বিষয় নং-০৯: হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) এর হারানো সুঁই ফিরে পাওয়া:


মাওলানা মুতীউর রহমান ‘এসব হাদীস নয়’ লিখিত কিতাবের ১৬১ পৃষ্ঠায় লিখা হয়েছে যে, ‘একবার রাসূল (ﷺ) এর সঙ্গে হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) রাতের আঁধারে তাঁর বিছানায় ছিলেন। আম্মাজান আয়েশা (رضي الله عنه)-এর হাত থেকে একটি সুঁই পড়ে গেলে খোঁজাখুঁজির পরও তা পাচ্ছিলেন না। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হেসে উঠলে তাঁর দাঁতের নূরের ঝলকে পুরো কামরা আলোকিত হয়ে যায়। ফলে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) সে নূরে তাঁর সুঁইটির সন্ধান পান।’’

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! এ ঘটনাটি বানানো তাতে কোনো সন্দেহ নেই, মূল কিতাবে কিরূপ আছে তা উল্লেখ করলেই বুঝতে পারবেন এখানে কি কি জালিয়াতি করা হয়েছে। এ জালিয়াতি বর্ণনা ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩১৯ পৃষ্ঠায় এবং মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী (সম্পাদিত) ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ গ্রন্থের ১৬৮ পৃষ্ঠায় হুবহু সংকলন করেছে।

প্রিয় পাঠক! বিশুদ্ধ বর্ণনাগুলো উল্লেখ করলেই বুঝতে পারবেন যে, তাদের বর্ণনায় কত মিথ্যার আশ্রয় এবং শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। হাদিসে আছে,  রাসূল (ﷺ) আয়েশা (رضي الله عنه) এর সাথে ছিলেন না অথচ তারা লিখেছেন- مع الرسول রাসূল (ﷺ) তাঁর সাথে ছিলেন, এটা এক জঘণ্য মিথ্যাচার। অথচ যেই কিতাবের বরাত দিয়েছেন সেই ‘আছারুল মারফুআ’ নামক কিতাবে এ কথাটি নেই। অপর মিথ্যা বর্ণনাটি হল-

فَضَحِكَ النَّبِيُّ ﷺ وَخَرَجَتْ لَمْعَةُ أَسْنَانِهِ فَأَضَاءَتِ الْحُجْرَةَ

 -“রাসূল (ﷺ) এমন সময় হেসে উঠলেন তাঁর দাঁতের নূরের ঝলকে (সুই খুঁজে পেলেন) ঘর আলোকিত হয়ে গেল।” মিথ্যাবাদীর প্রতি আল্লাহর লানত! দেখুন, তারা নিজেরাই জাল হাদিস তৈরি করে আবার নিজেরাই জাল বলে বই বের করে টাকা উপার্জনের জন্য।

এবার আমরা এ বিষয়ক হাদিসটি গ্রহণযোগ্য কিতাবের আলোকে নিম্নে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো, ইনশা-আল্লাহ।


❏ ইমাম ইবনে আসাকীর, সুয়ূতি (رحمة الله)সহ এক জামাত ইমামগণ সংকলন করেন-

......عن محمد بن إسحاق بن يسار عن يزيد بن رومان وصالح بن كيسان عن عروة بن الزبير عن عائشة  قَالَت كنت أخيط فِي السحر فَسَقَطت مني الابرة فطلبتها فَلم أقدر عَلَيْهَا فَدخل رَسُول الله ﷺ فتبينت الإبرة بشعاع نور وَجهه فَأَخْبَرته فَقَالَ يَا حميراء الويل ثمَّ الويل ثَلَاثًا لمن حرم النّظر إِلَى وَجْهي

-‘‘......বিখ্যাত সিরাতবিদ, ইমামুল মাগাজী, ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক বিন ইয়াসার (رحمة الله) তার দুই মহান উস্তাদ হযরত ইয়াযিদ ইবনে রুমান এবং ছালেহ ইবনে কায়সান (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন, তাঁরা হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি শেষ রাতে সেহেরির সময় কাপড় সেলাই করছিলাম। হঠাৎ আমার হাত থেকে সুঁই পড়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সেটি পাওয়া গেল না। অতপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আগমন করলে তাঁর মুখমন্ডলের নূরের আলোতে সেই সুঁইটি দৃষ্টিগোচর হয়। আমি রাসূল (ﷺ) কে এ সংবাদ দিলে তিনি বললেন,  হে হুমায়রা! যে আমার চেহারা মুবারকের দিদার থেকে বঞ্চিত। তার জন্য আফসোস, একথাটি তিনি তিনবার বলেছিলেন।’’ ১৪০

