বিষয় নং-০৯: আ‘লা হযরত (رحمة الله)-এর ফতোয়ায়ে আফ্রিকায় বর্ণিত একটি হাদিসের অপব্যাখ্যার জবাব


উক্ত হাদিসটি নিয়ে সমাজের কিছু নামধারী আলেম রাসূল (ﷺ) কে তাঁর রওযা মোবারকের মাটি দ্বারা সৃষ্টি তা প্রমাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।


❏ ইমাম আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরলভী (رحمة الله) তাঁর ফতোয়ায়ে আফ্রিকা ৮৯ পৃষ্ঠায় খতিবে বাগদাদীর বরাতে মানব সৃষ্টির ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে উক্ত হাদিসটি উলে­খ করেন। আমাদের কতিপয় দেওবন্দী হযরতগণ দাবী করে থাকেন যে, ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (رحمة الله) রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরি বলেছেন। নাউযুবিল্লাহ!


প্রথমত. আমি বলবো, আ’লা হযরত (رحمة الله) হাদিস বর্ণনাকারী নন বরং খতিবে বাগদাদী , এমন একটি হাদিস তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন বলে আ’লা হযরত (رحمة الله) তাঁর কিতাব থেকে হাদিসটি সংকলন করেছেন।


দ্বিতীয়ত. উক্ত হাদিসটির সনদের উপরে ভিত্তি করবে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য না অগ্রহণযোগ্য।


তৃতীয়ত. হক্কানী গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিসগণের মতামত কী উক্ত হাদিসের ব্যাপারে তা দেখতে হবে, তার পর বলা যাবে যে উক্ত হাদিসের উপরে আক্বীদা রাখা যাবে কি না।


অপরদিকে এটি আ‘লা হযরত (رحمة الله)-এর কথা বা উক্তি নয়, বরং তিনি একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন মাত্র। আমাদের কতিপয় বিভ্রান্তিকর আলেম এ জাল হাদিসকে তাঁর অভিমত বলে চালিয়ে দিতে চান, সে সমস্ত আলেমদের কতিপয় তালিকা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।


১. পাকিস্তানের দেওবন্দী আলেম মাওলানা সরফরায খাঁন সফদর তার নূর আওর বাশার ৫ পৃষ্ঠায় (যা বাংলায় অনুবাদ করেছেন হাটহাজারী মাদরাসার থানবী প্রকাশনী হতে) তাতে তিনি এমনটি উল্লেখ করেছেন।


২. ওহাবী দেওবন্দী মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী তার বিভ্রান্তির অবসান গ্রন্থের ৯৪-৯৫ পৃষ্ঠায় এবং মাওয়ায়েজে ওলীপুরীর পৃষ্ঠা নং- ১/২৪২ (আনোয়ার লাইব্রেরী,  ১১/১ বাংলা বাজার ইসলামী টাওয়ার হতে প্রকাশিত) তাতে তিনি এমনটি উল্লেখ করেছেন।


৩. ধামতী মাদ্রাসার সাবেক মুহাদ্দিস ওহাবী দেওবন্দী মাওলানা আব্দুল করিম সাহেবের “তাওহীদ,  রেসালাত ও নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) এর সৃষ্টি রহস্য” এর ২১১ পৃষ্ঠায়, তাতে তিনি এমনটি উল্লেখ করেছেন।


৪. অপরদিকে দেওবন্দী মৌলভী ওলীপুরী তার “সুন্নি নামের অন্তরালে” গ্রন্থের একাধিক স্থানেও অনুরূপ উলে­খ করেছেন।


৫. ওহাবী দেওবন্দী মাওলানা আমিরুল ইসলাম ফরদাবাদী তার “বিশ্বনবী (ﷺ) এর সৃষ্টি ও ইলমে গায়ব” পুস্তকের ৫৪ পৃষ্ঠায় (ফরদাবাদ প্রকাশনী), তাতে তিনি এমনটি উল্লেখ করেছেন।


এ হাদিসের বিষয়ে সনদ গবেষণা তাত্ত্বিক আলোচনা:


প্রথম সূত্র:


