বনূ তামিম ও খাওয়ারিজ



তামিম গোত্রভুক্তদের অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আমাদের মনোযোগ আবারও আকর্ষণ করার মতো সর্বাধিক প্রসিদ্ধ যে হাদীসটি বিদ্যমান তা সম্ভবতঃ যুল খোয়াইসারা-বিষয়ক:


❏ হাদিস 26:


হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه) বলেন,


بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقْسِمُ قِسْمًا، أَتَاهُ ذُو الخُوَيْصِرَةِ، وَهُوَ رَجُلٌ مِنْ بَنِي تَمِيمٍ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ اعْدِلْ، فَقَالَ: وَيْلَكَ، وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَعْدِلْ، قَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ فَقَالَ عُمَرُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ائْذَنْ لِي فِيهِ فَأَضْرِبَ عُنُقَهُ؟ فَقَالَ: دَعْهُ، فَإِنَّ لَهُ أَصْحَابًا يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ مَعَ صَلاَتِهِمْ، وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ، يَقْرَءُونَ القُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ، يُنْظَرُ إِلَى نَصْلِهِ فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَيْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى رِصَافِهِ فَمَا يُوجَدُ فِيهِ شَيْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى نَضِيِّهِ، - وَهُوَ قِدْحُهُ -، فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَيْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى قُذَذِهِ فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَيْءٌ، قَدْ سَبَقَ الفَرْثَ وَالدَّمَ، آيَتُهُمْ رَجُلٌ أَسْوَدُ، إِحْدَى عَضُدَيْهِ مِثْلُ ثَدْيِ المَرْأَةِ، أَوْ مِثْلُ البَضْعَةِ تَدَرْدَرُ، وَيَخْرُجُونَ عَلَى حِينِ فُرْقَةٍ مِنَ النَّاسِ قَالَ أَبُو سَعِيدٍ: فَأَشْهَدُ أَنِّي سَمِعْتُ هَذَا الحَدِيثَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَشْهَدُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ قَاتَلَهُمْ وَأَنَا مَعَهُ، فَأَمَرَ بِذَلِكَ الرَّجُلِ فَالْتُمِسَ فَأُتِيَ بِهِ،


“আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম; ওই সময় তিনি গনীমতের মালামাল বণ্টন করছিলেন। তামিম গোত্রভুক্ত যুল খোয়াইসারা নামের এক লোক এসে বলে, ‘হে রাসূল (ﷺ)! ইনসাফের সাথে বণ্টন করুন।’ মহানবী (ﷺ) উত্তর দেন, ‘আফসোস তোমার প্রতি! আমি ন্যায়পরায়ণ না হলে কে হবে? তুমি বিষাদগ্রস্ত ও হতাশ যে আমি ন্যায়পরায়ণ নই?’ এমতাবস্থায় হযরত উমর ফারুক (رضي الله عنه) বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমাকে অনুমতি দিন যাতে আমি তার শিরোচ্ছেদ করতে পারি!’ কিন্তু হুযূর পূর নূর (ﷺ) বলেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও। তার আরও সাথী আছে। তাদের নামায বা রোযার মোকাবেলায় তোমাদের নামায-রোযাকে অন্তঃসারশূন্য মনে হবে; তারা কুরআন তেলাওয়াত করে, কিন্তু ওর মর্মবাণী কণ্ঠনালির নিচে যায় না। তীর যেমন ধনুক থেকে লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যায়, তারাও ইসলাম ধর্ম থেকে তেমনি খারিজ হয়ে যাবে’।” হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه) আরও বলেন, “আমি (আল্লাহর নামে) কসম করে বলছি, হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (رضي الله عنه) যখন তাদের (খারেজীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তিনি নির্দেশ দেন যেন ওই লোককে খুঁজে বের করে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়; আর তাকে আমাদের সামনে ধরে আনা হয়।”[২৮.]

