✧ তাফসীর, তাবল ও তাহরীফের মধ্যে পার্থক্য 


একটি হচ্ছে কুরআনের তাফসীর, আর একটি হচ্ছে তাবীল ও ৩য়টি হচ্ছে কুরআনের তাহরীফ। এ তিনটির ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা ও পৃথক পৃথক বিধান রয়েছে। মনগড়া তাফসীর করা হারাম। এর জন্য ঐতিহ্যের (রিওয়ায়েত কৃত তথ্যাদি) প্রয়োজন। নিজ বিদ্যাবুদ্ধি বলে কুরআনের বৈধ তাবীল করা জায়েয ও ছওয়াবের কাজ। কুরআনের তাহরীফ অর্থাৎ মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান কুফরী।


(১) তাফসীরঃ 


তফসীর হচ্ছে ঐতিহ্যের সাহায্যে কুরআনের ওই সব বিষয় বর্ণনা করা, যেগুলো জ্ঞানের সাহায্যে বোধগম্য হয় না। যেমন আয়াতের শানে নুযুল, কিংবা নাসিখ ও মানসুখ (রহিতকারী আয়াতসমূহ ও রহিত আয়াতসমূহ)। যদি কেউ কোন ঐতিহ্যের উল্লে­খ ছাড়া মনগড়াভাবে বলে যে অমুক আয়াত মানসুখ হয়েছে (রহিত হয়েছে) বা অমুক আয়াতের শানে নুযুল এরূপ হবে, তাহলে তা’ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না বরং এরূপ বর্ণনাকারী গুনাহের ভাগী হবেন। 



✧ মনগড়া তাফসীর হারামঃ


❏ আল্লাহ বলেন,


مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ 


-‘‘যখন আমি কোন আয়াতকে রহিত করে দিই কিংবা বিস্মৃত করে দিই তখন এর চেয়ে উত্তম কিংবা এর মতো (কোন আয়াত) নিয়ে আসবো। তোমার কি খবর নেই যে, আল্লাহ সব কিছু করতে পারেন?  


❏ মিশকাত শরীফ, কিতাবুল ইলম ২য় পরিচ্ছেদে আছেঃ- ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত,


مَنْ قَالَ فِي الْقُرْآنِ بِرَأْيِهِ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ 


-‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাখ্যায় মনগড়া কিছূ বলে, সে যেন জাহান্নামে নিজ ঠিকানা বানিয়ে নেয়)।’’  

{ক) তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ কিতাবুত্ তাফসীরঃ ৫/১৯৯ হাদিসঃ ২৯৫০

খ) নাসায়ীঃ সুনানে কোবরাঃ ৫/৩০ হাদিসঃ ৮০৮৪

গ) বায়হাকীঃ শু’আবুল ঈমানঃ ২/৪২৩ হাদিসঃ ২২৭৫-২২৭৬

ঘ) আহমদঃ আল-মুসনাদঃ ১/২৩৩ হাদিসঃ ২০৬৯

ঙ) আবি শায়বাহঃ আল-মুসান্নাফঃ ৬/১৩৬পৃ. হাদিসঃ ৩০১০১} 


❏ মিশকাত শরীফের ওই একই জায়গায় আরও উলি­খিত আছেঃ- হযরত জুনুদুব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত,


مَنْ قَالَ فِي كِتَابِ اللهِ بِرَأْيِهِ فَأَصَابَ فَقَدْ أَخْطَأَ 


-‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাখ্যায় মনগড়া কিছু বলে এবং তা যদিও সঠিক হয়, তবুও সে ভুল করেছে বলে সাব্যস্ত হবে।’’ 

{ক) তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ কিতাবুত তাফসীরঃ ৫/১৯৯ হাদিসঃ ২৯৫১-২৯৫২

