প্রীতিভোজ


ইসলামে ওলীমা করা সুন্নাত। বিবাহ অনুষ্ঠানের পর কিংবা বাসর রাত যাপনের পর স্বামীর পক্ষ থেকে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে ভোজের ব্যবস্থা করাকে ওলীমা বলা হয়। এটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সামর্থানুযায়ী করা হবে। এতে চাপ প্রয়োগ কিংবা কোনো প্রকারের ধরা-বাঁধা করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ বিবাহে ওলীমা অনুষ্ঠান করেছেন। হযরত যয়নাব (رضي الله عنه) কে বিয়ে করে বকরী যবেহ করে গোশ্ত ও রুটি দ্বারা মেহমানদের তৃপ্তি সহকারে আহার করান। ৯৪

 ৯৪.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র, মিশকাত, পৃ. ২৭৮, হাদিস নং ৩০৬২-৬৩

 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (رضي الله عنه) কে বলেন أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ তুমি একটি বকরী দিয়ে হলেও ওলীমা অনুষ্ঠান করো। ৯৫

৯৫.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র মিশকাত; পৃ. ২৭৮, হাদিস নং ৩০৬১

 

তবে অহংকার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রতিযোগীতামূলক খাবার আয়োজনকারীর দাওয়াত কবুল না করাই উত্তম। এ ধরনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত অন্ষ্ঠুানে অংশগ্রহণ করতে এবং পানাহার করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিষেধ করেছেন। ৯৬

৯৬.বায়হাকী, (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৯, হাদিস নং ৩০৭৭

 

কিন্তু আমরা ইসলামী আদর্শচ্যুত হয়ে অনেক অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। কনে পক্ষ থেকে এক প্রকারের জোর জরবদস্তীভাবে বর পক্ষ দুই হাজার, পাঁচ হাজার লোকের খাবার আদায় করা চরম অন্যায়। শুধু তা নয় বরং খাবারের আইটেম কী হবে- তাও উল্লেখ করে দেয়। খাবারের আগে-পরে কী কী দিতে হবে, কোন ক্লাব ভাড়া করবে, বিয়ের দিন প্রথমে একশ থেকে পাঁচশ জনের খাবার বরের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। নির্ধারিত মেহমানের অতিরিক্ত আসলে তাদেরকেও যথাযথভাবে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি খাবারের আইটেম নিয়ে বাড়াবাড়ী করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বিয়ে ভঙ্গের বহু নজীরও আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাই। কনে পক্ষ হওয়াটাই যেন তাদের অপরাধ, সব গ্লানি তাদেরই সহ্য করতে হয়। বিয়ের পর দিন বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে কনে পক্ষ (মুরগীর পাক, ট্যাংয়ের) ভাত নিয়ে দেখতে গেলে বিয়ের দিন কনেপক্ষ থেকে পাঠানো ফ্রিজে রাখা বাসী খাবার খেয়ে ফিরে আসতে হয়।


বিয়ের দিন বরের বাড়ির জন্য সংসারে প্রয়োজনীয়- অপ্রয়োজনীয় যাবতীয় আসবাবপত্র- পাটি-বালিশ, খাট-ফালং, টিভি-ফ্রিজ থেকে আরম্ভ করে ময়লা ফেলার পাত্র থেকে শুরু করে চুলার ছাই তুলার কাঠিমালা পর্যন্ত পাঠাতে হয়। ছোট থেকে মাঝারী ও বড় আকারের হান্ডি, পাতিল, ডেক্সি, কড়াই, পিঠা বানানোর মেলুন, পীরা, গরম ডেক্সি ধরার জন্য লোশনী, সাবানদানীসহ এতো সব দেওয়ার পরও বরপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। কোন একটি আইটেম একটিু নিরস হলে কিংবা ভুলে বাদ পড়লে তড়িৎগতিতে তা কনে পক্ষের কানে পৌঁছানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে খোটা মেরে বউকে ইঙ্গিতে কিংবা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো পরিবারে এজন্যে কনেকে নির্যাতিতও হতে হয়।


