চত্বারিংশ অধ্যায় 


স্বামী-স্ত্রী এর মাঝে ভাবপ্রবণতা এবং রাসুল ﷺ এর সুন্নাত 


প্রথম প্রথম বিয়ে হলে জামাই বউ এর মাঝে অদ্ভুত ভালাে লাগা থাকে । একটুখানি হাসি , একটু মিষ্টি কথা যেন মনকে ছুয়ে ছুয়ে যায় । বিয়ের পর প্রথম যখন জামাই বউ একজন আরেকজনের কাছাকাছি আসে , তখন উভয়ের মাঝে মিষ্টতা , আতিশয্য , ভালােলাগা বর্ণনাতীত। 


আহা! যদি জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দিনই এমন হতাে। তাহলে কি আর কিছু লাগতাে দুনিয়াতে?! বিয়ের প্রথম কয়েকটা মাস হলাে হানিমুন টাইপ। যখন এই হানিমুন পিরিয়ড শেষ, তখন থেকেই আসল ঘটনা শুরু। জামাই তাঁর চাকরী, ব্যবসা নিয়া ব্যস্ত। সারাদিন পর ক্লান্ত শ্রান্ত আর খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। চীৎকার করে বউয়ের কাছে খাবার চান, ধপ করে সােফায় বসে থম মেরে পড়ে থাকেন আর না হয় টিভি দেখেন, অথবা অন্য কাজ করেন। অতঃপর খাওয়া শেষে সিংকে প্লেট ফেলে রেখে আবার সােফায় গিয়ে বসেন।


এভাবে একটার পর একটা অর্ডার করতে থাকেন স্ত্রীকে । অপরদিকে , জামাই মহাশয় তাঁর কোন এক পুরনাে বন্ধুকে ফোন করেন , অথবা ফোন করেন কোন কলিগকে । এরপর ঘুমের পালা । যদি জামাই মহাশয়ের মুড ভালাে থাকে , তাহলে তিনি স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে থাকেন । কিন্তু শুধু নিজের খায়েশ মেটানােই থাকে উদ্দেশ্য । কাজ কর্ম শেষে ধপ করে পড়ে তিনি ঘুমিয়ে যান । বেচারী বউয়ের ব্যাপারে তাঁর কোন খেয়ালই থাকেনা । এভাবে , এটাই হয়ে যায় প্রতিদিনের রােযনামচা । 


এবার আসুন বউয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপারটা যাচাই করে দেখি । বউ প্রথম প্রথম চেষ্টা করে জামাইকে সন্তুষ্ট করার । কিন্তু ধীরে ধীরে সে তাঁর উৎসাহ , উদ্দিপনা হারাতে থাকে । কারণ সে তাঁর জামাই এর মনযােগ পায়না । সে তাঁর জামাইকে খুশী করার জন্য রান্না করে । খাবারের ডেকোরেশন পর্যন্ত নিখুত ভাবে করে । কিন্তু জামাই তাঁর খাবারের প্রশংসাতাে দুরের কথা , দোষ ধরতে ধরতে কিছু বাকি রাখেনা । এভাবে এমন অবস্থা হয় যে , বউ ততােক্ষণ ভালাে থাকে যতক্ষণ জামাই বাসায় থাকেনা । কারণ জামাই বাসায় আসলেই শুরু হয় তাঁর দাসত্বের জীবন । সে হয়ে যায় চাকরানীর ন্যায় । 


এধরনের বিয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে। জীবনে সুখ পাওয়া হয়ে যায় দুষ্কর।স্বামীর উচিৎ রাসুল ﷺ এর মতাে তাঁর দাম্পত্য জীবনকে সাজিয়ে তােলা । প্রেমের আইকন পুরুষ হিসেবে আমরা রােমিওকে বুঝি, রাসুলকে নয়। এটা আসলেই অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রােমান্টিক স্বামী যদি বলতে হয় , তাহলে বলতে হবে আমাদের রাসুল ﷺ এর কথা। তাঁর জীবনী ভালােভাবে পড়লে তা আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 