২৮. বুখারী : আস সহীহ, বাবু আলামাতিন নবুওয়াত ফিল ইসলাম, ৪:২০০ হাদীস নং ৩৬১০।

(ক) মুসলিম : আস সহীহ, বাবু যিকরিল খাওয়ারিজ ওয়া সিফাতিহিম, ২: ৭৪৪ হাদীস নং ১০৬৪।

(খ) নাসায়ী : আস সুনান, ১:৪৭১ হাদীস নং ৮৫০৭।

(গ) বায়হাকী : শু‘য়াবুল ঈমান, ৮:২৯৬ হাদীস নং ১৬৭০২।

(ঘ) বাগাবী : শরহুস সুন্নাহ, ১০:২২৪ হাদীস নং ২৫৫২।

নোট : ‘লক্ষ্যভেদ করে বের হয়ে যাওয়া’ সম্পর্কে জানতে দেখুন আবূল আব্বাস আল-মোবাররাদ প্রণীত ‘আল-কামেল’, ‘আখবার আল-খাওয়ারিজ’ অধ্যায়, যা ‘দার আল-ফিকর আল-হাদীস’, বৈরুত (তারিখ অনুল্লিখিত) কর্তৃক আলাদাভাবে প্রকাশিত, যা’তে নিম্নের মন্তব্য আছে: ‘সাধারণতঃ এমনটি যখন হয় (লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া), তখন কোনো শিকারের রক্ত-ই তীরে মাখা থাকে না’।


এই হাদীসটিকে ব্যাখ্যাকারীগণ খারেজীদের প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি ভবিষ্যদ্বাণী, একটি সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করেন। নির্দিষ্ট এক ধরনের ধর্মের গোঁড়া সমর্থক আছে, যারা ধর্মে এতো জোরে প্রবেশ করে যে অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে আসে, যার দরুণ তাদের সাথে ধর্মের অল্প কিছু অংশ থাকে, বা কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই বিষয়টির প্রতি সমর্থনদাতা অন্যতম আলেম হলেন হাম্বলী মযহাবের ইবনুল জাওযী, যিনি হযরত মারূফ আল-কারখী (رحمة الله) ও হযরত রাবেয়া আল-আদাউইয়্যা (رحمة الله)র জীবনী রচনার জন্যে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর ‘তালবিস ইবলিস’ গ্রন্থের (বৈরুত, ১৪০৩ হিজরী, ৮৮ পৃষ্ঠায়) ‘খারেজীদের প্রতি শয়তানী বিভ্রমের উল্লেখ’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি উপরোক্ত হাদীসখানি উদ্ধৃত করে লিখেন:


هَذَا الرَّجُلُ يُقَالُ لَهُ ذُوْ الخُوَيْصَرَة التَّمِيْمِيْ وَفِيْ لَفْظٍ أَنَّهُ قَالَ لَهُ اَعْدِلْ فَقَالَ وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَعْدِلُ فَهَذَا أَوَّلُ خَارِجِيٌ خَرَجَ فِيْ الإِسْلَامِ وَآفته أَنَّهُ رَضِيَ بِرَأيِ نَفْسِهِ وَلَوْ وَقَفَ لِعِلْمِ أَنَّهُ لَا رَأيَ فَوْق َرَأي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وأتَّبَاعَ هَذَا الرَّجُل


“এই লোকের নাম যুল-খোয়াইসারা আত্ তামিমী। ইসলামে সে-ই প্রথম খারেজী। তার দোষ ছিল নিজ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সন্তুষ্ট থাকা; সে যদি (বে-আদবি থেকে) বিরত থাকতো, তবে সে উপলব্ধি করতে পারতো যে মহানবী (ﷺ)-এর দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো অভিমত নেই।”


ইবনুল জাওযী এরপর খারেজী আন্দোলনের প্রসারসম্পর্কিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, পাশাপাশি তামিম গোত্রের মুখ্য ভূমিকা সম্পর্কেও লিখেন। তিনি বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় বলেন,

