দ্বিতীয় অধ্যায়


(অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তি সমূহের বিবরণ)


এ অধ্যায়ে চারটি পরিচ্ছেদ আছে। প্রথম পরিচ্ছেদে রয়েছে ইলমে গায়বের সাথে সংশি­ষ্ট কুরআনের সমস্ত আয়াতের বিবরণ যেগুলো বিরুদ্ধমতাবলম্বীরা দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হাদীছ সমূহের বিবরণ, তৃতীয় পরিচ্ছেদ উলামায়ে কিরাম ও ফকীহগণের উক্তি সমূহের বিবরণ এবং চতুর্থ পরিচ্ছেদে যুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিকা আপত্তি সমূহের বিবরণ পেশ করা হয়েছে।


এ অধ্যায়ের প্রারম্ভে ভূমিকা স্বরূপ কয়েকটি জরূরী বিষয়ের উপর আলোকপাত করা দরকার-


(১) যে সমস্ত আয়াত ও হাদীছ সমূহ, বা ফকহীগণের উক্তিসমূহের হুযুর আলাইহিস সালামের অদৃশ্য জ্ঞানের অস্বীকৃতি প্রকাশ পেয়েছে, সে সবের দ্বারা হয়তো সত্ত্বাগত জ্ঞান কিংবা সমস্ত জ্ঞাতবিষয় তথা আল্লাহ তা’আলার জ্ঞানের সমপরিমাণ জ্ঞান বোঝানো হয়েছে, খোদা প্রদত্ত জ্ঞানকে অস্বীকার করা হয়নি। তা’ যদি না হয়, তাহলে এসব আয়াত ও হাদীছসমূহ এবং ইতিপূর্বে অদৃশ্য জ্ঞানের সমর্থনে উপস্থাপিত আয়াত ও হাদীছসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান কিরূপে সম্ভবপর হবে?


❏আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহমতুল্লাহে আলাইহে){ওফাত.৯৭৪হি.} ‘ফাতওয়ায়ে হাদিসিয়্যাতে’ এ ধরনের দলীলসমূহের উত্তরে বলেছেন যে ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন-


مَعْنَاهَا لاَيَعْلَمُ ذَلِكَ اسْتِقْلاَلاً وَّعِلْمَ اِحَاطَةٍ اِلاَّاللهُ تَعَالَى اَمَّا الْمُعْجِزَاتُ وَالْكَرَامَاتُ فَبِاِعْلَامِ اللهِ تَعَالَى


-‘‘ওসবের অর্থ হলো আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত সত্ত্বাগতভাবে ও সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য বিষয়াদি কেউ জানতে পারে না। অবশ্য কারামত ও মু’জিযা হিসেবে প্রকাশিত অদৃশ্য জ্ঞান আল্লাহ কর্তৃক জ্ঞাত করানোর ফলেই সম্ভবপর হয়ে থাকে।’’ 

{আল্লামা ইবনে হাজার মক্কীঃ ফতোয়ায়ে হাদিসিয়্যাহঃ ১/২২৩ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন}


বিরুদ্ধ মতাবলম্বীগণ বলেন যে, যে সব দলীলে ইলমে গায়বের স্বীকৃতি রয়েছে, আর যেসব দলীলে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে, সেইগুলো দ্বারা পার্থিব সমস্ত বিষয়ের জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের সমন্বয়মূলক ব্যাখ্যা সেসব কুরআনের আয়াত, সহীহ হাদীছ ও উলামায়ে উম্মতের উক্তি সমূহের বিপরীত, যেগুলো আমি ইলমে গায়বের সমর্থনে ইতিপূর্বে পেশ করেছি।


হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) এর জ্ঞান, অনুরূপ লওহে মাহফুজের ‘জ্ঞান বলতে সমস্ত বিষয়কে অন্তভুর্ক্ত করে। উপরন্ত হুযুর আলাইহিস সালামের ইরশাদ রয়েছেঃ সমস্ত জগত আমার নিকট এ হাতের মতই দৃশ্যমান। সুতরাং এ ধরনের সমন্বয় সাধনমূলক ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে বাতিল।


