প্রামাণ্য দলিল - ৩: আলবানী ও ইবনে তাইমিয়ার মুখোশ উন্মোচন 


ইমাম আল-হাকিমের বক্তব্য আলবানী দেখেছেন ঠিকই, কিন্তু পছন্দ করেননি। আর তাই তিনি সেটাকে উপেক্ষা করেন এবং একগুঁয়েভাবে ও অসততার আশ্রয় নিয়ে আওনের দুর্বল রওয়ায়াতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অপপ্রয়াস পান।


হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)র ঘটনাসম্বলিত বর্ণনাটিকে অসার প্রতীয়মান করার উদ্দেশ্যে আলবানীর (এবং ইবনে তাইমিয়ার) প্রতারণাপূর্ণ অপচেষ্টা সত্ত্বেও সেটা যে সহীহ হাদীস, তা ওপরে খোলাসা করা হয়েছে। এই ঘটনা পরিস্ফুট করে যে মহানবী (ﷺ)-এর বেসাল শরীফ তথা পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার পরও তাঁর শাফাআত তথা সুপারিশ প্রার্থনা জায়েয। কেননা যে সাহাবী [১৯] হাদীসটি বর্ণনা করেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটা জায়েয। আর বর্ণনাকারীর এই উপলব্ধি শরীয়তের দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। কেননা শরীয়তের বিস্তারিত আইনকানুন (গবেষণা করে) বের (এস্তেম্বাত) করার ক্ষেত্রে এর ওজন অনেকখানি।


আমরা যুক্তির খাতিরেই বর্ণনাকারীর উপলব্ধি অনুযায়ী কথা বলেছি। নতুবা বাস্তবে হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) কর্তৃক ওই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে মহানবী (ﷺ)-এর সুপারিশ কামনা করতে বলাটা ইতিপূর্বে হুযূর পাক (ﷺ)-এর বরাবরে অন্ধ সাহাবী (رضي الله عنه)র শাফাআত প্রার্থনার যে সাক্ষ্য [২০] তিনি বহন করছিলেন, সেই শরীয়তসিদ্ধ রীতিরই অনুসরণ ছাড়া কিছু নয়।


❏ হাদিস :


ইবনে আবি খায়তামা আপন ‘তারীখ’ তথা হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনী ও খ্যাতির বিবরণসম্বলিত পুস্তকে [২১] বিবৃত করেন:

عَنْ أَبِي جَعْفَرٍ، عَنْ عُمَارَةَ بْنِ خُزَيْمَةَ، عَنْ عُثْمَانَ بْنِ حُنَيْفٍ، أَنَّ " رَجُلًا ضَرِيرَ الْبَصَرِ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُعَافِيَنِي، فَقَالَ: «إِنْ شِئْتَ أَخَّرْتَ ذَاكَ، فَهُوَ أَعْظَمُ لِأَجْرِكَ، وَإِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ اللَّهَ؟» ، فَقَالَ: ادْعُهُ، فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ وَيُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ، وَيَدْعُوَ بِهَذَا الدُّعَاءِ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، يَا مُحَمَّدُ، إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ فَتُقْضَى، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ»


-ইবনে আবি খায়তামা বলেন, মুসলিম ইবনে ইবরাহীম আমার কাছে বর্ণনা করেন যে, হাম্মাদ ইবনে সালামা বলেছেন: “আবূ জা’ফর আল-খাতামী আমাকে জানান ‘আমারা ইবনে খুযায়মা হতে, তিনি উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) হতে এই মর্মে যে,


জনৈক অন্ধ ব্যক্তি মহানবী (ﷺ)-এর কাছে আসেন এবং আরয করেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ, আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি। আমার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া বা প্রার্থনা করুন।’


