বেগানা নারীকে দেখা, কথা বলা, উঠা-বসা করা সর্বশেষ ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া 


এ সবকিছু হারাম, কিন্তু বক্ষমান আয়াতে দেখা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার কথা উল্লেখিত হয়েছে। কারণ চোখে দেখা হলো পাপের সূচনা আর ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া হলো এর পরিণতি। এখানে প্রথম ও শেষটা উল্লেখ করে এ উভয়ের মাঝখানের সবকিছু হারামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।


নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার প্রথম ধাপ হলো দৃষ্টি। তাই এই অপকর্মের সূচনাকেই বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এখানে দৃষ্টি সংযত রাখার কথা বলা হয়েছে। 


উপরিউক্ত আয়াতে নারীদের দৃষ্টি ও লজ্জাস্থান সংযত ও হেফাযত করতে বলা হয়েছে কিন্তু এর পূর্বের আয়াতে পুরুষদের দৃষ্টি ও যৌনাঙ্গের হেফাযত করার কথা বলা হয়েছে। কারণ ব্যভিচারের সূচনা নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষে হতে পারে। হযরত হাসান বসরীর  মুরসালরূপে বর্ণনা করেন-

قَالَ: بَلَغَنِي أَنَّ رَسُولَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:لَعَنَ اللَّهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُورَ إِلَيْهِ –

আমার কাছে বিশ্বস্ত সূত্রে পৌছেছে যে, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ইরশাদ করেন, যে অন্যের প্রতি দৃষ্টি দিবে এবং যার দিকে দৃষ্টি পতিত হবে উভযের প্রতি আল্লাহ লা’নাত করেন। ২০২

২০২.ইমাম বায়হাকীর (৪৫৮ হি.) শোয়াবুল ঈমান, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭০

 

হযরত বুরাইদা  (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা হযরত আলী  (رضي الله عنه) কে বললেন 

يَا عَلِيُّ لَا تُتْبِعِ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ فَإِنَّ لَكَ الْأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الْآخِرَةُ 

হে আলী ! হঠাৎ একবার দৃষ্টির পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিও না, কেননা তোমার প্রথম বার ক্ষমাযোগ্য কিন্তু দ্বিতীয়বার ক্ষমাযোগ্য নয়। ২০৩

২০৩.আহমদ, তিরমিযী, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৯

 

হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ  (رضي الله عنه) বলেন,

-سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ نَظَرِ الْفُجَاءَةِ فَأمرنِي أَن أصرف بَصرِي – 

আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করলাম যদি কারো প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যায় তখন কি করব? উত্তরে তিনি আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ করলেন।২০৪

২০৪.ইমাম মুসলিম রা. (২৬১ হি.), সহীহ মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৮

 

হযরত আবু উমাম  (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন-

 قَالَ: مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْظُرُ إِلَى مَحَاسِنِ امْرَأَةٍ أَوَّلَ مَرَّةٍ ثُمَّ يَغُضُّ بَصَرَهُ إِلَّا أَحْدَثَ اللَّهُ لَهُ عِبَادَةً يَجِدُ حلاوتها –

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, কোন স্ত্রী লোকের সৌন্দর্য্যরে প্রতি যদি কোন মুসলমান পুরুষের প্রথম দৃষ্টি পড়ে যায় অতঃপর সাথে সাথে সে তার দৃষ্টি অবনত করে ফেলে তাহলে আল্লাহ তার জন্য এমন এক ইবাদতের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন যেই ইবাদতের স্বাদ সে পায়। ২০৫

২০৫.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র, (২৪১ হি.), মুসনাদে আহমদ, সৃত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭০

 

হযরত উম্মে সালমা  (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, একদা তিনিও হযরত মাইমূনা  (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র কাছে ছিলেন। হঠাৎ অন্ধ সাহাবী হযরত উম্মে মাকতূম  (رضي الله عنه) তাঁর কাছে আগমন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন, 

- احْتَجِبَا مِنْهُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَيْسَ هُوَ أَعْمَى لَا يُبْصِرُنَا؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفَعَمْيَاوَانِ أَنْتُمَا؟ أَلَسْتُمَا تُبْصِرَانِهِ؟ 

