৭. স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া


স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামী তার সাধ্যানুযায়ী যখন যা স্ত্রীকে প্রদান করেন স্ত্রী তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে না করে অল্পকেও অধিক মনে করে হাসিমুখে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করা উচিত। বস্তু কিংবা বস্তুর মূল্য হিসাব না করে স্বামী যে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা প্রকাশার্থে উপহার দিয়েছেন সেটা হিসাব করা উচিত যা একজন স্ত্রীর জন্য অমূল্য সম্পদ। একজন স্ত্রীর জন্য তার স্বামীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই হলো সবচেয়ে বড় মূল্যবান বস্তু যা টাকা দিয়ে কিনা যায় না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীকে আরো বেশি দিতে ইচ্ছে হয়। আল্লাহ তা‘আলাও বলেছেন- যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তবে তোমাদেরকে আমি নিয়ামত আরো বাড়িয়ে দেবো।


স্বামীর কোন উপহার স্ত্রীর পছন্দ না হলেও মুখের সামনে অপছন্দের কথা বলা উচিত নয়। এতে সমস্ত আনন্দ মুহুর্তের মধ্যে ভেস্তে যাবে এবং উভয়ের মধ্যে মনমালিন্যতা দেখা দেবে।


অনেক মেয়েদের স্বভাব হলো স্বামী তার কোনো একটি চাহিদা পূরণ করতে না পারলে স্ত্রী রাগান্বিত হয়ে বলেন- “তুমি জীবনে আমার একটি চাহিদাও পূর্ণ করনি।” অর্থাৎ সামান্য বিষয়ে অতীতের স্বামীর সব অবদানকে অস্বীকার করে বসে। হযরত আসমা (رضي الله عنه) বলেন, আমাদের মহিলাদের একটি দলের নিকট দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গমন করছিলেন এবং তিনি আমাদেরকে সালাম দিয়ে বললেন, সাবধান! কল্যাণকারীর অকৃতজ্ঞ হওয়া থেকে বেঁচে থাক। আমি বললাম,হে আল্লাহর রাসূল! কল্যাণকারীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা কী? তিনি বললেন, তোমরা একটা সময় পর্যন্ত পিতা-মাতার অধীনে জীবন যাপন কর। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা (বিবাহের মাধ্যমে) স্বামীর দ্বারা আনন্দিত করেন। তার মাধ্যমে তোমাদের এবং সন্তানাদির আর্থিক কল্যাণ অর্জিত হয়। অতঃপর তোমরা তার প্রতি যখন অসন্তুষ্ট হয়ে যাও তখন বলে ফেল যে, আমি কখনো তার থেকে কোনো কল্যাণ পাইনি। ১১৬

১১৬.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. (২৪১ হি.) মুসনাদে আহমদ, আলাউদ্দিন আলী ইবনে হুসসাম উদ্দিন র. (৯৭৫হি.) কানযুল উম্মাল খণ্ড ১৬, পৃ. ১৬৫; নুরুদ্দিন আলী ইবনে আবি বকর র. (৮০৮হি.) মাজমাউয যাওয়ায়েদ।

 

لا ينظر الله إلى امرأة لا تشكرلزوجها وهي لا تستغني عنه

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত মারফু হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- আল্লাহ তা‘আলা ঐ মহিলার প্রতি দয়ার দৃষ্টিতে থাকাবেন না, যেই মহিলা তার স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ, অথচ স্ত্রী স্বামীর অমুখাপেক্ষী নয়। ১১৭

১১৭.আলী ইবনে হুসসাম উদ্দিন র (৯৭৫হি.) কানযুল উম্মাল, খণ্ড ১৬, পৃ. ১৬৫

 

সাধারণত দেখা যায় যে, মহিলারা তারা নিজেদের চেয়ে বৃত্তবান ধনীদের অবস্থা দেখে নিজেদের অবস্থা বিবেচনা করে থাকে। অন্যদের চেয়ে নিজের শাড়ি-গয়না একটু নিরস হলে স্বামীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় না রেখে ঝগড়া আরম্ভ করে দেয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন- “তোমরা নিজেদের চেয়ে উন্নতদের দিকে তাকিও না বরং নিজেদের চেয়ে যারা নিম্নমানের জীবন-যাপন করে তাদের দিকে তাকাও।” এতে কৃতজ্ঞতার উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে।


