বিষয় নং-১৪: রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া থাকা প্রসঙ্গ: 


❏ ইমাম হাকেম তিরমিযি (رحمة الله)সহ এক জামাত ইমামগণ সংকলন করেন-

اخْرُج الْحَكِيم التِّرْمِذِيّ عَن ذكْوَان ان رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لم يكن يرى لَهُ ظلّ فِي شمس وَلَا قمر

-‘‘হযরত যাকওয়ান (رضي الله عنه) বলেন,  হুযূর (ﷺ) এর ছায়া চাঁদ সূর্যের আলোতে জমীনে পড়ত না।’’ ১৯৮

১৯৮. ইমাম হাকেম তিরমিযী: নাওয়াদিরুল উসূল : পৃ-১/২৯৮ পৃ:, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কোবরা : ১/১২২ পৃ:, হা/৩২৮, আল্লামা ইমাম কাস্তাল্লানী : মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া : ২/১২০ পৃ:, আল্লামা ইমাম জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ৪/২২০ পৃ., শায়খ সুলায়মান জুমাল : ফতোয়ায়ে আহমদিয়া শরহে হামবীয়া, পৃ-১৪৮, শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী : মাদারেজুন নবুওয়াত : ১/১৪২ পৃ., আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামিন : পৃ : ৬৬৮, আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ৩/১৪২ পৃ., আল্লামা মাহদী আল-ফাসী, মাতালিউল মুসাররাত : পৃষ্ঠা নং : ৩৬৫, আল্লামা ইবনে সালেহ : সুবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ : ২/৯০ পৃ:, ইমাম আহমদ রেযা : নুরুল মুস্তফা : পৃষ্ঠা, ৮২, ইমাম মুকরিযী : আল ইমতাওল আসমা : ১০/৩০৮ পৃষ্ঠা, ইমাম মুকরিযী : মাকারুম বিখাসায়েসুন্নবী, ২/২৩৫ পৃষ্ঠা, আল্লামা শফী উকাড়ভী : জিকরে জামিল : পৃ-৩২৪, আল্লামা ওমর বিন আব্দুল্লাহ সিরাজুদ্দীন : ফতোয়ায়ে সিরাজিয়া : ১/২৯৭ পৃ.


সনদ পর্যালোচনা:


এ হাদিসটির মান ‘হাসান’। এটিকে যদি আহলে হাদিস ও দেওবন্দী আলেমেরা যঈফও বলে থাকেন তারপরও এর অনেক শাওয়াহেদ সহীহ হাদিস রয়েছে। এ হাদিসটিকে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী (সম্পাদিত) ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ এর ২২৯-২৩০ পৃষ্ঠায় জাল বলে উল্লেখ করেছেন। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩৫৭-৩৬৪ পৃষ্ঠা পর্যন্তু রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া ছিল না প্রমাণের অনেক অপচেষ্টা করেন। তিনি তার এ মতের পক্ষে একটি যঈফ হাদিসকে ভুয়া তাহকীক করে সহীহ বলেছেন; যার আলোচনা সামনে আসবে ইন শা আল্লাহ। তিনি তার গ্রন্থের ৩৫৯-৩৬০ পর্যন্ত এটিকে জাল প্রমাণের অনেক অপচেষ্টা করেন। আরেক দেওবন্দী মাওলানা মুতীউর রহমান লিখিত ‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১৭০ পৃষ্ঠায়ও একে জাল বলেছেন।


রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া থাকার বিষয়ে কয়েকটি হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা ও সঠিক ব্যাখ্যা:


হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদিসের জবাব:


‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থের ১৭১-১৭২ পৃষ্ঠা মাওলানা মুতীউর রহমান পর্যন্ত দুটি হাদিস উল্লেখ করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া জমিনে পড়তো। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে তার দুটি প্রমাণের মধ্যে সেও একটিকে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই সেগুলোর পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি বিধায় এখানে উল্লেখ করবো।


প্রথম হাদিস ও তার ব্যাখ্যা


মাওলানা মুতীউর রহমান এ হাদিসকে তার গ্রন্থের ১৭১ পৃষ্ঠায় রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া থাকার পক্ষে প্রথম হাদিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

نا بَحْرُ بْنُ نَصْرِ بْنِ سَابَقٍ الْخَوْلَانِيُّ، نا ابْنُ وَهْبٍ، حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ بْنُ صَالِحٍ، عَنْ عِيسَى بْنِ عَاصِمٍ، عَنْ زِرِّ بْنِ حُبَيْشٍ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: صَلَّيْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ صَلَاةَ الصُّبْحِ قَالَ: فَبَيْنَمَا هُوَ فِي الصَّلَاةِ مَدَّ يَدَهُ، ثُمَّ أَخَّرَهَا، فَلَمَّا فَرَغَ مِنَ الصَّلَاةِ، قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، صَنَعْتَ فِي صَلَاتِكَ هَذِهِ مَا لَمْ تَصْنَعْ فِي صَلَاةٍ قَبْلَهَا قَالَ: إِنِّي رَأَيْتُ الْجَنَّةَ قَدْ عُرِضَتْ عَلَيَّ، وَرَأَيْتُ فِيهَا. . . . قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ، حَبُّهَا كَالدُّبَّاءِ، فَأَرَدْتُ أَنْ أَتَنَاوَلَ مِنْهَا، فَأُوحِيَ إِلَيْهَا أَنِ اسْتَأْخِرِي، فَاسْتَأْخَرَتْ، ثُمَّ عُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ، بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ حَتَّى رَأَيْتُ ظِلِّيَ وَظِلَّكُمْ

-“হযরত আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه)বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করলেন। ফলে তিনি নামাজেই সামনের দিকে হাঁত বাড়িয়ে দিলেন, অত:পর ফিড়িয়ে আনলেন। যখন নামাজ থেকে বের হলেন তখন আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার হাঁত সামনের দিকে বাড়ালেন অথচ ইতোপূর্বে এরূপ করেননি। রাসূল (ﷺ) বললেন: আমি দেখলাম আল্লাহ পাক আমার সামনে জান্নাত পেশ করলেন এবং আমি ইহাতে দেখতে লাগলাম।.... জান্নাত থেকে আমি কিছু নিতে চাইলে আমার প্রতি ওহী নাজিল হল আপনি সরে দাঁড়ান। তারপর জাহান্নাম উপস্থিত করা হল যা আমার ও তোমাদের সামনেই ছিল। ফলে আমার ও তোমাদের ছায়া সেখানে দেখতে পাই।” (সহীহ্ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং ৮৯২)


পর্যালোচনা:


প্রিয় পাঠক! ইহা প্রিয় নবীজি (ﷺ)-এর ছায়া সম্পর্কিত হাদিস নয়, কারণ এই ঘটনা ছিল ফজরের নামাজের সময়, বলুন ফজরের সময় কি সূর্য থাকে যে ছায়া পড়বে!? 


