৭. একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করা


ইসলামে একাধিক স্ত্রী তথা একসাথে চারজন স্ত্রী একজন পুরুষ রাখতে পারে, যদি সকলের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা সম্ভব হয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-

 واِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً

আর যদি ইনসাফ করার ব্যাপারে তোমরা ভয় কর, তবে একটি স্ত্রী রাখাই উত্তম। স্ত্রীদের বাসস্থান, ভরণ-পোষণ, অলংকার, উপঢৌকন, ভালোবাসা, রাত্রিযাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা প্রয়োজন।


তবে সন্তানের মা হলে তাকে খোরপোশ একটু বেশী দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক সাথে নয়টি স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করতেন যদিও তাঁর উপর তা আবশ্যক ছিলনা। তিনি কেবল আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও জাতিকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-

 مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ وَتُؤْوِي إِلَيْكَ مَنْ تَشَاءَ 

আপনি তাদের (স্ত্রীদের) মধ্য থেকে যাকে চান দূরে রাখুন আর যাকে চান কাছে রাখুন। ১৬৮

১৬৮.সূরা আহযাব, আয়াত: ৫১

 

عن ابن عباس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قبض عن تسع نسوة وكان يقسم منهن لثمان

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নয়জন স্ত্রী রেখে দুনিয়া থেকে ওফাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে আট দিন পালা বণ্টন করে দিয়েছেন। ১৬৯

১৬৯.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯

 

عَنْ عَائِشَةَ ان سودة الما كبرت قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، قَدْ جَعَلْتُ يَوْمِي مِنْكَ لِعَائِشَةَ، ্রفَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقْسِمُ لِعَائِشَةَ يَوْمَيْنِ، يَوْمَهَا وَيَوْمَ سَوْدَةَ

হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় হযরত সাওদা (رضي الله عنه) যখন বৃদ্ধা হয়ে গেলেন তখন তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার পালার দিনটা হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) কে দিয়ে দিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আয়িশা রা’র জন্য দু’দিন নির্ধারণ করে দিলেন। একদিন তার নিজের আর একদিন হযরত সাওদাহ (رضي الله عنه) এর। ১৭০

১৭০.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯


উপরিউক্ত হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, স্ত্রী তার নির্ধারিত দিনকে অন্য কারো জন্যে উৎসর্গ করে দিতে পারে। কারণ এটি স্ত্রীর হক। সুতরাং স্ত্রী তা যাকে ইচ্ছে দিতে পারেন।


উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইন্তেকালের সময় নিম্নোক্ত নয়জন স্ত্রী বিদ্যমান ছিলেন। 

১. হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) 

২. হযরত হাফসাহ (رضي الله عنه) 

৩. হযরত সাওদাহ (رضي الله عنه) 

৪. হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) 

৫. হযরত সাফিয়া (رضي الله عنه) 

৬. হযরত মাইমূনা (رضي الله عنه) 

৭. হযরত উম্মে হাবীবা (رضي الله عنه) 

৮. হযরত যয়নাব (رضي الله عنه) ও 

৯.হযরত জুআইরিয়া (رضي الله عنه) ।


মানুষ হিসাবে সর্বক্ষেত্রে সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীদের প্রতি সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। এতদসত্ত্বেও যদি যেসব বিষয়ে ব্যক্তির হাত নেই সেই সব বেষয়ে আল্লাহর নিকট অক্ষমতা প্রকাশ করা এবং আল্লাহর দরবারে তাওবা করা উচিত।

 عن عائشة أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقْسِمُ بَيْنَ نِسَائِهِ فَيَعْدِلُ , ثُمَّ يَقُولُ: ্রاللَّهُمَّ هَذَا قَسْمِي فِيمَا أَمْلِكُ , فَلَا تَلُمْنِي فِيمَا تَمْلِكُ وَلَا أَمْلِكُ 

হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নিজ পবিত্র স্ত্রীগণের মাঝে সমতা রক্ষা করতেন এত্যন্ত ইনসাফ করতন আর বলতেন, হে আল্লাহ! এটা আমার বণ্টন যার মালিক আমি। আপনি আমাকে ভৎর্সনা করবেন না ঐ বিষয়ে যার মালিক আপনি, আমি নই। ১৭১

১৭১.তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯

 

