائر ما لا يحيط به نطاق البيان، وأنا أذهب إلى جواز لعن مثله على الغيين ولو لم يتصور أن يكون له مثل من الفاسقين، والظاهر أنه لم يثب، واختمال توبته أضعف من إيمانه، ويلحق به ابن زیاد وابن ستعد وجماعة لعنة الله ع وجل عليهم أجمعين، وعلى أنصارهم وأعوانهم وشيعتهم ومن مال إليهم إلى يوم الديني ما دمعت عين 

عبد الله الحسین 

على أبي 

▪‘আমার নিশ্চিত ধারণা এই খবিস ইয়াযিদ আসলে মহানবি (ﷺ) এর রিসালাতেই বিশ্বাস করত না। 

আল্লাহর হারাম অর্থাৎ মক্কার এবং তার নবি (ﷺ)এর হারাম অর্থাৎ মদিনার অধিবাসীদের সাথে, মহানবি (ﷺ)এর পবিত্র ও সম্মানিত পরিবারবর্গের সাথে জীবিত ও মৃত অবস্থায় সে যে আচরণ করেছে এবং তার ভেতর থেকে যেসব অবমাননাকর কার্যকলাপ প্রকাশিত হয়েছে, এগুলাে তার ইমানহীনতার বড় প্রমাণ। 

[তার উদাহরণ সেই ব্যক্তির মতাে, যে] 

পবিত্র কুরআনের পাতা আবর্জনার ভেতর ছুড়ে ফেলে। তার কর্মকাণ্ড তৎকালীন মুসলিমদের কাছে অজ্ঞাত ছিল তাও আমার মনে হয় না। কিন্তু তারা পরাভূত ও পরাক্রান্ত অবস্থায় ছিল। ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের আর কিছু করার সামর্থ্য ছিল না, যাতে যা হবার, আল্লাহ সেটা করে ফেলেন। এটা যদিও মেনে নেয়া হয় যে, এই খবিসটি মুসলমান ছিল, তবে বলতে হবে সে ছিল এমন মুসলমান, যার ভেতরে জায়গা করে নেয়া কবিরা গুনাহগুলাের কথা বলে শেষ করা যায় না। আমার মতে, এমন ফাসিককে নির্দিষ্ট করে লানত দেয়া জায়েয । অবশ্য এমন ফাসেক যে কেউ হতে পারে, তা কল্পনাতেও আসে না। স্পষ্টত সে তাওবা করেনি। তার তাওবার সম্ভাবনা তার ইমানের সম্ভাবনার চেয়েও ক্ষীণ। তার সাথে ইবন যিয়াদ, ইবন সাদ ও একটি দল রয়েছে। এদের সবার উপর মহান আল্লাহর লানত । যারা তাদের মদদদাতা সহায়তাকারী, যারা তাদের সমর্থক, যারা তাদের প্রতি আকৃষ্ট, কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহর লানত, ততদিন পর্যন্ত লানত, যতদিন একটি চোখ হলেও আবু আব্দুল্লাহ আল হুসাইন (رضي الله عنه)র জন্য অশ্রু ঝরাবে।' 

(আল্লামা মাহমুদ আলুসি, রুহুল মাআনি ফি তাফসিরিল কুরআনির আযিম, বৈরুত: দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, তাবি, খ, ২৬, পৃ. ৭৩) । 


◼ আল্লামা আলুসি (رحمة الله) অন্যত্র বলেছেন, আর শিয়াদের হেয় করার জন্য ইয়াজিদের পক্ষ নেয়া মূর্খতা। কেবল কোনাে বেদআতির পক্ষেই ইয়াযিদকে ভালােবাসা ও তাকে সম্মানিত করা সম্ভব । ইয়াযিদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এমনই যে তার ভক্তরাও ইমানহীন হতে বাধ্য। ইবন আসাকির আদ দিমাশকি এমত শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, ইয়াযিদের সামনে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শির মােবারক রাখার পর সে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেছিল, 

ليت أشياخي يبذر شهدوا + جزع الخزرج في وقع الأسل 

لعبت هاشم بالملك فلا + ملك جاء ولا وحي نزل 

বদরে নিহত হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি দেখত 

বর্ষাবৃষ্টির সময় খাযরাজদের আতঙ্ক। হাশেমিরা রাজত্ব নিয়ে খেলাধুলা করেছে; কোন ফেরেশতা আসেনি, কোন ওহিও নাযিল হয়নি।' 


◼ ইবন আসাকির (رحمة الله) এরপর বলেছেন, 

فإن صحت عنه فهو كافر بلا ريب 

‘সে যদি সত্যিই একথা বলে থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে কাফির। 

(ইবনুল ইমাদ আল হাম্বলি, শাযারাতুয যাহাবি ফি আখবারি মান যাহাব, বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ২০১২ খ্রি., খ. ১, পৃ. ১৪৩) 


◼ আল্লামা ইয়াফেঈ (رحمة الله) বলেছেন, 

وأما حكم من قتل الحسين أو أمر بقتله ممن استحل ذلك فهو كافر وإن لم يستحل فهو فاسق فاجر 

 

‘যে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করেছে অথবা তাঁকে হত্যার আদেশ দিয়েছে, তার ক্ষেত্রে হুকম হলাে সে এটা হালাল মনে করলে কাফির এবং যদি হালাল মনে না করে থাকে, তবে ফাসিক ও পাপিষ্ঠ।

(ইমাম আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবন আসআদ আল ইয়াফেঈ, মিরআতুল জিনান ওয়া ইবরাতুল ইয়াকজান ফি মারিফাতি মা ইউতাবারু মিন হাওয়াদিস্যি যামান, বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৭ খ্রি., খ, ১, পৃ. ১১০) 

 
Top