৫ম অধ্যায়

তাকলীদ সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ এবং উহাদের উত্তর


তাকলীদ বিরোধিতাকারীদের উত্থাপিত আপত্তিসমূহ দু’ধরনের। কতগুলো হচ্ছে অবান্তর, বাজে সমালোচনামূলক কিংবা বিদ্রুপাত্মক। এগুলোর উত্তরের প্রয়োজন নেই। আর কতগুলো হচ্ছে প্রতারণামূলক প্রশ্ন উত্থাপন করে গায়র মুকালি­দগণ মাযহাবের অনুসারীগণকে ধোঁকা দিয়ে থাকে এবং সাধারণ মুকালি­দগণ তাদের প্রতারণা শিকার হয়ে পড়ে। এ শেষোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর নিম্নে পেশ করা হলো।


১নং আপত্তিঃ 


তাকলীদ যদি একান্ত প্রয়োজন হতো, তাহলে সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) কেন কারও তাকলীদ করেন নি?


উত্তরঃ 


সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) এর কারো তাকলীদ করার প্রয়োজন ছিল না। তাঁরা হুজুর (ﷺ) এর সাহচর্য প্রাপ্ত হওয়ায় সমস্ত মুসলমানদের ধর্মীয় নেতা বা ইমাম হিসেবে গণ্য। ফলস্বরূপ ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله), শাফি’ঈ (رحمة الله) প্রমুখ ধর্মীয় ইমামগণ তাঁদেরই অনুসরণ করেছিলেন।


❏ মিশকাত শরীফের “ফাযহিলুস সাহাবা” অধ্যায়ে আছেঃ হযরত উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত,


اَصْحَابِىْ كَالنُّجُوْمِ بِاَيِّهِمْ اِقْتَدَ يْتُمْ اِهْتَدَيْتُمْ.


-‘‘আমার সাহাবীগণ তারকারাজির মত। তোমরা যে কারো অনুসরণ করো না কেন, সঠিক পথের সন্ধান পাবে।’’  

{ক) খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ৫/পৃ. ৫৫৪ হাদিসঃ ৬০১৮

খ) ইমাম আদিঃ আল-কামিলঃ ২/৩৭৭ হাদিসঃ ৫০২

গ) আবু হুমায়দীঃ আল-মুসনাদঃ পৃ. ২৫০, হাদিসঃ৭৮৩

ঘ) ইমাম বায়হাকীঃ ইতিকাদঃ পৃ. ৩১৯

ঙ) ইবনে বার্ঃ জামেউল উলুমঃ ২/৯১ পৃ.

চ) ইমাম বায়হাকীঃ আল মাদখালঃ ১/৭২ পৃ.

ছ) ইমাম সাখাভীঃ আল-মাকাসিদুল হাসানাঃ পৃ. ৪৬ হাদিসঃ ৩৯

জ) আল্লামা আজলূনীঃ কাশফুল খাফাঃ ১/১১৮ হাদিসঃ ৩৮১

ঝ) ইমাম সূয়ুতীঃ খাছায়েসুল কোবরাঃ ২/৪৫৪

ঞ) ইমাম সুরখুসীঃ মবসুত শরীফঃ কিতাবুল আদাবুল কাজীঃ ২৬/৮৩}


উল্লেখিত হাদীছ গ্রন্থের একই অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছেঃ


❏ হযরত এরবাদ ইবনে সারিয়া (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত,


عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ.


-‘‘তোমরা আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আকড়ে ধর।’’  

{ক) ইমাম ইবনে মাজাহঃ আস-সুনানঃ ১/১৫-১৬, হাদিসঃ ৪২-৪৩

খ) ইমাম তিরমিজীঃ আস্-সুনানঃ ৫/৪৩ পৃ. হাদিসঃ ২৬৭৬

গ) ইমাম আবু দাউদঃ আস্-সুনানঃ ৪/২০০ হাদিসঃ ৪৬০৭

ঘ) ইমাম বায়হাকীঃ সুনানে কোবরাঃ ১০/১১৪ পৃ.

ঙ) ইমাম বায়হাকীঃ শুয়াবুল ঈমানঃ ৬/৬৭ হাদিসঃ ৭৫১৫-৭৫১৬

চ) ইবনে কাসিরঃ জামেউল মাসানীদঃ ৯/২৪০৫ হাদিসঃ ৬৪৭৪-৬৪৭৫

ছ) ইমাম বায়হাকীঃ দালায়েলুল নবুয়তঃ ৬/৫৪১ পৃ.

জ) ইমাম বগভীঃ শরহে সুন্নাহঃ ১/১৮১ হাদিসঃ ১০২

ঝ) ইমাম ইবনে হিব্বানঃ আস-সহীহঃ ১/১৭৮ হাদিসঃ৫

ঞ) ইবনে আসাকিরঃ তারীখে দামেস্কঃ ২১/১৪৭-১৪৮ হাদিসঃ ৮৭১০-৮৭১১ ও ৮৭১২

ট) ইমাম তাবরানীঃ মুসনাদি-সামীনঃ ১/২৫৪ হাদিসঃ ৪৩৭

ঠ) ইমাম তাবরানীঃ মু’জামুল কাবীরঃ ১৮/২৫৭ হাদিসঃ ৬৪২ 

ড) দারেমীঃ আস-সুনানঃ ১/৫৭ হাদিসঃ ৯৫

ঢ) খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতুল মাসাবীহঃ ১/৫৩ পৃ. কিতাবুল ইতিসাম হাদিসঃ ১৬৫

ণ) আহমদ ইবনে হাম্বলঃ আল-মুসনাদঃ ৪/১২৬ পৃ.}


উত্থাপিত আপত্তিটায় দৃষ্টান্ত হলো, যেমন কেউ বলতে পারে ‘আমরা কারো উম্মত নই। কেননা আমাদের নবী (ﷺ) কারো উম্মত ছিলেন না। সুতরাং, উম্মত না হওয়াটা রসূল (ﷺ)-এর সুন্নত।’ এর উত্তরে বলতে হবে, হুজুর (ﷺ) নিজেই নবী, সবাই তাঁর উম্মত। অতএব, তিনি কার উম্মত হবেন? তদ্রূপ সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) হলেন সবার ইমাম। সুতরাং, তাঁদের ইমাম আবার কে হবে?