হযরত শেখ সাদী (رحمة الله) জ্ঞানার্জনের সময়কালে একদা অভাবেব কারণে খালি পায়ে জুতা বিহীন চলছিলেন। মনে মনে তিনি নিজের ভাগ্যের প্রতি আক্ষেপ করছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে, তার ন্যায় অন্য একজন মানুষের একটি পা নেই। তখন তিনি এই বলে আল্লাহর শোকর করলেন যে, আল্লাহ আমাকে জুতা কিনার তাওফিক না দিলেও তো অন্তত পা দিয়েছেন যা দিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছি। তখন সাথে সাথে তার অন্তর থেকে বিষণœতা দূরীভূত হয়ে গেল এবং আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন।


স্বামীর সাধ্যের অতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবী করা স্ত্রীর অনুচিত। একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র স্ত্রীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অতিরিক্ত খোরপোশ দাবী করেছিলেন। তারা তাঁর চতুর্দিকে বসে রইলেন। এ অবস্থায় হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) ও হযরত ওমর (رضي الله عنه) তাঁর অনুমতিক্রমে ভিতরে প্রবেশ করলেন, হযরত ওমর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বিমর্ষ অবস্থায় চুপ করে বসে থাকতে দেখলেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, আমি এমন কথা বলবো যাতে রাসূলুল্লাহ হাসেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আপনি দেখতেন যে, আমার স্ত্রী বিনতে খারেজা আমার কাছে এরূপ (অতিরিক্ত) খোরপোশ চাইতেছে, তাহলে আমি উঠে তার ঘাড়ে আঘাত করতাম। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হেসে দিলেন আর বললেন, এরা আমার চারপাশে ঘিরে বসে আছে- তারা তাদের বাড়তি খোরপোশ চাচ্ছে। তখন হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) উঠে তাঁর কন্যা হযরত আয়িশা রা’র ঘাড় মটকাতে লাগলেন এবং হযরত ওমর (رضي الله عنه) উঠে তাঁর কন্যা হযরত হাফসা রা’র ঘাড় মটকাতে লাগলেন আর উভয়ে বলতে লাগলেন- তোমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র নিকট এমন বস্তু দাবী করছ যা তাঁর কাছে নেই। তখন তারা বললেন, খোদার কসম! আমরা আর কখনো তাঁর কাছে এমন কিছু দাবী করবো না যা তাঁর কাছে নেই। অতঃপর তিনি এক মাস কিংবা ঊনত্রিশ দিন তাঁদের কাছ থেকে পৃথক রইলেন। অতঃপর এই আয়াত নাযিল হল- “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের বলুন, যদি তোমরা পার্থিব জিন্দেগী ও দুনিয়ার ভোগ-বিলাস চাও, তবে এসো আমি তোমাদেরকে কিছু দিয়ে ভালভাবে বিদায় করে দিই। আর যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এবং পরকাল চাও, তবে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য আল্লাহ মহান পুরস্কার ঠিক করে রেখেছেন। ১১৮

১১৮.সূরা আহযাব, আয়াত: ২৮-২৯


অতঃপর তিনি হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) কে প্রথমে বললেন, হে আয়েশা! আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, এর উত্তর তোমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ ব্যতিত দ্রুত দিওনা। আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন কি বিষয়ে? তখন তিনি উক্ত আয়াতদ্বয় পাঠ করে শুনালেন। তখন আয়েশা (رضي الله عنه) বললেন, আপনার ব্যাপারেও কি আমাকে আমার পিতার সাথে পরামর্শ করতে হবে? বরং আমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালকে গ্রহণ করলাম।১১৯

১১৯.ইমাম মুসলিম র. (২৬১হি.) সহীহ মুসলিম, সূত্র মিশকাত, পৃ. ২৮১

 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র কাছে তাঁর স্ত্রীগণ অতিরিক্ত খোরপোশ দাবী করছিলেন আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ কারণে মনক্ষুন্ন হয়ে বসে আছেন। ওদিকে মহান আল্লাহ আরশ আ‘যম থেকে তাঁর হাবীব (ﷺ) ’র অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আয়াত নাযিল করে স্ত্রীদের শাসিয়ে দিয়ে তাঁর হাবীব (ﷺ) কে সান্তনা দিলেন। কারণ রাসূলুল্লাহ ’র কষ্ট আল্লাহ কখনো বরদাস্ত করেন না।