রাসূলে পাক (ﷺ) এরশাদ ফরমান, ‘যাও এবং অযূ করে দুই রাকআত (নফল) নামায পড়ো; অতঃপর দু’আ করো, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আপনারই নবী (ﷺ)-এর মধ্যস্থতায়, যিনি করুণার পয়গম্বর। এয়া মুহাম্মাদুর (ﷺ)! আমি আল্লাহর দরবারে আপনারই সুপারিশ তথা মধ্যস্থতা চাচ্ছি যাতে আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে। হে আল্লাহ! আমার এই আরযি ক্ববূল করুন এবং আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে নবী করীম (ﷺ)-এর সুপারিশ আপনি গ্রহণ করুন।’ (মহানবী (ﷺ) অতঃপর বলেন) তোমার যদি কখনো এ ধরনের কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে এভাবে দু’আ করবে।’ [২২]


ওপরের এই হাদীসের এসনাদ (সনদ) সহীহ। এর শেষ বাক্যটি কখনো প্রয়োজন দেখা দিলে মহানবী (ﷺ)-এর কাছে শাফাআত প্রার্থনার ক্ষেত্রে তাঁরই প্রকাশ্য অনুমতির কথা ব্যক্ত করে।


এতদসত্ত্বেও ইবনে তাইমিয়া খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে ওই শেষ বাক্যটির প্রতি আপত্তি উত্থাপন করেন এই মর্মে যে, এতে লুক্কায়িত কিছু পরিভাষাগত ত্রুটি (’ইল্লা) বিদ্যমান [২৩]। আমি (শায়খ গোমারী) ওইসব অপযুক্তির অসারতা অন্যত্র প্রদর্শন করেছি [২৪]। বাস্তবিকই ইবনে তাইমিয়া কর্তৃক আপন উদ্দেশ্যের পরিপন্থী কোনো হাদীসের দেখা পেলে তা প্রত্যাখ্যান করার দুঃসাহস দেখানোটা তার মজ্জাগত একটি বৈশিষ্ট্য, যদিও ওইসব হাদীস সহীহ বলে সপ্রমাণিত। [২৫]



তথ্যসূত্রঃ



[১৯] নোট: (ﷺ)-কে জীবদ্দশায় যিনি দেখেছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন এমন পুণ্যাত্মাবৃন্দ হচ্ছেন সাহাবা-এ-কেরাম।

[২০] নোট: হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)-ই হাদীসটির রওয়ায়াতকারী।

[২১] নোট: ইবনে তাইমিয়া-ও এই বিবরণ নিজ ‘ক্বা’য়েদা ফীল তাওয়াসসুল’ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেন।

[২২] তারীখে ইবনে আবি খায়তামা।     

[২৩] নোট: যে ধরনের ত্রুটি হাদীসের বা অন্ততঃ সেটার শেষ বাক্যের প্রামাণিকতা পক্ষপাতদুষ্ট করতে পারে।

[২৪] নোট: শায়খ গোমারী তাঁর আল-রাদ্দ আল-মুহকাম আল-মতীন ‘আলাল কিতাব আল-মুবীন’ শীর্ষক পুস্তকের ১৪১ পৃষ্ঠায় প্রদর্শন করেন যে ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘আল-ক্বওল আল-মুবীন ফী হুকমিদ্ দু’আ ওয়া নিদ’আ আল-মওতা মিন আল-আম্বিয়া ওয়াল-সালেহীন’ গ্রন্থে এমন ভান করেন যেন হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) ও তাঁর দ্বারা ওই তাওয়াসসুলের দু’আ শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ঘটনাটা বানোয়াট (মাকযুবা); কেননা (ইবনে তাইমিয়ার মতে) এই ঘটনা সত্য হলে এর জন্যে শর্তস্বরূপ খলীফা উসমান ইবনে আফফান (رضي الله عنه)-কে যালেম হতে হতো, এমন যালেম শাসক যিনি মানুষের অধিকার অস্বীকার করতেন এবং তাদের ফরিয়াদ শুনতেন না। উপরন্তু, ইবনে তাইমিয়া দাবি করেন যে সুন্নাহের কোনো বইপত্রেই এই ঘটনার উল্লেখ নেই।