أَخْبَرَنَاهُ أَحْمَدُ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ غَالِبٍ، قَالَ: أَخْبَرَنَا أَبُو بَكْرٍ الإِسْمَاعِيلِيُّ، قَالَ: أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يُوسُفَ الْهَرَوِيُّ قَاطِنُ دِمَشْقَ، قَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْبَغْدَادِيُّ بِمِصْرَ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ سَهْلٍ أَبُو هَارُونَ الرَّازِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ يُوسُفَ الأَزْرَقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ الشَّيْبَانِيُّ، عَنْ أَبِي الأَحْوَصِ الْجُشَمِيِّ، عَن عبد الله بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ يُذَرُّ عَلَى سُرَّتِهِ مِنْ تُرْبَةٍ، فَإِذَا طَالَ عُمُرُهُ رَدَّهُ اللَّهُ إِلَى تُرْبَتِهِ الَّتِي خَلَقَهُ اللَّهُ مِنْهَا وَأَنَا وَأَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ خُلِقْنَا مِنْ تُرْبَةٍ وَاحِدَةٍ وَفِيهَا نُدْفَنُ 


-“হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: প্রত্যেক শিশুর নাভিতে সেই মাটি রাখা হয় যেখানে তাকে দাফন করা হবে। তিনি আরো বলেন: আমি, আবু বকর, উমর একই মাটির তৈরী এবং একই জায়গায় দাফন হব।” ১৪৯

➥{ইমাম খতিবে বাগদাদী : তারিখে বাগদাদ, ৩/৫৪২ পৃ. হাদিস,  ১০৬২ ও ৩/১৫৫ পৃ. হা/১১১৪ ১৫/৩২ পৃ. হা/৬৯৫০, ইবনে আসাকীর, তারীখে দামেস্ক, ৪৪/১২০ পৃ. হাদিস: ৯৫৭৬, দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৪/২৮ পৃ. হাদিস: ৬০৮৭, ইমাম ইবনে জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাত, ১/১৯৩ পৃ. হাদিস:৩১০, আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ, ১১/৩৮৮ পৃ. হাদিস:৫২৪০, তিনি বলেন,  হাদিসটি বাতিল।}


সনদ পর্যালোচনা:


❏ এই হাদিস দিয়েও অনেকে রাসূল (ﷺ) কে মাটির তৈরী বলা অপচেষ্টা করেন। অথচ এটি একটি গরীব ও বানোয়াট তথা জাল হাদিস। খতিবে বাগদাদী (رحمة الله) হাদিসটিকে غريب ‘গরীব’ বলেছেন। যেমন উল্লেখ আছে:


غريب من حديث الثوري عن الشيباني، لا أعلم يروي إلا من هذا الوجه،


-“শায়বানী থেকে সাওরীর বর্ণিত রেওয়াতটি ‘গরীব’ এই সূত্রটি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য কোন সূত্র আমার জানা নেই।” 


(তারিখে বাগদাদ, ৩য় খণ্ড, ৫৪২ পৃ: রাবী নং ১০৬২)।


❏ এই হাদিসের সনদে একজন মিথ্যাবাদী ও বাতিল বর্ণনাকারী রয়েছে। তার নাম হল: موسى بن سهل بن هارون (মূসা ইবনে সাহল ইবনে হারুন) যেমন ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন: 


مُوسَى بن سهل بن هَارُون الرَّازِيّ عَن اسحاق الْأَزْرَق بِخَبَر كذب 


-“মূসা ইবনে সাহল ইবনে হারুন রাজী বর্ণনাকারী ইসহাক্ব আযরাকী থেকে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করত।” 


(ইমাম যাহাবী: আল মুগনী, রাবী নং ৬৪৯৪)


❏ বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে জাওযী (رحمة الله) একে موضوع ‘জাল হাদিস’ বলেছেন। 


(ইমাম ইবনে জাওযী: কিতাবুল মাওদ্বুআত, ১ম খণ্ড, ৩২৮ পৃ:; তাফসিরে মারেফুল কোরআন, ৮৫৬ পৃ:, সৌদি সরকারের বিনা মূল্যে দেওয়া ছাপা, তাফছিরে মাজহারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৭৩ পৃ:)।


❏ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) ও হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) আরো বলেন:


موسى بن سهل بن هارون الرازي عن إسحاق الأزرق بخبر باطل 


-“মূসা ইবনে সাহল ইবনে হারুন রাজী ইসহাক্ব আযরাকী থেকে বাতিল রেওয়াত বর্ণনা করত।” 


(ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতদাল, রাবী নং ৮৮৭৩; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ৪১৪)


