মহিলাদের পোশাক


পোশাক-পরিচ্ছদ মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পোশাক দ্বারা মানুষের রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ পায়। পোশাক দ্বারা মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন ঢেকে রাখা ও সৌন্দর্যের উপকরণ তেমনি শরীয়তের দিক নিদের্শনা মেনে ব্যবহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। পোশাক-পরিচ্ছদের ভালোমন্দ মানুষের মধ্যে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্তর ও মন-মানসিকতায় গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।


পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও উপকারী।শরীয়ত বিশেষ কোন পোশাক সুনির্দ্দিষ্ট করে দেয়নি এবং কোন নির্দিষ্ট ডিজাইন বা আকৃতিও বলে দেয়নি। কারণ বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল, আবহাওয়া ও মৌসুমভেদে পোষাক পরিধানের স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে কিছু মৌলিক নীতি ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, এ ধরনের পোশাক গ্রহণীয় ও এ ধরনের পোশাক বর্জনীয়। সুতরাং মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে এসব নীতিমালা অনুসরণ করা আবশ্যক যা দ্বারা পোশাক-পরিচ্ছদের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন সাধিত হবে। 



মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরবে না শাড়ী ?


ডরশরঢ়বফরধ এর বর্ণনায় শাড়ী শব্দটি সংস্কৃত যার মানে ৩ থেকে ৪ ফুট প্রস্থ আর ১৮ থেকে ২০ ফুট দৈর্ঘের বস্ত্র খণ্ড যা ভারতবর্ষের মেয়েরা অঙ্গজুড়ে পরিধান করে। এর অনুসঙ্গ হিসাবে আরো দু’টি অন্তর্বাসের কথা বলা হয়েছে। একটি নীচের অংশ ‘পেটিকোট’ যা উত্তরে মারটি ভাষায় লেহাংগা, তামিলে পাভিল, তেলেগুতে পাভিলা পশ্চিমে ঘাঘরা আর পূর্ব ভরতে ‘ছায়া’ নামে পরিচিত। উপরের অংশের নাম সাধারণ ভাবে ব্লাউজ বলে। এই পোশাকটা ভরতীয় ধর্ম দর্শন অনুযায়ী সমস্ত দেবীদের প্রিয় পোশাক এবং এখনও পূজামন্ডপে স্থাপিত দেবী মূর্তির গায়ে শাড়ী পরিহিতা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০-১৮০০ শতকের মধ্যে ভারতের পশ্চিম অংশে এর প্রচলন ঘটে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ভারতীয় প্রাচীন ঐতিহ্য ‘নাট্যশাস্ত্রে’ মহিলাদের নাভিমূল হলো পবিত্রতা ও সৃষ্টিকুশলতার উৎস। সে কারণে শাড়ী পরিধানের সময় ঐস্থান উম্মুক্ত রাখতে হয়। শাড়ী পরিধানের এই ধরন ভারত , বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় এখনো প্রচলিত তবে কিতা হিন্দু ধর্মের দেবীদের অনুসরণ করে ? মুসলমান ঘরের মা-বোনদের শুধু এটুকু ভাবতে  বলবো শাড়ী যে তাদের পোশাক নয় তা তাদের বোধগম্য হওয়া প্রয়োজন। এই তিনটা দেশ ব্যতিত দুনিয়ার কোনো দেশের মুসলিম মেয়েদের পোশাকের তালিকায় শাড়ী নেই। এটা যারা হজ্জ্ব করেছেন তারা সাক্ষ্য দেবেন। শাড়ী মুসলমানদের পোশাক কখনোই ছিলনা, তবে শাড়ী পরা দোষের হতো না যদি এর দ্বারা পুরো শরীর, মাথা, ঘাড়, বুক ও পেট ঢেকে পরিধান করা হতো। শাড়ী পরিধানের ঢংটাই এমন যে, বুক, পিট ও পেট উদোম রাখতে হবে মাথা ও ঘাড়ে তা উঠবে না। পূজোর দিনে কেউ যদি মন্ডপে যেয়ে থাকেন তাহলে স্বরস্বতী, লক্ষীকে এই কায়দায় শাড়ী পরিহিতা পাবেন। তাহলে আমি একজন মুসলিম নারী হিসাবে যে কাপড়টা পরিচ্ছদ হিসাবে পরিধান করছি যার কাটিং এবং পরিধানের ঢং সম্পূর্ণ হিন্দু একজন দেবীর মত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)এরূপ পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন যা ভিন্ন ধমাবলম্বীরা পরিধান করে থাকে। আমি কি তবে ভিন্ন ধর্মানুসারীর পোশাকই পড়ছি ?