(২) ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপস্থাপিত দলীলসমূহ যথা আল্লাহ কালাম ‘আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়ব জানে না’ বা হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইরশাদ ‘আমি গায়ব জানি না’ কিংবা ফকীহগণের উক্তি ‘যে খোদা ভিন্ন অন্য কাউকে ইলমে গায়বের অধিকারী বলে বিশ্বাস করে, সে কাফির’ ইত্যাদি যাবতীয় দলীল স্বয়ং তাদের মতেরও বিপরীত। কেননা তাঁরাও অদৃশ্য জ্ঞানের কিয়দাংশের সমর্থক। কেবল পূর্বাপর সমস্ত বিষয়ের সম্পূর্ণ জ্ঞানের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। সুতরাং, উলি­খিত আয়াত ও উক্তিসমূহ থেকে তাঁরাও রেহাই পেতে পারেন না। কেননা, শুধু একটি বিষয়েরও ইলমে গায়ব স্বীকার করা হলে তাদের পেশকৃত দলীলের বিপরীত হয়ে যায়। তর্কশাস্ত্রের অকাট্য বিধি অনুযায়ী ‘সামান্য নঞর্থক যুক্তি বাক্যের’ সহিত 


বিশেষ সতর্ক যুক্তি বাক্যের বিরোধিতার’ সম্বন্ধ থাকে। দু’টি পরস্পর বিরোধী যুক্তি বাক্যের প্রথমটি সত্য হলে, দ্বিতীয়টি মিথ্যা হবেই, আবার দ্বিতীয়টি মিথ্যা হলে প্রথমটি অবশ্যই সত্য হবে। সুতরাং, এক্ষেত্রেও হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান নেই’ ও হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আংশিক অদৃশ্য জ্ঞান আছে’ এ দুটো বিরুদ্ধে বিরোধিতামূলক’ বাক্য একই সঙ্গে সত্য হতে পারে না।


(৩) ভিন্ন মতাবলম্বীগণ আরও বলেন যে, ঐ সমস্ত দলীলের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ইলমে গায়বকে অস্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু আংশিক জ্ঞানকে অস্বীকার করা হয় নি। যদি তাই হয়, তাহলে কোন মতানৈক্যই রইলো না। কেননা, সৃষ্টি পূর্বাপর যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞান علم ماكان وما يكون খোদার জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোঁটা মাত্র। আমরাও তো খোদার জ্ঞানের মুকাবেলায় হুযুর আলাইহি সালামের জ্ঞানকে আংশিক বলেই দাবী করি।


(৪) ভিন্ন মতাবলম্বীরা বলে যে, ইলমে গায়ব খোদারই একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য। তাই খোদা ভিন্ন অন্য কারো জন্য এ জ্ঞান স্বীকার করাটা কুফর। তাদের এ কথায় তারা নিজেরাই কাফিরদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে গেছেন। কেননা খোদার গুণাবলীর যে কোন একটিতে অন্য কাউকে শরীক করা যেমন কুফর, সব গুণাবলীতে শরীক করাও তথৈবচ। যেমন, যে ব্যক্তি সৃষ্টি জগতের যে কোন একটি জিনিসের স্রষ্ঠারূপে কোন বান্দাকে স্বীকার করে, সে যেমন বিধর্মী হয়ে যায়, তেমনি যে ব্যক্তি অন্য কাউকে জগতের সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করে, সেও কাফির হয়ে যায়। অতএব, তাঁরাও যেহেতু হুযুর আলাইহিস সালামের আংশিক ইলমে গায়বকে স্বীকার করেন, সেহেতু কুফরী থেকে তাঁদেরকেও রক্ষা নেই। তবে, হ্যাঁ, একথাই বলুন যে সত্ত্বাগত ও স্বয়ং সম্পূর্ণজ্ঞান খোদারই একমাত্র বৈশিষ্ট্য, আর (খোদা) প্রদত্ত জ্ঞান হুযুর আলাইহিস সালামের একটি বৈশিষ্ট্য বা গুণ। এতে কোন শির্ক হলো না। এটাইতো আমরা বলি।

 
Top