[২৫] বঙ্গানুবাদকের জরুরি নোট: খলীফা উসমান (رضي الله عنه) ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির ঘটনাটি সত্য হলে খলীফা যালেম হিসেবে প্রতীয়মান হন মর্মে ইবনে তাইমিয়ার যুক্তি ধোপে টেকে না। কেননা খলীফা ওই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে পরে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর আরজির বিষয়টি স্মরণ করতে পারছিলেন না। যেখানে খলীফা নিজেই কারণ দর্শিয়েছেন, সেখানে যুক্তি খাড়া করার কোনো অবকাশ-ই নেই। উপরন্তু, এই ঘটনায় রূহানী তথা আধ্যাত্মিক প্রশাসনের আলামত পাওয়া যায়। ওই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি মসজিদে নববীতে অবস্থিত রওযা-এ-আকদসের কাছে মহানবী (ﷺ)-এর তাওয়াসসুল পালন করার পর খলীফা উসমান (رضي الله عنه) নিশ্চয় হুযূর পাক (ﷺ) হতে রূহানী তথা আধ্যাত্মিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন। নতুবা তিনি বিষয়টি স্মরণ করতে পারতেন না এবং এর প্রতি গুরুত্বও দিতেন না। রাষ্ট্রীয়কার্য পরিচালনায় এতোগুলো বিষয়ের মাঝে কারো সুনির্দিষ্ট বিষয় স্মরণ করতে পারাও এক কঠিন ব্যাপার বটে! ওই যুগে তো আর বর্তমানকালের মতো কম্পিউটার ফাইলিং ছিল না! সব কিছুই খলীফাকে স্মরণে রাখতে হতো।


❏ হাদিস :


এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে আল-বুখারী (رحمة الله)-এর ‘সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসটি: 

 كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ غَيْرُهُ 

“আল্লাহ অস্তিত্বশীল ছিলেন এবং তিনি ছাড়া আর কিছুই অস্তিত্বশীল ছিল না”। [২৬]


আল-ক্বুরআন, সুন্নাহ, যুক্তি এবং আল-এজমা’ আল-মুতাএয়াক্কান তথা নির্দিষ্ট ঐকমত্যের স্পষ্ট দলিল-প্রমাণের সাথে এই হাদীসটি সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু যেহেতু এটা ইবনে তাইমিয়ার চিরন্তন জগতের ধারণার সাথে মিলেনি, সেহেতু তিনি আল-বুখারীরই বর্ণিত এই হাদীসের অপর একটি সংস্করণের দিকে ফেরেন; তাতে এরশাদ হয়েছে:

 كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ غَيْرُهُ 

“আল্লাহ অস্তিত্বশীল ছিলেন এবং তাঁর আগে কিছুই ছিল না।”[বুখারী : আস সহীহ, ৪/১০৫ হাদীস নং ৩১৯১] 


❏ হাদিস :


তিনি হাদীসের প্রথম সংস্করণটি দ্বিতীয়টির মোকাবেলায় নাকচ করে দেন এই অজুহাতে যে সেটা অপর একটি হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ:

 أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ 

“আপনি-ই প্রথম; আপনার আগে কোনো কিছুই ছিল না।” 

[ইবনে আবী শায়বা : আল মুসান্নাফ, ৬/৩৯ হাদীস নং ২৯৩১৩।]

(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ২/৩৮১ হাদীস নং ৮৯৪৭।

(খ) মুসলিম : আস সহীহ, ৪/২০৮৪ হাদীস নং ৪/২০৮৪ হাদীস নং ২৭১৩।

(গ) ইবনে মাজাহ : আস সুনান, ২/১২৫৯ হাদীস নং ৩৮৩১।

(ঘ) আবু দাউদ : আস সুনান, ৪/৩১২ হাদীস নং ৫০৫১।

(ঙ) তিরমিযী : আস সুনান, ৫/৩৪২ হাদীস নং ৩৪০০।[২৭]


