অধ্যায়ঃ সওম-ই-ভেসাল


□ 'তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছো?'


□ 'আমার রব আমাকে আহার ও করান, পানও করান' -এর ব্যাখ্যাঃ

□ 'সওম-ই ভেসাল (মধ্যভাগে ইফতার-সেহরী না করে একটানা কয়েকদিন রোযা রাখা) নিষিদ্ধ

________

❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৮৮৭)]

○ অধ্যায়ঃ [একটি বিশেষ অধ্যায়]

[ﻭﻋﻦ ﺍﺑﻰ ﻫﺮﻳﺮﺓ ﻗﺎﻝ ﻧﻬﻰ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﷺ ﻋﻦ ﺍﻟﻮﺻﺎﻝ ﻓﻰ ﺍﻟﺼﻮﻡ ﻓﻘﺎﻝ ﻟﻪ ﺭﺟﻞ ﺍﻧﻚ ﺗﻮﺍﺻﻞ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺎﻝ ﻭﺍﻳﻜﻢ ﻣﺜﻠﻰ ﺍﻧﻰ ﺍﺑﻴﺖ ﻳﻄﻌﻤﻨﻰ ﺭﺑﻰ ﻭﻳﺴﻘﻴﻨﻰ . - ‏( ﻣﺘﻔﻖ ﻋﻠﻴﻪ )]

হযরত আবূ হোরায়রা [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ [ﷺ] রোযার মধ্যে 'ভেসাল' করতে নিষেধ করেছেন। (টীকাঃ ৮)

তখন হুযূরকে একজন লোক জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহ্'র রসূল! আপনি তো 'ভেসাল' করেন। (টীকাঃ ৯)

হুযূর এরশাদ ফরমালেন, "তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছো? (টীকাঃ ১০)

আমি এভাবে রাত অতিবাহিত করি যে, আমার রব আমাকে আহার করান ও পান করান।" (টীকাঃ ১১)

[মুসলিম, বোখারী]

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ


___

৮. (রসূলুল্লাহ্ [ﷺ] রোযার মধ্যে 'ভেসাল' করতে নিষেধ করেছেন।)

◇ টীকাঃ ৮.

রোযার ভেসাল' হচ্ছে- রাতে ইফতার করা ছাড়াই, কোন কিছু পানাহার করা ব্যতীত পরবর্তী দিনের রোযা রেখে নেওয়া। সঠিক অভিমত হচ্ছে- এ 'ভেসাল' আমাদের জন্য 'মাকরুহ'-ই তাহরীমী। আর এখানে নিষেধ হারাম নির্দেশক। এ নিষেধের মধ্যে শতশত হিকমত রয়েছে। ভেসালের কারণে শরীল অত্যন্ত দূর্বল হয়ে যায়। ভেসালের ফলে অন্যান্য ইবাদত কঠিন হয়ে যায়।

ভেসালের মধ্যে সন্যাসী ও সাধুদের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। 'ভেসাল' সমস্ত উম্মতের জন্য না-জায়েয; চাই ওলী হোক, কিংবা অন্য কোন স্তরের লোক হোক।

৯. (তখন হুযূরকে একজন লোক জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহ্'র রসূল! আপনি তো 'ভেসাল' করেন।)

◇ টীকাঃ ৯.

নবী করীম [ﷺ] শুধু একদিনের নয়, বরং লাগাতার কয়েক দিনের রোযার 'ভেসাল' করতেন। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে রোযার উপর রোযা রাখতেন। এ কারণে প্রশ্নকারীর মনে সন্দেহ জাগলো-'ভেসাল' তো রসূলে পাকের সুন্নাত হওয়া চাই, নিষেধ কেন?

১০. (হুযূর এরশাদ ফরমালেন, "তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছো?")

◇ টীকাঃ ১০.