তোমরা তার থেকে পর্দা কর। আমি বললাম হে ইয়া রাসূলাল্লাহ ! সে কি অন্ধ নয় ? সে তো আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা কি অন্ধ ? তোমরা কি তাকে দেখছ না ? ২০৬

২০৬.আহমদ, তিরমিযী ও আবু দাউদ, সূত্র. মিশকাত; পৃ.২৬৯

 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-

 فالعينان زِنَاهُمَا النَّظَرُ وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ وَالْيَدُ زِنَاهَا الْبَطْشُ وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا وَالْقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ 

চোখের যিনা হলো (অবৈধ) দৃষ্টিদান, কানের যিনা হলো (হারাম) কথা বার্তা শ্রবণ করা, মুখের যিনা হলো (হারাম) কথা-বার্তা বলা, হাতের যিনা হলো ( হারাম বস্তৃ) ধরা এবং পায়ের যিনা হলো (হারাম কাজের প্রতি) চলা। তারপর মনে (অপকর্মের প্রতি) আকাক্সক্ষা জম্মায়(এটা মনের যিনা), এরপর লজ্জাস্থান সেটাকে কার্যে পরিণত করে (এটাই হচ্ছে যিনার সর্বশেষ পর্যায়) অথবা তা প্রত্যাখ্যান করে। ২০৭

২০৭.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ৬১১, হাদিস নং ১৬২২২

 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আসমা (رضي الله عنه) কে সন্বোধন করে বলেন-

 يَا أَسْمَاءُ، إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَاগ্ধ وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ –

হে আসমা ! নিশ্চয় মহিলা বালেগ হলে তার এই এই অঙ্গ ব্যতিত অন্য কোন অঙ্গ প্রদর্শন জায়েয নেই। তিনি এ সময় তার চেহারা মোবারক ও হাতের কব্জি মোবারকের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ২০৮

২০৮.ইমাম আবু দাউদ র. (২৭৫ হি.) সুনানে আবু দাউদ।

 

পর্দার দ্বিতীয়স্তর সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে -


হে নবী ! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যগণকে এবং মু’মিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে (সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়ে হিসাবে) চিনতে সহজ হবে। ফলে তাদেরকে (বকাটরা) উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালূ। ২০৯

২০৯.সূরা আহযাব, আয়াত: ৫৯

 

মাথার উপর ওড়না ব্যতিত লম্বা চাদরকে ‘জিলবাব’ বলা হয়, যা সম্ভ্রান্ত ও স্বাধীন মহিলা ওড়নার উপর মাথার উপরিভাগ দিয়ে পেছিয়ে চোখ দু’টি ব্যতিত মুখমন্ডলকে ঢেকে ফেলে। এর দ্বারা দাসী ও স্বাধীন মহিলার মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। তৎকালে রাস্তা-ঘাটে বখাটে ও দুষ্টু যুবকরা দাসীদের উত্যক্ত করত স্বাধীন মহিলাদেরকে নয়। তাই এ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের উদ্দেশ্য এরূপ জিলবাব পরিধান করার আদেশ দেয়া হয়েছে। 


বর্তমানেও সত্যিকার অর্থে পর্দা সহকারে মহিলারা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা মনে করে তাকে উত্যক্ত করা হয় না। পক্ষান্তরে নারী যখন বেপর্দা, আঁটসাঁট ও টাইট জিন্স পোশাক পরে কিংবা শরীরের আকর্ষনীয় অঙ্গ প্রদর্শনপূর্বক দেহ প্রদর্শনী, সৌন্দর্য প্রকাশ করে বিভিন্ন অঙ্গী-ভঙ্গি করে পথ চলে তখন রাস্তার অসৎ যুবকরা বুঝে নেয় যে, এটা কোন সভ্য ঘরের মেয়ে নয়। তাই তারা নির্ভিঘ্নে উক্ত মেয়েকে ইভটিজিং ও উত্যক্ত করে আর আজে-বাজে মন্তব্য ছুড়ে। 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,

-ترخى المراة الازار شبرا فقالت ام سلمة اذا تكشف اقدامهن قال فيرخين زراعا 

মহিলাগণ তাদের গায়ের চাদর (পায়ের নলার) এক বিগত নিচে ঝুলিয়ে ব্যবহার করবে। উম্মে সালমা  (رضي الله عنه) বললেন, তাহলে তো তাদের পা অনাবৃত হয়ে যাবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তাহলে একহাত পরিমাণ ঝুলিয়ে দিবে। 


