রিদ্দা: প্রথম ফিতনা  


নজদ সম্পর্কে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে আরেকটি বিষয় তাঁরা বিবেচনায় নিতে চাইবেন। এটি মহানবী (ﷺ) এর বেসাল (খোদার সাথে পরলোকে মিলন)-প্রাপ্তির পরে নজদীদের আচরণ সংক্রান্ত। ইতিহাসবিদগণ সাক্ষ্য দেন যে হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)'র খেলাফত আমলে যাকাত দেয়ার ব্যাপারে যতো বিদ্রোহ হয়েছে, তার অধিকাংশই নজদীদের দ্বারা সংঘটিত। উপরন্তু, আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অনেক নজদী বিদ্রোহ-ই অদ্ভূত ইসলামবিরোধী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাতি পায় যে বিদ্রোহটি, তা নবী দাবিদার ভণ্ড মুসাইলামার নেতৃত্বে হয়েছিল; এই লোক একটি পাল্টা শরীয়ত দাঁড় করিয়েছিল, যা’তে দৃশ্যতঃ অন্তর্ভুক্ত ছিল রোযা ও ইসলামী খাদ্যাভ্যাসের মতো মুসলিম আচার ও প্রথা। সে নামাযের ইসলামী বিধান মানতো, তবে ফজর ও এশা’র নামায বিলোপ করেছিল। তার তথাকথিত একটি ‘ঐশী বাণী’ ব্যক্ত করে:


❏ বনূ তামিম এক পবিত্র গোত্র,

স্বাধীন ও ত্রুটিমুক্ত,

যাকাত থেকে তারা মওকুফপ্রাপ্ত।

আমরা হবো তাদের রক্ষাকারী মিত্র,

যতোদিন বাঁচি, রাখবো তাদের সাথে বন্ধুত্ব!

যে কারো থেকে তাদের রাখবো সুরক্ষিত,

আর আমাদের মরণকালে তারা ‘রহমানের’ হেফাযতপ্রাপ্ত।[৩২.]

৩২. ইমাম তাবারী কৃত ‘তারিখ আল-রুসূল ওয়াল-মুলূক’, বৈরুত, ১৪০৭ হিজরী, ২:২৭৬পৃষ্ঠা।


মুসাইলামা ছিল একজন বাগ্মী। ফলে মধ্য আরব অঞ্চলে তার অনেক অনুসারী জুটে যায়। তবে ইতিহাসবিদগণ লিখেন যে মহানবী (ﷺ)-এর মো’জেযা (অলৌকিক ক্ষমতা) যখনই সে অনুকরণ করতে চাইতো, অমনি বিপর্যয় নেমে আসতো। তার কাছে নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আনা অসুস্থ শিশুরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়তো। তার ওযু করা পানি ফসলের ওপর ছিটালে জমি উর্বরতা হারাতো। তার ব্যবহৃত কূপগুলোর পানি লবণাক্ত হয়ে যেতো। কিন্তু গোত্রীয় প্রভাবের কারণে অনেকে এ সব বিষয় আমলেই নেয় নি।


عَنْ خَلِيْدٍ بْنِ ذَفَرَةَ النَّمَرِيِّ عَنْ عُمَيْرِ بْنِ طَلَحَةَ النَّمِرِيِّ عَنْ أَبْيْهِ أَنَّهُ جَاءَ الْيَمَامَةَ فَقَالَ أَيْنَ مُسْيْلَمَةُ قَالُوْا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ فَقَالَ لاَ حَتَّىْ أَرَاهُ فَلَمَّا جَاءَهُ قَالَ أَنْتَ مُسْيْلَمَةُ قَالَ نَعَمْ قَالَ مَنْ يَأتِيكَ قَالَ رَحْمَنُ قَالَ أَفِيْ نُوْرٌ أَوْ فِيْ ظُلْمَة ٌفَقَالَ فِيْ ظُلْمَةٍ فَقَالَ أَشْهَدْ أَنَّكَ كَذَّابٌ وَأَنَّ مُحَمَّدًا صَادِقٌ وَلَكِنَّ كَذَّابَ رَبِيْعَةُ أَحَبَّ إِلَيْنَا مِنْ صَادِقٍ مُضِرٍ فَقُتِلَ مَعَهُ يَوْمَ عَقْرَبَاءِ