খ) নাসায়ীঃ সুনানে কোবরাঃ ৫/৩১ হাদিসঃ ৮০৮৫-৮০৮৬

গ) তাবরানীঃ মু’জামুল কাবিরঃ ২/১৬৩ হাদিসঃ ১৬৭২

ঘ) আবু ই’য়ালাঃ আল-মুসনাদঃ ৩/৯০ হাদিসঃ ১৫২০

ঙ) তাবরানীঃ মু’জামুল আওসাতঃ ৫/২০৮ হাদিসঃ ৫১০১

চ) বায়হাকীঃ শু’য়াবুল ঈমানঃ ২/৪৩৩ হাদিসঃ ২২৭৭}



✧ তাফসীরের স্তর বর্ণনা


তাফসীরে কুরআনে কয়েকটি স্থর আছেঃ 

কুরআনের সাহায্যে কুরআনের তাফসীরের স্থান সর্বোদ্ধ। এরপরে হলো হাদীছের আলোকে কুরআনের তাফসীর। কেননা হুযুর (ﷺ) হলেন ছাহেবে কুরআন বা কুরআনের ধারক। সুতরাং হাদীছের মাধ্যকে কুরআনের ব্যাখ্যাও উচ্চমর্যাদার অধিকারী। এর পর হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম বিশেষতঃ ফকীহ সাহাবা ও খুলাফায়ে রাশেদীনের উক্তিসমূহের সাহায্যে কুরআনের ব্যাখ্যা।


তারপর হলো তাবেয়ীন ও তব'ই তাবেয়ীনের উক্তি সমূহের সাহায্যে তাফসীরের স্থান। যদি উক্তিসমূহ নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়, তা’হলে গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়। [আল্লামা গোলড়বী (رحمة الله) এর রচিত ‘ইলায়ে কালেমাতুল্লাহ’ নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত]



(২) তাবীলঃ


কুরআনের তাবীল হলো কুরআনের আয়াতের বিষয়াবলী ও সূক্ষ্ম তত্ত্বের বর্ণনা করা এবং আরবী ভাষায় ব্যাকরণের (নাহাব ও ছরফ) বিধানাবলীর ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের তাৎপর্য বিশেষণ করা। বিদ্বান ব্যক্তিদের জন্য এ তাবীল জায়েয। এর জন্য কোন ঐতিহ্যের প্রয়োজন হয় না। কুরআন, হাদীছ ও ফিকহ্ শাস্ত্রবিদের উক্তির মধ্যেও একথার যথার্থতা প্রমাণিত।


❏ আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন,


أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا 


-‘‘তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না? যদি এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে অবতীর্ণ হতো, তাহলে এর মধ্যে অনেক গরমিল ও মতভেদ দেখতে পেতো।’’ 

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৮২, পারাঃ ৫}

     


❏ তাফসীরে রুহুল বয়ানে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


يَتَاَمَّلُوْنَ وَيَتَبَصَّرُوْنَ مَافِيْهِ.


-‘‘কেন তারা কুরআনের অর্থকে তলিয়ে দেখে না এবং এর বিচিত্র সৌন্দর্যাদি জ্ঞান চক্ষু দিয়ে অবলোকন করে না?  

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৯৯ পৃ.}


❏ মিশকাত শরীফের “কিসাস” শীর্ষক আলোচনায় ১ম পরিচ্ছেদের হযরত আবি জুহাইফা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছেঃ জনৈক ব্যক্তি হযরত আলী (কার্রামাল্লাহু ওয়াজাহাহু) থেকে জানতে চেয়েছিলেন যে তাঁর কাছে কুরআন শরীফ ব্যতীত হযরত মুস্তাফা (ﷺ) প্রদত্ত অন্য কোন দান আছে কিনা। এর প্রত্যুত্তরে এর হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেছিলেনঃ


مَا عِنْدَنَا إِلَّا مَا فِي القُرْآنِ، إِلَّا فَهْمًا يُعْطَى رَجُلٌ فِي كِتَابِهِ، -


‘‘আমার কাছে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, এমন জ্ঞান ও বোধশক্তি আমার রয়েছে, যা আল্লাহর কালামের মর্ম উদ্ঘাটনের জন্য কাউকে দান করা হয়।’’ 