তৃতীয়স্তরে পর্দার ব্যাপারে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

 يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى – 

হে নবীপত্নীগণ ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে-মূখর্তা যুগের অনুরূপ নিজেদের প্রদর্শন করবে না। ২১০

২১০.সূরা আহযাব; আয়াত: ৩১-৩২


উপরোক্ত আয়াতে বিনা প্রয়োজনে রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নারীদেরকে বাইরে বেরুতে নিষেধ করা হয়েছে। নতুবা হজ্ব, ওমরা, পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাত, মাহরাম অসুস্থ, নিকটাত্মীয়-স্বজনকে সেবা এবং একান্ত  প্রয়োজন হলে জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মস্থানে পর্দা সহকারে বাইরে যাওয়া-আসা নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত। 


অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ

তোমরা তাঁর (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)) পত্নীগণের নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। ২১১

 ২১১.সূরা আহযাব; আয়াত: ৫৩

 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন -

 الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ 

নারী হলো গোপন রাখার যোগ্য। যখন সে ঘর থেকে  বেপর্দা বের হয়, শয়তান তখন তাকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে। ২১২

২১২.ইমাম তিরমিযী র. (২৭৯ হি.) জামে তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৬৯


মূলত পর্দা সর্ম্পকে প্রথমে সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াত মতান্তরে তৃতীয় ও পঞ্চম হিজরি সনে হযরত যয়নাব বিনতে জাহাশ  (رضي الله عنه)’র সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র বাসররাত যাপনের সময় অবতীর্ণ হয়। ২১৩

২১৩.বুখারী, হাদিস নং ৪৭৯২

 

হযরত আনাস  (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একবার হযরত ওমর  (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনার নিকট ভালোমন্দ সব রকমের মানুষ যাতায়াত করে। আপনি আপনার পবিত্র স্ত্রীদেরকে পর্দা করার আদেশ দিলে খুবই ভালো হতো। এর প্রেক্ষিতে পর্দার আয়াত নাযিল হয়। 


হাদিসে আরো একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, উম্মুল মু’মিন হযরত সাওদা বিনতে জাময়া  (رضي الله عنه) এক রাতে নিজের কোন প্রয়োজনে পর্দা সহকারে বাইরে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে হযরত ওমর  (رضي الله عنه)’র দৃষ্টি তাঁর উপর পড়ে। যেহেতু তিনি দীকাকৃতির ছিলেন এ কারণে হযরত ওমর  (رضي الله عنه) তাঁকে চিনে ফেলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম ! হে সওদা  (رضي الله عنه)! আপনি আমাদের দৃষ্টি থেকে লুকোতে পারবেন না। দেখেই চেনা যায়। সুতরাং আপনি বাইরে বের হবেন না। এ কথা শুনে হযরত সওদা  (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ)’র কাছে উপস্থিত হন এবং পুরো ঘটনা খুলে বলেন। প্রিয় নবী তখন হযরত আয়িশা রা’র গৃহে নৈশ ভোজ গ্রহণ করছিলেন এবং তাঁর হাতে গোশতপূর্ণ একখানা হাড় ছিল। এমতাবস্থায় তার কাছে ওহী নাযিল হলো। যখন ওহী নাযিল হওয়া শেষ হলো তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা প্রয়োজনে তোমাদের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ২১৪

২১৪.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.) সহীহ বুখারী, হাদি নং ৪৮৬১

 

এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, পর্দার এই আদেশ দেয়া হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)'র পূত পবিত্র স্ত্রীগণকে যাদের সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই বলেছেন 

-إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا 

হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে যাবতীয় অপবত্রিতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। ২১৫

২১৫.সূরা আহযাব, আয়াত: ৩৩

 