অতএব, এই বর্ণনা বাতিল ও ভিত্তিহীন। আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়াত হুজ্জাত বা দলিল হবে না। 


দ্বিতীয় সূত্র:


❏ অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়াত উল্লেখ করা হয়,


حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ الْحُسَيْنِ بْنِ مُحَمد بْنُ عَمْرو بْنِ أَبِي سَلَمَةَ التِّنِّيسِيُّ، حَدَّثني عَبد اللَّهِ بْنُ مُحَمد بْنِ مُوسَى بْنِ هارون بتنيس، حَدَّثَنا إِبْرَاهِيمُ بْنُ عُبَيد التَّمَّارُ عَنْ يعقوب بن الجهم، حَدَّثَنا مُحَمد بْنُ وَاقِدٍ عَنِ الْمَسْعُودِيِّ عَنْ عُمَر مَوْلَى عَفْرَةَ، عَن أَنَس بن مالك قَالَ قَال رَسُول اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيهِ وَسلَّمَ... قَالَ لأَن اللَّهَ خَلَقَنِي وَخَلَقَ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ مِنْ تُرْبَةٍ وَاحِدَةٍ وَفِيهَا نُدْفَنُ.


-“হযরত আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন:... আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আমাকে, আবু বকর ও উমরকে একই মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেখানে দাফন করা হবে।” 


(ইমাম ইবনে আদী: আল কামিল ফি দোয়াফাই রিজাল, ৮ম খণ্ড, ৪৭৫-৭৬ পৃ:)


❏ এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) ও হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেন: هذا حديث موضوع -“এই হাদিস বানোয়াট বা ভিত্তিহীন।” 


(ইমাম যাহাবী: মিযানুল এ’তেদাল, রাবী নং ৯৮০৯; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ১০৯৬)


❏ ইমাম যাহাবী (ﷺ) উল্লেখ করেন: فقال ابن عدي: البلاء فيه من يعقوب. -“ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) বলেছেন: এর সনদে ইয়াকুব নামক রাবী হল দোষী।” 


(ইমাম যাহাবী: মিযানুল ই‘তিদাল, রাবী নং ৯৮০৯; ইমাম আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ১০৯৬)


আকায়েদ শাস্ত্রে এরূপ রেওয়াতকে হুজ্জাত বা দলিল হিসেবে দাঁড় করানো হাস্যকর ব্যাপার বৈ কিছুই নয়। 



চতুর্থ সূত্র: 


❏ অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়াত উল্লেখ করা হয়,


عن محمد بن سيرين انه قال لو حلفت حلفت صادقا غير شاك ولا مستثنى ان الله تعالى ما خلق نبيه صلى الله عليه وسلم ولا أبا بكر ولا عمر الا من طينة واحدة


-“মুহাম্মদ ইবনে সিরীন (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যদি আমি কসম করে বলি তাহলে সত্যি হবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা নবী ﷺ, হযরত আবু বকর ও উমরকে একই মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” 


(ইমাম হাকেম তিরমিজি: নাওয়াদেরুল উছুল, ১ম খণ্ড, ২৬৮ পৃ:; উমদাতুল ক্বারী, মাজহারী) 


এই বর্ণনার কোন সনদই নেই। আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়াত হুজ্জত বা দলিল হবে না। 



পঞ্চম সূত্র: 


❏ অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়াত উল্লেখ করা হয়,


أَخْبَرَنِي أَبُو الْقَاسِمِ عَلِيُّ بْنُ الْحَسَنِ بْنِ مُحَمَّدِ بْنِ أَبِي عُثْمَانَ الدَّقَّاقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ الْوَرَّاقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو إِسْحَاقَ إِبْرَاهِيمُ بْنُ الْحُسَيْنِ بْنِ دَاوُدَ الْقَطَّانُ سَنَةَ إِحْدَى عَشْرَةَ وَثَلاثِ مِائَةٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ خَلَفٍ الْمَرْوَزِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِبْرَاهِيمَ الْمَرْوَزِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ جَعْفَرِ بْنِ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خُلِقْتُ أَنَا وَهَارُونُ بْنُ عِمْرَانَ، وَيَحْيَى بْنُ زَكَرِيَّا، وَعَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ مِنْ طَيِنَةٍ وَاحِدَةٍ 


-“মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মদ তদীয় পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: আমি, হারুন ইবনে ইমরান, ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া, আলী ইবনে আবী তালেব একই মাটি থেকে তৈরী।” 


(কাজী শাওকানী: ফাওয়াইদুল মাজমুআহ ফি আহাদিসিল মাওদ্বুআহ, হাদিস নং ৩৯; তারিখে বাগদাদ, রাবী নং ৩০৪১)



❏ মাওলানা কাজী শাওকানী বলেন: 


رواه الخطيب عن علي مرفوعًا، وهو موضوع. 