১৪০.ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি: খাসায়েসুল কুবরা: ১/১১১ পৃ., হা/২৮৭, ইমাম ইবনে আসাকীর: তারীখে দামেস্ক: ৩/৩১০ পৃ., আল্লামা শায়খ ইউসুফ নাবহানী: হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামীন: ৬৬৩ পৃ., আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী: লিসানুল মিযান: ৩/৩৪৪ পৃ ও ৬/৬৯০ পৃ., আবূ সা‘দ নিশাপুরী, শরফে মোস্তফা, ২/১০৩ পৃ., আবূ নুয়াইম ইস্পাহানী, দালায়েলুল নুবুয়ত, ১/১১৩ পৃ. দারূল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২/৪০ পৃ., ইফরাকী, মুকতাসারে তারিখে দামেস্ক, ২/৭৪ পৃ. মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৪৫৩ পৃ. হা/৩২১৩১ ও ১২/৪২৯ পৃ. হা/৩৫৪৯২


পর্যালোচনা:


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! সনদসহ এ ঘটনাটি তাদের চোখে পড়লো না, পড়লো নিজেদের এক মৌলভী আব্দুল হাই লাখনৌভীর বানানো ঘটনাটি।


❏ দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) শরহে শিফায় উল্লেখ করেন-

ودليله قول عائشة رضي الله تعالى عنها كنت أدخل الخيط في الإبرة حال الظلمة لبياض رسول الله ﷺ

-‘‘এ বিষয়ে দলিল হলো হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)-এর বক্তব্য আমি অন্ধকার রাতে হুযূর পুরনুর (ﷺ) এর নূরানী জ্যোতিতে সুঁইয়ের মধ্যে সুতা প্রবেশ করাতাম।’’ ১৪১

১৪১. মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা : ১/১৫৯ পৃ., দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।


❏ ইমাম আবু সা‘দ খরকুশী নিশাপুরী  (ওফাত. ৪০৬ হি.) এবং ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) সংকলন করেন-

روي أن عائشة رضي الله عنها كانت تخيط ثوبا في وقت السحر، فضلّت الإبرة وطفىء السراج، فدخل عليها النبي ﷺ فأضاء البيت، ووجدت عائشة الإبرة بضوئه، فضحكت، ثم قال النبي ﷺ: ويل لمن لا يراني يوم القيامة، قالت عائشة: ومن لا يراك يا رسول الله؟ قال: البخيل، قالت: ومن البخيل؟ قال: الذي لا يصلي عليّ إذا سمع اسمي.

-‘‘উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) সাহরীর সময় কিছু সেলাই করছিলাম। তার সূঁইটি পড়ে গেল। চেরাগও নিভে গেল। তখন নবী করীম (ﷺ) তাশরীফ আনলেন। ঐ সময় হুযূর-ই-আনওয়ার (ﷺ)-এর চেহারা মুবারকের নূরের আলোয় পুরো ঘরটি আলোকিত হয়ে গেল। অতঃপর আমি সুঁইটি পেয়ে গেলাম। তারপর হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আপনার চেহারা মোবারক কতই উজ্জ্বল। তখন হুযূর  ফরমান,  ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন আমাকে দেখতে পাবে না। মা আয়েশা (رضي الله عنه) আরজ করলেন,  ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! সে কে? যে আপনাকে দেখতে পাবে না? হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করলেন,  কৃপণ ব্যক্তি। আরজ করলেন,  কৃপণ কে? হুযূর (ﷺ) ইরশাদ করলেন, যে ব্যক্তি আমার নাম শুনলো, আর শুনার পর আমার উপর দুরূদ শরীফ পড়ল না।’’১৪২

১৪২.

(ক) ইমাম আবু সা‘দ খরকুশী, শরফুল মোস্তফা, ২/১০৩ পৃ.

(খ) আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী, নুযহাতুন নাযিরীন, পৃ-৪১


❏ আল্লামা মাহদী আল-ফাসী (رحمة الله) তার ‘মাতালিউল মুসাররাত ফি শরহে দালায়েলুল খায়রাত’ কিতাবের ২৫৬ পৃষ্ঠায় ইবনে সাবা (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন, 

كان النبى ﷺ يضيئ البيت المظلم من نوره ـ

-‘‘নবী করীম (ﷺ) এর নূরে অন্ধকার ঘর আলোকিত হয়ে যেত।’’ 

 
Top