ঐ শস্য ক্ষেতেই নদী-নালা থেকে পানি সরবরাহ করা হয়, যার অবস্থান সাগর থেকে অনেক দূরে। মুকাব্বিরের তাকবীর শুনে ঐ সকল মুক্তাদীরাই নামায পড়েন, যারা ইমাম থেকে দূরে থাকেন। সাগর পাড়ের নিকটে অবস্থিত শস্য ক্ষেতের জন্য নদী-নালার পানির প্রয়োজন হয় না। আর প্রথম কাতারের মুক্তাদীগণের জন্য মুকাব্বিরের প্রয়োজন পড়ে না। সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) হচ্ছেন প্রথম কাতারের মুক্তাদী। তাঁরা কোন মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি হুজুর (ﷺ) এর পত্রি সিনা মুবারক থেকে ফয়েয প্রাপ্ত। আমরা যেহেতু ঐ সাগর (হুযুরের সিনা মুবারক) থেকে হাজার হাজার নদীর উৎপত্তি হয়, সেগুলোতে একই সাগরের পানি প্রবাহিত হয় বটে, কিন্তু নাম ও গতিপথ ভিন্ন ভিন্ন। কোনটাকে গংগা, কোনটাকে যমুনা বলা হয়। অনুরূপ, হুজুর (ﷺ) হলেন রহমতের সাগর। তাঁর সিনা মুবারক থেকে যে নদী উৎপত্তি হয়ে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) এর পবিত্র বক্ষ মুবারক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, উহাকে হানাফী নামকরণ করা হয়েছে, আর যেটি ইমাম মালিক (رحمة الله) এর সিনা মুবারক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, উহাকে মালিকী মাযহাব বলা হয়েছে। সব নদীর পানি এক ও অভিন্ন, কেবল নাম ভিন্ন ভিন্ন। ঐ সব নদীর পানির প্রয়োজন হয়েছে আমাদের, সাহাবায়ে কিরামের নয়। যেমন হাদীছের সনদ বা সূত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় আমাদের নিকট; সাহাবায়ে কিরামের নিকট উহার আদৌ প্রয়োজন নেই।



২য় আপত্তিঃ 


সঠিক পথের সন্ধানের জন্য কুরআন ও হাদীছই যথেষ্ট। কুরআন হাদীছে এমন কি বিষয় নেই, যার জন্য ফিকহের সাহায্য নিতে হবে? 


❏ কুরআনেই ইরশাদ করা হয়েছে,


وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ


-‘‘আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোন কিছু বাকী নেই, যা’ ঐশী নূরে আলোকিত কুরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়নি।’’  

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ৫৯}

      

❏ আরও বলা হয়েছে,


وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ


-‘‘আমি কুরআনকে শেখার বা স্মরণ রাখার বা মুখস্থ করার সুবিধার্থে সহজ করে দিয়েছি। স্মরণ করার কেউ আছে কি?  

{সূরাঃ ক্বামারঃ আয়াতঃ ১৭, পারাঃ ২৭}

      

এ আয়াত সমূহ থেকে বোঝা গেল, কুরআনের মধ্যে সব কিছু আছে এবং কুরআন প্রত্যেকের জন্য সহজ। তাই মুজতাহিদের নিকট যেতে হবে কি জন্য?


উত্তরঃ 


হিদায়তের জন্য কুরআন ও হাদীছ নিঃসন্দেহে যথেষ্ট। এও ঠিক যে কুরআন-হাদীছের মধ্যে সব কিছু আছে। কিন্তু এ থেকে মাসাইল বের করার উপযুক্ততা থাকা চাই। সমুদ্রে অনেক মণিমুক্তা রয়েছে। এগুলো খুঁজে আনার জন্য ডুবুরীর প্রয়োজন। ইমামগণ হলেন সমুদ্রের ডুবুরীর মত। চিকিৎসা শাস্ত্রের গ্রন্থাবলীতে সব কিছুর উল্লে­খ আছে, তবুও আমাদেরকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়, ব্যবস্থাপত্র নিতে হয়। ধর্মীয় ইমামগণই হলেন আমাদের ডাক্তার সদৃশ। 


❏ আল কুরআনের আয়াত,

 وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْاَنَ এ বলা হয়েছে কুরআনকে স্মরণ রাখার জন্য বা হিফ্জ করার জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে; 


মাসাইল বের করার ক্ষেত্রে সহজ করে দেয়া হয়নি। যদি মাসাইল বের করা এতো সহজ হয়, তা’হলে হাদীছের কি প্রয়োজন থাকতে পারে। কুরআন সবকিছু আছে আর কুরআন সহজও। তবুও কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী (ﷺ) কেন এলেন? 


❏ কুরআনেই আছে,


 وَيُعَلِّمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ 


অর্থাৎ "সেই নবী তাদেরকে আল্লাহর কালাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেন।" 

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ১২৯, পারাঃ ১}


কুরআন ও হাদীছ হলো রূহানী ঔষধ, আর ইমাম হালেন রূহানী ডাক্তার।


৩য় আপত্তিঃ 


❏ কুরআন শরীফে মাযহাবের অনুগামীদের নিন্দা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,


اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ


-‘‘ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পাদরী ও ঋষিদেরকে খোদা মেনে নিয়েছে।’’  

{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াত নংঃ ৩১}

      

❏ আরও বলা হয়েছে,


فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ


-‘‘যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে ঝগড়া-ঝাটি হয়, সেটার মীমাংসার জন্য আল্লাহ ও রাসূল (عليه السلام) এর শরণাপন্ন হও।’’ 

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৫৯, পারাঃ ৫}


❏ আরোও ইরশাদ করা হয়েছে,


وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ


-‘‘এটাই হলো আমার সরল পথ। এ পথেই চলো। অন্যান্য পথে চলিও না, অন্যান্য পথে গেলে এ সরল পথ থেতে বিচ্যুত হয়ে পড়বে।’’ 

{সূরাঃ আনআম, আয়াতঃ ১৫৩, পারাঃ ৮}

      

❏ আরও ইরশাদ করা হয়েছে,


قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا


-‘‘তারা বলে, আমরাতো ওই পথেই চলবো, যে পথে আমাদের বাপ-দাদাদেরকে চলতে দেখেছি।’’ 

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ১৭০, পারাঃ ২}


এ সমস্ত আয়াত ও এ ধরনের অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের সামনে ইমামগণের নির্দেশ অনুযায়ী চলা কাফিরদেরই অনুসৃত পন্থা। সহজ সরল পথ একটিই। শাফেঈ, হানাফী, ইত্যাদি পথ চতুষ্টয় হলো বাঁকা পথ।