বিয়ের পরে কমপক্ষে দীর্ঘ এক বছর যাবৎ বিভিন্ন মাস ও দিবসকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন প্রকারের নাস্তা ও খাবার প্রেরণ করতে হয়। যেমন- রমযানে ইফতারী সামগ্রী, ঈদে বরপক্ষের ছোট বড় সকলের জন্য কাপড়, সেমাই-চিনি, শবে কদর, শবে বরাত, মর্হরম, মিলাদুন্নবী (ﷺ) , কুরবানীতে গরু-ছাগল ও যাবতীয় মরিচ, মসল্লা, তেলসহ রন্ধন সামগ্রী, রুটি, পরটা, বাগরখানী, রাধা ও কাঁচা সব ধরনের বস্তু সামগ্রী কনে পক্ষ থেকে বরপক্ষকে দিতে বাধ্য। আবার মৌসুমী ফল-ফ্রুট যেমন- আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, তরমুজ, বাঙী, জাম, বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন প্রকারের নাস্তা-পিঠা যেমন মধুভাত, গুড়াপিঠা, শীতপিঠা, জালিপিঠা, তালপিঠা, ফুলপিঠা ইত্যাদি নাম জানা-অজানা বহু ধরনের নাস্তা সামগ্রী পাঠাতে হয়। এগুলোর পরিমাণ আবার কম হতে পারবে না। সামর্থানুযায়ী কেউ সি.এন.জি করে কেউ ঠেলাগাড়ি করে আবার কেউ ট্রাকভরে পাঠায়। বরপক্ষ এগুলো তার সমাজে, পাড়া-প্রতিবেশীকে এবং আত্মীয়-স্বজনকে বিতরণ করে। বরপক্ষের চাহিদার তুলনায় এসব সামগ্রী একটু কম হলে বরের মা পুত্র বধুকে বলে- “ও বউ! আমরা তোমার পিতা-মাতার কাছে এসব কিছু চাইনি। দিলেন যখন এতো কম দিলেন কেন? আমার আত্মীয় স্বজন যে বেশী তা তোমার পিতা-মাতা কি জানেনা? এখন এগুলো কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেবো? তখন কনে পিতা-মাতার নিকট ফোন করে এ নিয়ে ঝগড়া করে। তখন কনের পিতা-মাতার মনের কষ্ট বহুগুণ বৃদ্ধি পায় আর মনে প্রশ্ন জাগে কনের পিতা-মাতা হলাম কেন?


বিয়ের পরে কনে পক্ষের আত্মীয় স্বজন নতুন জামাই বাবুকে দাওয়াত খাওয়াই। যেমন কনের খালার বাড়িতে, নানার বাড়িতে কিংবা ফুফুর বাড়িতে একের পর এক দাওয়াত গ্রহণ করতে হয় বরকে। প্রতি জনের পক্ষ থেকে বরসহ বরের ঘরের ছোট-বড় সকল সদস্যকে শাড়ি, থ্রিপিছ, পেন্ট-শার্ট ও জামা-কাপড় উপহার দিতে হয়। কোন সদস্য বরের সঙ্গে না আসলেও তার পোশাক পাঠিয়ে দিতে হয়। যেন এটা তাদের একান্ত প্রাপ্য। হ্যাঁ, কেউ যদি কাউকে কোন হাদিয়া বা উপঢৌকন দেয় তা নেয়া আবশ্যক। ফেরৎ দেওয়া অসৌজন্যমূলক আচরণ বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু আমরা যেসব আচার-অনুষ্ঠানের কথা বলছি তা হাদিয়ার পর্যায় অতিক্রম করে বাধ্যতামূলক অন্যায়-অবিচারে পর্যবেশীত হয়ে পড়েছে। কারণ এগুলোর কোন একটির সামান্য ব্যতিক্রম হলে সমালোচিত হয় এবং যার খেসারত দিতে হয় দীর্ঘদিনের প্রিয় বাড়ি-ঘর, ভাই-বোন. পিতা-মাতা ছেড়ে আসা কোমলমতি নতুন বধুকে।


