হাদীসে বর্ণিত নজদ


বহু আহাদীসে রাসূলে খোদা (ﷺ) বিভিন্ন দেশের প্রশংসা করেছেন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, নজদ অঞ্চল মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার সবচেয়ে কাছের হলেও এ সব হাদীসের কোনোটিতেই নজদের প্রশংসা করা হয় নি। ওপরে উদ্ধৃত সর্বপ্রথম হাদীসটিতে সিরিয়া ও ইয়েমেন দেশের জন্যে দোয়া করার বেলায় মহানবী (ﷺ)-এর আগ্রহ পরিদৃষ্ট হয়; আর নজদের জন্যে দোয়া করার ক্ষেত্রে তাঁর জোর অসম্মতিও এতে প্রকাশ পায়। অধিকন্তু, যেখানেই নজদ অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতেই স্পষ্ট দেখা যায় সেটি সমস্যাসঙ্কুল এলাকা। উদাহরণস্বরূপ, 


❏ হাদিস 6:


নিম্নবর্ণিত সহীহ হাদীসটি বিবেচনা করুন:


عَنْ عَمْرِو بْنِ عَبَسَةَ قَالَ بَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْرِضُ خَيْلًا وَعِنْدَهُ عُيَيْنَةُ بْنُ حِصْنِ بْنِ حُذَيْفَةَ بْنِ بَدْرٍ الْفَزَارِيُّ فَقَالَ لِعُيَيْنَةَ أَنَا أَبْصَرُ بِالْخَيْلِ مِنْكَ فَقَالَ عُيَيْنَةُ وَأَنَا أَبْصَرُ بِالرِّجَالِ مِنْكَ قَالَ فَكَيْفَ ذَاكَ قَالَ خِيَارُ الرِّجَالِ الَّذِينَ يَضَعُونَ أَسْيَافَهُمْ عَلَى عَوَاتِقِهِمْ وَيَعْرِضُونَ رِمَاحَهُمْ عَلَى مَنَاسِجِ خُيُولِهِمْ مِنْ أَهْلِ نَجْدٍ قَالَ كَذَبْتَ خِيَارُ الرِّجَالِ رِجَالُ أَهْلِ الْيَمَنِ وَالْإِيمَانُ يَمَانٍ وَأَنَا يَمَانٍ وَأَكْثَرُ الْقَبَائِلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي الْجَنَّةِ مَذْحِجٌ


হযরত আমর ইবনে আবাসা (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদিন ঘোড়া যাচাই-বাছাই করছিলেন; সাথে ছিল উবায়না ইবনে হিসন ইবনে বদর আল-ফাযারী। উবায়না মন্তব্য করে, ‘মানুষের মধ্যে সেরা তারাই, যারা নিজেদের তলোয়ার নিজেদের কাঁধেই বহন করে এবং বর্শা ঘোড়ার (পায়ে) বাঁধা সেলাইকৃত মোজার মধ্যে রাখে; আর যারা আলখাল্লা পরে। এরাই নজদের মানুষ।’[৫.] 

৫. আহমদ : আল মুসনাদ, হাদীসু আমর ইবন আবাসা, ৩২:১৯৮ হাদীস নং ১৯৪৫০।

(ক) আত্ তাবারানী।

(খ) আলী ইবনে আবি বকর আল-হায়সামী  : ‘মজমাউল যাওয়াইদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়াইদ’, কায়রো ১৩৫২ হিজরী,  ১০/৪৩।


কিন্তু হুযূর পূর নূর (ﷺ) প্রত্যুত্তর দেন, ‘তুমি মিথ্যে বলেছো! বরঞ্চ সেরা মানুষ হলো ইয়েমেনীরা। ঈমানদারী এক ইয়েমেনী, এই সেই ইয়েমেন যা’তে অন্তর্ভুক্ত লাখম, জুদাম ও আমিলা গোত্রগুলো....হারিস গোত্রের চেয়ে হাদ্রামওত সেরা; এক গোত্রের চেয়ে অপর গোত্র শ্রেয়; (আবার) আরেক গোত্র আরও মন্দ।....আমার প্রভু খোদাতা’লা কুরাইশ বংশকে অভিসম্পাত দিতে আমাকে আদেশ করেন, আর আমিও তাদের অভিসম্পাত দেই। কিন্তু এর পর তিনি তাদেরকে দু’বার আর্শীবাদ করতে নির্দেশ দেন, আর আমিও তা করি।......আল্লাহর দৃষ্টিতে কেয়ামত (পুনরুত্থান) দিবসে আসলাম ও গিফার গোত্র এবং তাদের সহযোগী জুহাইনা গোত্র আসাদ ও তামিম, গাতাফান ও হাওয়াযিন গোত্রগুলোর চেয়ে শ্রেয়।.....বেহেশ্তে সর্বাধিক সদস্য হবে ইয়েমেনী মাযহিজ ও মা’কুল গোত্রগুলোর’।”


