❏ অভিশপ্ত ইয়াযীদঃ

❏ কৃত:- মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান

==> ষাট হিজরী পর্যন্ত ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস নিষ্কলুষ, ন্যায়নীতি ও বিজয়াদি দ্বারা সমৃদ্ধ থাকার পর যে লোকটা ইসলামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলো, সে ছিলো হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র কুপুত্র ইয়াযীদ। এক মহান সাহাবী, ওহী লিখক ও ন্যায়পরায়ণ শাসক সাহাবীর সন্তান হয়েও ইয়াযীদ ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনভার লাভের পর পিতার শিক্ষা ও দীক্ষা এবং অন্যান্য বুযুর্গ ব্যক্তিদের নসীহত ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে তার ব্যক্তিগত দুশ্চরিত্র, বিলাসিতা, ইসলামী অনুশাসনের প্রতি উদাসীনতা বরং অবজ্ঞা ইত্যাদিকেই চরিতার্থ করেছিলো। তিন বছর নয় মাসের শাসনামলে সে দ্বীন ও গণ মানুষের কোন কল্যাণ করে সুনাম তো অর্জন করতে পারেনি বরং তার নানাবিধ কুকর্ম ও স্বৈরাচার এবং অযোগ্যতা দ্বারা গোটা মুসলিম জাতির বহু অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।


মুসলমান মাত্রই কোন ব্যক্তি ও তার কৃতকর্মের ধরন নির্ণয় করেন- কিতাবুল্লাহ্, সুন্নাতে রসূল, ইজমা’ ও ক্বিয়াসের আলোকে।

সুতরাং ইয়াযীদ এবং তার কৃতকর্মগুলোকে এতদ্ভিত্তিতে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করলে সে পলীদ (নাপাক), মাল‘ঊন (অভিশপ্ত), ধিক্কৃত ও পরিত্যাজ সাব্যস্ত হয়েছে; কিন্তু একশ্রেণীর অবিবেচক, ইসলামী নীতিমালার প্রতি উদাসীন ও ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী লোক ইয়াযীদকে নির্বিচারে ‘আমীরুল মু’মিনীন ও উদারপন্থী ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করতে দ্বিধাবোধ করছেনা। তারা ইয়াযীদের কৃতকর্ম, ধর্ম বিশ্বাস ও অমার্জনীয় সীমালংঘনগুলোকে হালকা করে দেখে তার পক্ষে উকালতি করতে গিয়ে উল্টো ফুলের চেয়েও পবিত্র ইমাম হযরত হোসাঈন [رضي الله عنه]’র অশালীন সমালোচনার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। অথচ সহীহ্ হাদীস শরীফে আছে, যখন কোন ফাসিক্ব বা পাপাচারীর প্রশংসা করা হয়, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা ক্রোধান্বিত হন এবং এ ক্রোধের কারণে তাঁর আরশ কেঁপে ওঠে। আর প্রশংসাকারী তার নির্লজ্জতা ও ইসলামের প্রতি তার বিদ্বেষকেই প্রকাশ করে।

উল্লেখ্য যে, ইয়াযীদের অপকর্ম ও সেগুলোর পরিণাম সম্পর্কে ইসলামের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে গ্রহণযোগ্য আলোচনা মওজূদ রয়েছে। পক্ষান্তরে, কিছুসংখ্যক বিধর্মী ইতিহাসবিদ ও বাতিলপন্থী লেখকের মন্তব্যাদি সরলপ্রাণ মুসলমান এবং এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানশূন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে। তাই এ নিবন্ধে ইয়াযীদের আসল পরিচয় প্রামান্য কিতাব-পুস্তকাদির আলোকে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।

◇ ইয়াযীদ কে?