আমাদের রাসুল ﷺ আদর্শ স্বামীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রীদের কাছে সবচাইতে শ্রেষ্ঠ মানুষ। একটি সুখী সংসার করতে হলে স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে অবশ্যই মনস্তাত্তিক, শারিরীক এবং আধ্যাত্নিক বন্ধন সুদৃঢ় হতে হবে। নিচে রাসুলের সুন্নত থেকে কিছু টিপস দেয়া হল, যা পালন করলে অবশ্যই সুখী সংসার গড়া সম্ভব হবে । 


১) সঙ্গী / সঙ্গিনীর অনুভুতি বােঝার চেষ্টা করুনঃ-

স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে পরস্পরের অনুভুতির ব্যাপারে অবশ্য অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে । স্বামীকে বুঝতে হবে কখন স্ত্রীর মন মেজাজ ভাল বা খারাপ । তেমনি স্ত্রীকেও বুঝতে হবে কখন স্বামীর মন মেজাজ স্বাভাবিক না। কখনই দুই জনের মন মেজাজ একসাথে খারাপ হওয়া যাবেনা । 


কথাকাটাকাটি বা ঝগড়ার সময় দুই জনের একজনকে অবশ্যই চুপ থাকতে হবে।এ সময় উচিৎ একজন আরেকজনের পাশে বসে সান্তনা দেয়া , সমস্যা বােঝার চেষ্টা করা , ভাল সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা । হাদিসে এসেছে , রাসুল ﷺ হযরত আয়েশা رضي الله عنها এর অনুভূতির ব্যাপারে এতটাই সচেতন ছিলেন যে , তিনি বুঝতেন কখন আয়েশা رضي الله عنها তাঁর উপর খুশী হতেন আর কখন অভিমান বা গােস্বা করতেন । 


২) তাঁকে আশ্বস্ত করুনঃ- 

স্বামী ও স্ত্রী দুজনকেই দুজনে আস্বস্ত রাখতে হবে । মানুষের জীবনে ভাল , খারাপ সময় এসেই থাকে । তাদেরকে জীবনের ভাল এবং খারাপ এই দুই সময়েই পাশে থাকতে হবে । ভাল সময় পাশে থাকলাম আর খারাপ সময় এলে ছেড়ে দূরে গেলাম এমনটি যেন না হয় । তাদের পরস্পরকে পরস্পরের কাছে স্বস্তি , ছায়া , অবলম্বন ইত্যাদি পেতে হয় । একবার সাফিয়াহ رضي الله عنها কোন এক সফরে রাসুল ﷺ এর সাথে যাবেন , কিন্তু তিনি একটু দেরী করে ফেললেন । যার ফলে তিনি কাঁদছিলেন । রাসুল ﷺ যখন তাঁকে এ অবস্থায় পেলেন , তিনি উম্মুল মুমিনীনের চোখের পানি মুছে দিয়ে প্রবােধ দিয়েছেন। 


৩) স্ত্রীর কোলকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে থাকুনঃ- 

স্বামীর কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত তুচ্ছ মনে হতে পারে । কিন্তু স্ত্রীর জন্য এটা অনন্য । এই আচরণ দুই হৃদয়কে কাছে টেনে নিয়ে আসে । এই আচরণে স্ত্রী প্রচন্ডভাবে আস্বস্ত হয় । বাহির থেকে স্বামীরা যখন বাসায় আসবেন , কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার স্ত্রীর কোলে মাথা রেখেন শুয়ে পড়ুন । এতে আপনার বিশ্রাম ও হবে , সেই সাথে স্ত্রী ও খুশী হবেন । হাদিসে এসেছে , রাসুল ﷺ হযরত আয়েশা رضي الله عنها এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন , এমনকি কুরআন তেলাওয়াত ও করতেন । 


৪) চুল আচড়ে দিনঃ- 

কোন কোন কাজ অনেক সময় সামান্য বলে মনে হলেও দাম্পত্য জীবনে এর প্রভাব যাদুময়ী । চুল আঁচড়ে দেয়া হল তাঁর মধ্যে অন্যতম । স্বামী স্ত্রী একে অপরের চুল মাঝে মাঝে আঁচড়ে দিতে পারেন । আমাদের উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা رضي الله عنها মাঝে মাঝে নবীজির চুল আঁচড়ে দিতেন । তেমনিভাবে অন্যান্য ছােটখাট কাজ করেও ভালবাসা বৃদ্ধি করতে পারেন । যেমনঃ জামা পড়তে সাহায্য করা , গরমের দিনে ঠান্ডা শরবত করে দেওয়া ইত্যাদি ।