❏ তালহা আল-নামারী নজদে এসে জিজ্ঞেস করে, “মুসাইলামা কোথায়?” এ কথা শুনে মানুষেরা তাকে বলে, “সাবধান! তাকে আল্লাহর রাসূল বলে ডাকো।” তালহা জবাব দেয়, “তাকে না দেখা পর্যন্ত ওই খেতাবে ডাকবো না।” অতঃপর মুসাইলামার সামনে উপস্থিত হলে সে জিজ্ঞেস করে, “মুসাইলামা কি তুমি?” সে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ।” তালহা জিজ্ঞেস করে, “তোমার কাছে কে আগমন করেন?” মুসাইলামা জবাবে বলে, “আল-রহমান।” তালহা আবার জিজ্ঞেস করে, “তিনি কি আলোতে আসেন, না অন্ধকারে?” জবাবে মুসাইলামা বলে, “অন্ধকারে।” এমতাবস্থায় তালহা বলে, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি মিথ্যেবাদী এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-ই সত্যবাদী। কিন্তু আমার কাছে তোমার গোত্রের মিথ্যেবাদীও তাঁর গোত্রের সত্যবাদীর চেয়ে প্রিয়ভাজন।” এরপর সে মুসাইলামা আল-কাযযাবের বাহিনীতে যোগ দেয় এবং আক্করাবার যুদ্ধে নিহত হয়।[৩৩.]

৩৩. তাবারী : ২: ২৭৭ পৃষ্ঠা।


এ ধরনের ঘটনা দুটো বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে। প্রথমতঃ এতে মুসাইলামার ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তার মতে, আল্লাহ আকৃতিসম্পন্ন যিনি ‘আসতে’ পারেন। দ্বিতীয়তঃ এতে অন্ধ অনুসরণের আরব গোত্রীয় প্রভাব ও প্রতাপ-প্রতিপত্তির দিকটিও পরিস্ফুট হয়, যা তখনো বিরাজমান ছিল।


বিরোধী ধর্মমতের নেতা হিসেবে মুসাইলামা ও তার নজদী উগ্রবাদীরা ‘বাগী’ তথা ধর্মে ফিতনা সৃষ্টিকারী ও খলীফার কর্তৃত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়; আর তাই হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) তাদেরকে দমনের উদ্দেশ্যে সেনাপতি হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ (رضي الله عنه)'র অধীনে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। হিজরী ১২ সালে হযরত খালেদ (رضي الله عنه) আল-আকরাবার যুদ্ধে নজদীদেরকে পরাজিত করেন। যুদ্ধের এই স্থানটি ছিল দেয়ালঘেরা একটি বাগান এবং এখানেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নজদীদের হাতে শত শত সাহাবী (رضي الله عنه) শহীদ হওয়ায় আমাদের ইতিহাসবিদদের কাছে এটি ‘মৃত্যু বাগিচা’ নামে পরিচিত হয়েছে। এই যুদ্ধ ছিল প্রাচীন আরব গোত্রবাদের বিরুদ্ধে সমান অধিকারের পক্ষাবলম্বনকারী ইসলাম ধর্মের, যে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে এই ঘটনায় যে মোহাজির সাহাবী (رضي الله عنه)দের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্রীতদাস হতে মুক্তিপ্রাপ্ত পারসিক সাহাবী হযরত সেলিম (رضي الله عنه); আর আনসার সাহাবী (رضي الله عنه)দের পতাকা উচুঁ করে ধরেছিলেন হযরত সাবেত ইবনে কায়েস (رضي الله عنه)। মুসলমানদের রণহুংকার কোনো গোত্র বা পূর্বপুরুষের নামে ছিল না, বরং তা ছিল ‘ইয়া মোহাম্মদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম (তাবারী, ২৮১)।

 وَقُتِلَ مُسَيْلَمَةُ 

❏ নবী দাবিদার ভন্ড মুসাইলামাকে হত্যা করেন ক্রীতদাস ইথিয়পীয় সাহাবী হযরত ওয়াহশি (رضي الله عنه)। যদিও তিনি ইতিপূর্বে মহানবী (ﷺ)-এর চাচা হযরত আমীরে হামযা ইবনে আব্দিল মোত্তালিব (رضي الله عنه)কে ওহুদের জ্বিহাদে শহীদ করেন, তবুও তিনি পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মে দাখিল হন এবং একজন সম্মানিত উম্মত হিসেবে পরিচিতি পান। আরবীয় সমাজের কাছে নিচু জাত বলে বিবেচিত একজন আফ্রিকী বংশোদ্ভূত ব্যক্তির দ্বারা নজদীদের গর্বের ‘নবী’কে হত্যা করার ব্যাপারটি ইসলামী সমতাবাদী নীতি-আদর্শের একটি শক্তিশালী প্রতীক ছিল।[৩৪.]

