দ্বিতীয় অধ্যায়

কবরে আযান দেয়া প্রসঙ্গে আপত্তি ও জবাবসমূহ


এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারীগণ নিম্ন বর্ণিত আপত্তিগুলো উত্থাপন করে থাকেন। ইনশা আল্লাহ, এগুলো ছাড়া তাদের আর কিছু বলার নেই।   


১নং আপত্তি- কবরে আযান দেওয়াটা বিদআত। প্রত্যেক বিদআত হারাম হেতু এ আযানটাও হারাম। হুযুর ﷺ থেকে এর কোন প্রমাণ নেই। সেই পুরানো কথারই পুনরাবৃত্তি।


উত্তর- আমি প্রথম অধ্যায়ে প্রমাণ করেছি যে দাফনের পর আল্লাহর যিকর তাসবীহ ও তকবীর বলা হুযুর ﷺ থেকে প্রমাণিত আছে। যার মূল প্রমানিত, সেটা সুন্নাত; এতে পরিবর্ধন নিষেধ নয়। ফকীহগণ বলেন যে, হজ্বের মধ্যে তলবিয়ার (তকবীর বলা) যে শব্দগুলো হাদীছ  সংগৃহীত হয়েছে, তা থেকে যেন বাদ দেয়া না হয়। তবে যদি কিছু বর্ধিত করা হয়, তা জায়েয আছে। হিদায়া ও অন্যান্য ফিক্হ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) আযানের মধ্যে তকবীরও আছে এবং কিছু অতিরিক্তও আছে। সুতরাং এটা সুন্নাত বলে প্রমাণিত আর যদি বিদআতই বলতে চান, তাহলে বিদআতে হাসনাই সুন্নাত বলে প্রমাণিত আর যদি বিদ্আতই বলতে চান, তাহলে বিদআতে হাসনাই বলতে হবে যেমন আমি বিদ্আতের আলোচনায় বর্ণনা করেছি। ফত্য়ায়ে রশিদীয়ার প্রথম খণ্ড কিতাবুল বিদ্আতের ৮৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে যে, “জনৈক ব্যক্তি দেওবন্দীদের নেতা রশীদ আহমদ থেকে জিজ্ঞাসা করেছিল-কোন মসীবতের সময় বুখারা শরীফের খতম পড়ানো কুরুনে ছালাছা থেকে প্রমাণিত আছে কিনা এবং এটা বিদআত কিনা? এর উত্তরে তিনি বলেছেন-কুরূনে ছালাছায় বুখারী শরীফ সংকলিতও হয়নি। কিন্তু এর খতম ঠিক আছে। যিকরে খায়েসের পর দুআ কবুল হয়। এর মূল শরীয়ত দ্বারা প্রমাণিত। তাই এটা বিদআত নয়-রশীদ আহমদ।” একই কিতাবের ৮৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে “নির্ধারিত তারিখে খানার আয়োজন করা বিদআত যদি ওবা ছওয়াব পৌঁছবে-রশীদ আহমদ।” তাহলে এবার বলুন, খতমে বুখারী ও বার্ষিক ফাতিহায় ছওয়াব কেন হচ্ছে। এটাতো বিদআত এবং আপনাদের মতে প্রত্যেক বিদআত হারাম, হারাম কাজে আবার ছওয়াব কিসের? 


বিশেষ দ্রষ্টব্য- দেওবন্দ মাদ্রাসায় মসীবতের সময় ছাত্রদের দ্বারা বুখারী শরীফের খতম পড়ানো হয়। দাওয়াতকারী কর্তৃক প্রদত্ত শিরনী ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং আদায়কৃত টাকাগুলো লাভ হিসেবে মাদ্রাসাই পেয়ে থাকে। প্রত্যেক দাওয়াতে কমপক্ষে পনের টাকা আদায় করা হয়। মনে হয় এ বিদআতটা এজন্যই জায়েয রাখা হয়েছে। যে মাদ্রাসার টাকার প্রয়োজন এবং টাকা আদায় করার একটা উৎকৃষ্ট মাধ্যম। তাহলে মুমিনদের কবরে আযান কেন হারাম হবে?