উত্তরঃ 


কুরআন করীম যে তাকলীদের নিন্দা করেছে, সেই সম্পর্কে আমি এ গ্রন্থের ১ম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। কুরআনের আয়াত  وُلَاتَتَّبِعُوْا السُّبُلُ (অন্যান্য পথে চলিও না) দ্বারা ইহুদীবাদ, খৃষ্টাবাদ, ইত্যাদি ইসলাম বিরোধী মতাদর্শকে বোঝানো হয়েছে। আর হানাফী, শাফে’ঈ ইত্যাদি কয়েকটি পথ নয়, বরং একই স্টেশনগামী চারটি সড়ক বা একই নদী হতে উৎপন্ন চারটি খাল। তা না হলে গায়র মুকালি­দদের মধ্যে ‘ছানয়ী’ ও ‘গযনবী’ নামে যে দু’টো দল রয়েছে, সে সম্পর্কে কি বলা হবে? ভিন্ন ভিন্ন পথের প্রশ্ন একমাত্র ‘আকাইদ বা বিশ্বাসের বিষয়বস্তু সমূহের পরিবর্তনের সহিত সম্পৃক্ত। চার মাযহাবের আকীদাহ এক। আমলের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের ব্যাপারটিও গৌণ। এ ধরনের মতভেদ স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেও বিরাজমান ছিল।


চতুর্থ আপত্তিঃ 


এ আপত্তিটা নিম্নে উল্লেখিত চার পংক্তি বিশিষ্ট কবিতায় ব্যক্ত করা হয়েছে,


هوتے  هوئے مصطفے كى گفتار – مت مان كسى كاقول وكردار،

دين حق راچار مذهب ساختند – فتنه دردين نبى اند اختند،


অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (ﷺ)-এর নির্দেশাবলী যখন আছে, অন্য কারো উক্তি বা কর্মকে গ্রহণ করো না। ধর্মীয় ইমামগণ সত্য ধর্ম ইসলামে চারটি মাযহাব সৃষ্টি করে প্রিয় নবী (ﷺ)-এর ধর্মে এক নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন।


উত্তরঃ 


পথভ্রষ্ট চকড়ালবীদের রচিত কবিতার সাহায্যে উক্ত আপত্তি খন্ডন করা হল। 


❏ কবিতাটি নিম্নে উল্লেখিত হলো,


هوتے  هوئے  كبرياكى گفتار – مت مان بنى كلقول وكردار


অর্থাৎ আল্লাহর বাণী কুরআন যখন আছে, তাই নবীর (ﷺ) এর কথা ও কর্ম অনুযায়ী চলো না। চকড়ালবীদের এ অবান্তর কথা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি লা-মাযহাবীদের কথাও বর্জনীয়।


❏ উপরের প্রশ্নে উল্লেখিত কবিতার ২য় লাইনের সহিত সঙ্গতপূর্ণ আর এক লাইন এভাবে রচিত হলোঃ


مسجد دوخشت عليحده ساختند – فتنه دردين بنى اندا ختند


অর্থাৎ (লা-মাযহাবীগণ) দু’ইটের মসজিদে পৃথকভাবে নির্মাণ করে নবী (عليه السلام) এর ধর্মের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।


❏ মাযহাব চারটি হওয়ার রহস্য আমি স্বরচিত কাব্য গ্রন্থে (দ্বীওয়ানে সালিক) নিম্নে বর্ণিত কবিতায় দু’টো লাইনে এভাবে উদঘাটন করার প্রয়াস পেয়েছিঃ


چاررسل فرشتے چارچار كتب هيں ديں چار

سلسلے دونوں چار چار لطف عجب هےچار ميں

آتش وآب وخاك وباد سب كا انهى سے هےثبات

چار کاسارا ماجر اختم هے چار يار هيں


অর্থাৎ চারজন রাসূল, চারজন ফিরিশ্তা, চারটি কিতাব, চারটি ধর্ম, শরীয়ত ও তরীকতের মধ্যে যথাক্রমে চারটি মাযহাব ও তারীকা। চার সংখ্যাটি সবিশেষ উল্লে­খযোগ্য। চারের মধ্যে এক অপূর্ব মাধুর্য ও তৃপ্তিবোধ রয়েছে। আগুন, পানি, মাটি, বাতাস- এ চার উপাদানের বদৌলতে সবকিছু অস্তিত্ববান হয়েছে। ‘চার’ সংখ্যাটির বিশেষত্ব চারজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর (চার আসহাব) মধ্যেও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।


চার সংখ্যাটি খোদার কাছে অতীব পছন্দনীয়। তিনি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন চারটি, ঐশী ধর্মও সৃষ্টি করেছেন চারটি, মানুষকেও চারটি উপদানের সমন্বয়ে সুন্দর আকৃতি দিয়েছেন, ইত্যাদি ........। মানযিলে মাকসুদে পৌঁছার পথ চতুষ্টয় যদি বিলীন হয়ে যায়, তা’হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা, পথ চারটিই হতে পারে। কা’বা ঘরের চার দিক থেকে নামায পড়া হয়। কিন্তু সবার সৃষ্টি কা’বার দিকেই নিবদ্ধ থাকে। অনুরূপ হুজুর (ﷺ) হলেন ঈমানের কা’বা। মাযহাব চারটি উক্ত কাবাগামী পথ চারটিকে বেষ্টন করে রয়েছে। এমতাবস্থায় আপনারা (চারটি পথই রুদ্ধ বিধায়) কোন্ রাস্তা দিয়ে সেখানে পৌঁছবেন?


❏ কোন এক কবি সুন্দর বলেছেন,


مذهب چارچوں چهار راه اند – بهر منت جو جاده پيمائى

خود يكے بينى ازچهار طرف – كعبه راچوں تو سجده بنمائ


 (অর্থাৎ চার মাযহাবই যখন চারটি পথ হিসেবে চিহ্নিত হল, কাজেই অনুগ্রহ লাভের জন্য যে কোন একটি পথ অবলম্বন কর। চতুর্দিক থেকে সিজদা দিলেও একটি মাত্র কা’বাই দৃশ্যমান হবে।


কুরআন থাকা সত্ত্বেও যেমন হাদীসের প্রয়োজন হয়, তদ্রূপ হাদীছ থাকা সত্ত্বেও ফিকহের প্রয়োজনীয়তা থাকে। ফিকহ হলো কুরআন হাদীছের তাফসীর। যেই বিধি-বিধান আমরা কুরআন হাদীছে পাই না, ফিকহ শাস্ত্রই উহাকে পরিস্ফুষ্ট করে তোলে।


৫ম আপত্তিঃ 


তাকলীদে খোদা ভিন্ন অন্যকে নির্দেশ প্রদানকারী মানা হয়, ইহা শির্ক। সুতরাং ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদও শির্ক। 


❏ মহান প্রভু আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান, 


اِنِ الْحُكْمُ اِلاَّ الِلَّهِ


আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম নেই অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কেউ হুকুম করার অধিকারী নয়। 

(সূরাঃ ইউসূফ, আয়াত নংঃ ৪০)