❏ ইমাম হাকেমের বর্ণনায় এসেছে-

بَيْنَمَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي ذَاتَ لَيْلَةٍ صَلَاةً إِذْ مَدَّ يَدَهُ

-‘‘এক রাতে রাসূল (ﷺ) নামায পড়াচ্ছিলেন। তিনি সহসা সামনের দিকে হাত বাড়ান।.....।’’ (ইমাম হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ৪/৫০৩ পৃ. হা/৮৪০৮)


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! রাতে কি কোন ব্যক্তির ছায়া পতিত হয়? আর সেকালে এত আধুনিক বাতির ব্যবস্থাও ছিল না। অপরদিকে সনদ সহীহ হলেও হাদিসের মতন নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কেননা, ইমাম হাকেমের বর্ণনায় রাতের নামায এবং ইমাম ইবনে খুজায়মার বর্ণনায় ফজরের নামাযের কথা উল্লেখ রয়েছে।

এখানে জিল্লুন শব্দের অর্থ সম্মান ও আশ্রয় হবে। সর্বোপরি এখানে ظِلِّيَ وَظِلَّكُمْ (জিল্লী ওয়া জিল্লুকুম) দ্বারা প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও সাহাবীদের ছায়াকে উদ্দেশ্য নয়। কারণ ছায়া যদি উদ্দেশ্য হত তাহলে শুধু জাহান্নামে ছায়া পড়ল কিন্তু জান্নাতে ছায়া পড়ল না ইহার মানে হতে পারে না। 

প্রিয় নবীজি (ﷺ) বললেন, জান্নাত ও জাহান্নাম পেশ করা হয়েছিল بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ (বাইনি ওয়া বাইনাকুম) আমার ও তোমাদের মাঝে। লক্ষ্য করুন, প্রিয় নবীজি (ﷺ) হলেন ইমাম, আর সাহাবীরা হলে মুক্তাদী। জান্নাত-জাহান্নাম পেশ করা হয় উভয়ের মাঝে। অর্থাৎ নবীজির পিছনে এবং সাহাবীদের সামনে, কারণ তখন দয়াল নবীজি নামাজে ছিলেন। তাহলে একই সাথে সামনে থেকে পিছনে এবং পিছন থেকে সামনে ছায়া পড়ে কিভাবে!? কারণ ছায়া তো একই সাথে সামনে ও পিছনে পড়ে না। এখানে প্রিয় নবীজি (ﷺ) ظِلِّيَ وَظِلَّكُمْ (জিল্লী ওয়া জিল্লুকুম) ‘আমার ও তোমাদের ছায়া’ কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। কেননা এরূপ অনেক ক্ষেত্রেই রূপক অর্থে ظِلّ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। 


❏ যেমন লক্ষ্য করুন:-

حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ، فِيمَا قُرِئَ عَلَيْهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ مَعْمَرٍ، عَنْ أَبِي الْحُبَابِ سَعِيدِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ؓ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ : إِنَّ اللهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلَالِي، الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّي

-“হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন বলবেন, কে আমার ইজ্জতকে ভালবেসেছ, তাদের জন্য আমার ছায়া রয়েছে, যখন আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না।” (সহীহ্ মুসলিম, হা/৬৭১৩; মুসনাদে আহমদ, হা/৮৮৩২)


● হাদিসটি হযরত এরবাজ ইবনে সারিয়া (رضي الله عنه) থেকে ইমাম আহমদ (رحمة الله) তার মুসনাদে ছহীহ্ সনদে বর্ণনা করেছেন।


দেখুন এই হাদিসে আল্লাহর ছায়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আল্লাহর কোন ছায়া নেই কারণ আল্লাহ ছায়া থেকে পবিত্র। এখানে আল্লাহর আরশের ছায়া হল উদ্দেশ্যে। 


❏ যেমন ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেন-

جَزَاؤُهُ أَن أظلهُ فِي ظِلِّي يَوْم لَا ظل إِلَّا ظِلِّي مَعْنَاهُ ظل عَرْشِي يَوْم الْقِيَامَة

-“তার প্রতিদান হল সেদিন তার ছায়া হবে আমার ছায়ায় যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। ইহার অর্থ হল কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া।” (ইমাম যাহাবী, আল-কাবাইর, ১ম খণ্ড, ৬৮ পৃ:)


● আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এখানে ظل শব্দের অর্থ আল্লাহ্ ও রাসূলের শানে করেছেন- أَيْ: رَحْمَتِهِ -‘‘তার রহমতের নিচে।’’ ১৯৯

১৯৯. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মেরকাত : ২/৩৭৮ পৃ. হা/৭০১


❏ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন-

وَقِيلَ: الْمُرَادُ ظِلُّ الْعَرْشِ إِذْ جَاءَ فِي بَعْضِ طُرُقِ الْحَدِيثِ فِي ظِلِّ عَرْشِهِ

-‘‘কোন কোন ব্যাখ্যাকার বলেছেন, আল্লাহর ছায়া বলতে এখানে আল্লাহর আরশের ছায়া উদ্দেশ্য, এ বিষয়ে অনেক পদ্ধতীতে হাদিস বির্ণত হয়েছে।’’  ২০০

২০০. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মেরকাত : ২/৩৭৮ পৃ. হা/৭০১


❏ এ বিষয়ে আরো দুইটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা যায়,

ثنا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ شَبِيبٍ، ثنا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، ثنا ابْنُ أَبِي فُدَيْكٍ، أَنَّ مُوسَى بْنَ يَعْقُوبَ، أَخْبَرَهُ عَنْ عَبْدِ الْأَعْلَى بْنِ مُوسَى بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ قَيْسِ بْنِ مَخْرَمَةَ، أَنَّ إِسْمَاعِيلَ بْنَ رَافِعٍ يُحَدِّثُهُ، عَنِ ابْنِ أَسْلَمَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ لِي أَبُو عُبَيْدَةَ: أَشْهَدُ لَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: لَا تَسُبُّوا السُّلْطَانَ؛ فَإِنَّهُ ظِلُّ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ

-“জায়েদ ইবনে আসলাম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সাহাবী আবু উবাইদা (رضي الله عنه) আমাকে বলেছেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন: তোমরা সুলতানকে গালি দিয়োনা, নিশ্চয় সে জমীনে আল্লাহর ছায়া।” {ইমাম ইবনে আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, হা/১০১৩; ইমাম বায়হাকী, শুয়াইবুল ঈমান, হা/৬৯৮৭, হযরত উমর (رضي الله عنه) থেকে} 


❏ ইমাম আসেম (رحمة الله) আরও সংকলন করেন-

حَدَّثَنَا الْمُقَدَّمِيُّ، ثنا سَلْمُ بْنُ سَعِيدٍ الْخَوْلَانِيُّ، ثنا حُمَيْدُ بْنُ مِهْرَانَ، عَنْ سَعْدِ بْنِ أَوْسٍ، عَنْ زِيَادِ بْنِ كُسَيْبٍ، عَنْ أَبِي بَكْرَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: السُّلْطَانُ ظِلُّ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ، فَمَنْ أَكْرَمَهُ أَكْرَمَ اللَّهَ، وَمَنْ أَهَانَهُ أَهَانَهُ اللَّهُ