অর্থাৎ যাঁদেরকে স্বয়ং মহান আল্লাহ ভিতরে বাইরের যাবতীয় পাপ পঙ্খিলতা থেকে সম্পূর্ণ পূত-পবিত্র রেখেছেন তাদেরকেই পর্দা করার আদেশ দিয়েছেন। অপর দিকে যে সব পুরুষদেরকে সম্বোধন করে এই বিধান জারি করেছেন তারা হলেন কষ্টি পাথরে পরীক্ষীত নিঁখুত খাটি মু’মিন এবং যাঁরা হিদায়েতর উজ্জ্বল নক্ষত্র ফেরেশতাতুল্য  সাহাবায়ে কিরাম। তাদের জন্য যদি এই বিধান প্রজোয্য হয়, তাহলে আমাদের ন্যায় পাপী-তাপীদের বেলায় পর্দার বিধানের গুরুত্বও প্রয়োজনীয়তা সহস্রগুণ বেশী। সুতরাং যত বড় মুত্তাকী পরহেযগার হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই কোন বেগানা নারী-পুরুষ ইসলামী পর্দা প্রথার উর্ধ্বে নয়। 


যাদের থেকে পর্দা করা ফরয়


যে সব নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ-শাদী জায়েয, তাদের পরস্পরের মধ্যে পর্দা করা ফরয। একজন অপর জনের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম। 


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-

 لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثالثهما الشَّيْطَان 

কোন (প্রাপ্ত বয়স্ক) নারী-পুরুষ নির্জনে একত্রিত হবে না, কারণ তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হবে শয়তান।২১৬ 

২১৬.ইমাম তিরমিযী র. (২৭৯ হি.) জামে তিরমিযী, সূত্র. মিশকাত; পৃ.২৬৯

 

বর্তমান মুসলিম সমাজের অভিভাবকরা নিজেদের যুবতী কন্যাদেরকে যুবকদের  সাথে সিনেমা হলে, সমুদ্র সৈকতে, চাইনিজ রেঁস্তোরায় কিংবা কোনো আত্মীয়ের বাড়ীতে নি:সংকোচ চিত্তে যাওয়া-আসার অনুমতি দেন। অভিভাবকদের দৃষ্টিতে এরা কচি মনে হলেও বয়স ও মনের কুমন্ত্রণার দিক দিয়ে কিন্তু তারা কচি নয়। বর্তমানে আরো প্রত্যেক যুবক-যুবতীর হাতে রয়েছে মোবাইল যা সকল অনিষ্ট ও চরিত্র হননের বৃহৎ হাতিয়ার। তার সঙ্গে রয়েছে হাদিসের  ভাষ্য মতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অদৃশ্য শক্তিশালী মানবের চিরশত্রু অভিশপ্ত শয়তান। সুতরাং তালতো ভাই, খালাতো ভাই, চাচাতো ভাই, ক্লাসভাই কিংবা বয়ফ্রেন্ড- এদের কারো সাথে অবাধ মেলা-মেশা করা সম্পূর্ণ হারাম। 


হযরত ইবনে আব্বাস  (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ননা করেন 

-لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا ذُو مَحْرَمٍ 

মাহরাম ব্যতিত কোনো পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হবেনা। ২১৭

২১৭.ইমাম বুখারী র. (২৫৬ হি.) সহীহ বুখারী, খণ্ড-২,পৃ-২৮৭

 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,

-اذا استطعرت المراة فمرت على القوم – ليجدوا ريحها فهى زانية 

–নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে মানুষের পাশ দিয়ে চলা-ফেরা করে এই উদ্দেশ্যে যে, লোকেরা তার সুগন্ধি লাভ করবে তাহলে সেই নারী ব্যভিচারিণী বলে গণ্য হবে।২১৮

২১৮.কানযুল উম্মাল, খণ্ড. ১৬, পৃ. ১৫৯

 

দেবর, ভাসুরকেও নারীরা দেখা দিতে পারবেনা বরং তাদের থেকেও পর্দা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন-

 إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ: رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ: يَا رَسُولَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ؟ قَالَ: الْحَمْوُ الْمَوْتُ 

হে পুরুষগণ ! তোমরা বেগানা নারীদের ঘরে প্রবেশ থেকে বিরত থাক। একজন সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! স্ত্রীলোকের শ্বশুরালয়ের পুরষদের-দেবর-ভাসুর সম্পর্কে আপনার কি মতামত ? অর্থাৎ তাদেরকে কি দেখা দিতে পারবে ? উত্তরে তিনি বললেন দেবর তো মৃত্য স্বরূপ। অর্থাৎ দেবর তো ভাবীর জন্য আরো মারাত্মক। ২১৯