{ক) বুখারীঃ আস-সহীহঃ ১২/২৪৬ পৃ. হাদীসঃ ৬৯০৩

খ) তিবরিযীঃ মেশকাতুল মাসাবীহঃ কিতাবুল কিসাসঃ ২/৬৩৪ পৃ. হাদীসঃ ৩৪৬১

গ) তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ ৪/১৭ পৃ হাদীসঃ ১৪১২

ঘ) নাসায়ীঃ সুনানে কোবরাঃ ৮/২৩ পৃ. হাদীসঃ ৪৭৪৪

ঙ) দারেমীঃ আস-সুনানঃ ২/২৪৯ হাদীসঃ ২৩৫৬}

     

❏ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় মিরকাত (শরহে মিশকাত) এ উল্লেখিত আছেঃ


وَالْمُرَادْ مِنْهُ مَا يُسْتَنْبَطُ بِهِ الْمَعَانِىْ وَيُدْرَكُ بِهِ الْاِشَارَاتُ وَالْعُلُوْمُ الْخُفْيََةُ.


-‘‘বোধশক্তি বলতে ঐ জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে যাদ্বারা কুরআনের গুঢ়মর্ম উদ্ঘাটন করা যায়, কালামের ইঙ্গিত ও ভাবার্থ উপলব্ধি করা যায় ও অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম ও রহস্যাবৃত জ্ঞানের সন্ধান মিলে।’’ 

{মোল্লা আলী ক্বারীঃ মিরকাতুল মাফাতীহঃ ৭/৫৬ পৃ.}


উক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে বোঝা গেল, কুরআনের ভাবার্থে চিন্তাভাবনা করা, স্বীয় বিদ্যাবুদ্ধির প্রয়োগ ও থেকে সংশি­ষ্ট তথ্য উদ্ঘাটন অবৈধ নহে। সবক্ষেত্রে ঐতিহ্যের প্রয়োজন পড়ে না।


❏ সুবিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ জালালাইনের টীকায়, যা ‘জুমল’ নামে খ্যাত উল্লেখিত আছেঃ-


اَلْصُل التَّفْسِيْرِ اَلْكَشَفُ وَاَصْلُ التَّاوِيْلِ الرُّجُوْعُ وَعِلْمُ التَّفْسِيْرِ عِلمٌُ عَنْ اَحْوَالِ الْقُرْآنِ مِنْ حَيْثُ دَلاَ لَتِهِ عَلَى مُرَادِ اللهِ تَعَالىَ بِحَسْبِ الطَّاقَةِ الْبَشَرِيَّةِ ثُمَّ هُوَ قِسْمَانِ تَفْسِيْرٌُ وَهُوَمَا لَا يُدْرَكُ اِلاَّ بِالنَّقْلِ كَلَسْبَاِب النُّزُوْلِ، وَتَاوِيْلٌُ وَهُوَ مَايُمْكِنُ اِدْا رَاكُهُ بِالْقَوَاعِدِ الْعَرَبِيَّةِ فَهُوَ مِمَّا يَتَعَلَّقُ بِالدَّرَايَةِ وَالسِّرُفِىْ جَوَازِ التَّاوِيْلِ بِالرَّءْىِ بِشُرُوْطِهِ دُوْنَ التَّفْسِيْرِ اَنَّ التَّفْسِيْرَ كَشَهَادَةِ عَلَى اللهِ قَطَعٌُ بِاَنَّهُ عَنَى بِهَذَا اللَّفْظِ هَذَا الْمَعْنَى وَلاَ يَجُوْزُ اِلَّا بِتَوْفِيْقٍ وَلِذَا جَزًمَ الْحَاكِمُ بِاَنَّ تَفْسِيْرَ الصَّحَابِىْ فِىْ حُكْمِ الْمَرْفُوْعِ وَالتَّاوِيْلَ تَرجِيْعٌُ لِاحَدِ الْمُحْتَمَلَاتِ بِلَاقَطْعٍ

.