অর্থাৎ কারো প্রতি মনের আকর্ষণ ও ভালোবাসা বেশী হওয়া ব্যক্তির আয়ত্তাধীন নয়, বরং তা আল্লাহ প্রদত্ত বিষয়। এক্ষেত্রে যদি মানুষ থেকে কারো প্রতি অন্তরের ভালোবাসা প্রবল হয়ে থাকে সে বিষয়ে আল্লাহ যেন বান্দাকে পাকড়াও না করেন সেজন্য তাঁর প্রতি নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমার প্রার্থনা করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-

 وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ

আর তোমরা কখনো স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবেনা, যদিও এর আকাঙ্খী হও। অতএব তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়োনা এবং অপরজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখোনা। ১৭২

১৭২.সূরা নিসা, আয়াত: ১২৯

 

আগেই বলা হয়েছে এসব বিষয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবুও উম্মতকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এরূপ করেছেন।


একাধিক স্ত্রী থাকলে স্বামীর সাথে সফরে যাওয়ার জন্য স্ত্রীরা সবাই আগ্রহ প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে একজনের উপর অপরজনকে প্রাধান্য দিলে অপর স্ত্রীরা নাখোশ হবে। আবার সবাইকে সফরে নিয়ে যাওয়াটাও স্বামীর পক্ষে যদি সম্ভব না হয় তাহলে সমস্যা থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে স্ত্রীদের মধ্যে লটারীর মাধ্যমে সফরের জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে।


হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কোথাও সফরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন স্ত্রীদের মধ্যে লটারীর ব্যবস্থা করতেন।

 فَأَيَّتُهُنَّ خَرَجَ سَهْمُهَا خَرَجَ بِهَا مَعَهُ،

তাদের মধ্যে যার নাম লটারীতে উঠে আসতো তিনিই তাঁর সাথে সফরে বের হতেন। ১৭৩

১৭৩.বুখারী ও মুসলিম, সূত্র. মিশকাত; পৃ. ২৭৯

 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রإِذَا كَانَ عِنْدَ الرَّجُلِ امْرَأَتَانِ فَلَمْ يَعْدِلْ بَيْنَهُمَا جَاءَ يَوْمَ القِيَامَةِ وَشِقُّهُ سَاقِطٌ

হযরত হোরায়রা (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তির নিকট দু’জন স্ত্রী আছে আর সে তাদের মধ্যে ইনসাফ করে না তাহলে সে কিয়ামত দিবসে এক পার্শ্ব ঝোঁকা অবস্থায় উপস্থিত হবে।১৭৪

১৭৪.তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, দারেমী, সূত্র. মিশকাত; ২৭৯


মাসআলা : সমতা শুধু অবস্থান করার ক্ষেত্রে, সহবাস করার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব নয়। ১৭৫

 ১৭৫.ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১, ও হিদায়া, খণ্ড ২

 

মাসআলা : স্ত্রী নতুন হোক বা পুরাতন, কুমারী হোক বা অকুমারী, সুস্থ হোক বা অসুস্থ, গর্ভবতী হোক বা না হোক, ঋতুবতী হোক বা না হোক, পাগল হোক বা সুস্থ মস্তিষ্ক- সর্বাবস্থায় স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব। এভাবে স্বামী সুস্থ হোক বা অসুস্থ, পৌরষত্ব সম্পন্ন হোক বা পৌরষত্বহীন, বালিগ হোক বা বালিক হওয়ার কাছাকাছি বয়সের হোক- সকল অবস্থায়ই স্বামীর উপর সমতা বজায় করা ওয়াজিব। ১৭৬

১৭৬.ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১

 

উল্লেখ্য যে, পূর্ণ সমতা বজায় রাখার মানে সংখ্যা ও পরিমাণের দিক দিয়ে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা বুঝানো হয়নি বরং প্রত্যেক স্ত্রীর অধিকার, সাম্য ও প্রয়োজননুপাতে দরকারী জিনিসপত্র পরিবেশন করার কথা বলা হয়েছে। কারণ একাদিক স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যেকের রুচি, চাহিদা ও পছন্দ একই ধরনের হবে না। যুক্তি সঙ্গত চাহিদা, রুচি ও প্রয়োজন পরিমাণ স্বামীর সাধ্যানুযায়ী স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে। বিলাসিতা, অযৌক্তিক, অপব্যয় এবং স্বামীর সামর্থের বাইরে অতিরিক্ত কিছু স্ত্রীরা দাবী করলে তা পূরণ করতে স্বামী বাধ্য নয়।

 
Top