অষ্টম অধ্যায়

বিভিন্ন নফল ইবাদত প্রসঙ্গ


বিষয় নং- ০১: রযব মাসের নামায ও রোযার ফযিলত।


আরবী মাসের মধ্যে রযব মাস হলো ফযিলতপূর্ণ মাসসমূহের একটি। এ মাসে নফল ইবাদত এবং নফল রোযার বিশেষ ফযিলত রয়েছে। কিন্তু ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার “হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থের ৫২৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রজব মাসের সিয়ামের বিশেষ সাওয়াব বা রজব মাসের বিশেষ কোনো দিনে সিয়াম পালনের উৎসাহ জ্ঞাপক সকল হাদীসই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।’’


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! রযব মাসের সিয়ামের ফযিলতে অনেক হাদিসে পাক বর্ণিত হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন সনদের ভিন্ন ভিন্ন হুকুম, তিনি কোনো হাদিস উল্লেখ করে সনদ পর্যালোচনা না করে কিভাবে এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করতে পারলেন তা দেখে আমি রীতিমত অবাক! এটি একজন হাদিস গবেষক আলেমের কথা হতে পারেনা, এবার আমি কতিপয় হাদিসের কিতাব থেকে রযব মাসে সিয়াম পালনের কতিপয় হাদিসে পাক তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইন শা আল্লাহ।


❏ ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) সংকলন করেন-


عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ سَعِيدٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : مَنْ صَامَ يَوْمًا مِنْ رَجَبٍ كَانَ كَصِيَامِ سَنَةٍ، وَمَنْ صَامَ سَبْعَةَ أَيَّامٍ غُلِّقَتْ عَنْهُ سَبْعَةُ أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، وَمَنْ صَامَ ثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ فُتِحَتْ لَهُ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ.


-‘‘হযরত আব্দুল আযিয ইবনে সাঈদ (رحمة الله) তিনি তার পিতা হযরত সাঈদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে রযবে ১টি রোযা রাখবে তা এক বছরের রোযার সমতুল্য, যে রযবে সাতটি রোযা রাখবে মহান আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ করে দিবেন, আর যে ব্যক্তি রযবে আটটি রোযা রাখবে মহান আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দিবেন।’’


(ইমাম বায়হাকী, ফাযায়েলুল আওকাত, ৯২ পৃ. হা/৯ এবং শুয়াবুল ঈমান, ৫/৩৩৬ পৃ. হা/৩৫২০, তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ৬/৬৯ পৃ. হা/৫৫৩৮, ইমাম হাইসামী, মাযমাউয-যাওয়াউদ, ৩/১৯১ পৃ. হা/৫১৫৩ এবং হা/৫১৩২, মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৫৭৮ পৃ. হা/২৪২৬৩-৬৪)


❏ এ হাদিসের তাবরানীর ও বায়হাকীর সনদে ‘আব্দুল গাফুর’ নামে একজন যঈফ রাবী রয়েছেন।


(ইমাম হাইসামী, মাযমাউয-যাওয়াউদ, হা/৫১৩২)


❏ তবে আল্লামা মুত্তাকী হিন্দী (رحمة الله) এ হাদিসটি আরেকটি সূত্রে অর্থাৎ - الخطيب عن أبي ذر -‘‘ইমাম খতিবে বাগদাদী (رحمة الله) এটি হযরত আবু যার গিফারী (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন।’’


(মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৫৭৮ পৃ. হা/২৪২৬৩)


❏ আল্লামা মুত্তাকী হিন্দী (رحمة الله) সংকলন করেন-


مسند أنس رضي الله عنه عن عامر بن شبل الحرمي سمعت رجلا يحدث أنه سمع أنس بن مالك يقول: في الجنة قصر لا يدخله إلا صوام رجب-ابن شاهين في الترغيب -


-‘‘হযরত আমের বিন শাবল আল-হারমী (رضي الله عنه) বলেন,  আমি এক ব্যক্তি হতে শুনেছি তিনি হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন যে,  জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে যেখানে রযব মাসের রোযাদার ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।’’  ১

➥{(ক) ইবনে আসাকীর, তারীখে দামেস্ক, ২৫/৩৩৪ পৃ. হা/৩০৪৫     

(খ) আল্লামা মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৬৫৩পৃ. হা/৩৪৫৮২

(গ) হাইসামী, মাযমাউয যাওয়াইদ, ৩/১৯১পৃ.}



❏ হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।  তিনি বলেন,  রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-



صَوْمُ أَوَّلِ يَوْمٍ مِنْ رَجَبٍ كَفَّارَةُ ثَلاَثِ سِنِينَ وَالثَّانِي كَفَّارَةُ سَنَتَيْنِ وَالثَّالِثِ كَفَّارَةُ سَنَةٍ ثم كل يوم شهرا



-‘‘যে ব্যক্তি রযবের প্রথম দিনে রোযা রাখবে তাহলে তা তার জন্য বিগত তিন বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যাবে, আর যে দ্বিতীয় দিন রোযা রাখবে তার দুবছরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যাবে, আর যে রযবের তৃতীয় দিনে রোযা রাখবে তার এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হবে, আর অন্যান্য দিনের রোযা রাখা দ্বারা প্রত্যেকটি রোযার বিনিময়ে এক মাসের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’’ 


(মুত্তাকী হিন্দী,  কানযুল উম্মাল,  ৮/৫৭৭ পৃ. হা/২৪২৬১,  ইমাম সুয়ূতি,  জামেউস সগীর,  হা/৭৯৪০, আল্লামা শায়খ ইউসুফ নাবহানী,  ফতহুল কাবীর,  ২/১৮৩ পৃ. হা/৭২৭৬)


❏ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মানাভী (رحمة الله) বলেন-


الصوم مندوب في رجب


-‘‘রযবে রোযা রাখা মোস্তাহাব।’’ 


(মানাভী,  ফয়যুল কাদীর,  ৪/২১০ পৃ.) 