-“হযরত আবী বাকরা (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: সুলতান জমীনবাসীর জন্য ছায়া। যে তাকে সম্মান করল সে আল্লাহকে সম্মান করল আর যে তাকে অসম্মান করলো সে আল্লাহকে অসম্মান করলো।” {ইমাম ইবনে আবী আছেম: আস-সুন্নাহ, হা/১০২৪; ইমাম বায়হাকী, শুয়াইবুল ঈমান, হা/৬৯৮৪, হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে}


এখানে সুলতানকে আল্লাহর ছায়া বলা হয়েছে, অথচ বাস্তবে তারা আল্লাহর ছায়া নয়। এখানে রূপক অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক তেমনি সেখানে প্রিয় নবীজি (ﷺ) রূপ অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। মুহাদ্দিসীনে কিরাম ইহার সু-স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা দেননি। যেহতেু শুধু জাহান্নামে ছায়ার কথা বলা হয়েছে, জান্নাতে নয়। সেহেতু এটা প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও সাহাবীদের সত্ত্বা অর্থ নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও সাহাবীদের সত্ত্বা জাহান্নামে থাকবে এটা কল্পনাও করা যায় না। তবে নিশ্চয় জাহান্নামী পাপীদেরকে শাফায়াতের মাধ্যমে প্রিয় নবীজি (ﷺ) ও পরে সাহাবীরা বের করে আনবেন সেহেতু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, জাহান্নামে পাপীদের শাফায়াত করার ছায়া। আল্লাহই সর্বোজ্ঞ।


দ্বিতীয়ত. জবাব হলো আপনারাই তো বলেন নবী গায়বের সংবাদ দিতে পারে না এবং তিনি গায়েব জানেন না। আপনারাই বলেন রাসূল (ﷺ) হাযির নাযির নন। তাহলে দেখুন রাসূল (ﷺ) ও সাহাবীদের সামনেই জান্নাত জাহান্নাম উপস্থিত ছিল। কিন্তু রাসূল (ﷺ) ই শুধু দেখতে পেলেন আর সাহাবীদের কাছে তো তা গায়ব ছিল। শুধু তাই নয় জান্নাত থেকে ফল নিতেও চাইলেন,  রাসূল (ﷺ) এর দৃষ্টিতে বা নিকটে  জান্নাত আল্লাহ্ কত কাছে করে দিয়েছেন। এটা কী রাসূল (ﷺ) এর গায়বের খবর নয়? আর প্রমাণিত হলো যে, রাসূল (ﷺ) এর সামনে জান্নাত জাহান্নাম উপস্থিত।


উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদিস ও তার পর্যালোচনা:


মাওলানা মুতীউর রহমান সাহেব তার লিখিত ‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থের ১৭২ পৃষ্ঠায় নিম্নের হাদিসটিকে খুব জোরালোভাবে রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া থাকার পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। 

ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার লিখিত ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩৬৩ পৃষ্ঠায়ও এটিকে ছায়া থাকার পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। তিনি এটিকে জোরালোভাবে লিখেছেন-‘‘এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটি সহীহ।’’

আমরা দেখবো যে প্রকৃতপক্ষে হাদিসটির মান কি। 


❏ ইমাম আহমদ (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

حَدَّثَنَا عَفَّانُ، حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، قَالَ حَدَّثَنَا ثَابِتٌ: عَنْ سُمَيَّةَ، عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ فِي سَفَرٍ لَهُ،... قَالَ: فَتَرَكَهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَا الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمَ شَهْرَيْنِ، أَوْ ثَلَاثَةً، لَا يَأْتِيهَا، قَالَتْ: حَتَّى يَئِسْتُ مِنْهُ، وَحَوَّلْتُ سَرِيرِي، قَالَتْ: فَبَيْنَمَا أَنَا يَوْمًا بِنِصْفِ النَّهَارِ، إِذَا أَنَا بِظِلِّ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُقْبِلٌ

-“হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সফরে ছিলেন।... তিনি বলেন: রাসূলে পাক (ﷺ) তাকে (যায়নবকে) রাগ করে জিলহজ্জ ও মর্হারামের দুই অথবা তিন মাস তার কাছে আসেননি। এমনকি আমরা নিরাশ হয়ে গেলাম। আমার মনের অবস্থাও পরিবর্তন হয়ে গেল। ফলে একদা আমি মধ্য বেলায় তাঁর কাছে ছিলাম। যখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আগত সময়ে ছায়া দিলেন।”  (মুসনাদে আহমদ, হা/২৫০০২)


এখানে ‘ছায়া দিলেন’ এর ভাবার্থ হল ‘তাকে আশ্রয় দিলেন’। কেননা পরিত্যাগ করার পর ছায়া দেওয়ার অর্থ হল আশ্রয় দেওয়া। আর ظِلّ (জিল্লুন) এর আরেকটি অর্থ হল আশ্রয় দেওয়া। 


❏ মুসনাদে আহমদে আরেকটি রেওয়াতে আছে,

فَلَمَّا كَانَ شَهْرُ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ، دَخَلَ عَلَيْهَا، فَرَأَتْ ظِلَّهُ، فَقَالَتْ: إِنَّ هَذَا لَظِلُّ رَجُلٍ، وَمَا يَدْخُلُ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَنْ هَذَا؟ فَدَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،

-“যখন রবিউল আওয়াল মাস আসল তখন আমি রাসূল (ﷺ) এর ছায়া দেখতে পেলাম। তিনি (যায়নব) বলেন: নিশ্চয় ইহা একজন পুরুষ ব্যক্তির ছায়া, অথচ আল্লাহর নবী (ﷺ) আমার কাছে আসেনি, তাহলে এটা কে? অত:পর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রবেশ করলেন।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৬৮৬৬) 


❏ উল্লেখ্য যে, হাদিসের শেষের অংশটুকু অর্থাৎ 

فَقَالَتْ: إِنَّ هَذَا لَظِلُّ رَجُلٍ، وَمَا يَدْخُلُ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَمَنْ هَذَا؟ فَدَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، 

-“তিনি (যায়নব) বলেন: নিশ্চয় ইহা একজন পুরুষ ব্যক্তির ছায়া, অথচ আল্লাহর নবী (ﷺ) আমার কাছে আসেনি, তাহলে এটা কে? অত:পর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) প্রবেশ করলেন।”


সনদ পর্যালোচনা:


এই অংশটুকু ইমাম আহমদ (رحمة الله) এর কাছে বর্ণিত হলেও ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম ইবনে সা’দ (رحمة الله) এর ‘তাবাকাত’-এ এবং ইমাম তাবারানী (رحمة الله) এর ‘আওছাতে’ এই অংশটুকু উল্লেখ করা হয়নি। ফলে এই অংশটুকু ‘শায’ অথবা ‘মুনকার’ হলে গন্য হবে। কেননা এই অংশটুকু যদি ঐ হাদিসের অংশ হত তাহলে ইমাম ইবনে সা’দ ও ইমাম তাবারানী (رحمة الله) এর কাছেও ইহা বর্ণিত হত। এতে বুঝা যাচ্ছে এই অংশটুকু নিশ্চয় কোন রাবী বাড়িয়ে বর্ণনা করেছেন। 