উত্তরঃ 


যদি খোদা ভিন্ন অন্যকে বিচারক বা ফায়সালা করার অধিকারী নিযুক্ত করা শির্ক হয়, তাহলে হাদীছ মান্য করাও শিরকে পরিণত হল। অধিকন্তু, সমস্ত হাদীছবেত্তা, তাফসীরকারকগণও মুশরিক সাব্যস্ত হয়ে গেলেন, কেননা ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) আবু দাউদ (رحمة الله), মুসলিম (رحمة الله) প্রমুখ মুহাদ্দিছগণও মুকালি­দ ছিলেন। আর ইমাম বুখারী (رحمة الله) প্রমুখ হাদীছ বিশোরদগণও মুকালি­দ মুহাদ্দিছগণের শিষ্য ছিলেন। 


❏ (আইনী শরহে বুখারী দেখুন) আমি আমার রচিত দীওয়ানে সালেকে’ এর উত্তর এভাবে দিয়েছি,


جوتيرى تقليد شرك هوتى محدثىن سارے هوتے مشرك

بخارى مسلم ابن ماجه امام اعظم ابو حنيفه،

كه جتنے فقهاء محدثين هيں تمهارے خرمن سے خوشه چين هيں،

هوں واسطے سے كه بے وسيله امام اعطم ابوخنيفه.


অর্থাৎ- হে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) যদি আপনার তাকলীদ বা অনুসরণ করা শির্ক হতো, তাহলে ইমাম বুখারী (رحمة الله), মুসলিম (رحمة الله) ও ইবনে মাজা (رحمة الله) মুশরিক বলে গণ্য হবেন। যত ফিকহ বিশারদ ও হাদীছ বেত্তা আছেন, সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেই আপনারই সঞ্চিত স্তুপীকৃত জ্ঞান ভান্ডার হতে জ্ঞানরূপ সম্পদ আহরণ করে ধন্য হয়েছেন।


যে রিওয়ায়াতে (বা হাদীছ বর্ণনায়) একজন ফাসিক রাবী বা বর্ণনাকারীর উল্লে­খ থাকে; সেই রিওয়ায়াত যাঈফ (দুর্বল) বা মাওযু (বানোয়াট) বলে গণ্য হয়। এমতাবস্থায় যে রিওয়ায়াত কোন মুকালি­দ থাকে, সে রিওয়ায়াত মুশরিক (?) বর্ণনাকারীর সংশি­ষ্টতার জন্য বাতিল (?) বলে গণ্য হবে। যেহেতু ইমাম তিরমিযী ও আবু দাউদ (رحمة الله) মুকালি­দ বিধায় মুশরিক (?) হয়ে গেলেন, সেহেতু তাঁদের রিওয়ায়াত সমূহ গ্রহণযোগ্য হবার কোন প্রশ্নই উঠে না। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ আগেই বাদ পড়ে গেলেন, কেননা তাঁরা মুকালি­দের তথা মুশরিখদের শিষ্য (?) এখন হাদীছ কোথায় হতে সংগ্রহ করবেন?


❏ কুরআন পাক ইরশাদ করছে,


وَاِنْ خِفْقُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَمًا مِنْ اَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ اَهْلِهَا.


 অর্থাৎ- যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদের আশংকা কর, তাহলে পুরুষের পক্ষে একজন ও মেয়ের পক্ষের একজন শালিসকার নিযুক্ত করে পাঠাও। 

{সূরাঃ নিসা, আয়াতঃ ৩৫, পারাঃ ৫}

      

সিফ্ফীনের যুদ্ধে হযরত ‘আলী (رضي الله عنه) ও হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) শালিসকার নিয়োগ করেছিলেন। হুজুর (ﷺ) নিজেই বনী কুরায়জার ঘটনায় হযরত সা’দ ইবন মু’আয (رضي الله عنه) কে বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন। উল্লেখিত আয়াত, اِنِ الْحُكْمَ اِلاَّالِلَّهِ এর অর্থ হলো আসল হুকুম আল্লাহরই। খোদা ভিন্ন অন্যান্য যে সব ব্যক্তিবর্গের নির্দেশাবলী রয়েছে, যেমন ‘উলামা, ফিক্হবিদ ও মাশায়িখের নির্দেশাবলী; এরূপ হাদীছের নির্দেশামালা সবগুলোই পরোক্ষভাবে খোদার হুকুমে অন্তভুর্ক্ত। যদি উক্ত আয়াত দ্বারা খোদা ব্যতীত অন্যের হুকুম মানা শির্ক বলে গণ্য করি, তাহলে বর্তমানে সারা দুনিয়ার লোক, যারা কোর্ট-কাচারীতে দায়েরকৃত মামলা মুকাদ্দামায় বিচারকের রায়কে মেনে চলছেন, সবাইতো, মুশরিক হয়ে গেলেন।


৬ নং আপত্তিঃ 


মুজতাহিদের কিয়াস হচ্ছে এক প্রকারের ধারণা। ধারণা করাটা পাপ। কুরআন শরীফে ধারণা করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমনঃ


❏ কুরআন ইরশাদ করছে,


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا


-‘‘হে ইমানদারগণ অনেক ধরনের ধারণা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয় কোন কোন ধারণা পাপ হিসেবে গণ্য হয় এবং কারো দোষত্রুটি তালাশ করো না। এবং একে অপরের গীবত বা নিন্দা করো না।’’  

{সূরাঃ হুজরাত, আয়াতঃ ১২, পারাঃ ২৬}


সুতরাং, ধর্মের ব্যাপারে কেবল কুরআন সুন্নাহ মুতাবিক ‘আমল করা চাই’; অন্য কাউকে অনুসরণ করার কোন প্রয়োজন নেই। যেমনঃ


❏ নিম্নে উল্লেখিত কবিতার একটি লাইনে ব্যক্ত হয়েছে,


اصل دين آمد كتاب الله مقدم دشتن

پس حديث مصطفے ازجان مسلم داشت


-‘‘ধর্মের মূল কথা হলো আল্লাহর কিতাবকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া, এরপর হাদীছকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরা।


উত্তরঃ 


এ প্রশ্নের উত্তর এ অধ্যায়ের শেষে সংযোজিত পরিশিষ্টে প্রদান করা হবে, যেখানে ‘কিয়াস’ কাকে বলে, এর বৈশিষ্টসমূহ কি কি, সে সম্পর্কে

বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।



৭নং আপত্তিঃ 


ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) বলেছেন, যদি কোন হাদীছ সহীহ প্রমাণিত হয়, তখন সেটাই হবে আমার মাযহাব। অতএব আমরা যারা তাকলীদের সমর্থক নই ইমাম আবু হানীফার (رحمة الله) উক্তিকে হাদীছের বিপরীত পাওয়ায় বর্জন করেছি। এগুলোই হলো গায়র মুকালি­দদের উপস্থাপিত দলীল প্রমাণ। এর অতিরিক্ত আর কোন প্রমাণ তারা দিতে পারেন না। এগুলোকেই সাজিয়ে গুজিয়ে বাড়িয়ে কমিয়ে বারবার বর্ণনা করে থাকেন।


উত্তরঃ 


এ কথা সত্য যে, ইমাম সাহেব (رحمة الله) বলেছেন যদি আমার উক্তি কোন সহীহ হাদীছের পরিপন্থী প্রমাণিত হয়, তাহলে হাদীছ অনুযায়ী আমল করাটাই হবে আমার মাযহাব। এটি ইমাম সাহেবের (رحمة الله) চূড়ান্ত পর্যায়ের খোদা ভীতির ইঙ্গিত প্রদান করে। এও ঠিক যে, মুজতাহিদের কিয়াস বা রায় ওখানেই প্রযোজ্য, যেখানে কোন ‘নস’ (সুস্পস্ট আয়াত, হাদীছ ইত্যাদি) বিদ্যমান নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ যুগে সারা পৃথিবীতে এমন কোন মুহাদ্দিছ কি পাওয়া যাবে, যিনি সনদ সহ সমস্ত হাদীছ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত আছেন, যিনি বলতে পারেন যে ইমাম আ’জম (رحمة الله) কোন্ হাদীছ থেকে কোন নির্দেশটি গ্রহণ করেছেন? আমাদের দৃষ্টি হাদীছের সুপ্রসিদ্ধ ৬টি গ্রন্থ ‘সিহাহ সিত্তাহ’ এর সীমা পর্যন্ত প্রসারিত, এর বাইরে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছায় না। তাই আমরা কিভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইমাম সাহেবের এ নির্দেশ / উক্তি কোন এক হাদীছ থেকে গৃহীত হয়নি? 


❏ হাদীছ শরীফেই তো বলা হয়েছে,


اِذَا بَلَغَكُمْ مِنِّى حَدِيْثٌُ فَاْعِرضُوْهُ عَلَى كِنَابِ اللهِ فَاِنْ وَافَقَهُ فَاقْبِلْوْهُ وَاِلًّا فَرَدُّوْاهُ .(مقدمه تفسيرات احمديه ص৪)


-‘‘(নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ দকরেন যখন তোমাদের কাছে আমার কোন হাদীছ বর্ণিত হয়, তবে উহাকে আল্লাহর কালামের সহিত মিলিয়ে দেখো। যদি কুরআনের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাহলে গ্রহণ করো; অন্যথায় বর্জন করো।’’ 

(তাফসীরে আহমদীয়্যাহ, মুকাদ্দমার ৪র্থ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)


এ হাদীছকে সামনে রেখে কোন চকড়ালভী মতাবলম্বী যদি বলে যে অনেক হাদীছ যেহেতু কুরআনের বিপরীত পাওয়া যায়, সেহেতু আমরা হাদীছকে বর্জন করে থাকি। যেমন, কুরআনে নির্দেশ আছে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ ওয়ারিশগনের মধ্যে বন্টন কর। আর হাদীছে আছে, নবীর পরিত্যক্ত সম্পদ ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন হয় না। চকড়ালভীদের এ বক্তব্য যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, (হে গায়র মুকালি­দগণ) আপনাদের বক্তব্যও তেমনি অগ্রাহ্য।



৮নং আপত্তিঃ 

 

ইমাম আ’জম (رحمة الله) এর উল্লে­খযোগ্য সংখ্যক হাদীছ জানা ছিল না। এজন্যইতো তাঁর রিওয়ায়াতসমূহ খুব কমই দৃষ্টিগোচর হয়; যে কয়টি আছে, সেগুলোও দ্বঈফ বা দুর্বল।


উত্তরঃ 


ইমাম আ’জম (رحمة الله) খুব উঁচুস্তরের মুহাদ্দিছ ছিলেন হাদীছ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে এতগুলো মাসাইল বের করতে পারলেন কি করে? তাঁর সংকলিত হাদীছ গ্রন্থ ‘মসনদে ইমাম আবু হানীফা’ ও ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله) এর সংকলিত হাদীছ গ্রন্থ ‘মুওয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ’ থেকে তাঁর হাদীছ সম্পর্কিত অনন্য সাধারণ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। হযরত সিদ্দীক আকবরের (رضي الله عنه) রিওয়ায়াত খুব কমই দেখা যায়। তাই বলে কি তিনি মুহাদ্দিছ ছিলেন না? অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বনের কারণে রিওয়ায়াত স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ইমাম সাহেব (رحمة الله) এর সমস্ত রিওয়ায়াতই বিশুদ্ধ। কেননা তাঁর জীবনকাল ছিল হুজুর (ﷺ) এর ইহকালীন জীবনের খুবই নিকটবর্তী। পরবর্তীকালে কোন কোন রিওয়ায়াতে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এতে ইমাম সাহেবের (رحمة الله) কিছু আসে যায় না। সনদ বা সূত্র যতই দীর্ঘতর হয়েছে, ততই দুর্বলতার মাত্রাও বেড়েছে।



সুক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নঃ 


অভিযোগঃ 

কেউ কেউ এও প্রশ্ন করে যে, আপনাদের কথা মতো চার মাযহাবই সঠিক, এটা কিরূপে হতে পারে? যে কোন একটিই হক বা সঠিক হবে। যেমন ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) বলেন, ‘ইমামের পেছনে নামায পড়ার সময় সূরা ফাতিহা পড়া মাকরূহ তাহরীমী; আর ইমাম শাফি’ঈ (رحمة الله) বলেন, ওটা ওয়াজিব। হয় ওয়াজিব হবে, না হয় মাকরূহ হবে, দুটোই কি করে সঠিক হতে পারে?