এক বছর পর মেয়ের ঘরে যখন কোনো সন্তান আসবে তখন আকীকার জন্য নানা বাড়ি থেকে গরু কিংবা ছাগল এবং সমপরিমাণ যাবতীয় খাবার সামগ্রী সরবরাহ করতে দেখা যায়। এসব আচার-ব্যবহার কনেপক্ষ মেয়ের সুখ-শান্তির জন্য ঋন করে হলেও করে থাকে। তারা একটুখানিও ভেবে দেখেনা যে, তাদেরও তো কন্যা সন্তান আছে। আবার এরকম মানুষও আছে যারা বলে- আমরাও আমাদের মেয়েদেরকে এসব দিয়ে এসেছি এখন ছেলেদের বেলায় নেবোনা কেন? এসব অপসংস্কৃতি ও অনৈসলামী কালচার চট্টগ্রামেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। বরপক্ষ তাদের বধুকে স্বর্ণালংকার প্রদান করে যা পরিধান করে বধু স্বামীর বাড়িতেই আসবে তার মূল্য হিসাব করে নির্ধারিত মাহর থেকে বিয়োগ করা হয়। পক্ষান্তরে কনে পক্ষ থেকে যত মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হোকনা কেন যা সর্বদা বরের ঘরে ব্যবহৃত হয় থাকে তা কোনো হিসাবেই আসে না।অবশ্য এসব চরিত্র সব পরিবারে সকল মানুষের মধ্যে নেই। এর ব্যতিক্রমধর্মী অনেক পরিবার দেখা যায় যারা এইসবকে মনে-প্রাণে পছন্দ করেন না বরং ঘৃণার চোখে দেখেন। এরূপ ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীতে সুখ-সমৃদ্ধি আদর্শ পরিবার আদৌ বিদ্যমান। যারা পুত্র বধুকে নিজেদের কন্যার ন্যায়, ভাসুর, দেবর, ননদরা নিজেদের বোনের মতো যথাক্রমে স্নেহ-মমতা ও সম্মান প্রদর্শন করে সহজেই আপন করে নেয়। নব বধুও নিজের পিতা-মাতা ও ভাই-বোন থেকে শশুরবাড়ির লোকজনকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের মনজয় করতে সচেষ্ট হয়। এভাবে একটি সুখী-সমৃদ্ধি পরিবার গঠিত হয়। আর এরূপ পরিবারকেই বলা হয় পৃথিবীর স্বর্গ।


বর্তমান আমাদের মুসলিম সমাজে উপরোক্ত অনৈতিক কার্যক্রম অলিখিত বিধি হিসাবে প্রচলিত হয়ে আসছে। দাতা কর্তব্য মনে করে দিচ্ছে আর গ্রহীতা হকদার মনে করে গ্রহণ করছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে এই সত্যটা বেরিয়ে আসবে যে, আজকে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সম্ভবত এ কারণেই পিতা-মাতার চেহারা মলিন হয়ে যায়।


মহানবী (ﷺ) তাশরীফ এনে ইসলাম থেকে যাহেলী যুগের যেসব অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে মুসলমানদেরকে বিশেষত নারী জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন বর্তমান মুসলিম জাতি ধীরে ধীরে পুনরায় সেই তিমিরে ফিরে যাচ্ছে। সুশিক্ষা ও আত্মমর্যাদাবোধের অভাবে এবং স্বার্থপরতা, বিলাসিতা ও লোভের মোহে অন্ধ হয়ে চোখ বুঝে এইসব অমানবিক কর্মকান্ড আমরা দিব্বি করে যাচ্ছি। এইসব থেকে বেরিয়ে আসা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর এজন্য প্রয়োজন কুরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞান ও অনুসরণ। এ বিষয়ে সমাজের সুশিক্ষিত আলোকিত মানুষ বিশেষত আলিম সমাজের ভূমিকা ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করা যায়। 


দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আজকের তথাকথিত নারী মুক্তির আন্দোলনকারীরা এ বিষয়ে সোচ্চার হতে এবং এগুলো বন্ধের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না, বরং তাদের কর্মকান্ড ও বিষয়বস্তু দেখে মনে হয় তারা কেবল ইসলামের বিরোদ্ধে নারী জাতিকে উচকিয়ে দিয়ে ইসলাম বিমুখ করার টীকাধারী নিয়ে মাঠে নেমেছেন।

 
Top