● ইমাম তাবারানী (رحمة الله) হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন,

لَمْ يَرْوِ هَذَيْنِ الْحَدِيثَيْنِ عَنْ ثَابِتٍ إِلَّا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ 

-“এই দুইটি রেওয়াত ছাবেত বেনানী থেকে হাম্মাদ ইবনে সালামা ব্যতীত কেউ বর্ণনা করেনি।” (ইমাম তাবারানী: মুজামুল আওছাত, হাদিস নং ২৬০৯)  


এদিকে বিবেচনা করে রেওয়াতটি গরীব বা একক বর্ণনা, যা কখনো দলিল হতে পারে না। এ হাদিসের গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাকারী ‘হাম্মাদ ইবনে সালামা’ যদিও কেউ কেউ তাকে সিক্বাহ বলেছেন কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একমত তার শেষ বয়সে স্মৃতি বিকৃতি ঘটেছিল। ইমামগণ তার বর্ণনাকে ত্রুটিযুক্ত বলেছেন। 


● যেমন তার সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন: وكان ثقه، له أوهام، -“সে বিশ^স্ত কিন্তু তার বর্ণিত হাদিসে ক্রুটি রয়েছে।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল ইতিদাল, রাবী নং ২২৫১)


● যেমন বিখ্যাত আসমউর রিজালবিদ ও হাদিসের ইমাম, ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) ‘হাম্মাদ বিন সালামা’ -এর জীবনীতে লিখেন- كَانَ يخطىء-‘‘তিনি হাদিসে ভুল করতেন।’’  ২০১

২০১.ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস-সিকাত, ৬/২১৬ পৃ. হা/৭৪৩৪, ইমাম মিয্যী, তাহযিবুল কামাল, ৭/২৬৭ পৃ.


তিনি আরও উল্লেখ করেন- قد كثر من تغير حفظه -‘‘তিনি স্মৃতি শক্তিতে অনেক দুর্বল ছিলেন।’’ ২০২

২০২.ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস-সিকাত, ৬/২১৬ পৃ. হা/৭৪৩৪


● ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন-

وقال البيهقي هو أحد أئمة المسلمين إلا أنه لما كبر ساء حفظه فلذا تركه البخاري وأما مسلم فاجتهد

-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বলেন, তিনি মুসলমানদের আইম্মাদের একজন হলেও বৃদ্ধ বয়সে তার স্মরণশক্তি ত্রুটি পাওয়া যায়। এজন্য ইমাম বুখারী (رحمة الله) তার হাদিস পরিত্যাগ করেছেন তবে ইমাম মুসলিম (رحمة الله) তার হাদিস (নেয়া যাবে কিনা) নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন।’’ ২০৩

২০৩. ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযিবুত-তাহযিব, ৩/১৪ পৃ. ক্রমিক.১৪


● ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) আরও উল্লেখ করেন-

قال أبو دواد: وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كِتَابٌ إِلا كِتَابَ قَيْسِ بْنِ سَعْدٍ الْمَكِّيِّ، يَعْنِي كَانَ حَافِظًا يَرْوِي مِنْ حِفْظِهِ.

-‘‘ইমাম আবু দাউদ (رحمة الله) বলেন, কায়েস ইবনে সা‘দ মাক্কী এর পান্ডুলিপি ব্যতিত তার অন্য  কোন পান্ডুলিপি নেই, এর অর্থ হল তিনি ঐ পান্ডুলিপির হাফেজ ছিলেন।’’২০৪

২০৪. যাহাবী, তারিখুল ইসলাম, ৪/৩৪২ পৃ.


● ইমাম যাহাবী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন-

وقال يحيى القطان: حماد بن سلمة، عن زياد الاعلم. وقيس بن سعد ليس بذاك.

-‘‘ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে কাত্তান (رحمة الله) বলেন, হাম্মাদ বিন সালামা  তিনি যিয়াদ  থেকে এবং কায়েস বিন সা‘দ (رحمة الله) থেকে যে হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন তা কিছুই নয়।’’  ২০৫

২০৫. যাহাবী, মিযানুল ই‘তিদাল, ১/৫৯২ পৃ. ক্রমিক.২২৫১


● যাহাবী তার আরেকটি গ্রন্থে লিখেছেন-

قلت هو ثقة صدوق يغلط وليس في قوة

-‘‘আমি বলি যদিও তিনি সিকাহ ও বিশ্বস্ত তবে তিনি হাদিসে ভুল করতেন এবং তিনি হাদিসে তেমন শক্তিশালী নন।’২০৬  

২০৬. যাহাবী, কাশেফ, ১/৩৪৯ পৃ. ক্রমিক/১২২০


● এজন্যই ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেছেন- وتغير حفظه بأخرة -‘‘তার শেষ বয়সে স্মৃতি শক্তিতে দুর্বল ছিল।’’ (ইবনে হাজার, তাক্বরীবুত তাহযিব, ১৭৮ পৃ. ক্রমিক.১৪৯৯) 


● এমনকি আহলে হাদিস আলবানী রাবী হাম্মাদ সম্পর্কে লিখেন-

أن حماد له أوهاما.

-‘‘নিশ্চয় হাম্মাদের বিষয়ে ক্রুটি রয়েছে।’’ (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ, ২/৩৩ পৃ. হা/৯৩০) 


উল্লেখ্য যে, এই হাদিসের বর্ণনাকারী سُمَيَّةُ ‘সুমাইয়্যা’ সম্পর্কে ইমাম শামছুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) বলেন: لا تعرف -“তাকে চিনিনা।” (ইমাম যাহাবী: মিযানুল ইতিদাল, রাবী নং ৩৫৫৮)


কোন কোন সূত্রে দেখা যায় سُمَيَّةُ ‘ছুমাইয়্যা’ এর স্থানে شُمَيْسَةُ ‘সুমাইছাহ’ এর নাম। মূলত হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে ‘ছুমাইয়্যা’ এর সূত্রে। 


● কেননা ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ছানআনী (رحمة الله) স্পষ্ট করেই বলেছেন: 

قَالَ عَبْدُ الرَّزَّاقِ: هُوَ فِي كِتَابِي سُمَيَّةُ، عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَيٍّ،

-“ইমাম আব্দুর রাজ্জাক বলেন: ইহা আমার কিতাবে আছে ছুমাইয়্যা বর্ণনা করেছেন ‘সাফিয়া বিনতে হুয়াই’ হতে।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৬৮৬৬)


❏ এ জন্যেই ইমাম আহমদ হাদিসটি বর্ণনার সময় সন্ধিহান হয়ে দু’টি নামই উল্লেখ করেছেন এভাবে: حَدَّثَتْنِي شُمَيْسَةُ، أَوْ سُمَيَّةُ 

-“আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেছেন ‘সুমাইছাহ অথবা ছুমাইয়্যা’।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ২৬৮৬৬)


নিশ্চয় এখানে شُمَيْسَةُ ‘সুমাইছাহ’ এর নামটি যোগ করেছেন বর্ণনাকারী ‘জাফর ইবনে সুলাইমান’। 


● কারণ ‘জাফর ইবনে সুলাইমান’ এর ব্যাপারে ইমাম ইবনে সা’দ (رحمة الله) বলেন: ثِقَةٌ، فِيْهِ ضَعْفٌ. -“সে বিশ্বস্ত এবং তার মাঝে দুর্বলতা রয়েছে।” (ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ৩৬)


ইমাম ইয়াহইয়া কাত্তান (رحمة الله) তার থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করতেন না এমনকি তার হাদিস লিখতেনও না। 


● ইমাম বুখারী (رحمة الله) বলেছেন:

قَالَ البُخَارِيُّ: جَعْفَرُ بنُ سُلَيْمَانَ الحَرَشِيُّ يُخَالِفُ فِي بَعْضِ حَدِيْثِهِ.