স্বামী-স্ত্রী কখনো কোনো বিষয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হলে তা যদি কনের পিতা-মাতার বোধগম্য হয় তখন তাদের উচিত প্রথমে নিজেদের মেয়েকে শাসন করা যেভাবে ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত আবু বকর ও ওমর (رضي الله عنه) করেছিলেন। এতে দু’টি উপকার নিহিত থাকে। প্রথমত স্ত্রী মনে করবে যখন আমার পিতা-মাতা স্বামীর পক্ষে রয়েছেন তখন নিশ্চয় আমি অন্যায় করছি। দ্বিতীয়ত স্বামীর রাগ কমে যাবে এবং শ্বশুর-শাশুরীকে ভুল বুঝবেনা। পক্ষান্তরে স্বামীর পিতা-মাতার উপস্থিতিতে ঝগড়া হলে তখন তার পিতা-মাতা প্রথমে নিজেদের ছেলেকেই থামিয়ে দেওয়া উচিত। এতে স্ত্রী অন্তত মনে করবে যে, স্বামী বিপক্ষ হলেও শ্বশুর-শাশুরী আমার পক্ষে রয়েছেন। এভাবে পানি দিয়ে জলন্ত আগুনকে যেভাবে নিভানো হয় তেমন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় প্রজ্জলিত অনল নিভানো সম্ভব। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে আগুনে তেল ছিটানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। 


হযরত নু’মান ইবনে বশীর (رضي الله عنه) বলেন, একদা হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র গৃহে গিয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। এ সময় তিনি হযরত আয়িশা রা’র উচ্চকণ্ঠ শুনতে পেলেন। ভিতরে প্রবেশ করে হযরত আশিয়া (رضي الله عنه) কে ধরে চড় মারার জন্য উদ্যত হলেন আর বললেন, সাবধান! আর কোনদিন যেন তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র সামনে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে না দেখি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) কে আয়িশা (رضي الله عنه) কে প্রহার করা থেকে বাধা দিলেন। আবু বকর (رضي الله عنه) নিজ কন্যার উপর রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আবু বকর (رضي الله عنه) চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখলে তুমি? এ ব্যক্তির হাত থেকে তোমাকে আমি কিভাবে বাঁচালাম? বর্ণনাকারী বলেন, এ ঘটনার পর কয়েকদিন যাবৎ হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র ঘরে আসলেন না। অতঃপর একদিন হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ ’র ঘরে এসে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন এবং প্রবেশ করে দেখলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও হযরত আয়িশা রা’র মধ্যে আপোষ হয়ে গেল। অর্থাৎ তাঁরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। এটা দেখে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) বললেন, আপনারা দু’জনে শান্ত পরিবেশে আমাকেও অন্তর্ভূক্ত করে নিন, যেভাবে আপনাদের অশান্ত পরিবেশে আমাকে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমরা তাই করলাম, আমরা তাই করলাম। ১২০

১২০.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫হি.), সুনানে আবু দাউদ, সূত্র মিশকাত; পৃ. ৪১৭


قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِذَا نَظَرَ أَحَدُكُمْ إِلَى مَنْ فُضِّلَ عَلَيْهِ فِي الْمَالِ وَالْخَلْقِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْهُ: مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ قَالَ: ্রانْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَا تَنْظُرُوا إِلَى من 

هُوَ فوقكم فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لَا تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُم

হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ এমন ব্যক্তিকে দেখবে যাকে ধন-সম্পদে ও সুন্দরে তার থেকে অধিক দেয়া হয়েছে, তখন সে যেন নিজের চাইতে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকে তাকায়। বুখারী ও মুসলিম, মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, তোমরা নিজেদের অপেক্ষা নিম্ন অবস্থার লোকদের প্রতি তাকাও। এমন ব্যক্তির দিকে তাকিও না যারা তোমার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের। যদি এই নীতি অবলম্বন করা তাহলে তোমার প্রতি আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতকে ক্ষুদ্র ও হীন মনে করবে না। ১২১

১২১.শায়খ ওয়ালী উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ র. (৭৪৯ হি.), মিশকাত, পৃ. ৪৪৭

 
Top