 অর্থাৎ ‘তাফসীর’ এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রকাশ করা আর ‘তাবীল’ এর অর্থ হলো ফিরে আসা বা যাওয়া। তাফসীরের জ্ঞান হলো কুরআন পাকের ঐ সমস্ত অবস্থা জানা, যা জ্ঞাত হলে মানুষ নিজ শক্তি সামর্থ অনুসারে আল্লাহর নির্দেশিত লক্ষ্যার্থ অনুধাবন করতে পারে। ইহা দু’ প্রকারঃ তফসীর ও তাবিল। তাফসীর ঐতিহ্য ব্যতীত জ্ঞাত হওয়া যায় না আর তাবীল হলো যা‘ আরবী ব্যাকরণের ভিত্তিতে জানা যায়। সুতরাং তাবীলের সম্পর্ক রয়েছে বোধশক্তির সঙ্গে। নিজস্ব মতানুযায়ী তাবীল জায়েয কিন্তু তাফসীর না জায়েয। এর পিছনে রহস্য হলো এ যে, তাফসীর হচ্ছে এ কথার সাক্ষ্য দেয়া ও বিশ্বাস করা যে আল্লাহ তা’আলা এ শব্দের দ্বারা এ অর্থ বুঝায়েছেন। ইহা জ্ঞাত না হলে স্বীয় বিদ্যাবুদ্ধি দ্বারা বলা বৈধ নহে। এ জন্য হাকিম (رحمة الله) এক্ষেত্রে মীমাংসা করে দিয়েছেন, যে কোন সাহাবীর তাফসীর মরফু হাদীছের মর্যাদা প্রাপ্ত। আর তাবীল হলো, অনিশ্চতভাবে সম্ভাব্য কয়েকটি অর্থের মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দেয়া।


❏ মিশকাতের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাতে ‘ইলম’ শীর্ষক আলোচনার ২য় পরিচ্ছেদে এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ-


أَيْ: مَنْ تَكَلَّمَ (فِي الْقُرْآنِ) أَيْ: فِي مَعْنَاهُ أَوْ قِرَاءَتِهِ (بِرَأْيِهِ) أَيْ: مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ مِنْ غَيْرِ تَتَبُّعِ أَقْوَالِ الْأَئِمَّةِ مِنْ أَهْلِ اللُّغَةِ وَالْعَرَبِيَّةِ الْمُطَابِقَةِ لِلْقَوَاعِدِ الشَّرْعِيَّةِ، بَلْ بِحَسَبِ مَا يَقْتَضِيهِ عَقْلُهُ، وَهُوَ مِمَّا يَتَوَقَّفُ عَلَى النَّقْلِ بِأَنَّهُ لَا مَجَالَ لِلْعَقْلِ فِيهِ كَأَسْبَابِ النُّزُولِ وَالنَّاسِخِ وَالْمَنْسُوخِ


-‘‘এ হাদীছের আসল কথা হলো-কুরআনের অর্থে কিংবা ক্বিরাত সম্পর্কে নিজের মতানুযায়ী কথা বলা, আরবী ভাষায় পারদর্শী ইমামগণের উক্তিসমূহের অনুসন্ধান না করে এবং শরীয়তের নীতিমালার প্রতি দৃষ্টি না রেখে নিজ বুদ্ধি বলে ব্যাখ্যা করা। অথচ সংশি­ষ্ট বিষয়াদি যথার্থভাবে বুঝতে হলে ঐতিহ্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। যেমনঃ 



বিভিন্ন আয়াত সমূহের শানে নুযুল ও নাসিখ-মানসুখ (রহিতকারী ও রহিত আয়াতসমূহ) সম্পর্কিত জ্ঞান।’’ 

{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারীঃ মিরকাতঃ কিতাবুল ইলমঃ ১/২৯১ পৃ.}

     

❏ তিরমিযী শরীফের দ্বিতীয় খন্ডের কিতাবুত তাফসীরের শুরুতে আছেঃ-


وَهَكَذَا رُوِيَ عَنْ بَعْضِ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْرِهِمْ، أَنَّهُمْ شَدَّدُوا فِي هَذَا فِي أَنْ يُفَسَّرَ القُرْآنُ بِغَيْرِ عِلْمٍ


-‘‘কোন কোন জ্ঞানী সাহাবী ও বিজ্ঞ ব্যক্তি থেকে বর্ণিত আছে যে, কেউ যেন রিওয়ায়েতকৃত তাফসীরের জ্ঞান ছাড়া কুরআনের তাফসীর না করেন। সে জন্য সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) কঠোরতা অবলম্বন করতেন। 

{তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ কিতাবুত-তাফসীরঃ ৫/২০০ হাদীসঃ ২৯৫২}