-“ইমাম বুখারী  বলেন: জাফর ইবনে সুলাইমান হারাশী কোন কোন হাদিসে খেলাফ বা বিরোধপূর্ণ বর্ণনা করতেন।” (ইমাম যাহাবী: সিয়ারে আলামিন নুবালা, রাবী নং ৩৬)


وَقَالَ السَّعْدِيُّ: رَوَى مَنَاكِيْر -

● “ইমাম সা’দী বলেন: সে মুনকার রেওয়াত বর্ণনা করত।” (ইমাম যাহাবী: সিয়ারু আলামিন নুবালা, রাবী নং ৩৬)


অতএব, এই হাদিস অত্যন্ত দুর্বল যা হুজ্জাত হওয়ার যোগ্য নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, হযরত ছাবেত বেনানী  বর্ণনা করেছেন মাজহুল বা অপরিচিত রাবী ‘ছুমাইয়্যা’ থেকে আর মাজহুল রাবী থেকে ছাবেত বেনানী (رحمة الله) এর রেওয়াত প্রতিষ্ঠিত বা নির্ভরযোগ্য নয়। 


● যেমন ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) বলেন:

وأحاديثه مستقيمة إذا روى عنه ثقة، -

“যখন সে বিশ্বস্ত রাবী থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তখন হাদিস গুলো প্রতিষ্ঠিত হবে।” (ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৮১১)


এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, হাদিসটি হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত কিনা সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ প্রথম অবস্থায় ‘সুমাইছাহ’ মা আয়েশা (رضي الله عنه) এর রেফারেন্স ছাড়াই বর্ণনা করেছেন। 


● যেমন লক্ষ্য করুন,

قَالَ عَفَّانُ: حَدَّثَنِيهِ حَمَّادٌ، عَنْ شُمَيْسَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ...

-‘‘আফ্ফান হাদিস বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ থেকে- তিনি সুমাইছাহ থেকে- তিনি নবী করিম (ﷺ) থেকে।... (মুসনাদে আহমদ, হা/২৫০০২)


এই দৃষ্টিতে হাদিসটি মুরসাল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, যা অন্য সহীহ্ ও প্রসিদ্ধ হাদিসের মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এই রেওয়াত দ্বারা রাসূলে পাক (ﷺ) এর ছায়া থাকার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ রেওয়াতটি বহুল সমালোচিত ও অনির্ভরযোগ্য।


শাব্দিক পর্যালোচনা:


এখানে ছায়া শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কারণ বর্ণনাকারী স্পষ্ট বলেছেন সে সময়টা ছিল نِصْف النَّهَارِ বা দিনের মধ্যবর্তী সময়। তখন সূর্য মাথার উপর থাকে। আর আমরা সবাই জানি দিনের মাঝামাঝি ছায়া সামনে বা পিছনে লম্বা হয় না। যার ফলে ছায়া দেখে দূর থেকে অনুভব করার কোন কথা সঠিক হতেই পারে না। 


রাসূল (ﷺ) এর ছায়া না থাকার আরও কিছু গ্রহণযোগ্য প্রমাণ:


হাদিস নং-১:


❏ বিশ্ববিখ্যাত উসূলবিদ আল্লামা আবুল বারাকাত আন্-নাসাফী (رحمة الله) যিনি সবার নিকটই গ্রহণযোগ্য তার তাফসীর গ্রন্থে একটি হাদিস উল্লেখ করেন- 

وقال عثمان إن الله ما أوقع ظلم على الأرض لئلا يضع إنسان قدمه على ذلك الظل

-‘‘আমিরুল মুমিনীন হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান (رضي الله عنه) বলেন হুযূর(ﷺ)এর ছায়া আল্লাহ্ যমিনে ফেলেননি যাতে কোন মানুষ তার ছায়ার উপর পা রাখতে না পারে।’’ ২০৭

২০৭. ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী, তাফসীরে মাদারিক, ২/৪৯২ পৃ.


হাদিস নং-২-৪


❏ যুগবরণ্য ইমাম সায়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (رحمة الله) ও বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম হাফেয ইবনে জাওযী (رحمة الله) হযরত সায়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে সহীহ সনদে বর্ণনা করেন- 

لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ الشَّمْسِ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ السِّرَاجِ

-‘‘হুযূর (ﷺ) এর ছায়া ছিল না। তিনি যখনই সূর্যের মুখোমুখি দন্ডায়মান হতেন তাঁর নূর সূর্যের আলোর উপর প্রবল থাকত এবং প্রদীপের আলোতে দন্ডায়মান হলে তাঁর নূরের দ্যুতি ওটার দীপ্তিতে ম্লান করে দিত।’’ ২০৮

২০৮. 

ক. ইমাম ইবনে জাওযী, আল-ওফা বি আহওয়ালিল মুস্তফা, ৪১২ পৃ.

খ. আল্লামা জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ৪/২২০ পৃ.

গ. ইমাম মুনাদী : শরহে শামায়েল : ১/৪৭ পৃ

ঘ. আল্লামা শফী উকাড়ভী : জিকরে জামীল : ৩২৪ পৃ

ঙ. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, জামেউল ওয়াসায়িল : ১/২১৭ পৃ.


ইমাম ইবনুল জাওযী  (ওফাত. ৫৯৭ হি.) সনদবিহীন হাদিস উল্লেখ পছন্দ করতেন না, তবে তিনি এ হাদিসটির কোন সনদ উল্লেখ করেননি। আমরা অনুসন্ধান করতে গিয়ে এটির দুটি সূত্র পেয়েছি। ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (رحمة الله) হতে ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর দূরুত্ব বেশি দিনের নয়। হয়তো বা তিনি তার ছাত্রের ছাত্রদের থেকে হাদিস শুনেছেন। অনেকে হয়তো বলতে পারেন ইবনে মোবারকের কথা তো কেউ বলেনি আপনি ভুল তথ্য দিচ্ছেন কেন! 


❏ আমি বলবো, ইমাম জুরকানী (رحمة الله) এ হাদিসটি উল্লেখ করার পূর্বে লিখেছেন-

روى ابن المبارك وابن الجوزي، عن ابن عباس

-‘‘ইমাম ইবনে মোবারক ও ইমাম ইবনে জাওযী (رحمة الله) হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন।’’ (জুরকানী, শারহুল মাওয়াহেব, ৫/৫২৫ পৃ. এবং ৭/২০০ পৃ.)