নজদের প্রশংসাকারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তুমি মিথ্যেবাদী।’ উপরন্তু, তিনি কোথাও নজদের প্রশংসা করেন নি। অথচ এর বিপরীতে অন্যান্য অঞ্চলের প্রশংসাসূচক অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, 


❏ হাদিস 7:


হযরত উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) অন্তিমলগ্নে নিম্নের আদেশ দেন,


أَنَّ النَّبِيَّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - قَالَ: " إِنَّ مِصْرَ سَتُفْتَحُ فَانْتَجِعُوا خَيْرَهَا، وَلَا تَتَّخِذُوهَا دَارًا ; فَإِنَّهُ يُسَاقُ إِلَيْهَا أَقَلُّ النَّاسِ أَعْمَارًا


“আল্লাহর শপথ! তাঁরই দোহাই দিয়ে আমি তোমাদের বলছি, মিসরীয়দের ব্যাপারে তোমরা তাদের ওপর বিজয়ী হবে; আর তারাও তোমাদের সাহায্যকারী হবে আল্লাহর পথে।”[৬]

৬. আত্ তাবারানী ।

(ক) আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ শ্রেণীভুক্ত, ‘মজমা’ ১০:৬৩। মিসরীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জানতে আরও দেখুন সহীহ মুসলিম, ইমাম নববী কৃত শরাহ, কায়রো ১৩৪৭ হিজরী, ১৬:৯৬-৯৭পৃষ্ঠা।



❏ হাদিস 8:


হযরত কায়স ইবনে সা’দ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,

 لَوْ كَانَ الْإِيمَانُ مُعَلَّقًا بِالثُّرَيَّا لَنَالَهُ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ فَارِسَ 

“তারকারাজি (আসমান) থেকেও যদি ঈমান দূর হয়ে যায়, তবুও ফারিস (পারস্য)-দেশের সন্তানেরা সেখানে তা পৌঁছে দেবে।”[৭] 

৭. আবু ইয়ালা : আল মুসনাদ, মুসনাদু কায়েস ইব্ন সা‘আদ, ৩: ২৩ হাদীস নং ১৪৩৩।

(ক) ইব্ন হিব্বান : আস সহীহ, যিকুরশ শাহাদাতিল মুস্তাফা, ১৬:২৯৮ হাদীস নং ৭৩০৮।

(খ) ত্ববরানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১৮:৩৫৩। সহীহ শ্রেণীভুক্ত করেছেন আল-হায়তামী নিজ ‘মজমা’ পুস্তকে, ১০: ৬৪-৬৫ পৃষ্ঠা; আরও জানতে দেখুন ইমাম নববী প্রণীত শরহে মুসলিম, ১৬:১০০ পৃষ্ঠা।


❏ হাদিস 9:


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,

 وَالسَّكِينَةُ فِي أَهْلِ الْحِجَازِ".

“সাকিনা তথা প্রশান্তি হেজায অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিরাজমান।” [৮]

৮ . (ক) আহমদ : আল মুসনাদ, মুসনাদু জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ, ৩:৩৪৫ হাদীস নং ১৪৭৫৭।

(খ) ত্ববরানী : আল মু‘জামুল আওসাত, ৯:৩৭ হাদীস নং ৯০৭১।

(গ) আল-বাযযার : আল-হায়তামী কর্তৃক উদ্ধৃত, ১০:৫৩।


❏ হাদিস 10:


হযরত আবূদ্ দারদা (رحمة الله)এর বর্ণনায় মহানবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, “তোমরা অনেক (মোজাহেদীন) যোদ্ধার দেখা পাবে। একটি বাহিনী সিরিয়ায়, আরেকটি মিসরে, অপর একটি ইরাকে, আবার একটি ইয়েমেনে”।[৯.]  

 ৯. আল-বাযযার ও তাবারানী; আল-হায়তামী কর্তৃক সহীহ শ্রেণীভুক্ত, মজমা’, ১০:৫৮।

 

জ্বেহাদে স্বেচ্ছাসেবকদের আবাসস্থল হিসেবে এই সব অঞ্চলকে প্রশংসা করা হয়েছে।


❏ হাদিস 11:


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,

 إِنَّ مَلَائِكَةَ الرَّحْمَنِ لَبَاسِطَةٌ أَجْنِحَتِهَا عَلَى الشَّامِ 

“পরম করুণাময়ের ফেরেশতাকুল সিরিয়ার ওপর তাঁদের পাখা মেলেছেন।”[১০]