উত্তরঃ 

এখানে ‘হক’ বা সঠিক বলতে যথার্থ বা প্রকৃত সত্য অর্থে বুঝানো হয়নি। ‘হক’ বলতে যা বুঝানো হয়েছে, তা হলো চার মাযহাবের যে কোন একটি অনুসরণ করলে খোদার কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে না কেননা মুজতাহিদের ভুলত্রুটিও ক্ষমাযোগ্য। এক দিকে আমির মুআবিয়া (رضي الله عنه) ও মওলা ‘আলী (رضي الله عنه) এর মধ্যে, অপর দিকে হযরত ‘আয়েশা সিদ্দীকা (رحمة الله) ও হযরত আলী (رضي الله عنه) এর মধ্যে গৃহযুদ্ধও হয়েছে। ন্যায় ও প্রকৃত সত্যের উপর যে কোন একজনই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ‘কিন্তু উভয়কে ‘হকের’ উপর প্রতিষ্ঠিত বলা হয়- এ অর্থে যে আল্লাহর কাছে কাউকে তজ্জন্য জওয়াবদিহি করতে হবে না। গভীর জংগলের মধ্যে এক ব্যক্তি কিবলার দিক নির্ণয় করতে পারছে না। সে নিজের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী চার রাকআত চার দিকে মুখ করে আদায় করেছে। কেননা যখনই তার ধারণা পাল্টে যায়, তখনই সে অন্য দিকে মুখ ফিরাতে থাকে। কিবলা নিশ্চয় এক দিকেই ছিল, চতুর্দিকে ছিল না। তথাপি তার নামায শুদ্ধ হয়েছে, চতুর্দিকেই তার কিবলা ঠিক হয়েছে। মুজতাহিদের ইজতিহাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে এতটুকু বলা হয়েছে যে, মুজতাহিদ ভুল করলেও একটি ছওয়াব পান। কুরআন করীম ইজতিহাদ প্রয়োগে হযরত দাউদ (عليه السلام) এর ভুল এবং হযরত সোলায়মান (عليه السلام) এর সঠিক রায়ের কথা বর্ণনা করেছে। কিন্তু কারো উপর যৎসামান্য দোষারোপও করা হয়নি। 


❏ বরং ইরশাদ করা হয়েছে,


 كُلاَّ اَتَيْنَا حُكْمًا وَّعِلْمًا 


অর্থাৎ- তাঁদের প্রত্যেককে আমি বিচার বিশে­ষণের ক্ষমতা ও জ্ঞান দান করেছি।


❏ মিশকাত শরীফের ‘ইমারত’ শীর্ষক আলোচনায় ‘আল-আমিন ফিল কাযা’ অধ্যায়ে হযরত আবু হুরায়রা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত আছে,


إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فلهُ أجرٌ واحدٌ


-‘‘যখন বিচারক চিন্তাভাবনা করে রায় দেন, এবং রায়টা সঠিক হয়, তখন তিনি দু’টো ছওয়াব পাবেন! পক্ষান্তরে, বিচারক যখন সঠিক রায়ের জন্য চিন্তাভাবনা করেন কিন্তু সঠিক রায়টা অনুধাবন করতে ভুল করে ফেলেন, তখনও তিনি একটি ছওয়াবের ভাগীদার হবেন।" 

{ক) বুখারীঃ আস-সহীহঃ ১০/৩১৮ হাদিসঃ ৭৩৫২

খ) মুসলিমঃ আস-সহীহঃ ৩/১৩৪২

গ) খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ ৩/পৃ. ৩২৪ হাদিসঃ ৩৭৩২

ঘ) তিরমিজীঃ আস-সুনানঃ ৩/৬১৬ পৃ. হাদিসঃ ১৩৩৬

ঙ) নাসাঈঃ সুনানে কোবরাঃ ৮/২২৩ পৃ. হাদিসঃ ৫৩৮১}

      

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আপত্তিটা উত্থাপনের আর অবকাশ রইল না। আপত্তিটা হচ্ছে কোন শাফে’ঈ মতাবলম্বী কর্ণমূল পর্যন্ত দুহাত উঠালে (নামাযের সময়) সঠিক বিবেচিত হয় কিন্তু কোন লা-মাযহাবী হাত উঠালে দূষণীয় হয়। এর পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে? এর উত্তর হলো শাফে’ঈ মতাবলম্বী শরীয়তের হাকিম তথা মুজতাহিদ দ্বারা ফায়সালা করিয়ে হাত উঠায়। মুজতাহিদ ভুল করলেও তা ক্ষমাযোগ্য। অপরদিকে লা-মাযহাবী যেহেতু কোন মুজতাহিদের মতামত নেয়নি, সেহেতু সে সঠিক কাজ করলেও দোষী সাব্যস্ত হবে।

যেমন বিচারকের রায় ব্যতিরেকে নিজের হাতে আইনকে তুলে নিয়ে কোন কাজ করলে সেটা অপরাধ। কিন্তু কোর্ট থেকে বিচারকের রায় নিয়ে ঐ একই কাজ করলে কোন অপরাধ হয় না। বিচারকই এক্ষেত্রে দায়ী থাকেন, বিচারক ন্যায় বদরের যুদ্ধবন্দীদের নিকট থেকে কিয়াস বা যুক্তি ভিত্তিতে ফিদ্য়া (মুক্তিপণ) আদায় করেছিলেন, পরে এর বিপরীত কুরআনের আয়াত নাযিল হয়। এতে বোঝা গেল, হুজুর (ﷺ) এর স্বীয় যুক্তিগ্রাহ্য এ কাজে আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু তাঁ সত্ত্বেও মুক্তপণ ফেরৎ দেওয়ার কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি। 


❏ বরং ইরশাদ করেন,


فَكُلُوْا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلاَلاً طَيِّبًا.


-‘‘এ সব মালামাল তোমরা ভোগ কর। এগুলো হালাল ও পবিত্র।’’  

{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ৬৯, পারাঃ ১০}


বোঝা গেল ইজতিহাদ প্রয়োগে ভুল হলে, সে ভুলের জন্য কোন কৈফিয়ত দিতে হয় না।



✧ পরিশিষ্টঃ


‘কিয়াস’ সম্পর্কিত বিষয়ের আলোচনা-

শরীয়তের দলীল চারটি- 

(১) কুরআন, 

(২) হাদীছ, 

(৩) ইজমা’য়ে উম্মত ও 

(৪) কিয়াস। 

ইজমা’র দলীল সমূহ আমি আগেই বর্ণনা করেছি যে, 


❏ কুরআন হাদীছের হুকুম হলো, “সাধারণ মুসলমানদের দলের অন্তভুর্ক্ত থাকো। যে এদের দল থেকে পৃথক হয়েছে, সে জাহান্নামী।” 


❏ কিয়াসের আভিধানিক অর্থ হলো, অনুমান করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় কিয়াস হলো মৌলিক মাসআলার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করে ওটার সহিত কোন অমৌলিক মাসআলার কারণ ও বিধির দিক থেকে সমন্বয় সাধন করা। অর্থাৎ, (মনে করুন) এমন একটি মাসআলা বা সমস্যার সমাধান বের করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হল, যার সম্পর্কে কুরআন-হাদীছে সুস্পষ্টভাবে উল্লে­খ নেই। তখন কুরআন বা হাদীছে বর্ণিত আলোচ্য মাসআলার সহিত সাদৃশ্যপূর্ণ কোন ‘আমল খুঁজ করে বের করা হল এবং এর কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় পূর্বক বলা হল যে, যেহেতু একই কারণ আলোচ্য মাসআলায় বিদ্যমান আছে, সেহেতু এ মাসআলায় অনুরূপ সিদ্ধান্ত স্থিরিকৃত হবে। 