দ্বিতীয় সূত্র: 


❏ উক্ত হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর মতনের ও সনদের সমর্থনে অন্য একটি ধারায় এ হাদিসটি ইমাম তাকি উদ্দিন আহমদ ইবনে আলী মাকরীযী (رحمة الله) (ওফাত. ৮৪৫হি.) তিনি সনদটি বর্ণনা করেন এভাবে-

وقال أحمد بن عبد اللَّه الغدافي أخبرنا عمرو بن أبي عمرو عن محمد بن السائب عن أبي صالح عن ابن عباس رضي اللَّه عنه: لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ الشَّمْسِ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ السِّرَاجِ

-‘‘আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ গাদ্দাফী  বলেন, আমাদেরকে আমর ইবনে আবি আমর  হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাকে মুহাম্মদ ইবনুস সায়িব হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাকে (তাবেয়ী) আবু সালেহ  বর্ণনা করেছেন, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) এর ছায়া ছিল না। তিনি যখনই সূর্যের মুখোমুখি দন্ডায়মান হতেন তাঁর নূর সূর্যের আলোর উপর প্রবল থাকত এবং প্রদীপের আলোতে দন্ডায়মান হলে তাঁর নূরের জ্যোতি ওটার দীপ্তিতে ম্লান করে দিত।’’ ২০৯

২০৯. আল্লামা ইমাম মাকরীযী, ইমতাউল আসমা‘আ বিমা লিন্নাবিয়্যি মিনাল আহওয়াল, ২/১৭০ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন। এ হাদিসটির অনুবাদ একাধিক বার দেয়া হয়েছে, এ জন্য এখানে পুনরায় দেয়া হয়নি।

 

তৃতীয় সূত্র:


❏ ইমাম আব্দুর রায্যাক (رحمة الله) হাদিস বর্ণনা করেছেন-

عن عبد الرزاق عن ابن جريج قال : اخبرنى نافع أن ابن عباس قال : لَمْ يَكُنْ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ ظِلٌّ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ شَمْسٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ الشَّمْسِ، وَلَمْ يَقُمْ مَعَ سِرَاجٍ قَطُّ إِلَّا غَلَبَ ضَوْءُهُ ضَوْءَ السِّرَاجِ

-‘‘ইমাম আব্দুর রায্যাক (رحمة الله) ইবনে যুরাইজ (رحمة الله) হতে তিনি হযরত নাফে (رضي الله عنه) হতে তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,  হুযূর (ﷺ) এর কোনো ছায়া ছিল না,  তাঁর ছায়া সূর্যের আলোতে পড়তো না বরং তাঁর নূরের আলো সূর্যের আলোর উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতো এবং কোন বাতির আলোর সামনে দাঁড়ালেও বাতির আলোর উপরে তাঁর নূরের আলো প্রাধান্য বিস্তার করতো।’’ ২১০

২১০. ইমাম আব্দুর রায্যাক : জযউল মুফকুদ মিন মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক : ৫৬ পৃ. হা/২৫


এ হাদিসটির সনদ নিয়ে কোন সমস্যা নেই, তবে এটি ইমাম আব্দুর রায্যাক (رحمة الله)-এর প্রকাশিত ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে নেই; রয়েছে ‘জুযউল মাফকুদে’ সামনে এ কিতাবের গ্রহণযোগ্যতা আলোকপাত করা হবে।


এ বিষয়ে বিভিন্ন ইমাম, মুহাদ্দিস, ইতিহাসবিদদের অভিমত:


❏ নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, হাফেযুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (ওফাত. ৯১১ হি.) তার ২০ বছরের শ্রম সাধনার কিতাব ‘খাসায়েসুল কোবরা’ নামক কিতাবে একটি অনুচ্ছেদ কায়েম করেন এভাবে-

بَاب الْآيَة فِي أَنه صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لم يكن يرى لَهُ ظلّ

-‘‘অনুচ্ছেদ: রাসূল (ﷺ)-এর ছায়া যমীনে দেখা যেত না।’’ (ইমাম সুয়ূতি, খাসায়েসুল কোবরা, ১/১১৬ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।) 


❏ মরক্কো ও স্পেনের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস হলেন ইমাম কাযী আয়ায (ওফাত. ৫৪৪ হি.)। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কিতাব হিসেবে ‘আশ শিফা বিতা‘রীফি হুকুকিল মুস্তফা ’ ধরা হয়। তিনি তাঁর উক্ত কিতাবে রাসূল (ﷺ)-এর মু‘জিযা, বৈশিষ্ট ও অলৌকিকত্ব বিষয়ক আলোচনায় বলেন, 

 وَمَا ذُكِرَ من أنَّهُ كَانَ لَا ظل شخصه فِي شَمْسٍ وَلَا قَمَرٍ لِأَنَّهُ كَانَ نُورًا وَأَنَّ الذُّبَابَ كَانَ لَا يَقَعُ عَلَى جَسَدِهِ وَلَا ثِيَابِهِ-

-‘‘তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রমাণাদির মধ্যে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর শরীর মোবারকের ছায়া হতো না, না সূর্যালোকে না চন্দ্রালোকে। কারণ তিনি ছিলেন নূর। তাঁর শরীর ও পোষাকে মাছি বসত না।’’ ২১১

২১১. ইমাম কাজী আয়ায : শিফা শরীফ, ১/৪৬২ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, ইমাম সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, ৮৫ পৃ. হা/১২৬


❏ হাফেযুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান সুয়ূতি (رحمة الله) লিখেন-

قَالَ ابْن سبع من خَصَائِصه ان ظله كَانَ لَا يَقع على الأَرْض وَأَنه كَانَ نورا فَكَانَ إِذا مَشى فِي الشَّمْس أَو الْقَمَر لَا ينظر لَهُ ظلّ

-‘‘হযরত ইবনে সাবা (رحمة الله) বলেছেন, এটা হুযূর (ﷺ) বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্তর্গত যে,  হুযূর (ﷺ) এর ছায়া যমীনে পড়তো না এবং তিনি ছিলেন সম্পূর্ন নূর। তিনি যখন হাটতেন সূর্যালোকে অথবা চন্দ্রালোকে তাঁর ছায়া দেখা যেত না।’’ ২১২

২১২. 

ক. আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ১/১১২ পৃ. হা/৩২৮

খ. আল্লামা ইমাম জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ৪/২০২ পৃ.

গ. ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরেলভী : নুরুল মোস্তফা : পৃ-৮২

ঘ. আল্লামা মাহদী আল-ফাসী : মাতালিউল মুর্সারাত, পৃ-৩৬৫

ঙ. শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী : হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামিন, ৬৬৮ পৃ.

চ. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী : মাদারেজুন নবুওয়াত : ১/১৪২ পৃ.