২নং আপত্তি- ফতওয়ায়ে শামীর বাবুল আযানের যেখানে আযানের স্থানসমূহের বর্ণনা করা হয়েছে, ওখানে আযানে কবরের কথাও উলে­খ করা হয়েছে কিন্তু সাথে সাথে বলা হয়েছে - 


لَكِنْ رَدَّهُ ابْنُ حَجَرٍ فِي شَرْحِ الْعُبَابِ.


কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজর ‘শরহে ইবাব’ গ্রন্থে এ আযানকে অগ্রাহ্য করেছেন।  ২৫৮

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ১/৩৮৫ পৃষ্ঠা}


অতএব বোঝা গেল যে, কবরে আযান দেয়াটা বাতুলতা মাত্র।


উত্তর- প্রথমতঃ আল্লামা ইবনে হাজর (رحمة الله) শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী। তিনি আযানে কবরকে অস্বীকার করেছেন, ইহা ঠিক। অথচ কয়েকজন হানাফী আলিমসহ অনেক উলামায়ে কিরাম আযানে কবরকে সুন্নাত বলেছেন। তাহলে বলুন, হানাফী মাযহাবের অনুসারীদেরকে কি অধিকাংশ আলিমের মতামত অনুযায়ী আমল করতে হবে, না শাফেঈ মাযহাবের উক্তি অনুযায়ী আমল করতে হবে? দ্বিতীয়তঃ আল্লামা ইবনে হাজরও আযানে কবরকে নিষেধ করেন নি বরং একে সুন্নাত বলতেই অস্বীকার করেছেন। যদি আমি বলি বুখারী শরীফ ছাপানো সুন্নাত নয়, তা একেবারে যথার্থই হয়েছে। কেননা হুযুর ﷺ'র যুগে বুখারীও ছিল না, প্রেসও ছিল না। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে এটা জায়েযও নয়। আল্লামা শামী ওই জায়গায় বলেছেন قَدْ يُسَنُّ الْأَذَانُ ওই সমস্ত অবস্থায় আযান দেয়া সুন্নাত। অবস্থাসমূহের মধ্যে আযানে কবরের কথা উলে­খ করার পর বললেন لَكِنْ رَدَّهُ ابْنُ حَجَرٍ কিন্তু ইবনে হাজর এটাকে অস্বীকার করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, কি অস্বীকার করেছেন? এর আগের ইবারত থেকে সুষ্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি সুন্নাত বলতেই অস্বীকার করেছেন। শামী বোঝার জন্য জ্ঞান ও ঈমানের প্রয়োজন। তৃতীয়তঃ যদি মেনে নেওয়া হয় যে আল্লামা ইবনে হাজর আযানকেই অস্বীকার করেছেন। এর ফলে মাকরূহ বা হারাম প্রমাণিত হতে পারে না। কেননা, কোন আলিমের অস্বীকৃতির দরুণ মাকরূহ বা হারাম প্রমাণিত হয় না, বরং এর জন্য শরীয়তের অকাট্য দলীলের প্রয়োজন হয়। শরীয়তের দলীয় ছাড়া মাকরূহ তনযীহও প্রমাণিত হয় না। 


❏ ফতওয়ায়ে শামীর مستحبات الوضوء শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত আছে-


وَقَالَ فِي الْبَحْرِ هُنَاكَ: وَلَا يَلْزَمُ مِنْ تَرْكِ الْمُسْتَحَبِّ ثُبُوتُ الْكَرَاهَةِ، إذْ لَا بُدَّ لَهَا مِنْ دَلِيلٍ خَاصٍّ.


অর্থাৎ মুস্তাহাব পরিত্যাগ করার দ্বারা মাকরূহ প্রমাণিত হয় না, কেননা মাকরূহ প্রমাণিত করার জন্য বিশেষ দলীলের প্রয়োজন। ২৫৯

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১২৪, ওযূূর মোস্তাহাব অধ্যায়।}


❏ শামীর প্রথম খণ্ডে مكروهات الصلوة শীর্ষক আলোচনা المستحب والسنة এর বর্ণনা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে-


تَرْكِ الْمُسْتَحَبِّ رَاجِعًا إلَى خِلَافِ الْأَوْلَى لَا يَلْزَمُ مِنْهُ أَنْ يَكُونَ مَكْرُوهًا إلَّا بِنَهْيٍ خَاصٍّ لِأَنَّ الْكَرَاهَةَ حُكْمٌ شَرْعِيٌّ فَلَا بُدَّ لَهُ مِنْ دَلِيلٍ.