এ প্রশ্ন অস্বীকারমূলক। আর ﺍﻳﻜﻢ (তোমাদের মধ্যে কে?) -এর মধ্যে সাহাবীগণ ও সমস্ত মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে আমার মতো কেউ নেই। যখন সাহাবীগণ হুযূর-ই আনওয়ার [ﷺ] -এর মতো হতে পারেন নি, তখন অন্য কেউ কোন্ মুখে হুযূরের সমান হবার দাবী করে? আমাদের আক্বীদা বা বিশ্বাস হচ্ছে-

(মূল কিতাবে উর্দূ বচন দ্রব্যষ্ট)

অর্থাৎ ''আমি আমার সম্পর্ক আপনার কুকুরের সাথে নির্ণয় করলাম, অথচ আমি বলছি নিজের ইচ্ছায়। এ কারণে আপনার দরবারে কুকুরেে সাথে সম্পর্ক রচনা করাও আমার জন্য বেয়াদবীর সামিল।'' (কারণ, আমি সেটারও উপযুক্ত নই।)

মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেনঃ

[ﻗُﻞْ ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺃَﻧَﺎ ﺑَﺸَﺮٌ ﻣِّﺜْﻠُﻜُﻢْ]

(হে হাবীব! আপনি বলুন, প্রকাশ্য মানবীয় আকৃতিতে আমি তোমাদের মতো, ১৮ঃ১১০)। এর মধ্যে নিছক মানবীয়তার মধ্যে তুলনা করা হয়েছে; যাতে ইলাহিত্বের কোন সংমিশ্রণ নেই। অর্থাৎ আমি তোমাদের মতো খাঁটি মানুষ; না খোদা, না খোদার শরীক। তারপর আমার বাশারিয়াত (মানবীয়তা)'র সাথে 'নবূয়ত' মিলিত হলো, যার কথা ﻳُﻮﺣَﻰٰ ﺇِﻟَﻲَّ (আমার প্রতি ওহী হয়) বর্ণনা করেছে। সুতরাং এ হাদীস শরীফ ক্বোরআনের এ আয়াতের পরিপন্থী নয়। সমগ্র জাহানের ওলীগণ এমন একজন সাহাবীর মতো হতে পারেন না, যিনি ঈমানী দৃষ্টিতে তাঁর চেহারা মুবারক এক মুহূর্তের জন্য দেখেছেন। তাঁর সত্তাতো আরো বহু উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন।

১১. (আমি এভাবে রাত অতিবাহিত করি যে, আমার রব আমাকে আহার করান ও পান করান।)

◇ টীকাঃ ১১.

আলিমগণ এ পানাহার করানোর বহু ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ

কেউ কেউ বলেছেন, এটা দ্বারা 'বরদাশত ক্ষমতা' বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা দ্বারা রুহানী খাদ্য বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা দ্বারা অপ্রকাশ্য কল্যাণদ্বারা ও মুনাজাতের তৃপ্তি বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এটা দ্বারা ক্ষুধা-পিপাসা অনুভূত না হওয়া বুঝানো হয়েছে। ইত্যাদি। কিন্তু ইশক্ব-এর ফাত্ওয়া হচ্ছে- হাদীস শরীফ একেবারে প্রকাশ্য অর্থবোধক। এতে হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ] মহান রবের তিন(০৩)টি নি'মাতের উল্লেখ করেছেনঃ

এক. তোমরা সবাই তোমাদের স্ত্রী-পুত্রদের সাথে রাত যাপন করে থাকো। কিন্তু আমি রাত যাপন করি আপন রবের সাথে। কবি বলেনঃ

অর্থাৎঃ তিনি ফরশ অর্থাৎ যমীনে অবস্থান করেন; কিন্তু তাঁর মানযিল হচ্ছে- আরশের উপরে। উপাধি 'উম্মী' (পার্থিব কোন ওস্তাদের নিকট পড়েননি)। অথচ তাঁর বিশাল কিতাবখানা (লাইব্রেরী) হচ্ছে- তাঁর পবিত্র হৃদয়ের মধ্যে।

তিনি 'উম্মী' উপাধি ধারণ করেছেন। অথচ বিশ্বের সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত। তাঁর নূরানী শরীরে ছায়া ছিলো না, অথচ গোটা বিশ্বের জন্য তিনি শামিয়ানা (ছায়াদাতা)।

দুই. 'আমি মহান রবের নিকট রয়ে নিজে পানাহার করছি না। বরং আমাকে মহান রব আহান করান ও পান করান। আহার করায় তাঁর বদান্যতার হাত, আর আহার করি আমি।'