১০. (ক) ইব্ন হিব্বান : আস  সহীহ, যিকরু বাসতিল মালায়িকা, ১৬:২৯৩ হাদীস নং ৭৩০৪।

(খ) তাবারানী; মজমা’ গ্রন্থের ১০:৬০ সহীহ হিসেবে শ্রেণীকরণ। আরও দেখুন তিরমিযীর ব্যাখ্যায় ইমাম মোহাম্মদ ইবনে আবদ্ আল-রহমান আল-মোবারকপুরী কৃত ‘তোহফাত আল-আহওয়াযী বি-শরহে জামে’ আল-তিরমিযী, ১০:৪৫৪ এতে তিনি এই হাদীসকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন।


❏ হাদিস 12:


আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হুযূর পাক (ﷺ) ইরশাদ ফরমান,

 أَتَاكُمْ أَهْلُ اليَمَنِ، هُمْ أَضْعَفُ قُلُوبًا، وَأَرَقُّ أَفْئِدَةً، الإِ يمَانُ يَمَانٍ، وَالحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ - 

“ইয়েমেনবাসী তোমাদের কাছে এসেছে। তাদের অন্তর কোমল, আত্মা আরও কোমল। ঈমানদারী এক ইয়েমেনী, আর জ্ঞান-প্রজ্ঞাও ইয়েমেনী।”[১১.]

১১.তিরমিযী, ফী ফযলিল ইয়ামান, নং- ৪০৪৮; মোবারকপুরী, ১০: ৪৩৫-৪৩৭পৃষ্ঠা - হাদীস হাসান সহীহ শ্রেণীভুক্ত; ৪৩৬ পৃষ্ঠায় ইমাম মোবারকপুরী উল্লেখ করেন যে আনসার সাহাবীদের পূর্বপুরুষগণ ইয়েমেন দেশ থেকে এসেছিলেন।


❏ হাদিস 13:


মহানবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, يَطْلُعُ عَلَيْكُمْ أَهْلُ الْيَمَنِ كَأَنَّهُمُ السَّحَابُ , هُمْ خِيَارُ مَنْ فِي الْأَرْضِ“ইয়েমেন দেশের মানুষেরা পৃথিবীর বুকে সেরা মানব।”[১২.]

১২ . আহমদ : আল মুসনাদ, হাদীসু জুবাইর বিন মুত‘আম, ৪:৮৪ হাদীস নং ১৬৮২৫।

(ক) আবূ ইয়ালা : আল মুসনাদ, ১৩:৩৯৮ হাদীস নং ৭৪০১।

(খ) আল-বাযযার; সহীহ শ্রেণীভুক্ত : আল-হায়তামী, ১০: ৫৪-৫৫।


❏ হাদিস 14:


রাসূলে খোদা (ﷺ) আরবীয় গোত্রগুলোর কাছে তাঁর এক দূত/প্রতিনিধি প্রেরণ করেন, কিন্তু তারা তাঁকে অপমান ও মারধর করে। এমতাবস্থায় তিনি হুযূর পাক (ﷺ) এর কাছে ফিরে এসে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে উত্তরে বলেন, “তুমি যদি ওমানের মানুষদের কাছে যেতে, তাহলে তারা তোমাকে অপমান করতো না, মারধরও করতো না।”[১৩.]

১৩ . মুসলিম, ফযাইল আস্ সাহাবা, ৫৭ পৃষ্ঠা; দেখুন ইমাম নববীর শরাহ তথা ব্যাখ্যা, ১৬তম খ-, ৯৮ পৃষ্ঠা, যা’তে তিনি মন্তব্য করেন, ‘এতে তাঁদের প্রশংসা ও মাহাত্ম্যের ইঙ্গিত রয়েছে।


ওপরের হাদীসগুলো অসংখ্য হাদীসের সংগ্রহশালা থেকে সংকলিত হয়েছে, যা’তে বিভিন্ন আশপাশ এলাকা সম্পর্কে মহানবী (ﷺ) এর প্রশংসা লিপিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু আবারও বলতে হচ্ছে, নজদ অঞ্চল এগুলোর যে কোনোটি থেকে সন্নিকটে হলেও সেটি সম্পর্কে প্রশংসাসূচক হাদীস লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত।


নজদীরা নিজেরাই এই সত্যটি সম্পর্কে সাধারণভাবে জানে, তবে তারা এর প্রচার করে না। এটি স্পষ্ট যে, নজদ অঞ্চল সম্পর্কে একটিমাত্র প্রশংসাসূচক হাদীস বিদ্যমান থাকলেও তারা উম্মাহকে তা জানিয়ে দিতো। তাদের প্রদেশ সম্পর্কে মহানবী (ﷺ) এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিন্দাকে পাশ কাটানোর বা নিষ্ক্রিয় করার জন্যে তাদের কেউ কেউ হাদীসে উল্লেখিত এলাকার বিষয়টিকে মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্য বলে স্বীকারই করে না, বরং নজদে বসবাসকারী গোত্র-উপগোত্রের বিভক্তির দিকেই নিজেদের মন্তব্যকে কেন্দ্রীভূত রাখে।

 
Top