 أَنَّ أَمْيْرَ القِتَالِ شَبِيْبُ بْنُ رَبْعِي التَّمِيْمِيْ 

“(সুন্নীদের বিরুদ্ধে হারুরা) যুদ্ধে সেনাপতি ছিল শাবিব ইবনে রাবী’ আত্ তামিমী।” তিনি ৯২ পৃষ্ঠায় আরও বলেন, “আমর ইবনে বকর আত্ তামিমী হযরত উমর (رضي الله عنه)কে হত্যা করতে সম্মত হয়েছিল।” খারেজীদের শিবিরে কুরআন তেলাওয়াতের তৎপরতার কারণে মৌচাকের মতো শব্দ হলেও সেখানেই আবার এই ধরনের গোপন ষড়যন্ত্র চলেছিল (৯১ পৃষ্ঠা, ‘তালবিস ইবলিস’)।


মূল খারেজী বিদ্রোহ আরম্ভ হয় সিফফিনের সালিশে, যখন প্রাথমিক যুগের ভিন্ন মতাবলম্বীরা হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করেছিল। তাদের একজন ছিল আবূ বিলাল মিরদাস্, তামিম গোত্রেরই সদস্য (ইবনে হাযম,২২৩); নিয়মিত নামায ও কুরআন তেলাওয়াত সত্ত্বেও সে এক নিষ্ঠুর খারেজী ধর্মান্ধে পরিণত হয়। ‘তাহকিম’ তথা ‘আল্লাহর আইন ছাড়া কোনো বিধান নেই’ انِ الْحُكْمُ الاَّلِلَّهِ, যা পরবর্তীকালে খারেজী দাওয়া’ কার্যক্রমের স্লোগানে রূপান্তরিত হয়, ওই ফর্মূলার প্রথম প্রবর্তনকারী হিসেবে তাকেই স্মরণ করা হয়।


ইমাম আবদুল কাহির আল-বাগদাদী খারেজী বিদ্রোহ সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণে এর সাথে তামিম গোত্রের ঘনিষ্ঠ এবং মধ্য-আরব অঞ্চলের অধিবাসীদের সার্বিক সংশ্লিষ্টতার বর্ণনাও লিপিবদ্ধ করেন; তিনি এও উল্লেখ করেন যে ইয়েমেন ও হেজাযের গোত্রগুলো থেকে কেউই এই বিদ্রোহে সম্পৃক্ত হয় নি। তিনি যুল-খুয়াইসারার পরবর্তীকালের খারেজী তৎপরতার একটি বিবরণ তাঁর বইয়ে দিয়েছেন। 


❏ হাদিস 27:


হযরত আলী (رضي الله عنه)র সামনে ধরে আনা হলে সে বলে,

 وَقَالَ يَا بْنَ أَبِىْ طَالِب وَالله لَا نُرِيْدُ بِقِتَالِكَ إِلَّا وَجْه اللهِ وَالدَّار الْآخِرَة وَقَالَ لَهُ عَلَىْ بَلْ مِثْلُكُمْ كَمَا قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ 

“ইবনে আবি তালেব! আমি শুধু আপনার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আল্লাহ ও পরকালেরই খাতিরে!” 

হযরত আলী (رضي الله عنه) জবাবে বলেন, “না, তুমি ওদের মতোই যাদের সম্পর্কে আল্লাহ ইরশাদ [২৯.] ফরমান,

 - قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا (১০৩) الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ‘

হে রাসূল বলুন: "আমি কি তোমাদের বলে দেবো সর্বাপেক্ষা অধিক মূল্যহীন কর্ম কাদের? তাদেরই, যাদের সমস্ত প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনেই হারিয়ে গেছে এবং তারা এ ধারণায় রয়েছে যে তারা সৎকর্ম করছে।[৩০.]