-“খতিব বাগদাদী ইহা আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন আর ইহা ভিত্তিহীন। 


(কাজী শাওকানী: ফাওয়াইদুল মাজমুয়া, হাদিস নং ৩৯)


❏ ‘কাশফুল হাছিছ’ গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করে লিখেছেন: هَذَا مَوْضُوع -“ইহা ভিত্তিহীন কথা।” 


(কাশফুল হাসিস, রাবী নং ৬৫৬)


❏ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) লিখেছেন: هَذَا مَوْضُوع -“ইহা ভিত্তিহীন কথা।” 


(ইমাম যাহাবী: মিযানুল ইতিদাল, রাবী নং ৭৪৯০ এর ব্যাখ্যায়)


❏ হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) বলেছেন: هَذَا مَوْضُوع -“ইহা ভিত্তিহীন কথা।” 


(ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: লিসানুল মিযান, রাবী নং ৫৩৬ এর ব্যাখ্যায়)


বলুন, জাহেল ছাড়া এরূপ রেওয়াত কেউ দলিল দিবে? আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ রেওয়াত হুজ্জাত বা দলিল হবে না। 



ষষ্ঠ সূত্র:


❏ অনুরূপ আরেকটি মাওজু বা বাতিল রেওয়াত উল্লেখ করা হয়,


أخبرنا أبو بكر محمد بن القاسم بن المظفر بن الشهرزوري بدمشق أنا أبو عمرو عثمان بن محمد بن عبيد الله المحمي بنيسابور أنا الشيخ أبو عبد الله محمد بن عبد الله الصوفي نا أبو أحمد محمد بن إبراهيم بن أبرويه بأستراباذ نا أبو الحسن علي بن الحسن القومسي بجرجان نا محمد بن الفضل بن حاتم نا محمد بن الحسن الجوري نا أحمد بن الحسن بن أبان المصري نا الضحاك بن مخلد عن ابن عون عن ابن سيرين عن أبي هريرة قال قال رسول الله (صلى الله عليه وسلم)... وخلقت أنا وأبو بكر وعمر من طينة واحدة وندفن جميعا في بقعة واحدة


-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে করিম (ﷺ) বলেছেন:... আমি আবু বকর ও উমর একই মাটির তৈরী ও সবাই একই স্থানে দাফন হব।” 


(ইমাম ইবনে আসাকির: তারিখে দামেস্ক, ৪৪তম খণ্ড, ১২১ পৃ:)


❏ এর বর্ণনার মাঝে أحمد بن الحسن بن أبان المصري (আহমদ ইবনে হাছান ইবনে আবান মিছরী) রয়েছে। তার ব্যাপারে ইমামদের অভিমত লক্ষ্য করুন:-


قال ابن عدي: كان يسرق الحديث. وقال ابن حبان: كذاب دجال، يضع الحديث على الثقات. وقال الدارقطني: وهو كذاب.


-“ইমাম ইবনে আদী  বলেন: সে হাদিস চুরি করত। ইমাম ইবনে হিব্বান  বলেন: সে মিথ্যাবাদী দাজ্জাল ও বিশ^স্ত রাবী থেকে হাদিস জালকারী। ইমাম দারে কুতনী বলেন: সে মিথ্যাবাদী।” 


(ইমাম যাহাবী: মিযানুল এতেদাল, রাবী নং ৩৩০; ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী: লিছানুল মিযান, রাবী নং ৪৮০)


আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ মিথ্যাবাদীর রেওয়াত কখনোই হুজ্জাত বা দলিল হবেনা। 



সপ্তম সূত্র:


❏ অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়,


خلقت أنا وأبو بكر وعمر من طينة واحدة. الديلمي عن ابن عباس


-“আমি আবু বকর, উমর একই মাটির তৈরী। ইমাম দায়লামী  হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে এটি বর্ণনা করেছেন।” 