মুস্তাহাব পরিত্যাগের ফলে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছাড়া ওটাকে মাকরূহ বলা যাবে না। মাকরূহ হচ্ছে শরয়ী হুকুম; এর জন্য বিশেষ দলীলের প্রয়োজন।  ২৬০

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৫৩, কিতাবুস-সিয়াম।}


তারা তো কবরে আযান দেয়াটা হারাম বলছেন। অথচ ফকীহগণ সুষ্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছাড়া কোন কিছুকে মাকরূহ তনযীহ বলতেও রাজি নন। যদি বলা হয়, আল্লামা শামী (رحمة الله) কবরে আযান প্রসঙ্গটা قِيلَ শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন এবং قِيلَ শব্দটা দুর্বলতার পরিচায়ক। এর জবাব হচ্ছে ফিকহশাস্ত্রে قِيلَ শব্দটা শুধু দুর্বলতা প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয় না। 


❏ শামীর কিতাবুসসওম ‘কাফফারা’ পরিচ্ছেদ আছে-


فتعبر المصنف بقيل ليس يلزم الضعف.


(গ্রন্থকার কর্তৃক قِيلَ শব্দের প্রয়োগ দুর্বলতার পরিচায়ক নয়) 


❏ অনুরূপ শামীর دفن الميت শীর্ষক আলোচনায় জানাযার সাথে যিকর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে -


قِيلَ تَحْرِيمًا، وَقِيلَ تَنْزِيهًا.


(মকরূহ তাহরীমি বলা হয়েছে এবং মাকরূহ তানযীহও বলা হয়েছে)২৬১   

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৩৩, সালাতুল জানাইয।}


দেখুন, এখানে দুটি উক্তির কথা উলে­খ করা হয়েছে এবং উভয় উক্তি قِيلَ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। 


❏ ফত্ওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল ওয়াকফে, মসজিদ শীর্ষক আলোচনায় বর্ণিত আছে -


وَقِيلَ: هُوَ مَسْجِدٌ أَبَدًا وَهُوَ الْأَصَحُّ، كَذَا فِي خِزَانَةِ الْمُفْتِينَ.


(এবং বলা হয়েছে যে ওটা চিরদিনের জন্য মসজিদেই থাকবে, এবং এ উক্তিটা সবচেয়ে সঠিক বলে গণ্য।)  ২৬২

{ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, ২/৪৫৮ পৃষ্ঠা}


এখানে সবচেয়ে সঠিক উক্তিটা قِيلَ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। তাই قِيلَ দুর্বলতার পরিচায়ক নয়। এবং قِيلَ শব্দকে যদি দুর্বলতার পরিচায়ক হিসেবে মেনেও নেওয়া হয়, তাতে আযানকে সুন্নাত বলার ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে কিন্তু জায়েয বলার ক্ষেত্রে নয়। কেননা, এটা সুন্নাত বলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। আমরাও কবরে আযানকে সুন্নাত বলি না, কেবল জায়েয ও মুস্তাহাব বলে থাকি।


৩নং আপত্তি- ফকীহগণ বলেন যে, কবরে গিয়ে ফাতিহা পাঠ ভিন্ন অন্য কোন কিছু যেন করা না হয়। আযানে কবর যেহেতু ফাতিহা ভিন্ন অন্য কিছু, তাই এটা হারাম। যেমন 


❏ বাহারুর রায়েকে বর্ণিত আছে-


وَيُكْرَهُ عِنْدَ الْقَبْرِ كُلَّمَا لَمْ يُعْهَدْ مِنْ السُّنَّةِ وَالْمَعْهُودُ مِنْهَا لَيْسَ إلَّا زِيَارَتُهَا وَالدُّعَاءُ عِنْدَهَا قَائِمًا.