❏ ‘শিফা শরীফের’ সম্মানিত ব্যাখ্যাকারদের অন্যতম আল্লামা ইমাম শিহাবুদ্দিন খিফ্ফাযী মিশরী (رحمة الله) ইমাম কাযি আয্যাযের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন, হুযূর (ﷺ) এর ছায়া মোবারক তাঁর মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে যমীনে ফেলা হয়নি। অথচ সমস্ত মানুষ তাঁর ছায়ায় বিশ্রাম করছে। অতঃপর বলেন, কুরআনুল করীমের উক্তি মতে তিনি উজ্জ্বল নূর এবং নূরের কোন ছায়া থাকে না। ২১৩

২১৩. ইমাম শিহাবুদ্দিন খিফ্ফাযী, নাসিমুর রিয়াদ্ব, ১/২৪২ পৃ. এবং ৩/২৮২ পৃ.


❏ বুখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণেতাদের অন্যতম, ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ কাস্তালানী (رحمة الله) এ বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করেন এভাবে,  

لَمۡ یَکُنۡ لَه ﷺ ظِلُّ فِی شَمْسٍ وَلَا قَمَرٍ

-‘‘বিশ্বকুল সরদার হুযূর (ﷺ) এর ছায়া, না সূর্যালোকে ছিল, না চন্দ্রালোকে।’’ ২১৪

২১৪. 

ক. আল্লামা ইমাম কাস্তাল্লানী : মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া : ২/৮৫ পৃ.

খ. আল্লামা জুরকানী : শরহুল মাওয়াহিব, ৪/২২০ পৃ.


❏ আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল বাকী যুরকানী (رحمة الله) ইমাম কাস্তালানীর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন,

ولم يكن له -صلى الله عليه وسلم- ظل في شمس ولا قمر لِأَنَّهُ كَانَ نُورًا

-‘‘হুযূর (ﷺ) এর ছায়া,  না সূর্যালোকে ছিল,  না চন্দ্রালোকে। তার কারণ তিনি ছিলেন নূর।’’  ২১৫

২১৫. আল্লামা জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ৫/৫২৪ পৃ:


❏ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের অন্য স্থানে লিখেন-

رواه البيهقى، ولم يقع له ظل على الأرض، ولا رؤى له ظل فى شمس ولا قمر

-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন যে চাঁদ সূর্যের আলোতে রাসূল এর ছায়া দেখা যেত না।’’  ২১৬

২১৬. 

ক. ইমাম কাস্তাল্লানী : মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া, ২/৩৪৩ পৃ.

খ. আল্লামা জুরকানী : শরহুল মাওয়াহিব, ৪/২২০ পৃ.


❏ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) আরও বলেন,

فكان إذا مشى فى الشمس أو القمر لا يظهر له ظل. قال غيره: ويشهد له قوله- صلى الله عليه وسلم- فى دعائه: واجعلنى نورا

-‘‘তিনি যখন হাটতেন সূর্যালোকে অথবা চন্দ্রালোকে তাঁর ছায়া দেখা যেত না। এ কথার সাক্ষ্য দেয় রাসূল (ﷺ) এর বুখারী শরীফের এ হাদিস যে হে আল্লাহ্! তুমি আমাকে নূর বানিয়ে দাও।’’ ২১৭

২১৭. 

ক. আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ১/১১২ পৃ. হা/৩২৮

খ. আল্লামা জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ৪/২০২ পৃ.

গ. ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরেলভী : নুরুল মোস্তফা : পৃ-৮২

ঘ. আল্লামা ইমাম ফার্সী : মাতালিউল মুর্সারাত শরহে দালায়েলুল খায়রাত : পৃ-৩৬৫

ঙ. শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী : হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামিন-৬৬৮ পৃ.

চ. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : মাদারেজুন নবুওয়াত : ১/১৪২ পৃ.


❏ বিখ্যাত ঐতিহাসিক, সিরাতবিদ, আল্লামা হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ দিয়ারবকরী (ওফাত. ৯৬৬ হি.) বলেন,

لَم یقَع ظِلُه علَی الاَرضِ وَلا راِیَ لَه ظِل  فى شَمۡسٍ وَلَا قَمَرٍ

-‘‘হুযূর (ﷺ) এর ছায়া যমীনে পড়তো না,  আর তার ছায়া না সূর্যালোকে দেখা যেতো,  না চন্দ্রালোকে।’’ ২১৮

২১৮. আল্লামা হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ দিয়ার বকরী : তারীখুল খামীস ফি আহওয়ালি আনফাসে নাফীস : ১/২১৯ পৃ.


❏ বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফেযুল হাদিস, আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) বলেন,

وَمِمَّا یُوَیِدُ اَنَّه ﷺ ضَاءَ نُورًا اَنَّه کَانَ اِذا مَشی فِی الشَّمسِ وَالقَمَرِ لَا یَظهرُ لَه ظِلٌّ لِاَنَّه لَایَظهرُ اِلَّا الکَشِیۡفِ وَهوَ صَلَّی اللہُ عَلَیۡه وَسَلَّمَ قَد خَلَصَه اَللہُ مِن سَائِرِ الکَثَافَاتِ الجِسمَانِیَّة وَصَیَّرَہ نُورًا صِرفًا لَایَظهرُ ظِلٌّ اَلًا

-‘‘হুযুরের সম্পূর্ণ নূর হওয়ার সমর্থন এ থেকে হয় যে,  সূর্যালোকে কিংবা চন্দ্রালোকে তাঁর ছায়া হতো না। কারণ ছায়া তো হয় জড় দেহের আর হুযূর (ﷺ) কে আল্লাহ্ তা‘য়ালা সকল শারীরিক জড়তা থেকে নিখূঁত করতঃ সম্পূর্ণ নূরে পরিণত করেছিলেন। অতএব হুযূর (ﷺ) এর কোন ছায়া ছিল না।’’ ২১৯

২১৯. আল্লামা ইমাম ইবনে হাজার মক্কী : আফযালুল র্কুরা, ১৮৬ পৃ.


❏ আল্লামা সোলায়মান জামাল (رحمة الله) বলেন,  

لَم يكن له صلى الله عليه وسلم ظل يظهر فى شمس ولا قمر

-‘‘হুযূর (ﷺ) এর ছায়া না সূর্যালোকে হতো এবং না চন্দ্রালোকে।’’ ২২০

২২০. আল্লামা সোলায়মান জুমাল : ফুত‚হাতে আহমদিয়া : ৫ পৃ.


❏ বিখ্যাত সূফি, দার্শনিক, আল্লামা জালালুদ্দীন রূমী (رحمة الله) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মসনবী শরীফে’ এ বিষয়ে বলেন,  

چوں فناشى از فقر پیرایہ بود

اومحمد دار بے سایہ بود

-‘‘যেহেতু খোদাপ্রেমে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর বিলীনতা দারিদ্র্যে সুশোভিত ছিল। সুতরাং তিনি ছায়া বিহীন ঘর স্বরূপ হন।’’ ২২১

২২১. মাওলানা রূমী : মসনভী শরীফ : পঞ্চশ দফতর : ৭৭ পৃ.