দৃষ্টান্ত স্বরূপঃ 


(১) কেউ জিজ্ঞাসা করলো, স্ত্রীর সঙ্গে পায়ুকামের মাধ্যমে যৌনমিলন উপভোগ সম্পর্কে শরীয়তের বিধান কি? আমি উত্তর দিলাম যে, ঋতুস্রাবের সময় অপবিত্রতার কারণে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করা হারাম। তদ্রূপ আলোচ্য মাসআলায়ও ঐ একই কারণে উক্ত কর্ম হারাম হবে। 


(২) কেউ জিজ্ঞাসা করলোঃ পিতা যদি কোন নারীর সহিত অবৈধভাবে ব্যভিচার করে তাহলে তার ছেলের সহিত উক্ত নারীর বিবাহ বৈধ হবে কিনা? উত্তরে আমি বললাম যে, সঙ্গম ও পিতা-পুত্রের মধ্যে বিদ্যমান অবিচ্ছেদ্য শারীরিক সম্পর্কের কারণে বাপের বিবাহিত স্ত্রী ছেলের জন্য হারাম। সুতরাং, এখানেও যেহেতু একই কারণ বিদ্যমান সেহেতু উক্ত মেয়েটি ছেলের জন্য হারাম হবে। এটাকেই ‘কিয়াস’ বলা হয়। কিন্তু শর্ত হলো যিনি কিয়াস করবেন, তাকে মুজতাহিদ হতে হবে। যার তার কিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়। কিয়াস আসলে শরীয়তের হুকুমকে প্রকাশ করে থাকে। ইহা স্বতন্ত্র বা স্বয়ং সম্পূর্ণ কোন বিধি প্রকাশ করে না। ইহা কুরআন, হাদীছ ও সাহাবীগণের কার্যাবলীতে বিদ্যমান রয়েছে।



❏ কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে,


فَاعْتَبِرُوْا يَااُوْلِى الْاَبْصَارِ.


অর্থাৎ- হে দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, শিক্ষা গ্রহণ করো।  

{সূরাঃ হাশর, আয়াতঃ ২, পারাঃ ২৮}

     

অর্থাৎ কাফিরদের অবস্থার সঙ্গে তোমাদের নিজেদের অবস্থা যাচাই করো। তোমরাও যদি তাদের মত আচরণ কর, তাহলে তোমাদেরও একই পরণতি হবে। এছাড়াও কুরআনে মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়ার ঘটনাকে নিদ্রার সঙ্গে ও ক্ষেত শুকায়ে পুনরায় সবুজ শ্যামল রূপ ধারণ করার সঙ্গে তুলনা করেই ব্যক্তি করা হয়েছে।

কুরআন শরীফে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাফিরদের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এটাও কিয়াস।


❏ বুখারী শরীফের কিতাবুল ইতিসামে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করা হয়েছে এবং নাম দেয়া হয়েছে,


بَابُ مَنْ سُئِلَ عِلْمًا وَهُوَ مُشْتَغِلٌ فِي حَدِيثِهِ، فَأَتَمَّ الحَدِيثَ ثُمَّ أَجَابَ السَّائِلَ


-‘‘যে কোন নির্দিষ্ট সুবিদিত নীতিকে এমন একটি রীতির সঙ্গে তুলনা করা, যার হুকুম আল্লাহ তা’আলা ব্যক্ত করেছেন, যাতে প্রশ্নকারী বুঝতে পারে, এর বিবরণ সম্পর্কিত অধ্যায়।’’ 

{ক) বুখারীঃ আস-সহীহঃ কিতাবুল ই’তিসামঃ ২/১০৮৮

 খ) বুখারীঃ আস-সহীহঃ ৬/২৬৬৭ হাদিসঃ ৬৮৮৪}


❏ উক্ত অধ্যায়ে একটি হাদীছ বর্ণিত আছে, যেখানে হুজুর (ﷺ) কর্তৃক একটি মেয়ে লোককে কিয়াসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদীছটি হলো,


اِنَّ اِمْرِأة جَاءَتْ اِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ اِنَّ اُمِّىْ نَذَرَتْ اَنْ تَحُجَّ اَفَا حُخُّ عَنْهَا قَاَل نَعَمْ حُجِّىْ عَنْهَا اَرَئِيْتِ لَوْكَانُ عَلَى اُمِّكِ دَيْنُ اَكُنْتُ قَاضِيَةً قَالَتْ نَعَمْ قَالَ اِقْضُو الَّذِىْ لَهُ فَاِنَّ اللهَ اَحَقُّ بِالْقَضًاءِّ


-‘‘একজন মেয়ে লোক হুজুর (ﷺ) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, আমার মা হজ্বের মান্নত করেছিলেন, এখন আমি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্ব সমাপন করবো? ইরশাদ ফরমালেন- হ্যাঁ, হজ্ব করো, (এরপর বললেন) তোমার মায়ের কর্য থাকলে, তুমি তা পরিশোধ করতে কিনা? মেয়েটি আরয করলো, জী হ্যাঁ। নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ ফরমালেন, আল্লাহর কর্যও আদায় কর। কেননা আল্লাহ তা’আলার কর্য আদায়ের ব্যাপারটি সর্বাগ্রেই বিবেচ্য হবে।’’ 

{বুখারীঃ আস-সহীহঃ ১/২৫০ পৃ. কাদীমী কুতুবখানা, করাচী}

     

❏ মিশকাত শরীফের কিতাবুল ইমারাত ماعلى الولاة অধ্যায়ে তিরমিযী শরীফের ১ম খন্ডের ابواب الاحكام এর শুরুতে ও দারমী শরীফে উল্লেখিত আছে যে, যখন হুজুর (ﷺ) হযরত মু’আয ইবন জাবাল (رضي الله عنه) কে ইয়ামনের বিচারক নিয়োগ করে পাঠালেন, তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ তুমি কিভাবে ফায়সালা করবে? আরয করলেন, আল্লাহর কালাম দ্বারা। নবী (ﷺ) ফরমালেনঃ যদি আল্লাহর কালামে না পাও? আরয করলেন, তাঁর রাসূলের সুন্নাত দ্বারা। নবী (ﷺ) ফরমালেনঃ যদি সেখানেও না পাও? আরয করলেনঃ