তিন. মহান রব আমাকে ওই রুজি আহার ও পান করান, যা দ্বারা না রোযা ভঙ্গ হয়, না রোযার ধারাবাহিকতা (ভিসাল) বিনষ্ট হয়। অর্থাৎ জান্নাতের ফলমূল এবং সালসাবীল-তাসনীম ইত্যাদির শরবত।

এ বাক্য দ্বারা কয়েকটা মাস্'আলা প্রতীয়মান হয়ঃ

এক. কেউ কোন স্তরে পৌঁছে হুযূর-ই আনওয়ার [ﷺ] -এর মতো হতে পারে না। যখন 'মানুষ'কে বাকশক্তিসম্পন্ন ( ﻧﺎﻃﻖ ) বৈশিষ্ট্য সমস্ত প্রাণী থেকে তার সত্তাগত পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, তখন 'নবূয়ত' ও 'ওহী'র গুণ ও বৈশিষ্ট্য দু'টিও হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ]'কে সমস্ত মানুষ থেকে সত্তাগতভাবে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে।

দুই. যদি হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ] ইবাদতের নিয়তে পানাহার ছেড়ে দেন এবং দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ যাবত আহার নাও করেন, তবুও হুযূরকে দুর্বলতা মোটেই স্পর্শ করবে না। আর যদি পবিত্র অভ্যাস হিসেবে আহার না করেন, তবে দুর্বলতাও পরিলক্ষিত হবে। পবিত্র পেটে পাথরও বাঁধা হবে। কেননা, হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ] 'নূর'ও, 'বশর'ও। ইবাদতের সময় নূরানিয়াত প্রকাশ পায়, আর অভ্যাস শরীফে 'বাশারিয়াত'-এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সুতরাং এ হাদীস শরীফ হযরত জাবিরের ওই বর্ণনার পরিপন্থী নয়, যাতে বর্ণিত হয়েছে যে, হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ] দু'বেলা না খাওয়ার কারণে দু'টি পাথর পেট মুবারকে বেঁধেছিলেন।

তিন. জান্নাতী ফলমূল আহার করলে এবং সেখানকার পানি পান করলে রোযা ভঙ্গ হয় না; যেমনিভাবে মহান রবের সাথে কথা বললে এবং হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ]'কে সালাম দিলে নামায ভঙ্গ হয় না। কোন কোন ওলী স্বপ্নে পানাহার করে ফেলেন। খাবারের খুশবু জাগ্রত হবার পর তাঁদের মুখে পাওয়া যায়, কিস্তু তাঁদের রোযা স্থির থাকে। দেখুন, স্বপ্নদোষ হলে আমাদের রোযা ভঙ্গ হয় না।

চার. কোন বোন বান্দা এ জীবনে জান্নাতী ফলমূল পেয়ে থাকেন। হযরত মরিয়ম [ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺴﻼﻡ] জান্নাতী ফল খেয়েছেন মর্মে পবিত্র ক্বোরআনে প্রমাণ পাওয়া যায়।

পাঁচ. হুযূর-ই আন্ওয়ার [ﷺ] -এর প্রতিটি কাজ আমাদের জন্য সুন্নাত নয়; বরং ওই কাজই সুন্নাত, যা আমাদের জন্য আমলযোগ্য হয়। হুযূর মোস্তফার বিশেষত্বগুলো আমাদের জন্য সুন্নাত নয়। 'রোযার ভেসাল', নয়(০৯)জন স্ত্রী একসাথে বিবাহাধীন রাখা আমাদের জন্য না সুন্নাত, না আমলযোগ্য। 'সুন্নাত' ও 'হাদীস' -এর মধ্যে পার্থক্য এটাই।

□ হাদীস শরীফ এর ব্যাখ্যা সম্বলিত টীকা পেতে সার্চ করুনঃ

f/Ishq-E-Mustafa ﷺ facebook.com/SunniAqidah

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী বদায়ূনী, বঙ্গানুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মান্নান, ৩য় খন্ড, পৃ. (১৯৭-১৯৯), হাদীস নং-১৮৮৭ এর টীকাঃ (৮-১১) দ্রব্যষ্ট, প্রকাশনায়ঃ ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম।]

 
Top