ওপরে উদ্ধৃত হাদীসগুলোর মাঝে দৃশ্যতঃ যে অসঙ্গতি বিরাজমান, তা সঙ্গতিপূর্ণ করার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে  হাফেয ইবনে হাজর বলেন:


“বস্তুতঃ হাদীসের এই দুইটি সংস্করণের মাঝে সঙ্গতি আনতে হলে প্রথমটির আলোকে দ্বিতীয়টিকে বুঝতে হবে, দ্বিতীয়টির আলোকে প্রথমটিকে নয়। অধিকন্তু, নীতিগত একটি ঐকমত্য (এজমা’) এক্ষত্রে বিদ্যমান যে, নস তথা ধর্মশাস্ত্রলিপির দুটি দৃশ্যতঃ পরস্পরবিরোধী সংস্করণের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের পদ্ধতিটি একটি সংস্করণকে বাতিল করার বিনিময়ে অপরটিকে সমর্থন করার পদ্ধতির ওপর প্রাধান্য পাবে।”


আসলে ইবনে তাইমিয়ার পক্ষপাত এই দুটি হাদীসের সংস্করণকে বোঝার ক্ষেত্রে তাকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছিল, যদিও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো পরস্পরবিরোধী নয়। এটা এ কারণে যে, “আল্লাহ অস্তিত্বশীল ছিলেন এবং তাঁর আগে কোনো কিছু ছিল না” মর্মে হাদীসের সংস্করণের অর্থ হিসেবে আল্লাহতা’লার মোবারক নাম ‘প্রথম’ বিদ্যমান; অথচ “আল্লাহ অস্তিত্বশীল ছিলেন এবং তিনি ছাড়া আর কিছুই অস্তিত্বশীল ছিল না” মর্মে হাদীসের সংস্করণে উদ্দিষ্ট অর্থ হচ্ছে তাঁর মোবারক নাম ‘এক’। এর প্রমাণ হলো আরেকটি হাদীসের সংস্করণ, যা’তে ঘোষিত হয়েছে, “সবকিছুর আগে আল্লাহ অস্তিত্বশীল ছিলেন।”     


❏ হাদিস :


হাদীস অস্বীকার করার ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়ার ধৃষ্টতার আরেকটি নমুনা হলো নিম্নের হাদীসটি: 

أَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِسَدِّ الأَبْوَابِ الشَّارِعَةِ فِي الْمَسْجِدِ وَتَرْكِ بَابِ عَلِيٍّ ".

“মসজিদে নববীর (ﷺ) সমস্ত দরজা যেগুলো রাস্তার দিকে মুখ করে ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেন; কিন্তু তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর দরজা (খোলা) রাখেন।” 


এই হাদীসটি সহীহ। ইবনে আল-জাওযী ভুল করে এটাকে নিজ ‘মওদু’আত ১/৩৬৩’ শীর্ষক বানোয়াট হাদীসের সংকলন পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। হাফেয ইবনে হাজর (رحمة الله) নিজ ‘আল-ক্বওল আল-মোসাদ্দাদ ১/৬’ গ্রন্থে [২৮]তাঁর এই ভুল শুধরে দেন। হযরত আলী (رضي الله عنه)র প্রতি সর্বজনবিদিত বিদ্বেষভাবের কারণে ইবনে তাইমিয়া এই হাদীসটি বানোয়াট মর্মে ইবনে আল-জাওযীর ঘোষণায় সন্তুষ্ট থাকেননি, বরং তিনি নিজের জালিয়াতির ঝুলি থেকে বের করা এই ছুতা-ও যোগ করেন যে মুহাদ্দেসীন তথা হাদীস বিশারদমণ্ডলী হাদীসটির জাল হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। ইবনে তাইমিয়ার মতের সাথে মিলেনি বলে কতো অগণিত হাদীস যে তিনি এভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তার হিসেব রাখা কঠিন।[২৯] 