❏ মাওলানা বাহরুল উলূম (رحمة الله) মসনবী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন,  

درمصرع ثانی اشارہ بہ معجزہ آں سرو صلی اللہ علیہ وسلم کہ آں سرو را سایہ نہ می افتاد

-‘‘দ্বিতীয় পংক্তিতে বিশ্বকুল সরদার হুযূর (ﷺ) এর মু‘জিযার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, হুযূরের ছায়া ছিল না।’’


❏ শায়খুল মুহাদ্দিসীন হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) বলেন, 

ونبود مر آں حضرت صلی اللہ علیہ وسلم را سایہ در آفتاب نہ در قمر

-‘‘নূরে মুজাস্সাম (رحمة الله) এর ছায়া না সূর্যালোকে ছিল,  না চন্দ্রালোকে।’’ ২২২

২২২. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী : মাদারিজুন্নবুওয়াত, ১/৪৩ পৃ.


❏ দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (رحمة الله) এ বিষয়ে বলেন,

ادرا صلی اللہ علیہ وسلم سایہ نبود در عالم شہادت سایہ ہر شخص از شخص لطیف ترست چون لطیف تر از وے صلی اللہ علیہ وسلم در عالم نباشد اورا سایہ چہ صورت دارد؟

-‘‘হুযূর (ﷺ) এর ছায়া ছিল না,  কারণ ইহ জগতে প্রত্যেক ব্যক্তির ছায়া তাঁর চেয়েও সূ²তম হয়। যেহেতু হুযূর (ﷺ) অপেক্ষা সূ²তম কোন বস্তু জগতে নেই,  অতএব হুযুরের ছায়া কিরূপে হতে পারে ?’’ ২২৩

২২৩. আল্লামা ইমাম মুজাদ্দেদে আলফেসানী : মাকত‚বাত শরীফ : তৃতীয় খণ্ড, ৯৩ পৃ. 


❏ ১৩শ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) বলেন,

سایہ ایشاں بر زمین نمی افتاد

 -‘‘হুযূর (ﷺ) এর ছায়া যমীনে পড়তো না।’’ ২২৪

২২৪. শায়খ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভী : তাফসীরে আযীযী, সূরা ওয়াদ্দোহা, ৩/৩১২ পৃ.


❏ বিখ্যাত মুফাসসির, আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ পানিপতি (رحمة الله) বলেন,

اولیاء اللہ گفتہ اند ارواحنا اجسادنا واجسادنا ارواحنا یعنی ارواح ما کار اجساد می کنند وگاہے اجساد از غایت لطافت برنگ اوراح می براید ومی گویند کہ رسول خدا را سایہ نبود صلی اللہ علیہ وسلم

-‘‘আল্লাহর অলিগণ বলেন, আমাদের আত্মাসমূহ আমাদের দেহ এবং আমাদের দেহ সমূহ আমাদের আত্মা। অর্থাৎ-কোন কোন সময় আমাদের আত্মা দেহের কাজ করে এবং কোন কোন সময় আমাদের দেহ চূড়ান্ত সূ²তা অবলম্বন করতঃ আত্মারূপে প্রকাশিত হয়। এজন্যই হুযূর (ﷺ) এর ছায়া ছিল না।’’ ২২৫

২২৫. আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ পানীপথি : তাযকিরাতুল মাওতা ওয়াল কুবূর : পৃ-২১


❏ আল্লামা শায়খ ইউসুফ নাবহানী (رحمة الله)  বর্ণনা করেন-

وكان اذا مشى فى قمر او شمس لا يظهر له ظل-

-‘‘রাসূল (ﷺ) যখন চন্দ্র ও সূর্যের আলোতে হাটতেন তখন তার ছায়া প্রকাশ পেত না।’’ ২২৬

২২৬. শায়খ ইউসুফ নাবহানী, জাওয়াহিরুল বিহার, ১/৪৫৩ পৃ.


❏ বিরুদ্ধবাদীদের সরদার দেওবন্দী আকাবীরদের অন্যতম, মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী বলেন,

حق تعالی در شان حبیب خود صلی اللہ علیہ وسلم فرمود کہ آمدہ نزد شما از طرف حق تعالی نور وکتاب مبین ومراد از نور ذات پاک حبیب خدا صلی اللہ علیہ وسلم نیز فرمود کہ اے نبی ترا شاہد مبشر و نذیر وداعی الی اللہ وسراج منیر فرستادہ ایم ومنیر روشن کنندہ ونور دہندہ را گویند پس اگر کسے را روشن کردن از انساناں محال بودے آن ذات پاک صلی اللہ علیہ وسلم را ہم ایں امر میسر نیامد کہ آ ذات پاک صلی اللہ علیہ وسلم ہم از جملہ اولاد آدم علیہ السلام اند مگر آں حضرت صلى اللہ علیہ وسلم ذات خود را چناں مطہر فرمود کہ نور خالص گشتند وحق تعالی ان جناب سلامہ علیہ را نور فرمود وبہ تواتر ثابت شد کہ آں حضرت عالی سایہ نہ داشتند ظاہر است کہ بجز نور ہمہ اجسام ظل می دارند۔

-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ) এর শানে ফরমায়েছেন, তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট হতে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। নূর দ্বারা হাবীবে খোদা (ﷺ) এর পবিত্র সত্তাকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘য়ালা আরো ফরমায়েছেন,  হে নবী (ﷺ)! আমি তো আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী,  আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী এবং উজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজে মুনীর) রূপে পাঠিয়েছি। আর ‘মুনীর’ উজ্জ্বলকারী ও আলোকদাতাকে বলে। সুতরাং মানুষের মধ্যে কাউকে উজ্জ্বল করা যদি অসম্ভব হতো তাহলে হযরত (ﷺ) এর পবিত্র সত্তার অন্তর্গত কিন্তু তিনি (ﷺ) তাঁর মোবারক সত্তাকে এমনভাবে পবিত্র করেছেন যে, তিনি নিখুঁত নূরে পরিণত হন এবং আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাকে নূর ফরমায়েছেন। আর সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) এর ছায়া ছিল না এবং এটাও প্রকাশ্যমান যে,  নূর ব্যতীত সমুদয় জড় দেহের ছায়া থাকে।’’ ২২৭

২২৭. মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী : ইমদাদুস সুলূক, পৃ-৮৫


❏ দেওবন্দী আকাবীরদের অন্যতম, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী এ বিষয়ে মত প্রকাশ করে বলেন,

يہ بات مشہورہ كہ ہمارے حضور صلى الله عليه وسلم كہ  سايہ نہے تہا اسلئہ كہ ہمارے حضور صلى الله عليه وسلم سرپا نور ہے نور تہے-  

-‘‘এ কথা প্রসিদ্ধ যে, আমাদের হুযুর (ﷺ) এর ছায়া ছিল না। (কারণ) আমাদের হুজুর (ﷺ) এর আপাদমস্তক নূরানী ছিলেন। হুযুর (ﷺ) -এর মধ্যে নামমাত্রও অন্ধকার ছিল না। কেননা ছায়ার জন্য অন্ধকার অপরিহার্য।’’ ২২৮

২২৮. মাওলানা আশরাফ আলী থানবী : শুক্রুন নিমাতির বিযিকরির রাহমাতি, পৃ-৩৯

 
Top