৫) গ্লাস বা পাত্রের একই জায়গা দিয়ে খানঃ-

হযরত আয়েশা رضي الله عنها যখন কোন পাত্র দিয়ে পানি পান করতেন , রাসুল ﷺ সেই একই পাত্রের সেই একই জায়গা দিয়ে পানি পান করতেন । তেমনি ভাবে গােশত খাওয়ার সময় আয়েশা رضي الله عنها যে স্থান হতে খেতেন রাসুল ﷺ ও ঐ একই স্থান হতে খেতেন । আপনি ও আপনার স্ত্রী বা স্বামীর সাথে এভাবে ব্যবহার করুন । আপনাদের মাঝে ভালবাসা হবে প্রকট এবং বন্ধন হবে অটুট । 


৬) চুম্বন করুনঃ-

রাসুল ﷺ প্রায়শই তাঁর স্ত্রীকে চুম্বন করতেন । এমনকি রােযা রাখা অবস্থায়ও । তেমনি আপনি আপনার স্ত্রীকে ও চুমু দিন । যেকোণ উসিলায় | চুমু দিন । ঘর থেকে বের হবার সময় , ঘরে ঢােকার সময় চুমু দিন । এটা আপনার স্ত্রীর প্রতি আপনার ভালবাসা প্রকাশ করে । আপনার স্ত্রী যখন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন , তখন আচমকা চুমু দিয়ে surprise দিন । আপনার বিবাহিত জীবনকে সুখী করতে হলে আপনাকে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। 


বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রীর মাঝে শারীরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকটায় দুজনকেই সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতে হবে। শরীয়ত ও স্বামী স্ত্রীর মাঝের এই সম্পর্ককে উৎসাহিত করেছে । স্বামী স্ত্রীর মাঝে যে শারীরিক সম্পর্ক হয়ে থাকে তা সদকা স্বরুপ । 


৬) খাবারের লােকমা মুখে তুলে খাইয়ে দিনঃ-

হাদিসে এসেছে স্ত্রীর মুখে খাবারের লােকমা তুলে দেয়াতেও সওয়াব রয়েছে । তাই স্বামী স্ত্রী উভয়েই পরস্পরকে খাবার মুখে তুলে খাইয়ে দিন । সুযােগ পেলেই একাজ করুন । 


৭) ঘরের কাজে সাহায্য করুনঃ-

রাসুল ﷺ যতক্ষণ বাসায় থাকতেন , ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন । তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন । নিজের কাপড় ধােয়া , জুতা সেলাই করা তিনিই করতেন । তেমনিভাবে স্বামী স্ত্রী যদি বিনা দ্বিধায় এবং বিনা জিজ্ঞাসাতেই পরস্পরের কাজে সাহায্য করে তাহলে একে অপরের প্রতি সহানুভুতিশীলতা অনুভব করবে যা দাম্পত্য জীবনের অন্যতম চালিকা শক্তি । 


৮)  গল্প করুনঃ-

স্ত্রীর সাথে আপনার জীবনের ঘটে যাওয়া কোন মজার ঘটনা , অথবা গল্প শেয়ার করুন । স্বামী স্ত্রীর মাঝে দেখা যায় এক পর্যায়ে গিয়ে কাজের আর সংসারের কথা ছাড়া অন্য কোন কথাবার্তা হয়না । এটা ঠিকনা । তাদের উচিৎ নিজেদের মাঝে হাল্কা খােশগল্পে মেতে ওঠা । অথচ আমরা যা করি তা হল , কোন ঘটনা বন্ধুদের কে ফোন করে বলে থাকি আর হাহাহুহু করে হাসি । কিন্তু স্ত্রীকে বলিনা । অথচ উচিৎ ছিল স্ত্রীকে নিয়েই সবার আগে হাহা হুহু হিহি করা । কাজেই আর দেরী না করে একটা রুটিন করুন , যে সময় আপনি ও আপনার স্ত্রী বসে হাল্কা খােশ মেজাজে কথাবার্তা বলবেন । 