তথ্যসূত্রঃ



[২৬] দেখুন হাফেয ইবনে হাজর কৃত ‘ফাতহুল বারী’, ১৩:৪১০।

[২৭] নোট: ইবনে তাইমিয়া ধারণা পোষণ করতেন যে সৃষ্টিসমূহ সবসময়-ই আল্লাহর সাথে অস্তিত্বশীল ছিল।

[২৮] আ’লম আল-কুতূব সংস্করণের ১০-১১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

[২৯] নোট: শায়খ আবদুল্লাহ গোমারী তাঁর বিভিন্ন লেখনীতে ইবনে তাইমিয়ার এই অসততার দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরেছেন। তাঁর এরকম একটি বইয়ের নাম ‘আল-রাদ্দ আল-মুহকাম আল-মতীন ‘আলাল কিতাব আল-মুবীন’। আরো অনেক আলেম-উলেমা ইবনে তাইমিয়ার এই দোষের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। তাঁদের মধ্যে সর্ব-ইমাম তক্বীউদ্দীন সুবকী, ইবনে হাজর আল-মক্কী, তক্বীউদ্দীন আল-হুসনী, আরবী আল-তুব্বানী, আহমদ যাইনী দাহলান মক্কী, মুহাম্মদ যাহেদ আল-কাউসারী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।



প্রামাণ্য দলিল - ৪


আলবানীর খাতিরে আমরা ধরে নিলাম যে হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)র ঘটনাটি দুর্বল, আর ইবনে আবী খায়তামা বর্ণিত হাদীসের সংস্করণটি قَالَ: " إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ لَكَ 

(‘তোমার যদি কখনো এ ধরনের কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে এভাবে দু’আ করবে’ - এই বাড়তি কথাসহ) ত্রুটিপূর্ণ (মু’আল্লাল), ঠিক যেমনটি ইবনে তাইমিয়া একে দেখতে চেয়েছেন। তথাপিও মহানবী (ﷺ)-এর শাফাআত প্রার্থনার বৈধতা প্রমাণের জন্যে অন্ধ সাহাবী (رضي الله عنه)র ঘটনাসম্বলিত হাদীসটি-ই যথেষ্ট হবে। এটা এ কারণে যে মহানবী (ﷺ) অন্ধ সাহাবী (رضي الله عنه)কে ওই পরিস্থিতিতে তাঁর সুপারিশ প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়াতে সর্বপরিস্থিতিতে তা প্রার্থনার যথার্থতা এতে পরিস্ফুট হয়েছে।


উপরন্তু, এ ধরনের শাফাআতকে বেদআত (বা গোমরাহী) বলে উল্লেখ করার কোনো অনুমতি-ই নেই। ঠিক যেমনটি অনুমতি নেই এ ধরনের সুপারিশকে অযৌক্তিকভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হায়াতে জিন্দেগী তথা দুনিয়ার জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা (মানে তাঁর বেসালের পরও এই শাফাআত প্রার্থনা বৈধ)।


বস্তুতঃ যে ব্যক্তি মহানবী (ﷺ)-এর এই সুপারিশকে তাঁরই প্রকাশ্য জিন্দেগীর সময়কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে, সে এক গোমরাহ-পথভ্রষ্ট [৩০]। কেননা সে একটি সহীহ হাদীসকে নাকচ করে এবং ফলশ্রুতিতে এর প্রয়োগকেও নিরুদ্ধ করে। আর এটাই হারাম কাজ।