২১৯.বুখারী ও মুসলিম, সৃত্র. মিশকাত; পৃ.২৬৮

 

হাদিসের বাস্তবতা


আমরা তখন ছাত্র, জামেয়ার হোস্টেলে অবস্থান করতাম। একদিন দেখলাম- একজন মহিলা ও একজন যুবক আমাদের কক্ষের সামনে কাকে যেন খুঁজছে। জিজ্ঞাস করে জানতে পারলাম তাওবা করার জন্য এসেছে। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করলে উত্তরে মহিলটি বলল, আমার স্বামী বিদেশে থাকেন। আমার পাশে ইনি আমার দেবর। আমার দেবরের সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ আমার অবৈধ সম্পর্ক চলে আসছে। এখন আগামী কাল আমার স্বামী আসবেন। তাই একটু তাওবা করার জন্য এসেছি। আমরা তখন তাদেরকে আমাদের একজন মুফতি সাহেবের কাছে প্রেরণ করেছি। এই হলো সমাজে প্রচলিত হাজারো ঘটনার একটি। এ কারণেই ভবিষ্যত দ্রষ্টা নবী করিম (ﷺ) দেবরকে মৃত্যুর ন্যায় ভয়ানক বলে আখ্যা দিয়েছেন।


পর্দার উপকারিতা


কুরআন-হাদিসের আলোকে উপরিউক্ত পর্দা সম্পর্কে শরীয়তের বিধান থেকে অনুমান করা যায় যে, ইসলামে পর্দার উপকারিতার গুরুত্ব কতখানি। মূলত কোন পুরুষ যখন কোন নারীর প্রতি তাকায়, তার সৌন্দর্য অবলোকন করে এবং তার শরীরের কামোত্তেজক অঙ্গগুলো প্রত্যক্ষ করে তখন সেই পুরুষের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে কামনার প্রাকৃতিক শিখা। সে শিখার দহনে অবিরাম দগ্ধিভ‚ত হতে থাকে সে। নিশায় ভাবতে থাকে কল্পনার স্বচ্ছ দর্পণে অঙ্কিত সেই নারীর দেহ সৌন্দর্য নিয়ে। কত ঘুম তার নষ্ট হয় সেই ভাবনার আঘাতে। কত রজনী কাটে বিনিদ্র কল্পনার জাল বুনতে বুনতে। কল্পনার সেই ছোট ছোট ঢেউ এক সময় বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গের সৃষ্টি করে তার যৌবন দরিয়ায়। সে তরঙ্গে অনামের মত হারিয়ে যায় সমাজ সভ্যতা নামের সকল বেড়ি-বন্ধন। স্বপ্নের নীল আকাশে সে তখন উড়তে থাকে কল্পনার পাখায় গা এলিয়ে বিলাসী বিহঙ্গেঁর মত। তার স্বপ্নের নারীকে একান্তে পাবার ক্ষীপ্র বাসনায় ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মত হিংস্র হয়ে ওঠে সে। তারপর যা ঘটে তা আমরা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করি চোখের সামনে কিংবা পত্র-পত্রিকায়। কিন্তু ভেবে দেখিনা এর উৎসটা কোথায়?


ইসলাম সে উৎসটাই সমূলে উপড়ে ফেলতে চায়। যেই কামময় দেহদর্শন শত অনিষ্টের জননী শরীয়ত সেই দেহ সৌন্দর্যকেই ঢেকে রাখতে আদেশ করেছে। কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। শরীয়ত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। একান্ত প্রয়োজনে বের হলে দবিজ পর্দার আড়াল হয়ে বের হবে। যেন তার উপস্থিতি কোন পুরুষের কামচেতনায় অযথা ঝড় না তুলে। বলা বহুল্য, নারীর সতীত্ব, সম্ভ্রম ও নাজুক মযার্দার  সুরক্ষায় পর্দা বিকল্প আশ্রায়। এর গুরুত্ব বাস্তবসিদ্ধ ও প্রশ্নাতীত। এর লংঘন শরীয়ত বিরোধী ও সামাজিক মযার্দার পরিপন্থী। ২২০

২২০.দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃ. ৩৯৪, ই.ফা.বা.

 
Top