(দায়লামী, আল-ফিরদাউস, হা/২৯৫১, ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, হাদিস নং ৩২৬৮৩; ইমাম সুয়ূতি: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ১১৯৫৩) 


এই বর্ণনার কোন সনদই নেই। আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই এরূপ ভিত্তিহীন, বানোয়াট রেওয়ায়েত হুজ্জাত বা দলিল হতে পারে না। 



অষ্টম সূত্র:


❏ অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়াত উল্লেখ করা হয়,


 وعن محمد بن علي قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم... وخلقت أنا وجعفر من طينة واحدة (ابن عساكر عن وهب بن وهب عن جعفر بن محمد عن أبيه مرسلاً، ووهب كان يضع الحديث


-“মুহাম্মদ ইবনে আলী বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন:... আমি ও জাফর একই মাটির তৈরী। (ইমাম সুয়ূতী  বলেন) ওহাব ইবনে ওহাব বর্ণনা করেছেন জাফর ইবনে মুহাম্মদ থেকে মুরসাল রূপে। আর বর্ণনাকারী ওহাব হাদিস জাল করতো।” 


(ইমাম সুয়ূতী: জামেউল আহাদিস, হাদিস নং ১১৯৫০; তারিখে ইবনে আসাকির, ৭২তম খণ্ড, ১২৬ পৃ:)


দেখুন ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন ইহা মুরসাল ও জাল বা মিথ্যা বর্ণনা। আর জাল রেওয়াত আকায়েদ শাস্ত্রে কখনোই হুজ্জাত বা দলিল হবে না। 



নবম সূত্র:


❏ অনুরূপ আরেকটি বাতিল রেওয়াত উল্লেখ করা হয়,


مُحَمَّد بن خلف الْمروزِي قَالَ الذَّهَبِيّ كذبه يحيى بن معِين قَالَه بن الْجَوْزِيّ فِي الموضوعات قَالَ ثَنَا مُوسَى بن إِبْرَاهِيم عَن مُوسَى بن جَعْفَر بن مُحَمَّد عَن ابائه مَرْفُوعا خلقت أَنا وَهَارُون وَعلي من طِينَة وَاحِدَة هَذَا مَوْضُوع 


-“মুহাম্মদ ইবনে খালাফ মারওয়াজী সম্পর্কে ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেন, ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। ইমাম ইবনে জাওযী (رحمة الله) তার ‘মাওদ্বুআত’ গ্রন্থে  এরূপ উল্লেখ করেছেন। মূসা ইবনে ইব্রাহিম বর্ণনা করেছেন- মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মদ হতে- তিনি তাদের পিতার সূত্রে মারফ‚ রূপে: আমি হারুন ও আলী একই মাটি থেকে তৈরী। আর ইহা বানোয়াট কথা।”  


(কাশফুল হাসিস, রাবী নং ৬৫৬, ১ম খণ্ড, ২২৭ পৃ:; মুজামে শুয়ূখু তাবারী, রাবী নং ১১২)


উল্লেখিত প্রমাণ ভিত্তিক আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রিয় নবীজি রাসূলে করিম (ﷺ) মাটির তৈরী বিষয়ক সকল রেওয়াত ভ‚য়া, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বাতিল। এর মধ্যে কয়েকটির কোন সনদই নেই। সকলেই অবগত আছেন, উসূলে হাদিসের ভাষায় একাধিক যঈফ হাদিস একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে হাছান লি’গাইরিহীর স্তরে পৌঁছে, কিন্তু একাধিক জাল ও বানোয়াট রেওয়ায়েত একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হয় না। তাই কেউ যদি একাধিক রেওয়ায়েত দেখে ইহাকে ‘হাসান’ বলে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে সে ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রে দক্ষ ছিল না।


আমরা সকলেই জানি, বায়হাকীকে সহীহ্ সনদে আছে: শেষ জামানায় হযরত ঈসা (عليه السلام) পৃথিবীতে আসবেন এবং রাজত্ব করবেন। পরে তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁকে রাসূল (رضي الله عنه) এর রওজা মোবারকের পাশে দাফন করা হবে। এখনো সেই দাফনের জায়গাটুকু খালি আছে। যদি এটা সঠিক হাদিস হত তাহলে আবু বকর, উমর (رضي الله عنه) এর সাথে হযরত ঈসা (رضي الله عنه) এর নামও থাকতো। সব চোরেই চোরি করে এবং সাথে প্রমাণও রেখে যায়!।