-‘‘রাসূল (ﷺ) এর যুগে যা ছিল না তা কবরের নিকটে করা মাকরুহ। তার কবরের নিকটে শুধু যিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাড়ানো অবস্থায় দোয়া করবে।’’  ২৬৩

{ইমাম ইবনে নুযাইম মিশরী, বাহরুর রায়েক, ২/২১০}


❏ ফাতওয়ায়ে শামীর কিতাবুল জানায়েযে উল্লেখিত আছে-


لَا يُسَنُّ الْأَذَانُ عِنْدَ إدْخَالِ الْمَيِّتِ فِي قَبْرِهِ كَمَا هُوَ الْمُعْتَادُ الْآنَ، وَقَدْ صَرَّحَ ابْنُ حَجَرٍ فِي فَتَاوِيهِ بِأَنَّهُ بِدْعَةٌ. وَقَالَ: وَمَنْ ظَنَّ أَنَّهُ سُنَّةٌ .....فَلَمْ يُصِبْ.


অর্থাৎ লাশ কবরে রাখার সময় আযান দেয়া যেমন আজকাল প্রচলিত আছে, সুন্নাত নয়, আল্লামা ইবনে হাজর বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, এটা বিদআত এবং কেউ একে সুন্নাত মনে করলে, ভুল করেছে।  ২৬৪

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ২/২৩৫}


❏ দুররুল বিহার গ্রন্থে বর্ণিত আছে-


مِنْ الْبِدْعِ الَّتِى شَاعَتِ فِى بِلاَدِ الْهِنْدِ الْاَذَانُ عَلٰى الْقَبْرِ بَعْدَ الدَّفن.


যেসব বিদআত হিন্দুস্থানে ছড়িয়ে পড়েছে, এর মধ্যে দাফনের পর কবরে আযান দেওয়াটাও রয়েছে।


توشيخ شرح تنقيح নামক গ্রন্থে আল্লামা মাহমুদ বলখী (رحمة الله) বলেন


الْاَذَان عَلٰى الْقَبْرِ لَيْسَ بِشَيْءٍ.


কবরে আযান দেয়াটা কিছুই না। মৌলভী ইসহাক ছাহেব মিয়াতা মাসায়েল গ্রন্থে উলে­খ করেছেন যে, কবরে আযান দেয়া মাকরূহ। কেননা, এটার কোন প্রমাণ নাই এবং যেটা সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয় সেটা মাকরূহ হয়ে থাকে।


উত্তর- ‘বাহারুর রায়েক’ গ্রন্থে কবরের কাছে গিয়ে যিয়ারত ও দুআ ভিন্ন অন্য কিছু করাকে মাকরূহ বলাটা একেবারে সঠিক হয়েছে।


কারণ এটা কবর যিয়ারতের সময় অন্য কিছু করার বেলায় বলা হয়েছে, অর্থাৎ ওখানে যখন যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাবেন, তখন কবরে চুমু দেয়া, সিজ্দা করা ও অন্যান্য নাজায়েয কাজ যেন করা না হয়। কিন্তু এখানে কথা হচ্ছে, দাফনকালীন সময় নিয়ে, যিয়ারতকালীন সময় নিয়ে নয়। যদি দাফনকালীন সময়টাও অর্ন্তভূক্ত করা হয়, তাহলে বলতে বাধ্য হবো যে লাশ কবরে রাখা, তক্তা ও মাটি দেয়া, দাফনের পর তলকীন করা, যাকে ফতওয়াযে রশিদীয়াতেও জায়েয বলা হয়েছে, সবকিছু নিষেধ হবে। লাশ জংগলে ফেলে দিয়ে ফাতিহা পাঠ করে পালিয়ে আসা চাই। কারণ যিয়ারতকালীন সময় ফাতিহা ভিন্ন অন্য কিছু করা নিষেধ। তাই মানতেই হয়, উপরোক্ত বক্তব্যই বাহারুর রায়েকের উদ্দেশ্য। তা’না হলে মৃতদেরকে সালাম করা, কবরে সবুজ তরুলতা বা ফুল অর্পণ করা সবার মতে জায়েয এবং এটা হুযুর ﷺ থেকে প্রমাণিত। বাহারুর রায়েকে ওখানে যিয়ারত ও দাঁড়িয়ে দুআ করা ছাড়া অন্য কিছু না করার জন্য বলা হয়েছে। 


