এক সালামে তিন রাকাত বিতর ও দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহ্হুদ

১. সা‘দ ইবনে হিশাম বলেন:

عن عائشة قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث لا يسلم إلا في آخرهن، وهذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه وعنه أخذه أهل المدينة. تعليق-١

‘আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাতে বিত্র পড়তেন এবং শেষ রাকাতের পূর্বে সালাম ফেরাতেন না’। মুসতাদরাকে হাকেমের বর্ণনায় রয়েছে: ‘আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর রা.ও বিত্র এভাবে পড়তেন এবং তাঁর কাছ থেকেই মদীনাবাসী এ আমল গ্রহণ করেছে’।

ইমাম হাকেম, যাহাবী, আইনী, নববী ও আনওয়ার শাহ কাশমীরী প্রমুখ হাদীসটি সহীহ বলেছেন। [বিস্তারিত পর্যালোচনা অংশ দ্রষ্টব্য] [আলমুসতাদরাক ১/৩০৪ হা.১১৮১ তহাবী ১/১৯৩ নাসায়ী ১/২২৮ হা.১৬৯৮ ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৩-৪৯৪ হা.৬৯১৩ কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মদীনা ১/১৩৭ ৩/২১৪ বিখ্যাত অনেক হাদীসবিশারদই এটিকে সহীহ বলেছেন: আত্তা‘রীফ ৪/৪৪০]

উল্লেখ্য যে, হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম ইবনুল জাওযী, ইমাম যাহাবী ও ইবনে হাযম জাহেরী রহ. প্রমুখ বলেন: এ হাদীস থেকে বুঝা যায় নবীজীর বিত্র নামায ছিল তিন রাকাত এক সালামে। তবে তাতে মাগরিবের নামাযের মত মাঝে বৈঠক করতেন। [আত্তানকীহ লিয্ যাহাবী ১/৩২৬ আল-মুহাল্লা ২/৮৯ আত্তাহকীক ফী মাসায়িলিল খিলাফ ও আততানকীহ লি ইবনে আব্দীল হাদী]

২. তিন রাকাতে তিন কেরাত পড়ার আলোচনায় হযরত উবাই ইবনে কা‘ব রা. এর উল্লিখিত বর্ণনায় সহীহ সনদে রয়েছে:

كان يوتر بثلاث ركعات لا يسلم فيهن حتى ينصرف تعليق-٢

‘তিনি তিন রাকাতে বিতর পড়তেন। আর তিন রাকাত পূর্ণ করেই সালাম ফেরাতেন’। সুনানে নাসায়ীর বর্ণনায় রয়েছে: ولا يسلم إلا في آخرهن ‘তিন রাকাত পূর্ণ করেই সালাম ফেরাতেন’। [শরহু মুশকিলিল আছার ১১/৩৬৮ হা.৪৫০১ নাসায়ী হা. ১৭০১ শুআইব বলেছেন: এর সনদ সহীহ]

৩. ছাবেত আল বুনানী র. বলেন: হযরত আনাস ইবনে মালেক রা.আমাকে বলেছেন, হে আবু মুহাম্মাদ! (ছাবেত এর উপনাম) আমার কাছ থেকে শিখে নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি। আর তিনি আল্লাহ তা‘আলা থেকে গ্রহণ করেছেন। তুমি শেখার জন্য আমার থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য অন্য কাউকে পাবে না। ছাবেত বলেন:

ثم صلى بي العشاءَ، ثم صلى ست ركعات يُسلم بين الركعتين، ثم أوتر بثلاث يسلم في آخرهن. تعليق-٣

অতঃপর তিনি আমাকে নিয়ে ইশার নামায পড়লেন। এর পর ছয় রাকাত নামায পড়লেন এবং এর প্রতি দুই রাকাতে সালাম ফেরান। তারপর তিন রাকাতে বিত্র পড়লেন এবং সবশেষে সালাম ফেরান।

[তারীখে দিমাশ্ক লি ইবনে আসাকির ৯/৩৬৩ আনাস ইবনে মালেক অধ্যায়। সুনানে তিরমিযী হা.৩৮৩১। আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমীরী রহ. বলেন: এ হাদীসের সনদ শক্তিশালী, মা‘আরিফুস সুনান ৪/২০৯ এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য: কানযুল উম্মাল হা.২১৯০২ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন: তাহাবী ১/২০৬ ও ইবনু আবী শাইবা হা.৬৯১০ এর সনদ সহীহ]

অন্য বর্ণনায় ছাবেত আল বুনানী বলেন:

صليت مع أنس وبت عنده قال : فرأيته يصلى مثنى مثنى، حتى إذا كان في آخر صلاته أوتر بثلات مثل المغرب. تعليق-٤

আমি হযরত আনাস রা. এর ঘরে রাত্রি যাপন করেছি এবং তাঁর সাথে নামায পড়েছি। তাঁকে দেখেছি রাতে দুই রাকাত করে নামায পড়েছেন। এবং সব শেষে মাগরিবের নামাযের মত তিন রাকাত বিত্র পড়লেন। [মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা.৪৬৩৬ সালাতুল বিত্র লিল মারওয়াযী- পৃ. ১২৩]