২৯. আল কুরআন : আল কাহাফ, ১০৩।

৩০. ইমাম আবদুল কাহির আল-বাগদাদী কৃত ‘আল-ফারক্ক বাইন আল-ফিরাক্ক’, কায়রো (তারিখবিহীন),৮০ পৃষ্ঠা; যুল-খোয়াইসারার পূর্ণ সনাক্তকরণের জন্যে ওই বইয়ের ৭৬ পৃষ্ঠা দেখুন।


প্রাথমিক যুগের খারেজী বিদ্রোহগুলো, যা নিরীহ, নিরপরাধ মুসলমানদের দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডে পরিপূর্ণ ছিল, তার বিবরণ দেয়ার সময় ইমাম আবদুল কাহির পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন যে প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ খারেজী বিদ্রোহের নেতা-ই নজদ অঞ্চল থেকে এসেছিল। 


❏ উদাহরণস্বরূপ, সবচেয়ে ভয়ংকর ও ব্যাপকতা লাভকারী ‘আযারিকা’ নামের খারেজী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় নাফী’ আল-আযরাক; এই লোক ছিল মধ্য-আরব অঞ্চলের বনূ হানিফা গোত্রভুক্ত (ইমাম আবদুল কাহির, ৮২ পৃষ্ঠা)। 


❏ ইমাম সাহেব লিপিবদ্ধ করেন, “নাফী’ ও তার অনুসারীরা মনে করতো যারা তাদের বিরোধিতা করে, তাদের এলাকা দারুল কুফর (বৈরী দেশ); তাই ওখানে বিরোধীদের নারী ও শিশুকে হত্যা করা বৈধ...আযারিকা খারেজীরা আরও বলতো, আমাদের বিরোধীরা মুশরিক (মূর্তি পূজারী), তাই তাদের কোনো আমানত আমরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নই” (ইমাম আবদুল কাহির, ৮৪ পৃষ্ঠা)। 


❏ যুদ্ধে আল-আযরাকের মৃত্যুর পর আযারিকা বিদ্রোহীরা উবায়দুল্লাহ ইবনে মা’মুন আত্ তামিমীর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। আল-মোহাল্লাব এরপর আহওয়ায এলাকায় তাদের মোকাবেলা করেন, যেখানে উবায়দুল্লাহ ইবনে মা’মুন আত্ তামিমী নিজেও মারা যায়; আর তার সাথে মারা পড়ে তার ভাই ইবনে মা’মুন এবং আযারিকার তিন’শ সবচেয়ে ধর্মান্ধ ও উগ্র খারেজী। বাকি আযারিকা খারেজীরা আয়দাজ অঞ্চলে পশ্চাদপসারণ করে, যেখানে তারা কাতারী ইবনে আল-ফুজা’আর প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। ইবনে ফুজা’আকে তারা আমীরুল মো’মেনীন বলে সম্বোধন করতো (ইমাম আবদুল কাহির, ৮৫-৮৬ পৃষ্ঠা)। 


❏ ইমাম সাহেবের বইয়ের ব্যাখ্যাকারী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে ইবনে ফুজা’আ-ও তামিম গোত্রভুক্ত ছিল (পৃষ্ঠা ৮৬)।


❏ আযারিকা-খারেজী মতবাদ গ্রহণ না করার জন্যে শত-সহস্র মুসলমান হত্যাকারী এই গোত্রের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল খারেজী নজদীয়া অংশে। এদের নামকরণ হয়েছিল নজদা ইবনে আমীরের অনুসরণে, যে ব্যক্তি হানিফা গোত্রভুক্ত ছিল; এই গোত্রের আবাসভূমিও নজদ অঞ্চলে। নজদা নিজেও নজদ এলাকার অন্তর্গত ইয়ামামায় তার সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে। [ইমাম আবদুল কাহির, ৮৭]


❏ সকল যুগের খারেজী মতবাদীদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নজদীয়া অংশও বিরোধী মতের প্রতি তাদের অসহিষ্ণুতা থেকে সৃষ্ট উত্তপ্ত বিতর্কের কারণে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই ধর্মীয় মতবাদগত বিরোধের কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মদীনা মোনাওয়ারায় খারেজী আক্রমণ, যা’তে অনেক বন্দী নেয়া হয়; এ ছাড়াও বন্দী অ-খারেজী মুসলমান নারীদের সাথে যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে বিভিন্ন খারেজী এজতেহাদের দরুন ওই বিরোধ দানা বাঁধে। এই বিভক্তি থেকে তিনটি প্রধান উপদলের সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক উপদলটির নেতৃত্ব দেয় বনূ হানিফা গোত্রভুক্ত আতিয়্যা ইবনে আল-আসওয়াদ। নজদার মৃত্যুর পরপরই তার দলটিও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার একটি উপদল বসরার আশপাশ এলাকা আক্রমণের জন্যে নজদ ত্যাগ করে। [ইমাম আবদুল কাহির, ৯০-৯১]