৯) সুখের কোন সংবাদ বা সময়টুকু তাঁর সাথে শেয়ার করুনঃ-

জীবনের ভাল সময় গুলাে অথবা কোন ভাল ঘটনায় যখন আপনি খুশী হন , সে সময় টুকু স্ত্রীর সাথে উদযাপন করুন । স্বআমী স্ত্রী পরস্পর সুখ ও দুঃখ উভয় ক্ষেত্রেই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে । 


১০) বাচ্চাদের মতাে খেলুন এবং প্রতিযােগিতা করুনঃ- 

রাসুল ﷺ তাঁর স্ত্রীদের সাথে হাসিতামাশা এবং ক্রীড়া কৌতুকে অংশগ্রহণ করতেন । হযরত আয়েশা رضي الله عنها এবং রাসুল ﷺ এর দৌড় প্রতিযােগিতার ঘটনাটি এর প্রকই উদাহরণ । 


১১) সুন্দর নাম দিন এবং সেই নামে ডাকুনঃ- 

রাসুল ﷺ তাঁর স্ত্রীদের সুন্দর নামে ডাকতেন । অনেকসময় তিনি আয়েশা رضي الله عنها কে আহ্লাদ করে “ আয়েশ ” বলে ডাকতেন । তিনি কোন কোন সময় “ হুমায়রা ” বলেও ডাকতেন । হুমায়রা অর্থ হল হাল্কা লালাভ । আলেমগণ বলেছেন , কেউ যদি এত ফর্সা হয় যে রােদের আলােয় তাঁর চেহারা লাল বর্ণ হয়ে যায় , তখন এ অবস্থাকে হুমায়রা বলা হয় । দাম্পত্য জীবনে এটাই দরকার । স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনকে প্রশংসা করবে , ভালবাসবে । ফলে জীবন হবে সুখময় । 


১২) সুন্দর জামাকাপড় পরুন এবং সাজুনঃ-

স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনের জন্য পরিপাটি করে থাকা জরুরী । স্ত্রীরা যেমন স্বামীর জন্য ভাল ভাল জামা কিনে পড়ে , সাজগােজ করে । স্বামীর ও উচিৎ  ভাল ভাল জামা পড়া , নিজেকে পরিপাটি করে রাখা , পরিচ্ছন্ন রাখা । অথচ আমাদের পুরুষদের মাঝে এটা দেখা যায়না । আর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেতাে একেবারেই উদাসীন । রাসুল ﷺ যখন বাহির থেকে বাসায় ফিরতেন , সঙ্গে সঙ্গে মেছয়াক করে নিতেন । 


১৩) সুগন্ধি ব্যবহার করুনঃ-

রাসুল ﷺ সুগন্ধী অনেক পছন্দ করতেন এবং দুর্গন্ধ ঘৃণা করতেন । তাঁর এক সুগন্ধীদানী ছিল এবং সেখানে থেকে তিনি নিয়মিত সুগন্ধী লাগাতেন । স্বামী স্ত্রীর উচিৎ সুগঙ্ঘী ব্যবহার করা । নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে মনােরম থাকা । কারণ দুর্গন্ধ স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালবাসার অন্তরায় । 


১৪) একান্তে ঘটে যাওয়া বিষয় গােপন রাখুনঃ-

স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঘটে যাওয়া একান্ত মুহুর্তের ব্যাপারগুলাে কখনই বন্ধু মহলে আলােচনা করবেন । এটা সম্পর্কের মাঝে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে । আপনার স্ত্রী শুধু আপনার জন্যই , আপনার স্বামী শুধু আপনার জন্যই । কখনই গােপন বিষয়গুলাে বাহিরে  সুগন্ধীদানী ছিল এবং সেখানে থেকে তিনি নিয়মিত সুগন্ধী লাগাতেন । স্বামী স্ত্রীর উচিৎ সুগঘী ব্যবহার করা । নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে মনােরম থাকা । কারণ দুর্গন্ধ স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালবাসার অন্তরায় । 


১৫) সঙ্গীর পরিবারের সদস্যদের ভালবাসুন এবং সম্মান করুনঃ- 

স্বামী এবং স্ত্রী শুধু তাদের নিজেরকে না , তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও সম্মান দেখাতে হবে , স্নেহ করতে হবে । অপরজনের সামনে অপ্রজনের নিকট আত্নীয়ের প্রশংসা করতে হবে । এতে উভয়ের মনে ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে । 

 
Top