বিষয় নং- ০৫: মূর্খের ইবাদতের চেয়ে আলিমের ঘুম উত্তম।


“হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থের ৪৪৮ পৃষ্ঠায় এ হাদিসটি প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-‘‘আরেকটি ভিত্তিহীন জাল কথা।’’ আমরা তার মূর্খতার জবাব গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দ্বারাই দেব ইন শা আল্লাহ! 


❏ হযরত সালমান ফারসী (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান-


حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ: ثنا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ الْحَسَنِ، قَالَ: نا أَحْمَدُ بْنُ يَحْيَى الصُّوفِيُّ، قَالَ: نا مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى الضَّرِيرُ، قَالَ: ثنا جَعْفَرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ إِسْمَاعِيلَ، عَنِ الْأَعْمَشِ، عَنْ أَبِي الْبَخْتَرِيِّ، عَنْ سَلْمَانَ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: نَوْمٌ عَلَى عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ صَلَاةٍ عَلَى جَهْلٍ


-‘‘হযরত সালমান (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (ﷺ) ইরশাদ করেন, জ্ঞানবান আলিমের নিদ্রা যাওয়া মূর্খজন সারারাত নামায আদায় করা হতে উত্তম।’’  ২৩

➥{ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী : হিলইয়াতুল আউলিয়া : ৪/৩৮৫ পৃ. দারুল কুতুব আল-আরাবী,  বয়রুত,  লেবানন,  সূয়তী : জামেউস সগীর : ২/৬৬৯ পৃ. : হা/৯২৯৪, জামিউল আহাদিস,  ২২/২৮৭ পৃ. হাদিস,  ২৪৯০০,  মোল্লা আলী ক্বারী : আসারুল মারফ‚আ : ২৫৫ পৃ., নাসিরুদ্দিন আলবানী : সিলসিলাতুল আহাদিসুদ্-দ্বঈফাহ : ৪/১১২ পৃ. : হা/৪৬৯৭,  দ্বঈফু জামে : ১/৮৬১ পৃ.হাদিস,  ৫৯৭৩, আজলূনী, কাশফুল খাফা : ২/২৯৬ পৃ. হা/২৮৬৬, মুত্তাকী হিন্দী : কানযুল উম্মাল : ১০/১৪০ পৃ. হা/২৮৭১১,  ও ১০/২৬১পৃ. হাদিস,  ২৯৩৮৬, এটি আলী হতে,  মুকাদ্দাসী শায়বানী,  আতরাফুল গারায়েব ওয়াল ইফরাদ, ৩/১১৮ পৃ. হাদিস,  ২২০৫, দায়লামী,  আল-ফিরদাউস, ৪/২৪৭ পৃ. হাদিস, ৬৭৩২, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ৩/২৫৪পৃ. হাদিস,  ১২৬৯৩, ইরাকী, তাখরীজে ইহইয়াউল উলূম, ২/৮৬৯ পৃ. ও ৬/৩০৮ পৃ. সালিম র্জারার, ইমা ইলা যাওয়াইদ, ৩/২৭ পৃ. হাদিস,  ১৯৫২,}



পর্যালোচনা:

ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর এ সনদটিকেও তার গ্রন্থের ৪৪৯ পৃষ্ঠায় জাল প্রমাণ করতে না পেরে যঈফ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সনদের কোন কারণে এটি যঈফ হলো তাও তিনি উল্লেখ করেননি। কোন নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস এটিকে যঈফ বলেননি।


❏ অপরদিকে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) উক্ত হাদিসটি সম্পর্কে বলেন :


رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ بِسَنَدٍ ضَعِيفٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي أَوْفَى لَكِنْ رَوَى أَبُو نُعَيْمٍ فِي الْحِلْيَةِ عَنْ سَلْمَانَ نَوْمٌ عَلَى عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ صَلَاةٍ عَلَى جَهْلٍ


-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) দুর্বল সনদে (এ বিষয়ক আরেকটি হাদিস) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবি আওফা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তবে ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী (رحمة الله) তার হিলইয়াতুল আউলিয়া গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী (رحمة الله) এর সূত্রে বর্ণনা করেন এভাবে, ‘একজন আলেমের নিদ্রা যাওয়া মূর্খ ব্যক্তির সারারাত নামায পড়া হতে উত্তম’।”  ২৪ 

➥{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফূআহ : ১/৩৭৪-৩৭৫ পৃ. হা/৫৬৭}



দেখুন এখানে তিনি হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه)-এর সনদ নিয়ে কোনো সমালোচনা করেননি।


❏ ইমাম আজলূনী (رحمة الله) বলেন:


رواه البيهقي بسند ضعيف عن عبد الله بن أبي أوفى؛ لكن روى أبو نعيم في "الحلية" عن سلمان: نوم على علم خير من صلاة على جهل؛ لأن العالم ينوي التقوي على الطاعة بخلاف الجاهل