اَجْتَهِدُ بِزَائِىْ وَلاَ الُوْقَالَ فَضَرَبَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ عَلَىْ صَّدْرِهِ وَقَالَ اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِىْ وَفَّقَ رَسُوْلَ رَسُوْلُ اللهِ لِمَا يَرْضَىْ بِهِ رَسُوْلُ اللهِ


-‘‘নিজের রায়কে সম্বল করে ইজতিহাদ প্রয়োগ করবো। (বর্ণনাকারী বলেন) তখন হুজুর (ﷺ) তার বুকে হাত মারলেন এবং ফরমালেন খোদার শুকরিয়া যে, তিনি তাঁর রাসূলের (ﷺ) দূতকে এমন কাজের উপযুক্ততা দিয়েছেন, যে কাজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সন্তুষ্ট হন।’’ 

{ক) তিরমিজীঃ আল-জামেঃ ৩/৬০৮ পৃ. হাদীসঃ ১৩২৭

খ) খতিব তিবরিযীঃ মেশকাতঃ পৃ. ৩২৪ হাদিসঃ

গ) আবু দাউদঃ আস-সুনানঃ ৩/৩০৩ হাদিসঃ ৩৫৯২

ঘ) দারেমীঃ আস-সুনানঃ ১/৭২ হাদিসঃ ১৭০

ঙ) ইমাম বগভীঃ শরহে সুন্নাহঃ ৫/৩৫২

চ) আবু হুমায়দীঃ আল-মুসনাদঃ ১/৭২ হাদিসঃ ১২৪

ছ) ইমাম তাহাভীঃ আল-মুসনাদঃ ৭/২৭৮ হাদিসঃ ৬৭৬০

জ) ইমাম যাহাবীঃ সিয়ারু-আলামিন আন্-নুবালাঃ ১/৪৪৮

ঝ) ইমাম আহমদঃ আল-মুসনাদঃ ৩৬/৩৩৩ পৃ. হাদিসঃ ২২০০৭}


এ থেকে কিয়াসের সমর্থনে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেল। যেহেতু হুজুর (ﷺ) এর ইহকালীন জীবনে ‘ইজমা’ হতে পারে না, সেহেতু মু’য়াজ (رضي الله عنه) ইজমার উল্লে­খ করেন নি। এরূপ সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের কিয়াসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। 


❏ হযরত ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) কিয়াস করে এমন একটি মেয়েকে, যে মহর ধার্যকরণ ব্যতিরেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল, ও পরে স্বামী মারা গিয়েছিল, মহরে মিছল (উক্ত মেয়ের নিকট আত্মীয়ার ক্ষেত্রে ধার্যকৃত মহরের সমপরিমাণ মহর) প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। (নাসায়ী শরীফ ২য় খন্ড, ৮৮ পৃষ্ঠা দেখুন) 


❏ লা-মাযহাবীরা কুরআনের আয়াত,


 اَجْتَنِبُوْا كَثِيْرًامِنَ الْظَنِّ 


"অধিকাংশ ধারণার বশবর্তী হওয়ার থেকে বিরত থাকো।"

{সূরাঃ হুজরাত, আয়াতঃ ১২, পারাঃ ২৬}

      

এর ভিত্তিতে যে আপত্তিটা উত্থাপন করে থাকে, এর উত্তর হলো আয়াতে উল্লেখিত ধারণা বলতে খারাপ বা বিরূপ ধারণা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করো না। এজন্যই তো উক্ত আয়াতের পরে গীবত (পরনিন্দা) ইত্যাদির নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়েছে। তা না হলে কিয়াস ও গীবতের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? যেমনঃ


❏ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমানঃ


اِنَّمَا النَّجْوَى مِنَ الشَّيْطَنِ.


-‘‘‘পরামর্শ করাটা শয়তানের পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়।’’  

{সূরাঃ মুযদালাহ, আয়াতঃ ১০, পারাঃ ২৮}

      

তাহলে কি প্রত্যেক পরামর্শই শয়তানী কাজ? কখনও নয়। বরং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক যে পরামর্শ, সেটাই হলো শয়তানী কাজ। তদ্রূপ যে সকল ক্ষেত্রে কিয়াসের নিন্দা করা হয়েছে, সে সকল ক্ষেত্রে ওই কিয়াসের কথাই বলা হয়েছে, যা খোদার হুকুমের মুকাবিলায় প্রয়োগ করা হয়। যেমন শয়তান সিজদার নির্দেশ পাবার পর ‘কিয়াস’ করে, আল্লাহর হুকুমকে অগ্রাহ্য করল। এ ধরনের কাজ কুফর বৈ আর কি! 

লা মাযহাবীরা আরও বলে যে আল্লাহ তা’আলা ফরমান,

اِنَّمَا اَتَّبِعُ مَايُوْحَىاِلَىَّ 

(আমার কাছে ওহী আসে আমি সেটারই অনুসরণ করি)। 

{সূরাঃ আ’রাফ, আয়াতঃ ২০৩, পারাঃ ৯}


 اِنَّمَا (ইন্নামা) শব্দটি حصر অর্থাৎ একট বিশেষ দিককেই সীমাবদ্ধ করণের জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ اِنَّمَا শব্দটি দ্বারা এ কথার উপর জোর দেয়া হয়েছে যে ওহী ছাড়া যেন আর কোন কিছু, যথা- ইজমা, কিয়াস ইত্যাদির অনুসরণ করা না হয়। শুধু কুরআন-হাদীছেরই যেন অনুসরণ করা হয়। কিন্তু তাদের জানা দরকার যে ইজমা-কিয়াসের উপর ‘আমল করা মানে কুরআন-হাদীছের উপরই আমল করা। কিয়াসের কাজ হলো কেবল পরিষ্ফুট করে ব্যক্ত করা।


পরিশেষে কিয়াস অস্বীকারকারীদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, যেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বিবরণ কুরআন হাদীছে পাওয়া না যায়, কিংবা বাহ্যিক দৃষ্টিতে হাদীছ সমূহের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বিবৃত হয়, তখন কি করবেন? যেমন বিমানে নামায পড়ার কি নিয়ম? অনুরূপ জুমার নামাযে প্রথম রাকআতে জামাআতের মুসল্লীগণ মওজুদ ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাকআতে জামাআতের মুসাল্লীগণ পেছন থেকে চলে যান। তখন কি জুমা’র নামায আদায় করবেন, না জুহরের নামায? এর রকম অন্যান্য কিয়াস নির্ভর মাসাইলের বেলায় আপনাদের কি উত্তর হবে? এ জন্যই বলছি, কোন ধর্মতাত্ত্বিক ইমামের দামান দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরুন, এটাই সর্বোত্তম পন্থা। আল্লাহ তাওফীক দান করুন।

 
Top