এক নজরে বিপরীতমুখি হাদিস সমূহ:


অপরদিকে উক্ত হাদিসের বিপরীতে তিনটির বেশি দুর্বল হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সেই হযরতবৃন্দগণ মনে হয় যেন এগুলো দেখেইনি।


প্রথম সূত্র: 


❏ এটি ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله) তার “আমলিয়্যাহ” গ্রন্থে সংকলন করেছেন হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান- 


قال أبو نعيم في أماليه: حدثنا محمد بن محمد بن عمرو بن زيد إملاء، حدثنا أحمد بن يوسف، حدثنا  أبو شعيب صالح بن زياد السوسي، حدثنا الهيثم بن جميل، حدثنا أبو معشر، عن المقبري، عن أبي هريرة، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: خلقني الله من نوره، وخلق أبا بكر من نوري، وخلق عمر من نور أبي بكر، وخلق  أمتي من نور عمر، وعمر سراج أهل الجنة. 


-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা আমাকে তাঁর নূর (ফয়েযের নূর) থেকে সৃষ্টি করেছেন। হযরত আবু বকরকে আমার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন,  উমারকে আবু বকরের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার উম্মতকে উমরের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর উমর হল জান্নাত বাসীদের প্রদীপ স্বরূপ।’’ ১৫০

➥{ইমাম যাহাবী : মিযানুল ই’তিদাল : ১/১৯০ পৃ. রাবী : ৮০৯}


সনদ পর্যালোচনা:


❏ তবে উক্ত সনদে ‘আহমদ ইবনে ইউসুফ’ নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার বিষয়ে বলেছেন لا يعرف -‘‘তাকে আমি চিনি না।’’  ১৫১

➥{ইমাম যাহাবী : মিযানুল ই’তিদাল : ১/১৯০ পৃ. রাবী : ৮০৯}


❏ অনুরূপ ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله)ও উলে­খ করেছেন। ১৫২

➥{ইমাম যাহাবী : মিযানুল ই’তিদাল : ১/১৯০ পৃ. রাবী : ৮০৯, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী : লিসানুল মিযান : ১/৩৬২ পৃ.}


হাদিসটি দুর্বল পর্যায়ের তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে এর সমর্থনে আরো দুটির বেশি সনদ রয়েছে।


দ্বিতীয় সূত্র: 


❏ ইমাম দায়লামী (رحمة الله) (ওফাত: ৫০৯ হিজরী) তিনি অনুরূপ আরেক সনদ বর্ণনা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে (رضي الله عنه) বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন


إِن الله عز وَجل خلقني من نوره وَخلق أَبَا بكر من نوري وَخلق عمر من نور أبي بكر وَخلق الْمُؤمنِينَ كلهم من نور عمر غير النَّبِيين وَالْمُرْسلِينَ -


-‘‘আল্লাহ্ আমাকে তাঁর নূর (ফয়েযের নুর) থেকে সৃষ্টি করেছেন,  আবু বকরকে আমার নূর থেকে, উমরকে আবু বকরের নূর থেকে এবং নবী রাসূল ব্যতীত মুমিনগণের সকলকেই উমরের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।’’  ১৫৩

➥{ইমাম দায়লামী : আল-মুসনাদিল ফিরদাউস : ১/১৭১ পৃ. হা/৬৪০}


ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর প্রথম বর্ণনাটি সম্পর্কে তার গ্রন্থের ৩২০ পৃষ্ঠায় লিখেন-“মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি মিথ্যা ও বানোয়াট।” তার নিকট আমার প্রশ্ন কোন মুহাদ্দিস হাদিসটি জাল বা বানোয়াট বলেছেন? আর বলে থাকলে তার নাম উলে­খ করলেন না কেনো? আমি নিজে স্বীকার করেছি যে হাদিসটির সনদ দুর্বল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে হাদিসটির একাধিক সনদ রয়েছে, 


দ্বিতীয় সনদটির ব্যাপারে তিনি বলেন-“এ অর্থে আরেকটি ভিত্তিহীন কথা”। তার কাছে আমার প্রশ্ন উক্ত হাদিসটির সনদ ভিত্তিহীন তাকে কে বললো? আর তার কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ থাকলে তিনি উলে­খ করলেন না কেন?