❏ ইমাম দায়লামী (رحمة الله) সংকলন করেন,  হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।  তিনি বলেন,  রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন- 


إِن فِي الْجنَّة نَهرا يُقَال لَهُ رَجَب من صَامَ يَوْمًا مِنْهُ شرب من ذَلِك النَّهر


-‘‘জান্নাতে একটি নহর (নদী) রয়েছে যে ব্যক্তি যে রযবে একটি রোযা রাখবে তাকে সে নহরের (নদীর) পানি (শরবত) পান করানো হবে।’’ 


(ইমাম দায়লামী,  আল-ফিরদাউস বি মাসারুল খিতাব, ১/২২০ পৃ. হা/৮৪৪, ইমাম ইবনে জাওযী,  ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ, ২/৬৫ পৃ. হা/৯১২, ইমাম শাজারী,  তারতিবুল আমালি,  ২/১২৯ পৃ. হা/১৮৪৪)


❏ অনুরূপ আরো হাদিস বর্ণিত হয়েছে-


عن أبي قلابة قال: في الجنة قصر لصوام رجب -


-‘‘হযরত আবি কুলাবাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,  জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে রযবে রোজা পালনকারীদের উক্ত প্রাসাদ দেয়া হবে।’’  ২ 

➥{ইবনে আসাকীর,  তারীখে দামেস্ক, ২৫/৩৩৪পৃ. হাদিস, ৩০৪৫, আল্লামা মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৬৫৩পৃ. হাদিস, ২৪৫৮১, ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হা/৩৮০২, ইমাম ইবনে শাহীন, তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/৩৯২ পৃ. হা/১৮৪৮}



❏ আল্লামা সান‘আনী (رحمة الله) বলেন- هذا أصح -‘‘এ হাদিসটি অধিক বিশুদ্ধ।’’ 


(সান‘আনী,  তানভীর,  ৭/১০ পৃ. হা/৫০৩৪) 


❏ ইমাম নববী (رحمة الله) এভাবে উল্লেখ করেছেন-


قلت وروى الْبَيْهَقِيّ فِي شعب الْإِيمَان عَن أبي قلَابَة قَالَ فِي الْجنَّة قصر لصوام رَجَب وَقَالَ هَذَا أصح



-‘‘আমি (ইমাম নববী) বলি, ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) তার শুয়াবুল ঈমানে হযরত আবু কালাবা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।  তিনি বলেন,  জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে রযবে বিশেষ দিনে রোজা পালনকরীদের উক্ত প্রাসাদ দেয়া হবে। তিনি (বায়হাকী) বলেন, এইি অধিক বিশুদ্ধ।’’ 


(ইমাম নববী,  শরহে সহীহ মুসলিম,  ৩/২৩৮ পৃ.)


❏ হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,


قال قال رسول الله ﷺ إِنَّ فِي الْجنَّة نَهرا يُقَالُ لَهُ رَجَبٌ مَاؤُهُ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ مَنْ صَامَ يَوْمًا مِنْ رَجَبٍ سَقَاهُ اللهُ مِنْ ذَلِكَ النَّهْرِ - 


-‘‘নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে বেহেস্তের মধ্যে একটি ঝরণা আছে,  যাকে রযব নহর বলা হয়। এর পানি দুধের চেয়ে সাদা এবং মধুর চেয়ে মিষ্টি। যে ব্যক্তি রযব মাসে একটি রোজা রাখবে, আল্লাহ্ পাক তাকে ঐ ঝরণার পানি পান করাবেন।’’  ৩

➥{আল্লামা মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ৮/৫৭৭ পৃ. হা/২৪২৬০, ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হা/, আল্লামা আব্দুল হাই লাখনৌভি, আছারুল মারফুআ, পৃ. ৫৯, ইমাম বায়হাকী, ফাযায়েলে আওকাত, ১/৯০ পৃ. হা/৮, ইমাম মানাভী, তাইসির, ১/৩২৬ পৃ. শায়খ আবদুল কাদীর জিলানী : গুনিয়াতুত ত্বালেবীন, পৃ-২৩৪, ইমাম সুয়ূতি, জামেউস সগীর, হা/৪৭১২, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ১/৩৭২ পৃ. হা/৪০১৫, ইমাম ইবনে শাহীন, তারগীব ওয়াত তারহীব, ২/৩৯১ পৃ. হা/১৮৪৭, }



মহান রব যেন সত্যগোপনকারী আলেমদের থেকে আমাদের ঈমান ও আমলকে হেফাযত করেন, আমিন।


❏ ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) সংকলন করেন-


قَالَ الشَّافِعِيُّ: وَبَلَغَنَا أَنَّهُ كَانَ يُقَالُ إِنَّ الدُّعَاءَ يُسْتَجَابُ فِي خَمْسِ لَيَالٍ فِي لَيْلَةِ الْجُمُعَةِ، وَلَيْلَةِ الْأَضْحَى، وَلَيْلَةِ الْفِطْرِ، وَأَوَّلِ لَيْلَةٍ مِنْ رَجَبَ، وَلَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ


-‘‘ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আগের যুগে (সাহাবী, তাবেয়ীদের যুগে) বলা হতো, পাঁচ রাতের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন, 

১. জুম‘আর রাতের দোয়া, 

২ ও ৩. ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া, 

৪. রযব মাসের প্রথম মাসের রাতের দোয়া এবং 

৫. শবে বরাতের দোয়া।’’ 


(ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ৫/২৮৭ পৃ. হা/৩৪৩৮) 

 
Top