৩৪. দেখুন আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে কুতায়বা রচিত ‘কিতাব আল-মা’আরিফ’, কায়রো, ১৯৬০ইং সংস্করণ, ২০৬ পৃষ্ঠা; আহমদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-বালাদুরী প্রণীত ‘ফুতুহ আল-বুলদান’, বৈরুত, পুনঃমুদ্রিত, তারিখবিহীন, ৮৬ পৃষ্ঠা।


❏ তথাপিও মুসাইলামা আল-কাযযাবের প্রতি অন্ধ ভক্তি মধ্য আরব অঞ্চলে টিকে যায়। নজদীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে একখানা বর্ণনা দিয়েছেন অ-মুসলমান পর্যটক পালগ্রেভ (Palgrave)। তিনি ১৮৬২ সালে এসে দেখতে পান যে, এতো বছর পরও কিছু কিছু নজদী গোত্রভুক্ত লোক মুসাইলামাকে নবী হিসেবে শ্রদ্ধা করে।[৩৫.]

৩৫. ডব্লিউ, পালগ্রেভ প্রণীত ‘ন্যারেটিভ অফ আ ইয়ারস্ জার্নী থ্রু সেন্ট্রাল এ্যান্ড ইস্টার্ন এ্যারাবিয়া’ (মধ্য ও পূর্ব আরবে এক বছরব্যাপী যাত্রার বিবরণ), লন্ডন, ১৮৬৫, ১ম খ-, ৩৮২ পৃষ্ঠা।


وَتَنَبَّأتْ أُمُّ صَادِرِ سَجَاحَ بِنْتِ أَوْس بْن أُسَامَةَ بْنُ العَنْبَرْ بْن يَرْبُوْع ابْن حَنْظَلَةَ بْن مَالِك بْن زَيْد مَنَاة بْن تَمِيْم، وَيُقَالُ: هِيَ سَجَاحَ بِنْتُ الحَارِثِ اِبْن عَقَّفان بْن سُوَيد بْن خَالِد بْن أُسَامَة وَتَكَهَّنَت فَأتّبِعُها قَوْمٌ مِنْ بَنِيْ تَمِيْمٍ وَقَوْمٌ مِنْ أَخْوَالِهَا بَنِي تَغْلِب ثُمَّ إنَّهَا سَجَعَتْ ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَتْ: إِنَّ رَبَّ السَّحَابِ، يَأمُرُكُمْ أَنْ تَغْزُوا الرِّبَابَ، فَغَزَتهْمُ فَهَزَمُوْهَا وَلْمْ يُقَاتِلُهَا أَحَدٌ غَيْرِهِمْ فَأتَتِ مَُسَيْلَمَةُ الْكَذَّابُ وَهُوَ بِحُجْرٍ فَتَزَوَّجَتْهُ وَجَعَلَتْ دِيْنُهَا وَدِيْنُهُ وَاحِدًا،


❏ ইসলামী খেলাফতের বিরুদ্ধে নজদী বিদ্রোহের অপর এক হোতা ছিল সাজাহ নাম্নী এক নারী, যার আসল নাম ছিল উম্মে সাদির বিনতে আউস। সেও তামিম গোত্রীয় ছিল। এই নারী এমন রব্ব তথা প্রভুর নামে ‘নবী’ দাবি করে, যে প্রভু ‘মেঘে’ অবস্থান করে; সে ‘ওহী’ বা ’ঐশী বাণী’ প্রকাশ করে তামিম গোত্রের কিছু অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়। ওই সময় তামিমদের এই অংশ মদীনায় কায়েম হওয়া খেলাফতের কর্তৃত্ব কতোখানি প্রত্যাখ্যান করবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে জড়িত ছিল। যে সকল গোত্র ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুদ্ধ পরিচালনার পর এই নজদী ভ- নারী অপর ভ- মুসাইলামার সাথে জোট বাঁধে। এ ছাড়া তার পরিণতি সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না।[৩৬.]

৩৬. ইবনে কুতায়বা রচিত ‘মা’আরিফ’, ৪০৫ পৃষ্ঠা; বালাদুরী কৃত ‘ফুতুহ’, ৯৯-১০০পৃষ্ঠা।
 
Top