তৃতীয় সূত্র: 


❏ ইমাম কুরতুবী (رحمة الله) [ওফাত.৬৭১ হি.] উক্ত হাদিসটির তৃতীয় একটি সূত্র বর্ণনা করেছেন-


وَذَكَرَ الثَّعْلَبِيُّ: وَقَالَ أَنَسٌ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: (إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى خَلَقَنِي مِنْ نُورٍ وَخَلَقَ أَبَا بَكْرٍ مِنْ نُورِي وَخَلَقَ عُمَرَ وَعَائِشَةَ مِنْ نُورِ أَبِي بَكْرٍ وَخَلَقَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْ أُمَّتِي مِنْ نُورِ عُمَرَ وَخَلَقَ الْمُؤْمِنَاتِ مِنْ أُمَّتِي مِنْ نُورِ عَائِشَةَ


-‘‘ইমাম ছালাভী (رحمة الله) তাঁর ‘তাফসীরে’ উলে­খ করেন হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেন নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘য়ালা আমাকে তাঁর নূর (ফয়যের নূর) থেকে সৃষ্টি করেছেন, নিশ্চয় আবু বকর (رضي الله عنه) কে আমার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন, উমর (رضي الله عنه) ও আয়েশা (رضي الله عنه) কে আবু বকরের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন সমস্ত মু‘মিনদেরকে উমরের নূর হতে আর সমস্ত মু‘মিন নারীদেরকে হযরত আয়েশার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন।’’  ১৫৪

➥{ইমাম কুরতুবী : তাফসীরে কুরতুবী: ১২/২৮৬ পৃ. সূরা নুর,  আয়াত,  ৩৯}


এ হাদিসটির বিষয়ে ইমাম কুরতুবী (رحمة الله) সনদ বর্ণনা না করলেও ইমাম ছালাভী (رحمة الله) সনদ বর্ণনা করেছেন।


❏ ইমাম ছালাভী (ওফাত. ৪২৭ হি.) তার ‘তাফসীরে ছালাভীতে’ হাদিসটি সনদসহ সংকলন করেছেন এভাবে-


أخبرنا أبو عثمان سعيد بن محمد بن محمد بن إبراهيم العدل قال: حدّثنا أبو الحسين محمد بن منصور الواعظ قال: حدّثنا أبو عمر محمد بن عبد الواحد الزاهد قال: حدّثنا محمد ابن يونس الكديمي قال: حدّثنا عبيد الله بن عائشة قال: حدّثنا حماد بن سلمة عن ثابت عن أنس قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلّم: أنّ الله تعالى خلقني من نوره، وخلق أبا بكر من نوري، وخلق عمر وعائشة من نور أبي بكر!، وخلق المؤمنين من أمّتي من الرجال من نور عمر، وخلق المؤمنات من أمّتي من النساء من نور عائشة،


-‘‘আমাকে সংবাদ দিয়েছেন আবু উসমান...তিনি তাবেয়ী হযরত সাবেত (رحمة الله) হতে তিনি হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন...।’’  ১৫৫

➥{ক. ইমাম ছালাভী, তাফসীরে ছালাভী,  ৭/১১১ পৃ. সূরা নুর, ৩৯,  দারুল ইহউয়াউত তুরাস আল-আরাবী,  বয়রুত,  লেবানন।}


সনদ পর্যালোচনা:


এ হাদিসটির সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের, তাতে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবী রয়েছেন কীনা জানি না। তাই তিনটি সনদকে যদি দুর্বলও বলা হয়, তাহলেও উসূলে হাদিসের পরিভাষায় সামগ্রিকভাবে ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য এতে কোনো সন্দেহ নেই।’’ ১৫৬

➥{ইমাম দায়লামী : আল-ফিরদাউস : ৪/১৭৮ পৃ., তাহের পাটনী : আত-তাযকিরাতুল মওদ্বুআত : ১৯৫ পৃ., ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি : আল-লাআলিল মাসনূ : ১/১৫০ পৃ. ও ১/৩২০ পৃ., ইবনুল ইরাক : তানযীহুশ-শরীয়্যাহ : ১/৩৫১ পৃ.}


সুতরাং আমাদের উচিত উক্ত ‘হাসান’ পর্যায়ের হাদিসগুলো বর্ণনা করা এবং মওদ্বু বা জাল হাদিস বর্ণনা পরিহার করা।

 
Top