❏ খারেজীদের শেষ বড় দলটির নাম এবাদিয়্যা, যেটি আজও অধিকতর শান্ত ও খর্বকায় আকৃতিতে জানজিবার, দক্ষিণ আলজেরিয়া ও ওমানে টিকে আছে। এর স্থপতি ছিল আরেক তামিম গোত্রভুক্ত আবদুল্লাহ ইবনে এ’বাদ। এই মতবাদ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল যা জানা যায় তা হলো, তাদের দৃষ্টিতে অ-এবাদী মুসলমানগণ কুফফার; তাঁরা মো’মেন (বিশ্বাসী) নন। তবে তাঁরা মুশরিক বা বহু উপাস্যে বিশ্বাসীও নন। “অ-এবাদী মুসলমানদের গুপ্তহত্যা তারা নিষেধ করে, কিন্তু প্রকাশ্য যুদ্ধকে অনুমোদন করে। তারা অ-এবাদী মুসলমানদের সাথে বিবাহ-সম্পর্কের অনুমতি দেয়, এবং তাঁদের উত্তরাধিকার নেয়াকেও অনুমতি দেয়। এবাদীরা দাবি করে যে আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ)এর পক্ষে জেহাদে সাহায্য হিসেবে এগুলো করা যায়।” [ইমাম আবদুল কাহির, ১০৩]


❏ হাদিস 28:


খারেজীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নারী ছিল বনূ তামিম গোত্রভুক্ত কুতাম বিনতে আলকামা। সে পরিচিত এই কারণে যে, সে তার জামাই ইবনে মুলজামকে বলেছিল, “আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো আমারই আরোপিত মোহরানার ভিত্তিতে; আর তা হলো তিন হাজার দিরহাম, একজন পুরুষ গোলাম ও একজন মহিলা বাঁদী, আর (হযরত) আলী (رضي الله عنه) এর হত্যা!” ইবনে মুলজাম বলে, “তুমি এর সবই পাবে; কিন্তু হযরত আলী (رضي الله عنه) কে কীভাবে হত্যা করবো?” কুতাম জবাব দেয়, “অতর্কিত হামলায় তাকে হত্যা করো। তুমি বেঁচে গেলে মানুষজনকে বদমাইশির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তোমার স্ত্রীর সাথেও বসবাস করবে; আর যদি তুমি এই প্রচেষ্টায় মারা যাও তবে চিরশান্তির স্থান বেহেশতে যাবে”।  সবাই জানেন, ইবনে মুলজাম কর্তৃক কুফার মসজিদে হযরত আলী (رضي الله عنه)কে ছুরিকাঘাতে হত্যার করার পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।[৩১.]

৩১. মুবাররাদ, ২৭।


মুসলমান সর্বসাধারণ যাঁরা অতীতের এই সন্তাপজনক ভুল-ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না, তাঁরা এই ঘটনাপ্রবাহের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে ঘভীরভাবে ভাবতে অবশ্যই চাইবেন। সহস্র সহস্র মুসলমান যারা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি ছিল নিবেদিত ও ধর্ম অনুশীলনে বিশিষ্ট, তারা এতদসত্ত্বেও খারেজী প্রলোভনের শিকারে পরিণত হয়। উলেমাবৃন্দ এই প্রলোভনের উৎস হিসেবে যুল-খোয়াইসারার ঘটনাকে খুঁজে পান, যে ব্যক্তি নিজেকে মহানবী (ﷺ)-এর চেয়েও উত্তম মুসলমান মনে করেছিল। আর সে অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ খারেজী নেতার মতোই বনূ তামিম গোত্রভুক্ত ছিল। অ-তামিমী খারেজী নেতাদেরও প্রায় সবাই নজদ অঞ্চল থেকে এসেছিল।

 
Top