❏ এ হাদীসের টীকায় ‘মাজমাউল বিহার’ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ-


لاَيَجُوْزُ اَنْ يُّرَادَ اَنْ لَّايَتَكَلَّمَ اَحَدٌُ فِى الْقُرْاَنِ اِلَّابِمَا سَمِعَهُ فَاِنَّ الصَّحَابَةَ قَدْ فَسَّرُوْا وَاخْتَلَفُوْا فِيْهِ عَلَى وُجُوْهٍ وَّلَيْسَ كُلَّ مَا قَا لُوْاهُ سَمِعُوْهُ مِنْهُ وَلِاَنَّهُ لَا يُفِيْدُحٍ دُعَاهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ اَللَّهُمَّ فَقِّهْهُ فِى الدِّيْنِ وَعَلَّمَهُ التَّاوِيْلُ ط


অর্থাৎ উল্লেখিত তিরমিযী (رحمة الله) এর বক্তব্য হতে এ ধারণা করা যাবে না যে, না শুনে কেউ কুরআনের ব্যাখ্যায় কোনরূপ মন্তব্য করতে পারবে না। কেননা, সাহাবায়ে কিরাম (رحمة الله) কুরআনের তাফসীর করেছেন এবং পরস্পরের মধ্যে অনেক মত পার্থক্যও বিদ্যমান ছিল। তাঁদের সব কথা নির্ভরযোগ্য সূত্রে শ্রুত ছিল না। অধিকন্তু হুযুর (ﷺ) এর দু’আ, ‘হে খোদা! এদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান এবং তাবীল করার শক্তি দান কর’, বৃথা পরিণত হবে।


❏ ইমাম গায্যালী (رحمة الله) ও তাঁর ‘ইহ্য়াউল উলুম’ গ্রন্থের ৮ম অধ্যায়ের ৪র্থ পরিচ্ছেদ শুধু এ কথা বোঝানোর উদ্দেশ্যে রচনা করেছেন যে, ঐতিহ্য ছাড়াও কুরআন বোঝা সম্ভবপর। তিনি বলেন, কুরআনের একটি বাহ্যিক অর্থ ও আর একটি অভ্যন্তরীন অর্থ রয়েছে। উলামা সম্প্রদায় জাহেরী অর্থের উপর গবেষণা করেন আর সূফী সম্প্রদায় অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশে­ষণ করে থাকেন। হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেছেন, “আমি ইচ্ছে করলে ‘সুরায়ে ফাতিহা’র এমন তাফসীর করতে পারি, যা’ গ্রন্থাকারে সন্নিবেশিত হলে ৭০টি উটের বোঝাই হবে”। তিনি (رضي الله عنه) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ বুঝতে পারবে, সে তাবৎ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারবে। এখন স্বভাবতঃ এ প্রশ্ন জাগে যে হাদীছে বলা হয়েছে যে, ‘কুরআনের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে নিজস্ব চিন্তাধারায় কিছু মন্তব্য করা ভুল হবে’,এ কথার তাৎপর্য কি? উক্ত হাদীসের মূল বক্তব্য হচ্ছে, যে সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান ঐতিহ্য ছাড়া সম্ভবপর নয়, শুধু সে সমস্ত বিষয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়া হারাম। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতির জন্য ইহ্য়াউল উলুমের উপরোক্ত অধ্যায়ের উল্লেখিত পরিচ্ছেদে দ্রষ্টব্য)


কুরআনের আয়াত সমূহের ব্যাপারে দ্বীনি ইমামগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ দেখা যায়। কেউ কোন নির্দিষ্ট জায়গায় ওয়াক্ফ করেন, কেউ অন্য জায়গায়, আবার কেউ কোন এক আয়াত থেকে একটি অনুশাসন বের করেন, অন্যজন এর বিপরীত ভাব ব্যক্ত করেন। যেমনঃ যীনার অপবাদ দানকারীর সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা, দ্ব্যর্থবোধক আয়াতসমূহের জ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ। অতএব, যদি নিজ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে খোদার কালামে একদম কিছু বলা না যায় এবং প্রত্যেক কথার জন্য ঐতিহ্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে এত মত পার্থক্য কেন?