মৌলভী আশরাফ আলী ছাহেবের রচিত ‘হিফজুল ঈমান’ গ্রন্থে একটি প্রশ্নোত্তর দেয়া হয়েছে। প্রশ্নটা হচ্ছে শাহ ওলীউল্লাহ ছাহেব কবরবাসীর অবস্থা অবলোকনের كشف القبور নিয়ম বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন-


وبعد هفت كره طواف كند ودراں تكبير بخواند وآغاز ازر است كند وبعده طرف پاياں رخسار نهد.


অর্থাৎ এরপর কবরকে সাতবার তওয়াফ করবেন এবং ডান দিক থেকে শুরু করবেন আর কবরের পায়ের দিকে নিজের কপাল রাখবেন। তাহলে কি কবরকে তওয়াফ ও সিজদা করা জায়েয? উক্ত গ্রন্থের ৬ পৃষ্ঠায় এর জবাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন এ তওয়াফটা পারিভাষিক নয়, যা সম্মান ও নৈকট্য লাভের জন্য করা হয় এবং যার নিষেধাজ্ঞা শরীয়তের সুষ্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত। তাই এখানে তওয়াফ শব্দটা আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ কবরবাসীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও ফয়েয লাভের উদ্দেশ্যে কেবল কবরের চারিদিকে ঘুরা। হযরত জাবির (رضي الله عنه) এর কাহিনীতে এর প্রমাণ রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, তাঁর পিতা ঋণগ্রস্থ অবস্থায় ইন্তিকাল করেন এবং ঋণদাতা এর জন্য হযরত জাবিরের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি হুযুর আলাইহিস সালামের সমীপে আরয করলেন- আপনি বাগানে তশরীফ আনয়ন করে এর একটা সুরাহা করিয়ে দিন। হুযুর ﷺ বাগানে তশরীফ নিয়ে গেলেন। এবং খেজুরের কয়েকটি স্তুপ করে বড় স্তুপের চারিদিকে তিন চক্কর দিলেন।


হুযুর আলাইহিস সালামের এ চক্করটা কোন তওয়াফ ছিল না, বরং এতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য চারিদিকে চক্কর দিয়েছেন। কবরের অবস্থা পরিদর্শনের আমলের বেলায়ও তা-ই করা হয়। এবার বলুন, যদি কবরে আযান এজন্য নিষিদ্ধ যে কবরে যিয়ারত ও দুআ ভিন্ন অন্য কিছু করা জায়েয নাই, তাহলে এ কবর তওয়াফ ও ফয়েয গ্রহণ জায়েয কেন? সুতরাং বাহারুর রায়েকের বাহ্যিক ভাষ্য আপনাদেরকেও অনুক‚ল নয়।


আরও একটি মজার কথা হলো হিফজুল ঈমান গ্রন্থের উপরোক্ত ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, কবরসমূহ থেকে ফয়েয পাওয়া যায় এবং ফয়েয লাভের জন্য ওখানে যাওয়া, তওয়াফ করা, কবরের উপর কপাল রাখা জায়েয। অথচ তকবিয়াতুল ঈমানে ওগুলোকে শিরক বলা হয়েছে। শামী, তুশেখ ও অন্যান্য কিতাবের যেসব ইবারত বিরোধিতাকারীরা উত্থাপন করেছে, ওসবের উত্তর ১নং আপত্তির উত্তরে দেয়া হয়েছে যে ওস ইবারতে সুন্নাত হওয়াটাকেই অস্বীকার করা হয়েছে, জায়েয হওয়াটাকে নয়। তুশেখ গ্রন্থে উল্লেখিত لَيْسَ بِشَيْءٍ এর অর্থ হারাম নয়। এর ভাবার্থ হচ্ছে এটা ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নাত নয়, কেবল জায়েয ও মুস্তাহাব মাত্র এবং একে ওয়াজিব বা সুন্নাত মনে করাটা ভুল। যেসব ফকীহগণ একে বিদআত বলেছেন, তাঁরা বিদআতে সুন্নাত বা বিদআতে মুস্তাহাবই বলেছেন, বিদআত মাকরুহ বলেননি। কেননা বিনা দলিলে মাকরুহ প্রমাণিত হয় না। মৌলভী ইসহাক ছাহেব হলেন দেওবন্দীদের নেতা, তাই তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। আর তিনি যে বিধানটা উলে­খ করেছেন অর্থাৎ যা সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা মাকরুহ, সেটা শুদ্ধ নয়। অন্যথায় কুরআনকে পারায় পারায় বিভক্তকরণ, হরকত দেওয়া এবং বুখারী শরীফও মাকরুহ হয়ে যাবে, কেননা এগুলো সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়। দুররুল মুখতারে অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-