আলবানী, আল্লাহ মাফ করুন, শর্ত সাপেক্ষতাকে রদ/রহিত বলে দাবি করার দুঃসাহস দেখান এ কারণে যে, তাঁর পূর্বধারণা ও প্ররোচনা স্রেফ কোনো ধর্ম শাস্ত্রলিপির দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট বলে সাব্যস্ত হয়েছে। অন্ধ সাহাবী (رضي الله عنه)র হাদীসটি যদি তাঁরই জন্যে বিশেষ/খাস (নেয়ামতের) বণ্টন হতো, তাহলে (ﷺ) তা স্পষ্ট করে বলতেন, যেমনটি তিনি হযরত আবূ বুরদা (رضي الله عنه)কে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন তাঁর ক্ষেত্রে দুই বছর বয়সী ছাগলের ক্বুরবানী-ই যথেষ্ট হবে, কিন্তু অন্যদের বেলায় তা যথেষ্ট হবে না। অধিকন্তু, এ কথাও ধরে নেয়া যায় না যে হুযূর পূর নূর (ﷺ) কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে হয়তো কালক্ষেপণ করেছিলেন, যখন তাঁর সাহাবীদের (رضي الله عنه) এর) ওই জ্ঞান তৎক্ষণাৎ জানার প্রয়োজন ছিল।




একটি ছল-চাতুরী ও তার নিবারণ     


ধরুন, কেউ এসে বল্লেন, ’এই হাদীসকে নবী পাক (ﷺ)-এর হায়াতে জিন্দেগীতে আমাদের সীমাবদ্ধ করতে হবে এ কারণে যে এতে হুযূর পাক (ﷺ)কে নেদা’ দিতে বা আহ্বান করতে হয়, (যেটা তাঁর বেসাল শরীফের পরে বৈধ নয়)।’ আমরা এই আপত্তির জবাবে বলবো, এটা প্রত্যাখ্যান করতে হবে; কেননা অসংখ্য হাদীসে মহানবী (ﷺ) আমাদের দিকনির্দেনা দিয়েছেন নামাযের তাশাহহুদ পাঠ করতে হবে [৩১]। আর এই তাশাহহুদেই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নবী করীম (ﷺ)-এর প্রতি সম্বোধনসূচক সালাত-সালাম: 

“হে নবী (ﷺ)! আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক”)

 السَّلَامُ عَلَىكَ أيُّها  النَّبِيِّ)। 

এই পদ্ধতিটি-ই সর্ব-হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত ইবনে যুবায়র ও মুআবিয়া (رضي الله عنه) মিম্বরে [৩২] দাঁড়িয়ে মানুষদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। অতঃপর এ বিষয়টি এজমা’ তথা ঐকমত্যে পরিণত হয়, যে সম্পর্কে ইবনে হাযম [ফাসল ফীল নিহল, ১:৮৯] ও ইবনে তাইমিয়া দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিয়েছেন।


আলবানী যেহেতু (ধর্মে) বিভেদ সৃষ্টিপ্রবণ, সেহেতু তিনি এজমা’ লঙ্ঘন করেছেন এবং হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত একটি রওয়ায়াতকে অনুসরণের বেলায় গোঁ ধরেছেন। 


তথ্যসূত্রঃ



[৩০] নোট: এটা এ কারণে যে মহানবী (ﷺ) যা বৈধ ঘোষণা করেছেন, তাকে ওই ব্যক্তি কার্যতঃ না-জায়েয ঘোষণা করেছে; আর এটাই হলো গোমরাহীমূলক কর্মকাণ্ড, যেটা মহানবী (ﷺ)-এর শরীয়তের রদ-বদল বা বিরোধিতা ছাড়া কিছু নয়।

[৩১] নোট: প্রতি দুই রাকআত নামাযের শেষে বেঠকে আল্লাহর একত্ব ও রাসূল (ﷺ)-এর রেসালাতের শাহাদাত বা সাক্ষ্য প্রদান।

[৩২] নোট: তথা মসজিদের ভেতরে জুমুআ’র নামাযে ইমামের খুতবা দিতে দাঁড়াবার সিঁড়িবিশেষ।

[৩৩] ইবনে আবী শায়বা : আল মুসনাদ, ১/২১৬ হাদীস নং ৩১৯।

(ক) আহমদ : আল মুসনাদ, ১/৪১৪ হাদীস নং ৩৯৩৫।

(খ) বায়হাকী : আস সুনানুল কুবরা, ২/১৯৮ হাদীস নং ২৮২০। 

 
Top