৩) তাহরীফঃ 


তাহরীফ হলো, কুরআনের এমন অর্থ বা মর্মার্থ বর্ণনা করা, যা উম্মাহর সর্বসম্মত মত, ইসলামী আকীদা বা তাফসীরকারকদের সর্বসম্মত অর্থের বিপরীত ঠেকে, কিংবা তাফসীরে কুরআনের বিপরীত কেউ বলে যে, এ আয়াতের তাফসীরে ব্যক্ত অর্থ ঠিক নয়, বরং আমি যা বলছি তাই সঠিক। এ ধরনের উক্তি স্পষ্ট কুফরী। কুরআনী আয়াত সমূহের ও ক্বিরাতে মুতাওয়াতির অস্বীকার করাও কুফরী, তেমনি কুরআন শরীফের মুতাওয়াতির অর্থকে অস্বীকার করাও কুফরী। যেমনঃ


❏ মওলবী কাসেম (নানুতবী) সাহেব খাতেমুন নবীয়ীন’ এর অর্থ করেছেন-মুখ্য নবী; যুগযুগ ধরে এর প্রচলিত ও ও শ্রুত ‘শেষ নবী’ অর্থে ব্যবহার করাটা সাধারণ লোকদের ধারণা অর্থাৎ ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি নবুওতকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন-আসলী (মুখ্য) ও আরেযী (গৌণ)। অথচ খাতেমুন নবীয়ীন এর অর্থ সম্পর্কে অনেক হাদীছের ও উম্মতগণের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে ‘শেষ নবী’। অর্থাৎ হুযুর (ﷺ) এর যামানায় বা পরে কোন নতুন নবী আসতে পারে না। মওলবী কাসেম সাহেবের এ ধরনের অর্থ হচ্ছে তাহরীফ। অনুরূপ, কুরআন শরীফের যে সমস্ত আয়াতে খোদা ভিন্ন অন্যকে ডাকা নিষেধ করা হয়েছে, সে সমস্ত ক্ষেত্রে তাফসীরকারকগণের সর্বসম্মত ব্যাখ্যা হচ্ছে- 


❏ খোদা ভিন্ন অন্য কারো পূজা না করা। যেমন,


وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ


-‘‘খোদা ভিন্ন অন্য কিছুর পূজা করিও না, যেগুলো উপকার বা ক্ষতি কিছুই করতে পারে না।’’  

{সূরাঃ ইউনুস, আয়াতঃ ১০৬, পারাঃ ১১}

     

❏ কুরআন শরীফেও উক্ত আয়াতের তাফসীর বিদ্যমান রয়েছে। যেমন,


 وَمَنْ يَّدْعُ مَعَ اللهِ اِلَهًا اَخَرَ


-‘‘যে ব্যক্তির খোদার সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে’’  .............।

{সূরাঃ মু’মিন, আয়াতঃ ১১৭, পারাঃ ১৭}


এখন উক্ত তাফসীর ও তাফসীরকারদের এ তাফসীরে সর্বসম্মত অভিমত থাকা সত্ত্বেও কেহ যদি বলে, খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে ডাকা নিষেধ, তাহলে সে কুরআনের তাহরীফ বা অপব্যাখ্যা করল। এ আলোচনাটুকু যথার্থরূপে স্মরণ রাখা দরকার। এটা খুবই উপকারী এবং সুধী পাঠকবৃন্দের কাজে আসবে। 

 

তাকলীদের বর্ণনা

তাকলীদ অধ্যায়ে পাঁচটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন।

(১) তাকলীদের অর্থ ও প্রকারভেদ; 

(২) কোন্ ধরনের তাকলীদ প্রয়োজন ও কোন্ ধরনের তাকলীদ নিষিদ্ধ; 

(৩) কার জন্য তাকলীদ জরুরী আর কার জন্য নিষ্প্রয়োজন; 

(৪) তাকলীদ ওয়াজিব হবার সমর্থনে দলীলাদি ও 

(৫) তাকলীদ সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ এবং ওদের পূর্ণাঙ্গ উত্তর। এ জন্য তাকলীদের বর্ণনাকে পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে।

 
Top