وَوُقُوفَ النَّاسِ يَوْمَ عَرَفَةَ فِي غَيْرِهَا تَشْبِيهًا بِالْوَاقِفِينَ لَيْسَ بِشَيْءٍ.


আরাফাতের দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান না করে অন্যত্র অবস্থানকারীকে অবস্থানকারীদের মত তুলনা করাটা অনর্থক। ২৬৫

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৭।}


❏ এর প্রেক্ষাপটে শামীতে উল্লেখিত আছে-


هُوَ نَكِرَةٌ فِي مَوْضِعِ النَّفْيِ فَتَعُمُّ أَنْوَاعَ الْعِبَادَةِ مِنْ فَرْضٍ وَوَاجِبٍ وَمُسْتَحَبٍّ فَيُفِيدُ الْإِبَاحَةَ، وَقِيلَ يُسْتَحَبُّ.


এখানে না বলার ক্ষেত্রটা অনির্দিষ্ট। সুতরাং ফরয ওয়াজিব ও মুস্তাহাবকে অন্তর্ভূক্ত করে। তবে মুবাহটা বাকী রয়েছে, কেউ কেউ মুস্তাহাব বাকী থাকার কথাও বলেছেন।  ২৬৬

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৭।}


❏ প্রখ্যাত ফকীহ শাস্ত্রের কিতাব হিদায়ায় টীকায় لَيْسَ بِشَيْءٍ প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে-


اَىْ لَيْسَ بِشَيْءٍ يَتَعَلَّقُ بِهِ الثَّوَابُ وَهُوَ يَصَدُقُ عَلٰى الْاِبَاحَةِ.


অর্থাৎ শব্দটা ছওয়াবের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং এর দ্বারা মুবাহ প্রমাণিত হয়।  ২৬৭

{হাশীয়ায়ে হেদায়া, পৃষ্ঠা-১৭৫।}


উপরোক্ত ইবারত থেকে বোঝা গেল যে, لَيْسَ بِشَيْءٍ শব্দটা মুবাহের অর্থেও ব্যবহৃত হয়।


৪নং আপত্তি-  আযান হলো নামাযের অবগতির জন্য। কিন্তু দাফনের সময় কোন নামাযটা হচ্ছে, যার অবগতির জন্য আযানের প্রয়োজন? সুতরাং এ আযানটা অনর্থক তাই জায়েয নয়।


উত্তর-  আযান শুধু নামাযের অবগতির জন্য মনে করাটা ভুল ধারণা। কত জায়গায় আযান দিতে হয়, তা প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। নবজাত শিশুর কানে যে আযান দেওয়া হয়, ওটা কোন নামাযের জন্য? হুযুর আলাইহিস সালামের যুগে রমযান মাসে শেষ রাত্রে দু’বার আযান দেয়া হতো-  একটি সাহরীর জন্য, অপরটি ফজর নামাযের জন্য।


