শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় রফয়ে ইয়াদাইন সুন্নত

একাধিক হাদীস ও অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমল একথা প্রমাণ করে যে, নামাযে শুধু প্রথম তাকবীরের সময় কান পর্যন্ত হাত তোলা সুন্নত। রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে ওঠার সময় হাত তোলা সুন্নত নয়।

সাহাবীগনের যুগে মদীনা শরীফ এবং কুফা এই দুটি শহরেই অধিকাংশ সাহাবী বসবাস করতেন। কুফা নগরীতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পাঁচশ সাহাবীসহ পনেরশ সাহাবী অবস্থান করতেন। তাঁদের মধ্যে তিনশত সাহাবী ছিলেন, যারা বায়আতে রেযওয়ানে শরীক ছিলেন এবং সত্তরজন সাহাবী এমন ছিলেন, যারা বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন।(মুকাদ্দমা নাসবুর রায়াহ দ্রষ্টব্য

তাঁদের মধ্যে হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা.ও ছিলেন, যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নামাযে অনেক স্থানে হাত তুলতে দেখেছেন বলে বর্ণনা করেছেন । তাঁদের মধ্যে হযরত আব্দল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও হযরত আলী রা.ও ছিলেন, যারা অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে প্রথম কাতারেই নামায আদায় করেছিলেন। হযরত আলী রা.ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একাধিক স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন বলে বর্ণিত আছে। এই দুই নগরীর আমল আমাদের সামনে রাখতে হবে।

মদীনা শরীফের আমল:

ইমাম মালেক রহ. -যিনি মদীনা শরীফের বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন- তিনি বলেছেন,

لا أعرف رفع اليدين في شيء من تكبير الصلاة لا في خفض ولا في رفع إلا في افتتاح الصلاة. (المدونة الكبرى صـ ١/٧١

অর্থাৎ নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোন তাকবীরের সময়, ঝোঁকার সময় বা সোজা হওয়ার সময় হাত তোলার নিয়ম আমার জানা নেই। (আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা, ১খ, ৭১পৃ)

কূফা নগরীর আমল:

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে নাসর (মৃত্যু ২৯৪ হি.) বলেছেন,

لا نعلم مصرا من الأمصار ينسب إلى أهله العلم قديما تركوا بإجماعهم رفع اليدين عند الخفض والرفع في الصلاة إلا أهل الكوفة، كذا في التمهيد ৯/২১২،২১৩ وزاد في الاستذكار: فكلهم لا يرفع إلا في الإحرام. (رقم ১৪০)

আমরা কূফাবাসী ছাড়া আর কোন শহরবাসী: যারা প্রাচীনকালে ইলমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন: সম্পর্কে জানি না, যারা সকলে মিলে নামাযে ঝোঁকার সময় ও সোজা হওয়ার সময় হাত তোলা ছেড়ে দিয়েছেন। (দ্র, তামহীদ লি ইবনি আব্দুল বার রহ. ৯/২১২,২১৩) আল ইসতিযকার গ্রন্থে একথাও ইবনে নাসর থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, কূফাবাসী সকলে শুধু তাহরীমার সময় হাত তুলতেন। (হাদীস ১৪০) (টীকা-১)

লক্ষ করুন, সকলে মিলে ছেড়েছেন এমন শহর শুধু কূফাই ছিল। তার মানে অন্যান্য শহরে ছেড়ে দেয়ারও লোক ছিল, হাত তোলারও লোক ছিল।

চিন্তা করুন, কূফার পনেরশ’ সাহাবীর কেউ যদি রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে ওঠার সময় হাত তুলতেন, তাহলে তাঁদের শাগরেদদের কেউ না কেউ অবশ্যই হাত তুলতেন। কিন্তু না, তাঁদের কেউই হাত তুলতেন না। ইমাম তিরমিযীও হযরত ইবনে মাসউদ রা. এর একবার হাত তোলার হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেন,

وبه يقول غير واحد من أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين وهو قول سفيان الثوري وأهل الكوفة

অর্থাৎ এ হাদীস অনুসারেই মত দিয়েছেন একাধিক সাহাবী ও তাবেয়ী। সুফিয়ান ছাওরী ও কূফাবাসীদের মতও এই হাদীস অনুসারে।

তামহীদ গ্রন্থে ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেছেন,

روى ابن القاسم وغيره عن مالك أنه كان يرى رفع اليدين في الصلاة ضعيفا إلا في تكبيرة الإحرام وحدها وتعلق بهذه الرواية عن مالك أكثر المالكيين وهو قول الكوفيين سفيان الثوري وأبي حنيفة وأصحابه والحسن بن حي وسائر فقهاء الكوفة قديما وحديثا.

অর্থাৎ ইবনুল কাসেম প্রমুখ ইমাম মালেক রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি তাকবীরে তাহরীমার সময় ছাড়া নামাযে অন্য কোথাও রফয়ে ইয়াদাইনকে দুর্বল মনে করতেন। ইমাম মালেক রহ. থেকে বর্ণিত এ বর্ণনাকেই মালেকী মাযহাবের অধিকাংশ আলেম গ্রহণ করেছেন। সুফিয়ান ছাওরী, আবু হানীফা, তাঁর শিষ্যবর্গ, হাসান ইবনে হায়্য, এমনকি প্রাচীন ও পরবর্তী উভয়কালের সকল কূফাবাসীর মত এটাই। (৯/২১২,২১৩)

সুফিয়ান ছাওরীর জীবনী পড়–ন। তাঁকে ‘আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস’ বা হাদীসের সম্রাট উপাধি দেওয়া হয়েছে। রফয়ে ইয়াদাইন নিয়মিত সুন্নত হিসাবে প্রমাণিত থাকলে তিনি তা ছেড়ে দিতেন না। ইমাম মালেক র.ও ছিলেন হাদীসের সম্রাট। মুয়াত্তায় তিনি রফয়ে ইয়াদাইনের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। এতদসত্ত্বেও মদীনা শরীফের অধিকাংশের আমল তদনুযায়ী না থাকার কারণে তিনিও হাত না তোলাকেই অবলম্বন করেছেন। মদীনা ও কূফার এ সকল সাহাবী ও তাবেয়ী একারণেই তো রুকুতে যাওয়ার আগে ও পরে হাত তুলতেন না যে- তাঁদের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মধ্যে তেমনটা করলেও অধিকাংশ সময় তা করেননি। কিংবা পূর্বে করেছেন বটে, পরে ছেড়ে দিয়েছেন। ভূমিকা স্বরূপ একথাগুলো আরজ করার পর এ বিষয়ের হাদীসগুলো তুলে ধরছি।

 
Top