-“ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (رضي الله عنه) থেকে জয়ীফ সনদে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আবু নুয়াইম (رحمة الله) তাঁর ‘হিলিয়া’ গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আলিমের ঘুম অজ্ঞ লোকের নফল নামাজের চেয়েও উত্তম। কেননা আলিম তাকওয়ার সাথে ঘুমানোর নিয়ত করে যা অজ্ঞ লোকের বিপরীত।” 


(ইমাম আজলুনী: কাশফুল খাফা, হাদিস নং ২৮৩৯)


তার বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল যে উক্ত হাদিসটির দুটি সনদ রয়েছে। আমরা কিতাবের শুরুতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি যে একাধিক তরিকায় দুর্বল সনদের হাদিস বর্ণিত হলেও তা ‘হাসান’ পর্যায়ে উন্নিত হয়, তাই উক্ত হাদিসটি নি:সন্দেহে ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য। 


❏ এ হাদিসটির তৃতীয় একটি সূত্র পাওয়া যায় মুত্তাকী হিন্দী (رحمة الله) সংকলন করেছেন এভাবে- 


عن علي قال: نوم على علم خير من اجتهاد على جهل. آدم في العلم. 


-‘‘হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একজন জাহেলের ইজতিহাদ বা গবেষণা থেকে আলিমের ঘুম উত্তম।’’  ২৫ 

➥{ইমাম মুত্তাকী হিন্দী,  কানযুল উম্মাল,  ১০/২৬১ পৃ. হা/২৯৩৮৬}



তাই তিনজন সাহাবীর বর্ণনা দ্বারা হাদিসটির যে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।


বিভিন্ন মুহাদ্দিসদের বক্তব্য:


❏ আল্লামা আবু তালেব মক্কী (رحمة الله) ওফাত ৩৮৬ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,


وقد روينا في خبر نوم العالم عبادة ونفسه تسبيح. 


-“অবশ্যই খবরের মধ্যে বর্ণনা করি, আলিমের ঘুম ইবাদত, তাদের চুপ থাকা তাসবীহ সমতুল্য।” 


(কুওয়াতুল কুলুবে ফি মুয়ামালাতিল মাহবুব, ১ম খণ্ড, ৬৭ পৃ:)


❏ হাফিজ ইবনে তাইমিয়া তদীয় কিতাবে হাদিসটি এভাবে উল্লেখ করেছেন,


وَفِي الْأَثَرِ: نَوْمُ الْعَالِمِ تَسْبِيحٌ. 


-“আছারের মধ্যে আছে, আলিমের ঘুম তাসবীহ্ সমতুল্য।” 


(হাফিজ ইবনে তাইমিয়া: মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া, ৭ম খণ্ড, ৪৪ পৃ:)


❏ আল্লামা আবু সাঈদ খাদেমী হানাফী (رحمة الله) ওফাত ১১৫৬ হিজরী তদীয় কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেন-


قَوْلُهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ نَوْمُ الْعَالِمِ خَيْرٌ مِنْ عِبَادَةِ الْجَاهِلِ


-“আল্লাহর রাসুল (ﷺ) এর বাণী হল: আলিমের ঘুম অজ্ঞ ব্যক্তির নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” 


(বারিকাতু মাহমুদিয়া ফি ত্বারিকাতি মুহাম্মদীয়া, ২য় খণ্ড, ৮০ পৃ:)


❏ আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ছিলাহ্ সান‘আনী (رحمة الله) ওফাত ১১৮২ হিজরী তদীয় কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন-


نوم العالم خير من عبادة الجاهل


-“আলিমের ঘুম অজ্ঞ লোকের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” 


(আল্লামা ছানআনী: আত তানভীর শরহে জামেউছ ছাগীর, ১২৩৫ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)


❏ আল্লামা তাজ উদ্দিন আব্দুল ওহাব ইবনে তক্বী উদ্দিন সুবকী (رحمة الله) ওফাত ৭৭১ হিজরী তদীয় কিতাবে বলেন,


رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ فِي شعب الْأَيْمَان مَوْقُوفا على عبد الله بن عَمْرو بن الْعَاصِ حَدِيث نوم الْعَالم عبَادَة وَنَفسه تَسْبِيح


-“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (رضي الله عنه) থেকে ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) ‘শুয়াইবুল ঈমান’ গ্রন্থে এই হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি হল: আলিমের ঘুম ইবাদত, তাদের চুপ থাকা তাসবীহ সমতুল্য।” 


(তাবকাতুল শাফিয়াতুল কুবরা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩০৭ পৃ:)


ফাজায়েল তথা মর্যাদার ক্ষেত্রে গায়রে মোখালেফ যঈফ হাদিস গ্রহণযোগ্য। সুতরাং ‘আলিমের ঘুম মূর্খ ব্যক্তির নফল সালাতের চেয়ে উত্তম’ তা এই হাদিসেও প্রমাণিত হল। উল্লেখ্য যে, ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) যেখানে হাদিসটিকে ‘যঈফ’ পর্যায়ের বলেছেন। সুতরাং ইহাকে ‘মওদ্বু হাদিস’ বা ভিত্তিহীন বলার কোন রাস্তা নেই।

 
Top