প্রাসঙ্গিক বক্তব্য-  কাথিয়া ওয়ার্ডে ফজরের নামাযের পর মুসাফাহা করার প্রচলন আছে এবং ইউ,পি,তে ঈদের নামাযের পর কোলাকুলি করার রেওয়াজ আছে। এক ভদ্রলোক আমার কাছে জানতে চাইলেন যে, মুসাফাহা কোলাকুলিতো প্রথম সাক্ষাতেই হওয়া চাই। নামাযের পরতো মানুষ চলে যাচ্ছে। তখন মুসাফাহা বা কোলাকুলি কেন? তাই এ মুসাফাহা বা কোলাকুলি বিদআত তথা হারাম হবে না কেন? আমি বললাম, কোলাকুলি হুযুর ﷺ থেকে প্রমাণিত আছে যেমন মিশকাত শরীফের কিতাবুল আদবে بَاب المصافحة والمعانقة নামে একটি অধ্যায় আছে। ওখানে বর্ণিত আছে যে হুযুর ﷺ হযরত যায়েদ ইবনে হারেছ (رضي الله عنه) এর সাথে কোলাকুলি করেছেন। হাদীছের বক্তব্য থেকে প্রতিভাত হয় যে, এ কোলাকুলিটা আনন্দেরই ছিল! ঈদের দিনটাও আনন্দের দিন। সেজন্য আনন্দ প্রকাশার্থে কোলাকুলি করে থাকে। অধিকন্তু 


❏ দুররুল মুখতারে পঞ্চম খন্ড الكراهية অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-


أَيْ كَمَا تَجُوزُ الْمُصَافَحَةُ ...... وَلَوْ بَعْدَ الْعَصْرِ وَقَوْلُهُمْ إنَّهُ بِدْعَةٌ أَيْ مُبَاحَةٌ حَسَنَةٌ كَمَا أَفَادَهُ النَّوَوِيُّ فِي أَذْكَارِهِ.


মুসাফাহা জায়েয যদিওবা আসর নামাযের পরেও হয়। ফকীহগণ আসরের নামাযের পর মুসাফাহাকে যে বিদআত বলেছেন, তা বিদআত মুবাহ হাসনা। যেমন ইমাম নববী (رحمة الله عليه) স্বীয় আযকারে বর্ণনা করেছেন। ২৬৮

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮১।}


❏ এর প্রেক্ষাপটে ফতওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে-


اعْلَمْ أَنَّ الْمُصَافَحَةَ مُسْتَحَبَّةٌ عِنْدَ كُلِّ لِقَاءٍ، وَأَمَّا مَا اعْتَادَهُ النَّاسُ مِنْ الْمُصَافَحَةِ بَعْدَ صَلَاةِ الصُّبْحِ وَالْعَصْرِ، فَلَا أَصْلَ لَهُ فِي الشَّرْعِ عَلَى هَذَا الْوَجْهِ وَلَكِنْ لَا بَأْسَ بِهِ.... قَالَ الشَّيْخُ أَبُو الْحَسَنِ الْبِكْرِيُّ: وَتَقْيِيدُهُ بِمَا بَعْدَ الصُّبْحِ وَالْعَصْرِ عَلَى عَادَةٍ كَانَتْ فِي زَمَنِهِ، وَإِلَّا فَعَقِبَ الصَّلَوَاتِ كُلِّهَا كَذَلِكَ كَذَا فِي رِسَالَةِ الشُّرُنْبُلَالِيُّ فِي الْمُصَافَحَةِ.


প্রত্যেক সাক্ষাতের সময় মুসাফাহা করা মুস্তাহাব এবং ফজরের পরে মুসাফাহা করার যে রেওয়াজ রয়েছে, শরীয়তে এর কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এতে কোন ক্ষতিও নেই, আর ফরয ও আসরের শর্তারোপ, কেবল মানুষের অভ্যাসের কারণেই করা হয়েছে। অথচ প্রত্যেক নামাযের পর মুসাফাহার একই হুকুম। ২৬৯