মূল কথা হলো নারীর পোশাক হতে হবে সালোয়ার কামিজ, লম্বা গাউন, পাজামা কামিজ যা দ্বারা চেহারা, হাতের তালু ও পায়ের সন্ধি বাদে সারা শরীর আবৃত হবে। এ জন্য কটন মোটা কাপড় নির্বাচন করা যেতে পারে। বর্তমান অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে এই পোশাকে কারো কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বউ হলে শাড়ী পরতেই হবে। নতুবা মুরুব্বীদের রোষানলে পড়তে হয়। তারা বলেন, শাড়ী পরিধান না করলে নাকি বউয়ের মতো লাগেনা। অনেক নতুন বধু শাড়ী পরতেও জানেনা। তবু অভিজ্ঞ নারীর সাহায্যে কিংবা পার্লারে গিয়ে হলেও শাড়ী পরতেই হবে। শাড়ী লম্বায় বার হাত হলেও এর পরার ভঙ্গিমা কোনভাবেই পর্দার চাহিদাও শর্ত পূরণ করে না। অন্যদিকে বিকল্প পোশাকগুলো পরলে একদিকে কাপড়ের সাশ্রয় অন্যদিকে কাজের পক্ষে সহায়ক এবং পর্দার বিধানও পূর্ণ হয়।


নারীর পোশাক এমন আঁট সাঁট ও ছোট মাপের হতে পারেবে না। যা পরলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে এবং দৈহিক গঠন ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে উঠে। 


এ প্রসঙ্গে হযরত আবু ইয়াযিদ মুযানী (رحمة الله) বলেন, হযরত ওমর  (رضي الله عنه) মহিলাদেরকে কাবাতী (মিসরে প্রস্তুতকৃত এক ধরণের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ত্বক দেখানা গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে উঠে। ২২১

২২১.আবু বকর আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ র. মুসান্নিফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং ২৫২৮৮

  

নারীর পোশাক খুব পাতলা ও মিহি না হওয়া উচিত যা দ্বারা শরীর দেখা  যায় এবং সতর প্রকাশ পায়। অবশ্য পাতলা কাপড়ের নীচে যদি সেমিজ জাতীয় কিছু ব্যবহার করে তবে আপত্তি নেই। 


এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আবু আলকামা তার মা থেকে বর্ণনা করেন, একবার  হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মু’মিন হযরত আয়িশা  (رضي الله عنه)’র নিকট বেড়াতে এলেন। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। হযরত আয়িশা   (رضي الله عنه) তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন। ২২২

২২২.ইমাম মালিক র. (১৭৯ হি.) মুয়াত্তা, খণ্ড.২, পৃ. ৯১৩

 

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ، دَخَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهَا ثِيَابٌ رِقَاقٌ، فَأَعْرَضَ عَنْهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَقَالَ: يَا أَسْمَاءُ، إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَا وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ 

হযরত আয়িশা  (رضي الله عنه) হতে বণিত একদা (আমার বোন) আসমা বিনতে আবু বকর  (رضي الله عنه) পাতলা কাপড়ে পরিহিতা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র নিকট প্রবেশ করলেন। তিনি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, হে আসমা ! মেয়েরা যখন বালিগা হয়, তখন শরীরের কোনো অঙ্গ প্রকাশ পাওয়া উচিত নয়, তবে কেবল মাত্র চেহারা ও হাতের কব্জি ব্যতিক্রম। ২২৩

২২৩.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ

 

নারী পুরুষের পোশাক পরিধান করতে পারবে না। অনুরূপ ভাবে পুরুষও নারীর পোশাক পরতে পারবে না। অর্থাৎ একে অপরের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করতে পারবে না

।عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ : لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ 

হযরত ইবনে আব্বাস  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐসব পুরুষকে অভিশাপ দিয়েছেন যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। ২২৪

২২৪.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.), সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫৪৬৫

 

হযরত হোরায়রা  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-

 صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا 

আমি জাহান্নামীদের দু’টি দলকে এখনো পর্যন্ত দেখিনি। একদল এমন যাদের গরুর লেজের ন্যায় লাঠি হবে। এর দ্বারা মানুষকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে। দ্বিতীয় দল ঐসব মহিলা যারা কাপড় পরিধান করবে কিন্তু মূলত তারা দ্বিগম্বর। তারা পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য কাপড় পরিধান করবে। এ সব মহিলাদের মাথা হবে উটের কুঁজের ন্যায় যা ঝুঁকে থাকবে। এ সব মহিলারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবেনা। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ অনেক দূর থেকে (পাঁচশ বছরের দূরত্ব থেকে) পাওয়া যাবে। ২২৫

২২৫.ইমাম মুসলিম র. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, খণ্ড.২, পৃ.২০৫

 

হযরত দিহিয়া ইবনে খলীফা  (رضي الله عنه) থেকে বণির্ত, তিনি বলেন, একদা নবী করিম (ﷺ)’র একটি কিবতী কাপড় আসে। (যা ছিল অতি মিহি) তিনি কাপড়খানা আমাকে দিয়ে বললেন- এটাকে দু’টুকরা করো। এক অংশ দিয়ে তোমার নিজের জামা তৈরী করো এবং অপর অংশ তোমার স্ত্রীকে দিও, যেন উহা দ্বারা ওড়না তৈরী করতে পারে। অতঃপর সে যখন কাপড়টা নিয়ে যেতে লাগল তখন তিনি বললেন-

 وأمر امرأتك ان تجعل تحته ثوبا لا يصفها 

তোমার স্ত্রীকে আদেশ করবে যেন এই কাপড়ের নীচে আস্তর লাগিয়ে ব্যবহার করে , যাতে শরীর দেখা না যায়। 


সতর ঢাকার জন্য পায়জামা হলো সর্বোত্তম পোশাক। লুঙ্গী, পেটিকোট অনেক সময় খুলে যায় কিংবা বাতাসে উল্টে যায়, ফলে সতর প্রকাশ হয়ে যায়। হযরত আলী  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা প্রবল বর্ষনের সময় আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র পাশে বাকী নামক স্থানে বসা ছিলাম। এমন সময় একজন মহিলা অতিক্রম করল যার মাথায় বোঝা ছিল। তার গাধাটি মাটির গর্তে পড়ে গেল। ফলে মহিলাটিও মাটিতে পড়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)দ্রুত মহিলার দিক থেকে তাঁর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। তখন অমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ! মহিলাটি তো পায়জামা পরিহিতা। তিনি বললেন-

 اللهم اغفر للمسر ولاف من امى ثلاثا ياايها الناس اتخذوا السرا ولات فانها من استر ثيابكم وحضوابها نسامكم اذا خرجن قال الشيخ احمد رحم الله المتسرولات 

–হে আল্লাহ ! আমার উম্মতের যারা পায়জামা পরিধান করবে তাদের আপনি ক্ষমা করে দিন। তিনি এই দোয়া তিনবার করেছিলেন। তারপর বলেছেন, হে লোক সকল ! তোমরা পায়জামার প্রচলন কর। কেননা পায়জামা তোমাদের পোশাকের মধ্যে পর্দা করার ক্ষেত্রে অধিক উপযুক্ত। আর তোমরা তোমাদের নারীদের উৎসাহিত কর তারা যেন প্রয়োজনে  বাইরে গেলে পায়জামা পরিধান করে। 


শায়খ আহমদ (رحمة الله) বলেন, অন্য বর্ণনায়  এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)পায়জামা পরিহিতা মহিলাদের জন্য রহমতের দোয়া করেছেন।২২৬

২২৬.মুজমায়া, খণ্ড. ৫,প.১২৩ ও আদাবে বায়হাকী, পৃ. ৩৫৮

 
Top