___________

নাম ইয়াযীদ, পিতা হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه], কুনিয়াৎ ‘আবূ খালিদ’ উমাইয়া বংশোদ্ভূত। সে ওই হতভাগা লোক, যার কপালে নিরপরাধ আহলে বায়ত-ই কেরামের হত্যাযজ্ঞের কালো দাগ লেগে আছে। এরপর থেকে প্রতিটি যুগে ইসলামী দুনিয়া তাকে তিরষ্কার করে আসছে এবং করতে থাকবে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার নাম ঘৃণা ভরে নেওয়া হবে। এ অপবিত্র-অন্তর বিশিষ্ট, পাষাণ হৃদয় এবং বংশের কলঙ্ক (ইয়াযীদ) ২৫ হিজরীতে আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র ঘরে মায়মূন বিনতে মুনজাদিল কিলাবিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। সে অতিমাত্রায় মোটা, কুৎসিৎ চেহারা বিশিষ্ট, বেশী চুল সম্পন্ন, দুশ্চরিত্র, বদ মেজাজ, ফাসিক্ব বা পাপাচারী, মদ্যপায়ী, অপকর্মে অভ্যস্ত, যালিম এবং বে-আদব (গোস্তাখ) ছিলো।

[সূত্র. ‘সাওয়ানিহ্-ই কারবালা’, কৃত. সদরুল আফাযিল সৈয়দ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী [رحمه الله عليه]]

রাজকীয় পরিবেশে সে লালিত হয়। হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه] তার লালন-পালনের ক্ষেত্রে কোনরূপ ত্রুটি করেননি। তিনি শুরু থেকেই লেখাপড়ার সাথে সাথে তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মাবলীও শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি দু’ বার তাকে আমীরুল হজ্জ নিয়োগ করেন। কয়েকটা যুদ্ধেও সে অংশগ্রহণ করেছিলো। আরবী সাহিত্য ও কাব্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিলো যথেষ্ট। সে কবিতা রচনা ও আবৃত্তিতে দক্ষতাও লাভ করেছিলো। অন্যদিকে শিকারের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো প্রবল। সে কয়েক প্রকারের শিকারী কুকুর পালন করতো ক্রমশ এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তজ্জন্য লোকেরা তাকে পছন্দ করতো না। হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র ইন্তিকালের পর ইয়াযীদ ৬০ হিজরীর রজব মাসে সিংহাসনে বসেছিলো।

[সূত্রঃ তারীখে ইসলাম, কৃত. ড. হামীদ উদ্দীন]

অবশ্য কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ৬৮০ খ্রিস্ট্রাব্দে এপ্রিল মাস, মোতাবেক ৬১ হিজরির সা’বান মাসে হযরত আমীরে মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র ইনতিক্বালের পর ইয়াযীদ সিংহাসনে অধিষ্টিত হয়।

[সূত্রঃ ইসলামের ইতিহাস, কৃত. হাসান আলী চৌধুরী]


◇ ইয়াযীদের মৃত্যুঃ

 ইয়াযীদ ইবনে মু‘আভিয়া ৩৯ বছর বয়সে ৬৪হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করেছে। বাবুস্ সগীরাহ্ গোরস্তানে তাকে গোরস্থ করা হয়।  [সূত্রঃ হায়াতুল হায়াওয়ান: কৃত. আল্লামা কামাল উদ্দীন দামিরী]


◇ শাসনকালঃ

ইয়াযীদ, মতান্তরে ৩ বছর ৯ মাস শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। ঐতিহাসিক আল ফাখরী, ফম ক্রেমার ও ইবনুত্ তিকতারের মতে ইয়াযীদের এ শাসনকাল তিন(০৩)টি দুষ্কর্মের জন্য কুখ্যাত ছিলো। প্রথম বছরে সে হযরত হুসাঈন ইবনে আলী [رضي الله عنه]’কে ও আহলে বায়তের নিরপরাধ লোকদেরকে শহীদ করেছে। দ্বিতীয় বছরে মদীনা শরীফের বিরুদ্ধে তার সৈন্য প্রেরণ করে মদীনা মুনাওয়ারাকে লুণ্ঠন ও অবমাননা করিয়েছে। আর তৃতীয় বছরে সে কা’বা শরীফের উপর হামলা করেছে ও কা’বার গিলাফে অগ্নিসংযোগ করেছে। এ তিনটি ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে এক অতি ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করেছিলো। [সূত্রঃ ইসলামের ইতিহাস: প্রথম খন্ড, কৃত, হাসান আলী চৌধুরী]

 
Top