{ইমাম ইবনে আবেদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৮১।}


এর থেকে বোঝা গেল মুসাফাহা যে কোন সময় জায়েয আছে। কিন্তু এ উত্তরে তিনি পুরাপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না এবং বলতে চাইলেন যে, মুসাফাহা কোলাকুলি প্রথম সাক্ষাতের সময় হওয়া উচিত। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, প্রথম সাক্ষাত কাকে বলে? এর উত্তরে তিনি বললেন, অদৃশ্য হওয়ার পর পুনরায় মিলনকে প্রথম সাক্ষাত বলা হয়। তখন আমি বললাম, অদৃশ্য হওয়ার দুটি রূপ আছে, একটি হচ্ছে শারীরিক অদৃশ্য হওয়া, অপরটি হচ্ছে মানসিকভাবে অদৃশ্য হওয়া। যেমন নামাযের সময় যদিওবা বাহ্যিকভাবে সমস্ত মুক্তাকী ও ইমাম একই জায়গায় আছে, কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিতে একে অপর থেকে অদৃশ্য ছিল, কারণ কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারে না, না পারে একে অপরের সাহায্য করতে। বরং তাদেরকে দুনিয়া থেকে অদৃশ্য বলা যায়। তাদের জন্য খানাপিনা, চলাফেরা সমস্ত দুনিয়াবী কাজ হারাম এবং-


قَالَ عَلَيْهِ السَّلَامُ: الصَّلَاةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِ.


নামায হচ্ছে মুমিনদের জন্য মিরাজ তুল্য’’ ২৭০

{ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী ১/২২৬পৃঃ  ১/২৩৩পৃঃ  দারু ইহইয়াউল তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, ১৪২০হি, মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ১/৫৫পৃঃ  ২/৫২৩পৃঃ  হাদিস:৫৮৫, ২/৬২৫পৃঃ  হাদিস : ৭৪৬, ২/৭০২পৃঃ  হাদিস : ৮৫৬, ৯/৩৭২২পৃঃ  হাদিস:৫৮৩৩, ৯/৩৩৭৪পৃঃ  হাদিস : ৫৮৫৬, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ ১৪২২হি, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, ২/২১৩পৃঃ  ও ৪/৪২৯পৃঃ এবং ৭/১৭২পৃঃ  ৮/৯৮পৃঃ  দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন}


 এ দৃশ্যটা প্রকাশ পায়; দুনিয়ার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন এবং সবাই আল্লাহর প্রতি মনোযোগী। যখন সালাম ফেরালেন, তখন আবার দুনিয়াতে এসে গেলেন, এবং দুনিয়াবী যাবতীয় কাজ হালাল হয়ে গেল। এ সময় অদৃশ্য হওয়ার পর পুনঃ মিলনই বোঝা গের। তাই মুসাফাহা সুন্নাত। তিনি বললেন, আপনিতো এটা যুক্তি দ্বারা বোঝালেন, কিন্তু শরীয়ততো এ সময়টাকে সাক্ষাতের সময় বলে নাই। আমি বললাম নিশ্চয়ই বলেছে। তা’ নাহলে ওই সময় সালাম কাকে হয় এবং কেন করা হয়? ইমামকে সমস্ত মুক্তাদী ও ফিরিশতাদেরকে সালাম করার নিয়ত করা চাই। আর একাকী নামাযের বেলায় কেবল ফিরিশতাদেরকে সালাম করার নিয়ত করা চাই। আর একাকী নামাযের বেলায় কেবল ফিরিশতাদেরকে সালাম করার নিয়ত করতে হবে। সালাম সাক্ষাতের সময় বা বিদায়ের সময় করা হয়। বলুন এখানে সালাম কেন? এ লোকগুলো কোথায় থেকে আসছে বা কোথায় যাচ্ছে? কৈ, কেউতো চলে যাচ্ছে না কারণ এক্ষুণি মুনাজাত হবে, ওজীফা পাঠ করবে এবং অনেকেই ইশরাকের নামায পড়েই উঠবেন। বোঝা গেল যে, উর্ধজগত পরিভ্রমণ করে এসে সালাম করছে। সুতরাং এরপর মুসাফাহা করলেন, তাতে ক্ষতি কি? তিনি বললেন, তাহলে প্রত্যেক নামাযের পর করা চাই। আমি বললাম, হ্যাঁ, প্রত্যেক নামাযের পরে করলেও তাতে কোন নিষেধ নেই। খোদার শোকর তার মনঃপুর হয়েছে। আযানের মাসআলাটাও তদ্রুপ।

 
Top