একত্রিংশ অধ্যায় 


 আনন্দ বিনোদনে সুন্নাত 

   

ইসলামের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালে মুক্তি। তাই ইসলামের বিধান জীবনব্যাপী। সুখী জীবনের জন্য চাই আনন্দ ও বিনোদন। নীরস নিরানন্দ জীবন হতাশা তৈরি করে। হতাশা জীবনের ব্যর্থতার কারণ। বিনোদন হলো আনন্দের মাধ্যম বা উপকরণ। মানসিক প্রশান্তির জন্য যা করা হয় তা-ই বিনোদন।


❏ নিঃসঙ্গতা মানবজীবনের অন্যতম সমস্যা। হজরত আদম عليه السلام-কে সৃষ্টি করে যখন জান্নাতে রাখা হলো, তখন তিনি একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার সমস্যায় পড়েন। তাঁর এই সমস্যা সমাধানে আল্লাহ তাআলা হজরত হাওয়া عليها السلام-কে সৃষ্টি করেন। শুরু হয় মানবসভ্যতার যৌথ পথচলা। মানুষ সামাজিক জীব, তাই সে নিঃসঙ্গ বা একাকী জীবন ধারণ করতে পারে না। নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন সুন্নত। বিনোদনের উপায় উপকরণগুলোর প্রায় সবই প্রিয় নবীজি ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম প্রয়োগ ও উপভোগ করেছেন। যেমন: গল্প, কৌতুক, হাস্যরস, খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, পদ্য প্রণয়ন, গদ্য পাঠ, সাহিত্য রচনা, সংগীত ইত্যাদি। আমাদের প্রিয় রাসুল ﷺ কুস্তিও লড়েছেন। তৎকালীন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরকে তিনি তিন-তিনবার হারিয়েছেন। মদিনায় যুবকদের শারীরিক কসরত তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন। হজরত আয়িশা رضي الله عنها–ও ঘরে বসে তা উপভোগ করেছেন। রাসুল ﷺ বিবি আয়িশা رضي الله عنها-এর সঙ্গে একাধিকবার দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন।



❏ শৈশবে নবীজি ﷺ খেলাধুলায় নেতৃত্ব দিতেন। কৈশোরে হুজুরে পাক ﷺ প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতেন। তরুণ বয়সে তিনি তরুণ সংঘ গড়ে তোলেন। যুবক বয়সে তিনি সমাজসেবামূলক কর্মে অংশগ্রহণ করেন। রাসুল ﷺ-এর রচিত কবিতা বুখারি শরিফসহ সিহাহ সিত্তাহ ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে উল্লেখ আছে। যেমন: ‘আনা নাবিউন লা কাযিব, আনা ইবনু আবদিল মুত্তালিব।’ অর্থ: আমি নবী মিথ্যা নই, আমি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হই। 


(সিরাতে ইবনে হিশাম)।



❏ নবীজি ﷺ কাব্য পছন্দ করতেন। হজরত হাসসান ইবনে সাবিত رضي الله عنه ভালো কবিতা রচনা করতেন এবং চমৎকার আবৃত্তি করতেন। রাসুল ﷺ তাঁর জন্য মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে আরেকটি মিম্বার বানিয়ে দিলেন। যেখান থেকে তিনি তাঁর কাব্য উপস্থাপন করতেন। প্রিয় নবীজি ﷺ ভালো শ্রোতাও ছিলেন। তিনি হজরত হাসসান رضي الله عنه-এর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে নিজের গায়ের চাদর তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। 


(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।



❏ আনন্দ-বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো সংগীত। প্রিয় নবীজি ﷺ প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে যখন মদিনায় গেলেন এবং দীর্ঘ দুই সপ্তাহের অবিরাম সফরের ক্লান্তিতে মলিন বদনে এক উষালগ্নে যখন সেখানে পৌঁছান; তখন মদিনার ছোট ছেলেমেয়েরা অভ্যর্থনা সংগীত গেয়ে প্রিয় নবীজি ﷺ-কে স্বাগত জানায়। (ইসলামি বিশ্বকোষ)। যুদ্ধ জয়ের পর বালিকারা নবীজি ﷺ-কে দফ (বিশেষ বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে গান গেয়ে বরণ করত। একবার নবীজি ﷺ সফরে থাকা অবস্থায় হজরত আয়িশা رضي الله عنها এক দাসীকে বিয়ে দিলেন। নবীজি ﷺ সফর থেকে ফিরে এসে জানতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন: তার বিয়েতে কি আনন্দ অনুষ্ঠান করেছ? হজরত আয়িশা رضي الله عنها বললেন, না। নবীজি ﷺ বললেন: কেন করোনি? 


(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।



❏ আমাদের প্রিয় নবী ﷺ হাজারো দুঃখ-কষ্টেও হাস্যরস ও কৌতুক করেছেন। একদা নবীজি ﷺ কয়েকজন সাহাবিসহ খেজুর খাচ্ছিলেন। প্রত্যেকে খেজুরের বিচি যাঁর যাঁর সামনে রাখছিলেন। নবীজি ﷺ তাঁর খেজুরের বিচি হজরত আলী رضي الله عنه-এর সামনে (তাঁর খেজুরের বিচির সঙ্গে) রাখতে লাগলেন। খেজুর খাওয়া শেষ হলে দেখা গেল সবার সামনে প্রায় সমপরিমাণ খেজুরের বিচি; কিন্তু হজরত আলী رضي الله عنه-এর সামনে দ্বিগুণ খেজুরের বিচি এবং নবীজি ﷺ-এর সামনে কোনো বিচিই নেই। এবার নবীজি ﷺ বললেন: আলী! তুমি তো দ্বিগুণ খেজুর খেয়েছ। হজরত আলী رضي الله عنه তখন বললেন, আমি হয়তো খেজুর বেশি খেয়েছি; কিন্তু খেজুরের বিচি খাইনি; আপনি তো খেজুরের বিচিসহই খেয়ে ফেলেছেন। 


(নবী ﷺ জীবনী)



❏ সহাস্য বদনে থাকা ও হাসিমুখে কথা বলা সুন্নত। রাসুল ﷺ সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে থাকতেন। হাদিস শরিফে রয়েছে: ‘কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলে, হাসিমুখে কথা বলা সদকা করার সমান সওয়াব।’ অর্থাৎ দানে যেমন পুণ্য হয় ও আত্মা পবিত্র হয় এবং প্রশান্তি লাভ করে; অনুরূপ হাসি দ্বারা পুণ্য অর্জন হয়, মন পরিষ্কার হয় ও শান্তি লাভ হয়। 


(শামায়েলে তিরমিজি)

 
Top