৪. হযরত আয়েশা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল নামাযের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন:

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يستفتح الصلاة بالتكبير، والقراءة بـ الحمد لله رب العالمين، وكان إذا ركع لم يشخصْ رأسَه ولم يصوِّبْه ولكن بين ذلك، وكان إذا رفع رأسه من الركوع لم يسجد حتى يستوى قائما، وكان إذا رفع رأسه من السجدة لم يسجدْ حتى يستوى جالسا، وكان يقول فى كلِّ ركعتين التحية ... تعليق-٥

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শুরু করতেন তাকবীর দিয়ে এবং কেরাত শুরু করতেন ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ দিয়ে। রুকুতে মাথা উপরেও উঠাতেন না আবার নিচেও নামাতেন না। বরং মাঝামাঝি অবস্থায় রাখতেন। রুকু থেকে সোজা হয়ে না দাড়িয়ে সেজদায় যেতেন না। এক সেজদা থেকে উঠে সোজা হয়ে না বসে আরেক সেজদায় যেতেন না। আর তিনি বলতেন: নামাযের প্রতি দুই রাকাতেই একবার আত্তাহিয়্যাতু পড়বে। ... [সহীহ মুসলিম হা.১১৩৮]

উপরোক্ত বর্ণনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিতর নামায এক সালামে তিন রাকাত। তবে দুই রাকাতে অবশ্যই তাশাহহুদ পড়তে হবে। এ বিষয়ক আরো বর্ণনা সামনে আসছে। আর দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদ ব্যতিত তিন রাকাত বিতর পড়ার কোন দলিল নেই। এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা পরিশিষ্ট অংশে করা হয়েছে।

সাহাবা-তাবেয়ীনও একই নিয়মে বিত্র পড়তেন। এখানে কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরা হল:

১. মাকহুল র. বলেন:

عن عمر بن الخطاب أنه أَوْتَرَ بِثَلاَثِ رَكَعَاتٍ، لم يَفْصِلْ بَيْنَهُنَّ بِسَلامٍ. تعليق-٦

হযরত উমর রা. তিন রাকাতে বিত্র পড়লেন। এবং দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফেরাননি। [ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯২ হা.৬৯০১]

২. মিস্ওয়ার ইবনে মাখরামা রা. বলেন:

دفنا أبا بكر ليلا فقال عمر انى لم أوتر فقام وصففنا وراءه فصلى بنا ثلاث ركعات لم يسلم الا في آخرهن. تعليق-٧

আমরা রাতের বেলা হযরত আবু বকর রা.এর দাফন সম্পন্ন করলাম। তখন হযরত উমর রা. বলেন: আমি বিত্র পড়িনি। অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরাও তাঁর পিছনে কাতার বাঁধলাম। তিনি তিন রাকাত নামায পড়লেন এবং সবশেষে সালাম ফিরালেন। [তহাবী ১/২০৬ ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯১ হা.৬৮৯১ মুসান্নাফে আব্দুররায্যাক ৩/২০ সালাতুল বিত্র লিল মারওয়াযী পৃ.২৭০ কাশমীরী রহ. বলেন: এর সনদ সহীহ]

৩. হাবীব আল-মুআল্লিাম বলেন:

قيل للحسن: إن ابن عمر كان يُسلم في الركعتين من الوتر؟ فقال : كان عمرُ أفقه منه - كان ينهض في الثالثة بالتكبير. تعليق-٨

অর্থ: হাসান বসরী কে জিজ্ঞেস করা হল: আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. (তিন রাকাত) বিত্রের দুই রাকাতের পর সালাম ফিরিয়ে তৃতীয় রাকাত পৃথক পড়তেন? তিনি বলেন হযরত উমর রা. তাঁর থেকে বেশী প্রজ্ঞাবান ছিলেন: তিনি (দ্বিতীয় রাকাতে স্বাভাবিক নিয়মে বৈঠক শেষে সালাম না ফিরিয়ে) তাকবীর বলে তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। [আলমুসতাদরাক হা. ১১৪১; সুনানে কুবরা: বাইহাকী হা. ৫০০৩; সালাতুল বিত্র- মারওয়াযী পৃ.২৭০ । এ হাদীসের সনদ সহীহ । হাফেজ ইবনে হাজার রহ.ও মৌনভাবে এর সমর্থন করেছেন: ফাতহুল বারী ২/৫৫৮]

৪. আবু ইসহাক বলেন:

كان أصحاب على وأصحاب عبد الله لاَ يُسَلِّمُونَ فِي رَكْعَتَيَ الْوِتْرِ. تعليق-٩

হযরত আলী রা. ও হযরত ইবনে মাসউদ রা. এর শিষ্যগণ বিত্রের দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফিরাতেন না। [ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৩ হা.৬৯১১ সালাতুল বিত্র লিল মারওয়াযী পৃ.২৭১]

৫. হিশাম ইবনুল গায্ র. বলেন:

عن مكحول أنه كان يُوتِرُ بِثَلاَثٍ، لا يُسَلِّمُ إلا في آخِرِهِنَّ. تعليق-١٠

অর্থ: হযরত মাকহুল র. তিন রাকাতে বিত্র পড়তেন। সালাম ফিরাতেন তিন রাকাত পূর্ণ করেই। [ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৩ হা.৬৯০৬ এর সনদ সহীহ]

৬. হাম্মাদ (ইবনে আবী সুলাইমান) র. বলেন:

نهاني إبراهيم أَنْ أُسَلِّمَ فِي الرَّكْعَتَيْنِ مِنَ الْوِتْرِ. تعليق-١١

বিখ্যাত তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী র. বিত্রের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফিরাতে নিষেধ করেছেন। [ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৩ হা.৬৯০৮]

৭. কাতাদাহ রহ. বলেন:

عن سعيد بن المسيب قال : لا يُسَلَّمُ فِي الرَّكْعَتَيْنِ مِنَ الْوِتْرِ.تعليق-١٢

হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়াব বলেন: বিত্র নামাযের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফিরাবে না। [ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৩ হা.৬৯০৭ এর সনদ সহীহ]

৮. আবুয-যিনাদ রহ. বলেন:

عن السبعة، سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيّبِ، وعُرْوَةَ بن الزُّبَيْرِ، والقَاسِم بن محمدٍ، وَأَبِي بَكْر بن عبد الرَّحمنِ، وخَارِجَةَ بن زَيْدٍ، وعُبَيْدِ اللَّهِ بن عبد اللَّهِ، وسُلَيْمَانَ بْنِ يَسَارٍ - في مَشْيَخَةٍ سِوَاهُمْ أَهْلِ فِقْهٍ وصلاحٍ وَفَضْلٍ، وَرُبَّمَا اختَلَفوا في الشَّيْءِ فَأُخذَ بِقَوْلِ أَكثرِهِمْ وَأَفْضَلِهِمْ رَأْيًا، فَكَانَ مِمَّا وَعَيْتُ عنهم عَلَى هذه الصِّفَةِ : أَنَّ الْوِتْرَ ثلاثٌ لَا يُسَلِّمُ إلَّا فِي آخِرِهِنَّ، (قال الطحاوي:) فهذا مَنْ ذَكَرْنَا مِنْ فُقَهَاءِ الْمَدِينَةِ وَعُلَمَائِهِمْ قَدْ أَجْمَعُوا أَنَّ الْوِتْرَ ثَلَاثٌ لَا يُسَلِّمُ إلَّا فِي آخِرِهِنَّ. تعليق-١٣

অর্থ: আমি মদীনার বিখ্যাত ‘সাত ফকীহ’ অথাৎ সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ, উরওয়া ইবনে যুবাইর, আবু বকর ইবনে আব্দুররহমান, খারিজা ইবনে যায়েদ, উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার: এর যুগ পেয়েছি। তাছাড়া আরো অনেক শায়খের যামানা পেয়েছি: যারা ইলম ও তাকওয়ায় অনন্য ছিলেন। কখনো তাদের মধ্যে মতভেদ হলে তাদের অধিকাংশের মত অনুযায়ী কিংবা প্রাজ্ঞতার বিচারে যিনি অগ্রগণ্য তার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হত। এই মূলনীতি অনুসারে তাদের যে সব সিদ্ধান্ত আমি ধারণ করেছি তন্মধ্যে একটি হচ্ছে: তাঁরা সকলে একমত হয়েছেন: বিত্র নামায তিন রাকাত; আর শেষ রাকাতেই কেবল সালাম ফিরাবে। (ইমাম তাহাবী রহ. বলেন: সুতরাং বুঝা যায় মদীনার যে সকল ফকীহ ও আলেমের নাম উল্লেখ করা হল তাঁরা এ বিষয়ে একমত যে, বিতর তিন রাকাত এবং সালাম হবে তিন রাকাত পূর্ণ করেই। [তাহাবী ২/২০৭ এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য]

৯. আমীরুল মু‘মিনীন ফিল হাদীস: সুফ্ইয়ান ছাউরী র. তাঁর পূর্বসূরি তাবেয়ীদের বিত্র নামাযের বিবরণে বলেন:

كانوا يستحبون أن يقرأ في الركعة الأولى : سبح اسم ربك الأعلى، وفي الثانية : قل يا أيها الكافرون، ثم يتشهَّد، وينهَضُ، ثم يقرأ في الثالثة : قل هو الله أحد. تعليق-١٤

অর্থ: তাঁরা তিন রাকাত বিত্রের প্রথম রাকাতে সূরা আ‘লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন পড়তেন। তারপর বসে তাশাহহুদ পড়ে আবার উঠে দাঁড়াতেন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়তেন। [সালাতুল বিত্র: মারওয়াযী পৃ. ২৭৯ ইবনে হাজার আসকালানী বলেন: এর সনদ সহীহ: নাতাইযুল আফ্কার ২/১১৪, ৫০৩]

 
Top